জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) এবং ২১টি হল সংসদের ভোট বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর)। তিন দশকেরও বেশি সময় পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই নির্বাচনের আগের রাত থেকেই পুরো ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে নানা নাটকীয়তায়।
প্রার্থীদের শেষ মুহূর্তের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা, বহিরাগত প্রবেশ, প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা, সাংবাদিকদের হয়রানি এবং ব্যালট বাক্স পরিবহনকে ঘিরে নানা অনিয়মের অভিযোগ— সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের মনে তৈরি হয়েছে শঙ্কা ও ক্ষোভ।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের বড় অংশ মনে করছেন অনিয়মের ছাপ প্রকট হয়ে উঠছে।
বহিরাগত প্রবেশ ও ছাত্রদল নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে অবস্থিত নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ে বহিরাগত প্রবেশের ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এসময় ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মারুফ মল্লিক এবং ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক নাজমুল হাসান অভি কমিশন অফিসে প্রবেশ করেন। তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন অচেনা ব্যক্তিকে ভবনে ঢুকতে দেখা গেছে।
এ ঘটনায় উপস্থিত কয়েকজন প্রার্থী এবং শিক্ষার্থী সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানান। তারা অভিযোগ করেন, বহিরাগতদের কমিশন অফিসে প্রবেশ শুধু নির্বাচনী আচরণবিধিরই লঙ্ঘন নয়, বরং ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা ঝুঁকিও তৈরি করছে।
শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তুলেছেন, প্রশাসন ৯ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্যাম্পাসে বহিরাগত ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও তা কার্যকর করা হয়নি।
ঘটনার পর প্রার্থীদের একটি অংশ নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। তাদের দাবি, বহিরাগতদের উপস্থিতি নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
অভিযুক্ত মারুফ মল্লিক সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ব্যক্তিগত কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন, নির্বাচনের কাজে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। নাজমুল হাসান অভিও একই দাবি করেন এবং বহিরাগত প্রবেশ নিয়ে অভিযোগকে ‘ভুল ব্যাখ্যা’ বলে উল্লেখ করেন। তবে শিক্ষার্থীদের একাংশ জানান, তাদের নিয়মিতভাবে ক্যাম্পাসে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ মাফরুহী সাত্তার বলেন, “আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলাম। বহিরাগত প্রবেশের ঘটনা সিকিউরিটি বিভাগের বিষয়। তবে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পেলে কমিশন ব্যবস্থা নেবে।”
প্রক্টরিয়াল বডির একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বহিরাগতদের প্রবেশ ঠেকানো যায়নি, কারণ কমিশন ভবনে প্রবেশের সময় কারা অনুমতি দিচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। ফলে প্রশাসনের ভেতর থেকেও শিথিলতা বা অনিয়ম ঘটছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
এ ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তারা রাতেই বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করে বহিরাগতদের অবিলম্বে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেওয়ার দাবি জানান। কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, নির্বাচনের আগের রাতে বহিরাগতদের প্রবেশ মানে নির্বাচন ‘প্রভাবিত করার চেষ্টা’ চলছে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
সাংবাদিকের ফোন কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ
বুধবার রাতের নির্বাচনী প্রস্তুতির ব্যস্ত সময়ে আরেকটি ঘটনা ক্যাম্পাসে নতুন করে ক্ষোভ সৃষ্টি করে। অভিযোগ, ব্যালট বাক্স পরিবহনের সময় ছবি তুলতে গেলে দৈনিক যায়যায়দিনের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ওসমান সরদারের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে তাতে থাকা ছবি জোরপূর্বক মুছে ফেলা হয়। এ ঘটনায় প্রাক্তন ছাত্রদল নেতা জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর এবং মশিউর রহমান রোজেনকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়েছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সাংবাদিক ওসমান সরদার সিনেট ভবনের সামনে ব্যালট বাক্স পরিবহনের ছবি তুলছিলেন। হঠাৎ কয়েকজন এসে তাকে ঘিরে ধরে ফোন ছিনিয়ে নেয়। কিছু সময় পর ফোনটি ফেরত দেওয়া হলেও তাতে থাকা ছবি মুছে ফেলা হয়। এতে উপস্থিত শিক্ষার্থী ও প্রার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
অভিযুক্ত বাবর ও রোজেন দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এবং ছাত্রদল ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আগে থেকেই ঘোষণা দিয়েছিল যে ৯ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনো বহিরাগত বা প্রাক্তন শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারবেন না। সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করেই তারা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভুক্তভোগী সাংবাদিক ওসমান সরদার বলেন, “আমি আমার দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে ভোটের আগের প্রস্তুতি ও ব্যালট বাক্স পরিবহনের ছবি তুলছিলাম। তখন কয়েকজন এসে আমাকে থামতে বলে। আমি ছবি তুলতে থাকলে তারা আমার ফোন কেড়ে নেয় এবং পরে ছবি ডিলিট করে দেয়। এতে আমি আতঙ্কিত ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।”
ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির সদস্যরা তাৎক্ষণিক বৈঠক করে এ ঘটনায় নিন্দা জানান। তারা নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দেবেন বলে জানান এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি তুলেন।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের এক সদস্য বলেন, “আমরা বিষয়টি অবগত হয়েছি। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে তা গণমাধ্যম স্বাধীনতার জন্য উদ্বেগজনক। এ নিয়ে কমিশনে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ এলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সাংবাদিকের ওপর এমন ঘটনার খবর ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষার্থীদের মাঝেও প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখেন, নির্বাচনকে ঘিরে এমন ঘটনার ফলে শুধু ‘স্বচ্ছতা নয়, নিরাপত্তাও প্রশ্নবিদ্ধ’ হচ্ছে।
পোলিং এজেন্ট ও ভোট গণনা নিয়ে বিভক্তি
ভোটের আগের রাতে প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্ব তৈরি হয় পোলিং এজেন্ট এবং ভোট গণনার পদ্ধতি নিয়ে। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস), ছাত্রদল এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের প্রার্থীরা বলেন, তাদের সংগঠনের পক্ষে প্রতিটি হলে পোলিং এজেন্ট দেওয়ার মতো লোকবল নেই। তাই ভোট গণনা অবশ্যই ম্যানুয়াল হতে হবে।
অন্যদিকে, সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট এবং স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলনের প্রার্থীরা এর বিপরীত মত দেন। তাদের দাবি, পোলিং এজেন্ট ছাড়া স্বচ্ছ নির্বাচন সম্ভব নয়। পাশাপাশি সক্রিয় মেশিন ব্যবহার না করলে জালিয়াতির সুযোগ থেকে যাবে।
সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের ভিপি প্রার্থী আরিফুল্লাহ আদিব বলেন, “স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পোলিং এজেন্ট থাকা আবশ্যক। কেবল সিসি ক্যামেরা দিয়ে অনিয়ম প্রতিরোধ সম্ভব নয়।”
স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলনের ভিপি প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু বলেন, “এজেন্ট ছাড়া নির্বাচন হলে জালিয়াতির ঝুঁকি বাড়বে। আমরা ইতোমধ্যে দেখছি নির্বাচনের আগে নানা অনিয়ম ঘটছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও নির্বাচন কমিশনের সদস্য সচিব অধ্যাপক রাশিদুল আলম বলেন, “এ বিষয়ে প্রার্থীদের ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। কমিশন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।”
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নির্দেশনা
পরিস্থিতি জটিল হওয়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার রাতেই কয়েকটি নির্দেশনা জারি করেন। তিনি জানান, এবারের নির্বাচনে কোনো বাহ্যিক পর্যবেক্ষক থাকবেন না। ভোটের দিন সকাল ৬টা থেকে ক্যাম্পাসে কোনো প্রাক্তন শিক্ষার্থী বা বহিরাগত পাওয়া গেলে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি প্রার্থী সর্বোচ্চ দুইজন পোলিং এজেন্ট রাখতে পারবেন। একজন ভোটগ্রহণ চলাকালে এবং অন্যজন ভোট গণনার সময় দায়িত্ব পালন করবেন। তবে এই সুযোগ পেতে হলে প্রার্থীদের লিখিত আবেদন করতে হবে।
ভোট গণনায় ব্যবহৃত হবে ওএমআর মেশিন। এজন্য একটি বিশেষ টেকনিক্যাল টিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যারা ভোটের দিন সকালে মেশিন পরীক্ষা করে দেখবে। তবে, দীর্ঘদিন আলোচিত ডোপ টেস্ট প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা দেননি।
প্রার্থীদের ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া
জাকসুতে সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের জিএস প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “সাবেক ছাত্রদল ও যুবদল নেতাদের নিয়ে কমিশনের গোপন বৈঠক, রাতে ব্যালট বাক্স পরিবহন, সাংবাদিকের ফোন কেড়ে নেওয়া— সব মিলিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এভাবে নির্বাচন হলে শিক্ষার্থীদের আস্থা নষ্ট হবে।”
তিনি আরও অভিযোগ করেন, “কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো দিনের আলোতে না হয়ে গভীর রাতে নেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন যদি সত্যিই নিরপেক্ষ থাকতো, তবে সব সিদ্ধান্ত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ও সকল প্রার্থীর উপস্থিতিতে নেওয়া হতো। অথচ রাতের অন্ধকারে বহিরাগতদের ডেকে বৈঠক বসানো হচ্ছে। এটা স্পষ্ট করে দেয়, একটি মহল নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে।”
প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আগে থেকেই ঘোষণা দিয়েছিল যে ৯ থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনো বহিরাগত অবস্থান করতে পারবে না। কিন্তু প্রাক্তন ছাত্রদল নেতাদের কমিশন অফিসে প্রবেশ করানো হলো। এটা শুধু আচরণবিধি লঙ্ঘন নয়, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার সঙ্গেও প্রতারণা।”
মাজহারুল আরও বলেন, “ডোপ টেস্টের প্রসঙ্গে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। কমিশন ইচ্ছাকৃতভাবে বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে, যাতে নির্দিষ্ট কিছু প্রার্থীর সুবিধা হয়। এতে শিক্ষার্থীদের মনে সন্দেহ আরও গভীর হচ্ছে।”
শেষে তিনি সতর্ক করে বলেন, “আগামীকালের ভোটে যদি বহিরাগতদের প্রভাব বা জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তা কেবল নির্বাচনের বৈধতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে না, বরং পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। শিক্ষার্থীরা তাদের ভোটাধিকার রক্ষায় আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবে।”
অন্যদিকে, স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলনের ভিপি প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু বলেন, “পোলিং এজেন্ট ছাড়া নির্বাচন জালিয়াতির ঝুঁকিতে পড়বে। আমরা দেখছি নির্বাচন বানচালের জন্য নানা তৎপরতা চলছে, কারা করছে আমরা জানি। কিন্তু প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এতে শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত।”
এ ছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও অনেককে প্রতিবাদ জানাতে দেখা গেছে। তারা বলছেন, বহিরাগত প্রবেশ ঠেকানো না গেলে আগামীকালের ভোট কোনোভাবেই নিরপেক্ষ হবে না।
বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) এবং ২১টি হল সংসদের ভোট বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর)। তিন দশকেরও বেশি সময় পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই নির্বাচনের আগের রাত থেকেই পুরো ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে নানা নাটকীয়তায়।
প্রার্থীদের শেষ মুহূর্তের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা, বহিরাগত প্রবেশ, প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা, সাংবাদিকদের হয়রানি এবং ব্যালট বাক্স পরিবহনকে ঘিরে নানা অনিয়মের অভিযোগ— সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের মনে তৈরি হয়েছে শঙ্কা ও ক্ষোভ।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের বড় অংশ মনে করছেন অনিয়মের ছাপ প্রকট হয়ে উঠছে।
বহিরাগত প্রবেশ ও ছাত্রদল নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে অবস্থিত নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ে বহিরাগত প্রবেশের ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এসময় ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মারুফ মল্লিক এবং ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক নাজমুল হাসান অভি কমিশন অফিসে প্রবেশ করেন। তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন অচেনা ব্যক্তিকে ভবনে ঢুকতে দেখা গেছে।
এ ঘটনায় উপস্থিত কয়েকজন প্রার্থী এবং শিক্ষার্থী সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানান। তারা অভিযোগ করেন, বহিরাগতদের কমিশন অফিসে প্রবেশ শুধু নির্বাচনী আচরণবিধিরই লঙ্ঘন নয়, বরং ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা ঝুঁকিও তৈরি করছে।
শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তুলেছেন, প্রশাসন ৯ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্যাম্পাসে বহিরাগত ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও তা কার্যকর করা হয়নি।
ঘটনার পর প্রার্থীদের একটি অংশ নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। তাদের দাবি, বহিরাগতদের উপস্থিতি নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
অভিযুক্ত মারুফ মল্লিক সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ব্যক্তিগত কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন, নির্বাচনের কাজে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। নাজমুল হাসান অভিও একই দাবি করেন এবং বহিরাগত প্রবেশ নিয়ে অভিযোগকে ‘ভুল ব্যাখ্যা’ বলে উল্লেখ করেন। তবে শিক্ষার্থীদের একাংশ জানান, তাদের নিয়মিতভাবে ক্যাম্পাসে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ মাফরুহী সাত্তার বলেন, “আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলাম। বহিরাগত প্রবেশের ঘটনা সিকিউরিটি বিভাগের বিষয়। তবে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পেলে কমিশন ব্যবস্থা নেবে।”
প্রক্টরিয়াল বডির একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বহিরাগতদের প্রবেশ ঠেকানো যায়নি, কারণ কমিশন ভবনে প্রবেশের সময় কারা অনুমতি দিচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। ফলে প্রশাসনের ভেতর থেকেও শিথিলতা বা অনিয়ম ঘটছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
এ ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তারা রাতেই বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করে বহিরাগতদের অবিলম্বে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেওয়ার দাবি জানান। কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, নির্বাচনের আগের রাতে বহিরাগতদের প্রবেশ মানে নির্বাচন ‘প্রভাবিত করার চেষ্টা’ চলছে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
সাংবাদিকের ফোন কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ
বুধবার রাতের নির্বাচনী প্রস্তুতির ব্যস্ত সময়ে আরেকটি ঘটনা ক্যাম্পাসে নতুন করে ক্ষোভ সৃষ্টি করে। অভিযোগ, ব্যালট বাক্স পরিবহনের সময় ছবি তুলতে গেলে দৈনিক যায়যায়দিনের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ওসমান সরদারের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে তাতে থাকা ছবি জোরপূর্বক মুছে ফেলা হয়। এ ঘটনায় প্রাক্তন ছাত্রদল নেতা জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর এবং মশিউর রহমান রোজেনকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়েছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সাংবাদিক ওসমান সরদার সিনেট ভবনের সামনে ব্যালট বাক্স পরিবহনের ছবি তুলছিলেন। হঠাৎ কয়েকজন এসে তাকে ঘিরে ধরে ফোন ছিনিয়ে নেয়। কিছু সময় পর ফোনটি ফেরত দেওয়া হলেও তাতে থাকা ছবি মুছে ফেলা হয়। এতে উপস্থিত শিক্ষার্থী ও প্রার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
অভিযুক্ত বাবর ও রোজেন দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এবং ছাত্রদল ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আগে থেকেই ঘোষণা দিয়েছিল যে ৯ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনো বহিরাগত বা প্রাক্তন শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারবেন না। সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করেই তারা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভুক্তভোগী সাংবাদিক ওসমান সরদার বলেন, “আমি আমার দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে ভোটের আগের প্রস্তুতি ও ব্যালট বাক্স পরিবহনের ছবি তুলছিলাম। তখন কয়েকজন এসে আমাকে থামতে বলে। আমি ছবি তুলতে থাকলে তারা আমার ফোন কেড়ে নেয় এবং পরে ছবি ডিলিট করে দেয়। এতে আমি আতঙ্কিত ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।”
ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির সদস্যরা তাৎক্ষণিক বৈঠক করে এ ঘটনায় নিন্দা জানান। তারা নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দেবেন বলে জানান এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি তুলেন।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের এক সদস্য বলেন, “আমরা বিষয়টি অবগত হয়েছি। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে তা গণমাধ্যম স্বাধীনতার জন্য উদ্বেগজনক। এ নিয়ে কমিশনে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ এলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সাংবাদিকের ওপর এমন ঘটনার খবর ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষার্থীদের মাঝেও প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখেন, নির্বাচনকে ঘিরে এমন ঘটনার ফলে শুধু ‘স্বচ্ছতা নয়, নিরাপত্তাও প্রশ্নবিদ্ধ’ হচ্ছে।
পোলিং এজেন্ট ও ভোট গণনা নিয়ে বিভক্তি
ভোটের আগের রাতে প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্ব তৈরি হয় পোলিং এজেন্ট এবং ভোট গণনার পদ্ধতি নিয়ে। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস), ছাত্রদল এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের প্রার্থীরা বলেন, তাদের সংগঠনের পক্ষে প্রতিটি হলে পোলিং এজেন্ট দেওয়ার মতো লোকবল নেই। তাই ভোট গণনা অবশ্যই ম্যানুয়াল হতে হবে।
অন্যদিকে, সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট এবং স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলনের প্রার্থীরা এর বিপরীত মত দেন। তাদের দাবি, পোলিং এজেন্ট ছাড়া স্বচ্ছ নির্বাচন সম্ভব নয়। পাশাপাশি সক্রিয় মেশিন ব্যবহার না করলে জালিয়াতির সুযোগ থেকে যাবে।
সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের ভিপি প্রার্থী আরিফুল্লাহ আদিব বলেন, “স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পোলিং এজেন্ট থাকা আবশ্যক। কেবল সিসি ক্যামেরা দিয়ে অনিয়ম প্রতিরোধ সম্ভব নয়।”
স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলনের ভিপি প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু বলেন, “এজেন্ট ছাড়া নির্বাচন হলে জালিয়াতির ঝুঁকি বাড়বে। আমরা ইতোমধ্যে দেখছি নির্বাচনের আগে নানা অনিয়ম ঘটছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও নির্বাচন কমিশনের সদস্য সচিব অধ্যাপক রাশিদুল আলম বলেন, “এ বিষয়ে প্রার্থীদের ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। কমিশন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।”
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নির্দেশনা
পরিস্থিতি জটিল হওয়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার রাতেই কয়েকটি নির্দেশনা জারি করেন। তিনি জানান, এবারের নির্বাচনে কোনো বাহ্যিক পর্যবেক্ষক থাকবেন না। ভোটের দিন সকাল ৬টা থেকে ক্যাম্পাসে কোনো প্রাক্তন শিক্ষার্থী বা বহিরাগত পাওয়া গেলে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি প্রার্থী সর্বোচ্চ দুইজন পোলিং এজেন্ট রাখতে পারবেন। একজন ভোটগ্রহণ চলাকালে এবং অন্যজন ভোট গণনার সময় দায়িত্ব পালন করবেন। তবে এই সুযোগ পেতে হলে প্রার্থীদের লিখিত আবেদন করতে হবে।
ভোট গণনায় ব্যবহৃত হবে ওএমআর মেশিন। এজন্য একটি বিশেষ টেকনিক্যাল টিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যারা ভোটের দিন সকালে মেশিন পরীক্ষা করে দেখবে। তবে, দীর্ঘদিন আলোচিত ডোপ টেস্ট প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা দেননি।
প্রার্থীদের ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া
জাকসুতে সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের জিএস প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “সাবেক ছাত্রদল ও যুবদল নেতাদের নিয়ে কমিশনের গোপন বৈঠক, রাতে ব্যালট বাক্স পরিবহন, সাংবাদিকের ফোন কেড়ে নেওয়া— সব মিলিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এভাবে নির্বাচন হলে শিক্ষার্থীদের আস্থা নষ্ট হবে।”
তিনি আরও অভিযোগ করেন, “কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো দিনের আলোতে না হয়ে গভীর রাতে নেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন যদি সত্যিই নিরপেক্ষ থাকতো, তবে সব সিদ্ধান্ত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ও সকল প্রার্থীর উপস্থিতিতে নেওয়া হতো। অথচ রাতের অন্ধকারে বহিরাগতদের ডেকে বৈঠক বসানো হচ্ছে। এটা স্পষ্ট করে দেয়, একটি মহল নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে।”
প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আগে থেকেই ঘোষণা দিয়েছিল যে ৯ থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনো বহিরাগত অবস্থান করতে পারবে না। কিন্তু প্রাক্তন ছাত্রদল নেতাদের কমিশন অফিসে প্রবেশ করানো হলো। এটা শুধু আচরণবিধি লঙ্ঘন নয়, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার সঙ্গেও প্রতারণা।”
মাজহারুল আরও বলেন, “ডোপ টেস্টের প্রসঙ্গে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। কমিশন ইচ্ছাকৃতভাবে বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে, যাতে নির্দিষ্ট কিছু প্রার্থীর সুবিধা হয়। এতে শিক্ষার্থীদের মনে সন্দেহ আরও গভীর হচ্ছে।”
শেষে তিনি সতর্ক করে বলেন, “আগামীকালের ভোটে যদি বহিরাগতদের প্রভাব বা জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তা কেবল নির্বাচনের বৈধতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে না, বরং পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। শিক্ষার্থীরা তাদের ভোটাধিকার রক্ষায় আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবে।”
অন্যদিকে, স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলনের ভিপি প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু বলেন, “পোলিং এজেন্ট ছাড়া নির্বাচন জালিয়াতির ঝুঁকিতে পড়বে। আমরা দেখছি নির্বাচন বানচালের জন্য নানা তৎপরতা চলছে, কারা করছে আমরা জানি। কিন্তু প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এতে শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত।”
এ ছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও অনেককে প্রতিবাদ জানাতে দেখা গেছে। তারা বলছেন, বহিরাগত প্রবেশ ঠেকানো না গেলে আগামীকালের ভোট কোনোভাবেই নিরপেক্ষ হবে না।