ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
দীর্ঘ ৩৩ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের ভোট হচ্ছে বৃহস্পতিবার। ২১টি ভোটকেন্দ্রে প্রায় ১১ হাজার ৮৯৭ থেকে ১১ হাজার ৯১৯ জন শিক্ষার্থী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সংসদের ২৫টি পদে ১৭৭ জন এবং ২১টি হল সংসদে ৪৪৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। জাকসুকে ঘিরে ক্যাম্পাসে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা পুনরুজ্জীবনের প্রত্যাশা জাগিয়েছে। তবে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছু শঙ্কা এবং প্রার্থিতা বাতিলের ঘটনা নিয়ে উত্তেজনা ক্যাম্পাসে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাঠে লড়ছেন কেন্দ্রীয় সংসদের ২৫টি পদে ১৭৭ জন এবং হল সংসদে ২১ পদে ৪৪৫ জন প্রার্থী
মোট ভোটারের তুলনায় ১৪০০ অতিরিক্ত ব্যালট ছাপানো হয়েছে। ৭০ শতাংশ ভোট পড়লেও সাড়ে আট হাজার ব্যালট প্রয়োজন, বাকি সাড়ে পাঁচ হাজার ব্যালট কীসের জন্য? প্রশ্ন এক শিক্ষার্থীর
‘যদি কোনো ভোটার ভুলভাবে ব্যালট পূরণ করেন সেক্ষেত্রে তাকে নতুন ব্যালট দেয়া হবে। এ উদ্দেশে অতিরিক্ত ব্যালট ছাপানো: ইসি
নির্বাচনী প্রস্তুতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরাপদ করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। ওএমআর (অপটিক্যাল মার্ক রিকগনিশন) ব্যালট পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান জানান, ‘একজন ভোটারকে কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ মিলিয়ে ৪০ জন প্রার্থীকে ভোট দিতে হবে। এজন্য ওএমআর ব্যালট ব্যবহার করা হচ্ছে, যা ফলাফল স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি করবে।’
২১টি ভোটকেন্দ্রে ২২৪টি বুথে ২১ জন রিটার্নিং অফিসার, ৬৭ জন পোলিং অফিসার এবং ৬৭ জন সহকারী পোলিং অফিসার দায়িত্ব পালন করবেন। প্রতি ২০০ ব্যালটের জন্য একটি বাক্স থাকবে এবং কেন্দ্রীয় ও হল সংসদের ব্যালট বাক্স আলাদাভাবে চিহ্নিত থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক রাশিদুল আলম জানিয়েছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষার্থী সংখ্যার অনুপাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পোলিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মোট ৬৭ জন শিক্ষক পোলিং অফিসারের দায়িত্বে আছেন। তাদের সহায়তায় সমান সংখ্যক কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। হল প্রাধ্যক্ষরা নিজ নিজ হলে সার্বিক তদারকি করবেন।
নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এক হাজার থেকে এক হাজার দুই শত পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে, যাদের একটি অংশ সিভিল পোশাকে ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করবেন। ভোটকেন্দ্রে আনসার সদস্যরাও আছেন।
ক্যাম্পাসজুড়ে ৮০টি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। তদারকির জন্য জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের সমন্বয়ে মনিটরিং টিম, প্রক্টরিয়াল বডি ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক দায়িত্বে রয়েছেন। এছাড়া দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন এবং জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েনের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার বলেন, ‘যদি কোনো ভোটার ভুলভাবে ব্যালট পূরণ করেন, তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জানালে তাকে নতুন ব্যালট দেয়া হবে। এ উদ্দেশে অতিরিক্ত ব্যালটপত্র মুদ্রণ করা হয়েছে।’
প্রচারণার শেষ মুহূর্তে উত্তাপ
গত ২৮ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া প্রচারণা গতকাল মঙ্গলবার মধ্যরাতে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়। শেষ দিনে প্রার্থীরা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে- মুরাদ চত্বর, পরিবহন চত্বর, টিএসসি, ক্যাফেটেরিয়া, বটতলা, চৌরঙ্গী, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, টারজান পয়েন্ট, ছাত্র-ছাত্রী হলসংলগ্ন সড়ক এবং বিভিন্ন অনুষদে- শিক্ষার্থীদের কাছে তাদের ইশতেহার তুলে ধরেছেন। রাতে আবাসিক হলগুলোর দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের সমস্যা শুনেছেন এবং নিজেদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) সমর্থিত ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’ প্যানেলের ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) প্রার্থী আরিফুজ্জামান (উজ্জ্বল) বলেন, ‘প্রচারণার শেষ দিনে আমরা বিভিন্ন অনুষদ, হল এবং শিক্ষার্থীদের আড্ডাস্থলে গিয়ে তাদের কাছে আমাদের পরিকল্পনা পৌঁছে দিয়েছি। ভোটারদের ইতিবাচক সাড়া আমাদের আশাবাদী করেছে।’
ছাত্রশিবির-সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আরিফ উল্লাহ জানান, ‘আমরা প্রতিটি হলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে আমাদের ইশতেহার পৌঁছে দিয়েছি। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সমর্থন পেয়েছি।’
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মেলন’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবদুর রশিদ বলেন, ‘গত কয়েক দিনের প্রচারণায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। জয়-পরাজয় নয়, জাকসু নির্বাচন বাস্তবায়িত হওয়াই আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন।’
ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মো. শেখ সাদী হাসান বলেন, ‘প্রথম দিন থেকেই শিক্ষার্থীদের অভাবনীয় সমর্থন পাচ্ছি। আমরা আশাবাদী, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোটে আমরা ঐতিহাসিক জয় পাব।’
আর ‘সংশপ্তক পর্ষদ’ এবং ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেলের প্রার্থীরাও নারী ক্ষমতায়ন এবং শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছেন।
# নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের শঙ্কা
নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ কিছু শঙ্কা দেখা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘প্রশাসন কীভাবে ধরে নিলো শতভাগ ভোটার উপস্থিত থাকবেন? মোট ভোটারের তুলনায় ১৪০০ অতিরিক্ত ব্যালট ছাপানো হয়েছে। ৭০ শতাংশ ভোট পড়লেও সাড়ে আট হাজার ব্যালট প্রয়োজন, বাকি সাড়ে পাঁচ হাজার ব্যালট কীসের জন্য?’ তিনি আরও প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘স্বয়ংক্রিয় ভোট গণনায় ম্যানিপুলেশন হবে না, এর গ্যারান্টি কী? প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট রাখা হচ্ছে না, তাহলে স্বচ্ছতা কীভাবে নিশ্চিত হবে?’
নারী হলগুলোতে শুধু নারী সাংবাদিকদের প্রবেশের অনুমতি নিয়েও অভিযোগ উঠেছে। ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘নির্বাচন একটি উৎসব, নিচের ফ্লোরে ভোট দিতে নারীরা কেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে? মানলাম, কেউ বিব্রত বোধ করতে পারেন, কিন্তু এ নিয়ম আগে জানানো হয়নি কেন? বেশিরভাগ মিডিয়া পুরুষ সাংবাদিক কর্মরত রয়েছেন, আর ক্যাম্পাসে নারী সাংবাদিক প্রায় নেই। এমতাবস্থায় আমি ছাত্রী হলগুলোতে ভোট কারচুপির আশঙ্কা করছি।’
ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন এবং উপাচার্যের ওপর আমরা পুরোপুরি ভরসা করতে পারছি না।’
# বিতর্ক ও অভিযোগ
নির্বাচনের আগে কয়েকটি বিতর্ক সামনে এসেছে। প্রার্থীদের জন্য ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে সম্পন্ন হয়। কেন্দ্রীয় সংসদের ১৬৩ জন এবং হল সংসদের ৪০৩ জন নমুনা দিলেও ৫৬ জন অনুপস্থিত ছিলেন। ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী আবু তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম বলেন, ‘প্রচারণার শেষ দিনে এ আয়োজন অপ্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করেছে।’
উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সোহেল আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ডোপ টেস্টের আয়োজন করা হয়েছে। প্রার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন।’
এছাড়া, ‘সংশপ্তক পর্ষদ’ প্যানেলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) প্রার্থী সোহাগী সামিয়া প্রচারণায় টাকার ছড়াছড়ি এবং আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে বলেন, ‘জাকসু নির্বাচনে টাকার ছড়াছড়ি হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।’ নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, ‘(গতকাল মঙ্গলবার) রাত ১২টা পর্যন্ত প্রচারণা চলেছে। এখন প্রচারণা চালালে আচরণবিধি ভঙ্গ হবে।’
# অমর্ত্য রায়ের প্রার্থিতা নিয়ে উত্তেজনা
‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী অমর্ত্য রায়ের প্রার্থিতা বাতিলের ঘটনা ক্যাম্পাসে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। নিয়মিত ছাত্রত্ব না থাকায় তার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়। এর প্রতিবাদে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেলের প্রার্থী ও সমর্থকরা সিনেট হলে নির্বাচন কমিশন ও উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসানকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। ভোর সাড়ে তিনটা পর্যন্ত গণমাধ্যমকর্মীদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। পরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা নিজেদের ইচ্ছায় এখানে নেই। আমাদের অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এটি নির্বাচনী কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে।’ উপাচার্য বলেন, ‘এটি আদালতের রায়, আমরা তা পরিবর্তন করতে পারি না। তবে সমাধানের জন্য পরামর্শ চাই।’
‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেলের একজন প্রার্থী বলেন, অমর্ত্য রায়ের প্রার্থিতা বাতিল শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর আঘাত।
১৯৯২ সালের পর এ প্রথম জাকসু নির্বাচন হচ্ছে, যা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শিবলী নোমান বলেন, ‘৩৩ বছর পর জাকসু নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক চর্চাকে নতুন মাত্রা দেবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শিক্ষার পরিবেশ এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে গতিশীল করবেন।’
ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবদুর রহমান বলেন, ‘জাকসুর মাধ্যমে শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে। অতীতের সংকট দূর করে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ প্রতিষ্ঠিত হবে।’
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
দীর্ঘ ৩৩ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের ভোট হচ্ছে বৃহস্পতিবার। ২১টি ভোটকেন্দ্রে প্রায় ১১ হাজার ৮৯৭ থেকে ১১ হাজার ৯১৯ জন শিক্ষার্থী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সংসদের ২৫টি পদে ১৭৭ জন এবং ২১টি হল সংসদে ৪৪৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। জাকসুকে ঘিরে ক্যাম্পাসে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা পুনরুজ্জীবনের প্রত্যাশা জাগিয়েছে। তবে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছু শঙ্কা এবং প্রার্থিতা বাতিলের ঘটনা নিয়ে উত্তেজনা ক্যাম্পাসে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাঠে লড়ছেন কেন্দ্রীয় সংসদের ২৫টি পদে ১৭৭ জন এবং হল সংসদে ২১ পদে ৪৪৫ জন প্রার্থী
মোট ভোটারের তুলনায় ১৪০০ অতিরিক্ত ব্যালট ছাপানো হয়েছে। ৭০ শতাংশ ভোট পড়লেও সাড়ে আট হাজার ব্যালট প্রয়োজন, বাকি সাড়ে পাঁচ হাজার ব্যালট কীসের জন্য? প্রশ্ন এক শিক্ষার্থীর
‘যদি কোনো ভোটার ভুলভাবে ব্যালট পূরণ করেন সেক্ষেত্রে তাকে নতুন ব্যালট দেয়া হবে। এ উদ্দেশে অতিরিক্ত ব্যালট ছাপানো: ইসি
নির্বাচনী প্রস্তুতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরাপদ করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। ওএমআর (অপটিক্যাল মার্ক রিকগনিশন) ব্যালট পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান জানান, ‘একজন ভোটারকে কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ মিলিয়ে ৪০ জন প্রার্থীকে ভোট দিতে হবে। এজন্য ওএমআর ব্যালট ব্যবহার করা হচ্ছে, যা ফলাফল স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি করবে।’
২১টি ভোটকেন্দ্রে ২২৪টি বুথে ২১ জন রিটার্নিং অফিসার, ৬৭ জন পোলিং অফিসার এবং ৬৭ জন সহকারী পোলিং অফিসার দায়িত্ব পালন করবেন। প্রতি ২০০ ব্যালটের জন্য একটি বাক্স থাকবে এবং কেন্দ্রীয় ও হল সংসদের ব্যালট বাক্স আলাদাভাবে চিহ্নিত থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক রাশিদুল আলম জানিয়েছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষার্থী সংখ্যার অনুপাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পোলিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মোট ৬৭ জন শিক্ষক পোলিং অফিসারের দায়িত্বে আছেন। তাদের সহায়তায় সমান সংখ্যক কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। হল প্রাধ্যক্ষরা নিজ নিজ হলে সার্বিক তদারকি করবেন।
নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এক হাজার থেকে এক হাজার দুই শত পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে, যাদের একটি অংশ সিভিল পোশাকে ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করবেন। ভোটকেন্দ্রে আনসার সদস্যরাও আছেন।
ক্যাম্পাসজুড়ে ৮০টি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। তদারকির জন্য জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের সমন্বয়ে মনিটরিং টিম, প্রক্টরিয়াল বডি ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক দায়িত্বে রয়েছেন। এছাড়া দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন এবং জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েনের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার বলেন, ‘যদি কোনো ভোটার ভুলভাবে ব্যালট পূরণ করেন, তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জানালে তাকে নতুন ব্যালট দেয়া হবে। এ উদ্দেশে অতিরিক্ত ব্যালটপত্র মুদ্রণ করা হয়েছে।’
প্রচারণার শেষ মুহূর্তে উত্তাপ
গত ২৮ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া প্রচারণা গতকাল মঙ্গলবার মধ্যরাতে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়। শেষ দিনে প্রার্থীরা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে- মুরাদ চত্বর, পরিবহন চত্বর, টিএসসি, ক্যাফেটেরিয়া, বটতলা, চৌরঙ্গী, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, টারজান পয়েন্ট, ছাত্র-ছাত্রী হলসংলগ্ন সড়ক এবং বিভিন্ন অনুষদে- শিক্ষার্থীদের কাছে তাদের ইশতেহার তুলে ধরেছেন। রাতে আবাসিক হলগুলোর দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের সমস্যা শুনেছেন এবং নিজেদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) সমর্থিত ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’ প্যানেলের ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) প্রার্থী আরিফুজ্জামান (উজ্জ্বল) বলেন, ‘প্রচারণার শেষ দিনে আমরা বিভিন্ন অনুষদ, হল এবং শিক্ষার্থীদের আড্ডাস্থলে গিয়ে তাদের কাছে আমাদের পরিকল্পনা পৌঁছে দিয়েছি। ভোটারদের ইতিবাচক সাড়া আমাদের আশাবাদী করেছে।’
ছাত্রশিবির-সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আরিফ উল্লাহ জানান, ‘আমরা প্রতিটি হলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে আমাদের ইশতেহার পৌঁছে দিয়েছি। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সমর্থন পেয়েছি।’
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মেলন’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবদুর রশিদ বলেন, ‘গত কয়েক দিনের প্রচারণায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। জয়-পরাজয় নয়, জাকসু নির্বাচন বাস্তবায়িত হওয়াই আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন।’
ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মো. শেখ সাদী হাসান বলেন, ‘প্রথম দিন থেকেই শিক্ষার্থীদের অভাবনীয় সমর্থন পাচ্ছি। আমরা আশাবাদী, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোটে আমরা ঐতিহাসিক জয় পাব।’
আর ‘সংশপ্তক পর্ষদ’ এবং ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেলের প্রার্থীরাও নারী ক্ষমতায়ন এবং শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছেন।
# নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের শঙ্কা
নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ কিছু শঙ্কা দেখা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘প্রশাসন কীভাবে ধরে নিলো শতভাগ ভোটার উপস্থিত থাকবেন? মোট ভোটারের তুলনায় ১৪০০ অতিরিক্ত ব্যালট ছাপানো হয়েছে। ৭০ শতাংশ ভোট পড়লেও সাড়ে আট হাজার ব্যালট প্রয়োজন, বাকি সাড়ে পাঁচ হাজার ব্যালট কীসের জন্য?’ তিনি আরও প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘স্বয়ংক্রিয় ভোট গণনায় ম্যানিপুলেশন হবে না, এর গ্যারান্টি কী? প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট রাখা হচ্ছে না, তাহলে স্বচ্ছতা কীভাবে নিশ্চিত হবে?’
নারী হলগুলোতে শুধু নারী সাংবাদিকদের প্রবেশের অনুমতি নিয়েও অভিযোগ উঠেছে। ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘নির্বাচন একটি উৎসব, নিচের ফ্লোরে ভোট দিতে নারীরা কেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে? মানলাম, কেউ বিব্রত বোধ করতে পারেন, কিন্তু এ নিয়ম আগে জানানো হয়নি কেন? বেশিরভাগ মিডিয়া পুরুষ সাংবাদিক কর্মরত রয়েছেন, আর ক্যাম্পাসে নারী সাংবাদিক প্রায় নেই। এমতাবস্থায় আমি ছাত্রী হলগুলোতে ভোট কারচুপির আশঙ্কা করছি।’
ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন এবং উপাচার্যের ওপর আমরা পুরোপুরি ভরসা করতে পারছি না।’
# বিতর্ক ও অভিযোগ
নির্বাচনের আগে কয়েকটি বিতর্ক সামনে এসেছে। প্রার্থীদের জন্য ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে সম্পন্ন হয়। কেন্দ্রীয় সংসদের ১৬৩ জন এবং হল সংসদের ৪০৩ জন নমুনা দিলেও ৫৬ জন অনুপস্থিত ছিলেন। ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী আবু তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম বলেন, ‘প্রচারণার শেষ দিনে এ আয়োজন অপ্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করেছে।’
উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সোহেল আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ডোপ টেস্টের আয়োজন করা হয়েছে। প্রার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন।’
এছাড়া, ‘সংশপ্তক পর্ষদ’ প্যানেলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) প্রার্থী সোহাগী সামিয়া প্রচারণায় টাকার ছড়াছড়ি এবং আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে বলেন, ‘জাকসু নির্বাচনে টাকার ছড়াছড়ি হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।’ নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, ‘(গতকাল মঙ্গলবার) রাত ১২টা পর্যন্ত প্রচারণা চলেছে। এখন প্রচারণা চালালে আচরণবিধি ভঙ্গ হবে।’
# অমর্ত্য রায়ের প্রার্থিতা নিয়ে উত্তেজনা
‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী অমর্ত্য রায়ের প্রার্থিতা বাতিলের ঘটনা ক্যাম্পাসে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। নিয়মিত ছাত্রত্ব না থাকায় তার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়। এর প্রতিবাদে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেলের প্রার্থী ও সমর্থকরা সিনেট হলে নির্বাচন কমিশন ও উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসানকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। ভোর সাড়ে তিনটা পর্যন্ত গণমাধ্যমকর্মীদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। পরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা নিজেদের ইচ্ছায় এখানে নেই। আমাদের অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এটি নির্বাচনী কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে।’ উপাচার্য বলেন, ‘এটি আদালতের রায়, আমরা তা পরিবর্তন করতে পারি না। তবে সমাধানের জন্য পরামর্শ চাই।’
‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেলের একজন প্রার্থী বলেন, অমর্ত্য রায়ের প্রার্থিতা বাতিল শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর আঘাত।
১৯৯২ সালের পর এ প্রথম জাকসু নির্বাচন হচ্ছে, যা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শিবলী নোমান বলেন, ‘৩৩ বছর পর জাকসু নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক চর্চাকে নতুন মাত্রা দেবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শিক্ষার পরিবেশ এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে গতিশীল করবেন।’
ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবদুর রহমান বলেন, ‘জাকসুর মাধ্যমে শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে। অতীতের সংকট দূর করে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ প্রতিষ্ঠিত হবে।’