রাবির দ্বাদশ সমাবর্তন: কালো গাউনে মোড়া স্মৃতি

বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫
জাহিদুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

https://sangbad.net.bd/images/2025/December/17Dec25/news/IMG-20251217-WA0002.jpg

সকাল গড়িয়ে বেলা বাড়তেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শুরু হয় অন্যরকম এক ব্যস্ততা। প্রতিদিন যে রাস্তায় তাড়া থাকে ক্লাসে যাওয়ার, আজ সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন শিক্ষার্থীরা। পরিচিত মতিহারের সবুজ চত্বর আজ কালো গাউনে ঢাকা। মাথায় টুপি, হাতে মোবাইল, চোখে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে লুকানো অদ্ভুত এক নীরবতা।

আজ দ্বাদশ সমাবর্তন। আর অনেকের কাছে আজই শেষবারের মতো ‘ছাত্র’ হয়ে থাকা।

https://sangbad.net.bd/images/2025/December/17Dec25/news/IMG-20251217-WA0003.jpg

আট কিংবা নয় বছর আগে যারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পা রেখেছিলেন অচেনা এক জগতে, আজ তারাই সবচেয়ে পরিচিত মানুষ হয়েও বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে। প্রথম দিনের দ্বিধা, হলে নতুন রুমে ওঠা, ক্লাসে নাম ডাকা, পরীক্ষার আগের রাতজাগা সব স্মৃতি আজ যেন এক সুতোয় গাঁথা হয়ে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়ামের সামনে কয়েকজন বন্ধু দল বেঁধে দাঁড়িয়ে। কেউ হাসছে, কেউ বারবার ক্যামেরার দিকে তাকাচ্ছে। কেউ মাদারবোর্ড উপরে ছুঁড়ে মেরে ক্যামেরায় বন্দি করতে ব্যস্ত।

“এই রাস্তাটা দিয়েই তো চার বছর যাতায়াত। চার বছর যে জায়গাগুলো ছিল দৈনন্দিন জীবনের অংশ, সেগুলো আজ হঠাৎ করেই স্মৃতির তালিকায় ঢুকে যাচ্ছে। পরিবহন কিংবা টুকিটাকিতে আড্ডার দিনগুলো বারবার স্মৃতিতে মনে পড়লে নিজের অজান্তে চোখ বেয়ে পানি চলে আসে," এমনিভাবে স্মৃতিচারণ করেন আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মঈন উদ্দিন।

বন্ধুদের ভিড়ের মাঝেও কেউ কেউ একটু আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। অনেকে চাকরির জগতে প্রবেশ করেছেন, আর অনেকে হয়তো বেকারত্বের শিকল থেকে বের হতে না পারার হতাশায় সমাবর্তনে আসেননি। চাকরির প্রস্তুতি, বিসিএসের স্বপ্ন, উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনা কিংবা অনিশ্চিত কোনো পথ। বাস্তব জীবনের প্রশ্নগুলো আজও মাথায় ঘোরে, কিন্তু সমাবর্তনের এই দিনে সেগুলো যেন কিছুটা থেমে যায়। আজকের দিনটা শুধু অর্জনের, শুধু নিজেদের।

ক্যাম্পাসের এক পাশে ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ থেমে যায় কয়েকজন। তাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে একজন হাসিমুখে এগিয়ে এসে সংবাদের প্রতিবেদককে জানালেন, "একটা সময় পুরো বিশ্ববিদ্যালয় চষে বেড়াতাম। কোন বাধা আমাদের থামাতে পারতো না। সন্ধ্যা হলে পরিবহনে একসাথে আড্ডা দেওয়া, ক্লাসের ফাঁকে রবির দোকানে চা আর সিগারেটের ধোঁয়া সারাটাদিনের ক্লান্তি অনায়াসে দূর করে দিতো। পরিক্ষার আগে নোটপাতি খোঁজার যে প্রচেষ্টা সেগুলো অনেক বেশি মিস করি। "

বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখশ হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন আইন বিভাগের জাহিদ হাসান। বর্তমানে নাটোরে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত। হুট করে হলের ৪৪৩ নম্বর রুমে এসে নিজের স্মৃতিগুলো খুজতে লাগলেন। এক পর্যায়ে সংবাদকে তার হলে কাটানোর দিনগুলো বর্ণনা করেন, বলেন, "হলের ব্লকের প্রত্যেকে আমাদের পরিবার ছিল। তাদের সাথে সারারাত আড্ডা দিতাম। একসাথে নিজেরা রান্না করে খাবার খেতাম। হলের পরিচিত করিডোর সবগুলো অনেক বেশি মিস করি। রাত জেগে আড্ডা, পরীক্ষার আগের দুশ্চিন্তা সবকিছু যেন শেষ হয়ে গেছে, এমন ভাবনাই বুকের ভেতর ভারী করে তোলে।”

সমাবর্তন শেষ হলে ক্যাম্পাস ধীরে ধীরে ফাঁকা হতে থাকে। গাউন খুলে ব্যাগে ঢোকানো হয়। টুপি হাতে নিয়ে শেষবারের মতো ছবি তোলা হয়। কেউ লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, কেউ শহীদ মিনারের দিকে হাঁটে নীরবে। পরিচিত জায়গাগুলো আজ হঠাৎ করেই অন্যরকম মনে হয়।

সাবেক শিক্ষার্থী আমেন মাহমুদ বলছিলেন, “এতদিন মনে হতো, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন অনেক বড়। আজ মনে হচ্ছে, সবকিছু কত দ্রুত শেষ হয়ে গেল।”

কথাটার ভেতরেই ধরা পড়ে সময়ের নির্মমতা। যে সময় কখনো থেমে থাকে না, শুধু মানুষকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঠেলে দেয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন কেবল একটি আনুষ্ঠানিক আয়োজন নয়। এটি সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। এখানে শেষ হয় একটি অধ্যায়, শুরু হয় আরেকটি। যেখানে আর নিয়মিত ক্লাস নেই, নেই পরীক্ষার রুটিন, আছে কেবল বাস্তব জীবনের মুখোমুখি হওয়া।

সন্ধ্যার দিকে ক্যাম্পাস আরও নীরব হয়ে আসে। দিনের আলো ফুরিয়ে গেলে স্মৃতিগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আজ যারা গাউন খুলে ফেলেছে, কাল থেকেই তারা ভিন্ন পরিচয়ে পথ চলবে। কেউ আর ছাত্র নয়, সবাই দায়িত্বের পথে। গাউন খুলে রাখা হয়, কিন্তু বিদায়ের অনুভূতি সহজে খুলে রাখা যায় না। আজ রাবিতে শেষ বিকেল। কাল থেকে সবাই আলাদা পথে। কিন্তু এই ক্যাম্পাস, এই দিন, এই বিদায়ের স্মৃতি থেকে যাবে আজীবন।

‘ক্যাম্পাস’ : আরও খবর

সম্প্রতি