‘আগে সকাল-বিকেল দু’বার নাস্তা করতাম। দুপুরে এবং রাতে ভাত খেতাম। কিন্তু এখন বিকেলের নাস্তা দূরে থাক সকালেও নাস্তা করার সময় কয়েকবার ভাবতে হয়। অনেকসময় খালি পেটে সকালে ক্লাসে চলে যাই। আবার ছুটির দিনে সকালটা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিই। যেন সকালের নাস্তার টাকাটা বাঁচাতে পারি। একবারে দুপুরের খাবার খাই। দ্রব্যমূল্য, খাবারের দাম সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়লেও টিউশনির বেতন একবারও বাড়েনি। তাই দিন যত যাচ্ছে ততই সংকটের মধ্যে পড়ছি।’
কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্দিন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ফয়সাল (ছদ্মনাম)। শুধু ফয়সাল নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনের একটি চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, খাবারের দাম ‘দফায় দফায় বাড়ছে’। কিন্তু যারা টিউশনি বা খন্ডকালীন চাকরি করে পড়ালেখার খরচ চালান, তাদের বেতন বাড়েনি। আগে যেখানে সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকার মধ্যে মাস চলে যেত, সেখানে এখন পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকায়ও ‘হিমশিম খেতে হচ্ছে’ বলে তাদের অভিযোগ।
ক্যান্টিন মালিকরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তারা নিজেরাও ‘সমস্যায়’ আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ভর্তুকি চালু করা না হলে এখনকার চেয়ে কম দামে খাবার বিক্রি করা সম্ভব না বলে জানিয়েছেন তারা বরং খাবারের দাম ভবিষ্যতে আরও বাড়াতে হতে পারে বলে জানালেন তারা।
অভিযোগ আছে, প্রতিটি হলের ক্যান্টিন থেকে ছাত্রলীগ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ মাসিক চাঁদা নিয়ে থাকেন। যার প্রভাব পড়ে খাবারের দাম ও মানের ওপর। যদিও বিষয়টিকে অস্বীকার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন। তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করে, সেখানে চাঁদাবাজির প্রশ্নই উঠে না।’
খাবারের দাম বেড়েছে
২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত
এ বছর আগস্টের শুরুতে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়ার পর সব ধরনের পণ্য এবং সেবার মূল্য রাতারাতি বেড়ে যায়। যার প্রভাব পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর ক্যান্টিন এবং দোকানে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ক্যান্টিন ও ক্যাফেটেরিয়া এবং ক্যাম্পাসের খাবারের দোকানগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুরগির মাংস যেখানে ৩৫-৪০ টাকায় পাওয়া যেত, সেখানে এখন তা ৫০ টাকা করা হয়েছে। ৩০-৩৫ টাকার মাছের টুকরা এখন নেয়া হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা। গরুর মাংস ৪৫-৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০-৬৫ টাকা। ডিম-ভাত পাওয়া যেত ২৫-৩০ টাকায় এখন সেটি ৩৫-৪০ টাকা। অন্যান্য খাবারেও একই অবস্থা।
হলের দোকানগুলোতেও বেড়েছে খাবারের দাম। মুরগির মাংস খিচুড়ি ৬০-৭০ টাকা, পোলাও ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে ৫০-৬০ টাকার মধ্যে এসব খাবার পাওয়া যেত। নুডুলস আগে ৩০-৩৫ টাকায় পাওয়া যেত, এখন সেটি ৪০-৪৫ টাকা।
খাবারের মান নিয়ে যত অভিযোগ
হলের খাবারের মান নিয়েও শিক্ষার্থীদের পাহাড় সমান অভিযোগ। কয়েকদিন আগে কবি জসীমউদ্দিন হলের ক্যান্টিনে পচা খাবার পরিবেশনের অভিযোগে ক্যান্টিনে তালা ঝুলিয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা। অভিযোগ আছে, বাজারের সবচেয়ে ‘নিম্নমানের’ চাল ও ‘পচা’ আলু কিনে হলের ক্যান্টিন, ডাইনিং ও খাবার দোকানগুলোতে রান্না হয়। সবজি, মাছ ও মাংসের গুণগত মান ‘খুবই খারাপ’। সবজি অধিকাংশই থাকে পচা। রান্নায় ব্যবহৃত তেলও ‘অত্যন্ত নিম্নমানের’।
আর হলগুলোর রান্নাঘর যেন ময়লার ভাগাড়। সেখানে কর্দমাক্ত অবস্থায় পচা আলু, ধুলাবালির মধ্যে পাথরে ভরা চাল স্তূপ করে রাখতে দেখা যায়। রান্নার হাঁড়ি-পাতিলগুলো কতদিন ধোয়া হয়নি বলতে পারবে না কেউ। মাছির ভন ভন আওয়াজ শুনলে যে কারও মনে হবে এগুলো পরিত্যক্ত কক্ষ। দুপুরে বিক্রি না হওয়া অবিশষ্ট খাবার রাতের জন্য রান্না করা খাবারে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে এসব খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন শিক্ষার্র্থরা।
শহীদুল্লাহ হলের শিক্ষার্থী আলভি ইসলাম বলেন, ‘গন্ধযুক্ত চাল ভালোভাবে ধুয়ে রান্না না করায় অনেক সময় রান্নার পরও থাকে প্রকট দুর্গন্ধ। ২৫০ গ্রাম ডাল দিয়ে পাঁচ গামলা ডাল রান্না করা হয়। হলুদের গন্ধে তাতে মুখ দেয়া সম্ভব নয়। এসব খাবার খেয়ে প্রায়ই বমি ও পেটের পীড়ায় ভুগতে হয়। ভালো চিকিৎসক দেখালে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের তাগাদা দেন। কিন্তু ক্যাম্পাসে ভালো কোন রেস্তোরাঁ না থাকায় টাকা থাকলেও এর বাইরে ভালো খাবার মেলে না।’
সূর্যসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী শামসুল আলম জানান, ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সবচেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা হলো খাবার নিয়েই। খাবারে মরা তেলাপোকা থেকে শুরু করে মশামাছি পাওয়া যেন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়তে এসে প্রকট খাদ্য ও আবাসন সমস্যার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করতে হয় অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে। শিক্ষার্থীদের কষ্টের এসব গল্প ও দৃশ্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেন দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না । শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে এসব সমস্যার সমাধান দরকার।
কী বলছেন ঢাবির চিকিৎসকরা
ঢাবি মেডিকেল সেন্টারের দুইজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সংবাদকে জানান, যারা নিয়মিত হলে খায় তাদের বড় একটা অংশ ‘নিম্নমান ও অপুষ্টিকর বাসি-পচা খাবার’ খেয়ে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন। শিক্ষার্থীদের বয়স অনুযায়ী প্রত্যেকের দিনে অন্তত ২ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার ক্যালরি প্রয়োজন। স্বাভাবিক জীবনধারণ ও পড়াশোনা ঠিকমতো চালিয়ে যেতে এটা অবশ্যই দরকার। তবে ক্যাম্পাসে যে খাবার পাওয়া যায়, তাতে প্রয়োজনের এক-তৃতীয়াংশ ক্যালরিও থাকে না। প্রোটিন ও ফ্যাট থাকে না বললেই চলে।
চাঁদাবাজি ও ফাও খাওয়ার অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে
প্রতিটি হলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে ক্যান্টিন মালিকদের কাছ থেকে মাসিক হারে চাঁদা নেয়ার অভিযোগ আছে। আবার ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা হলের ক্যান্টিন এবং দোকান থেকে ফাও খায়। এ বিষয়ে একজন ক্যান্টিন মালিকের বক্তব্যের রেকর্ড সংবাদের কাছে আছে। নিরাপত্তার স্বার্থে তার নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হলো না।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন বলেন, ‘ছাত্রলীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা খাদ্যসংকটসহ হলের শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে হল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে। প্রশাসনের মাধ্যমে যেকোন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। সেখানে চাঁদাবাজির প্রশ্নই উঠে না।’
সাদ্দাম বলেন, ‘খাবারের দাম বেড়েছে এটি যেমন সত্য, তেমনি হলগুলোতে মানসম্মত খাবারও সরবরাহ করা হয় না। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে আমরা বিশ্বিবদ্যালয় প্রশাসনকে জানিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয়ভাবে হলগুলোতে ভর্তুকি প্রদান করতে পারে অথবা সরকারের কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কোন প্রকল্প চালু করতে পারে। তাহলেই এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে।’
কী বলছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সমস্যা সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। আমরা একটা সেল গঠন করেছি। কোন হলে কি পরিমাণ দাম বেড়েছে সেগুলো জেনে একটা সমন্বয় করা হবে। দু-একদিনের মধ্যে সভা ডেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অনুরোধ করব এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য।’
আর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘হলে খাবারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এ বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিভাবে খাবারের গুণগত মান টিকিয়ে রাখা যায় এবং কেউ যাতে অযাচিতভাবে দাম বৃদ্ধি না করে এ ব্যাপারে হল প্রশাসন বিশেষভাবে যতœশীল থাকবে। এক্ষেত্রে তাদের বিশেষ নির্দেশনা দেয়া আছে।’
মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট ২০২২
‘আগে সকাল-বিকেল দু’বার নাস্তা করতাম। দুপুরে এবং রাতে ভাত খেতাম। কিন্তু এখন বিকেলের নাস্তা দূরে থাক সকালেও নাস্তা করার সময় কয়েকবার ভাবতে হয়। অনেকসময় খালি পেটে সকালে ক্লাসে চলে যাই। আবার ছুটির দিনে সকালটা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিই। যেন সকালের নাস্তার টাকাটা বাঁচাতে পারি। একবারে দুপুরের খাবার খাই। দ্রব্যমূল্য, খাবারের দাম সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়লেও টিউশনির বেতন একবারও বাড়েনি। তাই দিন যত যাচ্ছে ততই সংকটের মধ্যে পড়ছি।’
কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্দিন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ফয়সাল (ছদ্মনাম)। শুধু ফয়সাল নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনের একটি চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, খাবারের দাম ‘দফায় দফায় বাড়ছে’। কিন্তু যারা টিউশনি বা খন্ডকালীন চাকরি করে পড়ালেখার খরচ চালান, তাদের বেতন বাড়েনি। আগে যেখানে সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকার মধ্যে মাস চলে যেত, সেখানে এখন পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকায়ও ‘হিমশিম খেতে হচ্ছে’ বলে তাদের অভিযোগ।
ক্যান্টিন মালিকরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তারা নিজেরাও ‘সমস্যায়’ আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ভর্তুকি চালু করা না হলে এখনকার চেয়ে কম দামে খাবার বিক্রি করা সম্ভব না বলে জানিয়েছেন তারা বরং খাবারের দাম ভবিষ্যতে আরও বাড়াতে হতে পারে বলে জানালেন তারা।
অভিযোগ আছে, প্রতিটি হলের ক্যান্টিন থেকে ছাত্রলীগ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ মাসিক চাঁদা নিয়ে থাকেন। যার প্রভাব পড়ে খাবারের দাম ও মানের ওপর। যদিও বিষয়টিকে অস্বীকার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন। তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করে, সেখানে চাঁদাবাজির প্রশ্নই উঠে না।’
খাবারের দাম বেড়েছে
২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত
এ বছর আগস্টের শুরুতে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়ার পর সব ধরনের পণ্য এবং সেবার মূল্য রাতারাতি বেড়ে যায়। যার প্রভাব পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর ক্যান্টিন এবং দোকানে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ক্যান্টিন ও ক্যাফেটেরিয়া এবং ক্যাম্পাসের খাবারের দোকানগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুরগির মাংস যেখানে ৩৫-৪০ টাকায় পাওয়া যেত, সেখানে এখন তা ৫০ টাকা করা হয়েছে। ৩০-৩৫ টাকার মাছের টুকরা এখন নেয়া হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা। গরুর মাংস ৪৫-৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০-৬৫ টাকা। ডিম-ভাত পাওয়া যেত ২৫-৩০ টাকায় এখন সেটি ৩৫-৪০ টাকা। অন্যান্য খাবারেও একই অবস্থা।
হলের দোকানগুলোতেও বেড়েছে খাবারের দাম। মুরগির মাংস খিচুড়ি ৬০-৭০ টাকা, পোলাও ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে ৫০-৬০ টাকার মধ্যে এসব খাবার পাওয়া যেত। নুডুলস আগে ৩০-৩৫ টাকায় পাওয়া যেত, এখন সেটি ৪০-৪৫ টাকা।
খাবারের মান নিয়ে যত অভিযোগ
হলের খাবারের মান নিয়েও শিক্ষার্থীদের পাহাড় সমান অভিযোগ। কয়েকদিন আগে কবি জসীমউদ্দিন হলের ক্যান্টিনে পচা খাবার পরিবেশনের অভিযোগে ক্যান্টিনে তালা ঝুলিয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা। অভিযোগ আছে, বাজারের সবচেয়ে ‘নিম্নমানের’ চাল ও ‘পচা’ আলু কিনে হলের ক্যান্টিন, ডাইনিং ও খাবার দোকানগুলোতে রান্না হয়। সবজি, মাছ ও মাংসের গুণগত মান ‘খুবই খারাপ’। সবজি অধিকাংশই থাকে পচা। রান্নায় ব্যবহৃত তেলও ‘অত্যন্ত নিম্নমানের’।
আর হলগুলোর রান্নাঘর যেন ময়লার ভাগাড়। সেখানে কর্দমাক্ত অবস্থায় পচা আলু, ধুলাবালির মধ্যে পাথরে ভরা চাল স্তূপ করে রাখতে দেখা যায়। রান্নার হাঁড়ি-পাতিলগুলো কতদিন ধোয়া হয়নি বলতে পারবে না কেউ। মাছির ভন ভন আওয়াজ শুনলে যে কারও মনে হবে এগুলো পরিত্যক্ত কক্ষ। দুপুরে বিক্রি না হওয়া অবিশষ্ট খাবার রাতের জন্য রান্না করা খাবারে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে এসব খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন শিক্ষার্র্থরা।
শহীদুল্লাহ হলের শিক্ষার্থী আলভি ইসলাম বলেন, ‘গন্ধযুক্ত চাল ভালোভাবে ধুয়ে রান্না না করায় অনেক সময় রান্নার পরও থাকে প্রকট দুর্গন্ধ। ২৫০ গ্রাম ডাল দিয়ে পাঁচ গামলা ডাল রান্না করা হয়। হলুদের গন্ধে তাতে মুখ দেয়া সম্ভব নয়। এসব খাবার খেয়ে প্রায়ই বমি ও পেটের পীড়ায় ভুগতে হয়। ভালো চিকিৎসক দেখালে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের তাগাদা দেন। কিন্তু ক্যাম্পাসে ভালো কোন রেস্তোরাঁ না থাকায় টাকা থাকলেও এর বাইরে ভালো খাবার মেলে না।’
সূর্যসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী শামসুল আলম জানান, ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সবচেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা হলো খাবার নিয়েই। খাবারে মরা তেলাপোকা থেকে শুরু করে মশামাছি পাওয়া যেন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়তে এসে প্রকট খাদ্য ও আবাসন সমস্যার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করতে হয় অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে। শিক্ষার্থীদের কষ্টের এসব গল্প ও দৃশ্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেন দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না । শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে এসব সমস্যার সমাধান দরকার।
কী বলছেন ঢাবির চিকিৎসকরা
ঢাবি মেডিকেল সেন্টারের দুইজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সংবাদকে জানান, যারা নিয়মিত হলে খায় তাদের বড় একটা অংশ ‘নিম্নমান ও অপুষ্টিকর বাসি-পচা খাবার’ খেয়ে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন। শিক্ষার্থীদের বয়স অনুযায়ী প্রত্যেকের দিনে অন্তত ২ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার ক্যালরি প্রয়োজন। স্বাভাবিক জীবনধারণ ও পড়াশোনা ঠিকমতো চালিয়ে যেতে এটা অবশ্যই দরকার। তবে ক্যাম্পাসে যে খাবার পাওয়া যায়, তাতে প্রয়োজনের এক-তৃতীয়াংশ ক্যালরিও থাকে না। প্রোটিন ও ফ্যাট থাকে না বললেই চলে।
চাঁদাবাজি ও ফাও খাওয়ার অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে
প্রতিটি হলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে ক্যান্টিন মালিকদের কাছ থেকে মাসিক হারে চাঁদা নেয়ার অভিযোগ আছে। আবার ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা হলের ক্যান্টিন এবং দোকান থেকে ফাও খায়। এ বিষয়ে একজন ক্যান্টিন মালিকের বক্তব্যের রেকর্ড সংবাদের কাছে আছে। নিরাপত্তার স্বার্থে তার নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হলো না।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন বলেন, ‘ছাত্রলীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা খাদ্যসংকটসহ হলের শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে হল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে। প্রশাসনের মাধ্যমে যেকোন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। সেখানে চাঁদাবাজির প্রশ্নই উঠে না।’
সাদ্দাম বলেন, ‘খাবারের দাম বেড়েছে এটি যেমন সত্য, তেমনি হলগুলোতে মানসম্মত খাবারও সরবরাহ করা হয় না। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে আমরা বিশ্বিবদ্যালয় প্রশাসনকে জানিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয়ভাবে হলগুলোতে ভর্তুকি প্রদান করতে পারে অথবা সরকারের কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কোন প্রকল্প চালু করতে পারে। তাহলেই এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে।’
কী বলছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সমস্যা সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। আমরা একটা সেল গঠন করেছি। কোন হলে কি পরিমাণ দাম বেড়েছে সেগুলো জেনে একটা সমন্বয় করা হবে। দু-একদিনের মধ্যে সভা ডেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অনুরোধ করব এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য।’
আর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘হলে খাবারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এ বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিভাবে খাবারের গুণগত মান টিকিয়ে রাখা যায় এবং কেউ যাতে অযাচিতভাবে দাম বৃদ্ধি না করে এ ব্যাপারে হল প্রশাসন বিশেষভাবে যতœশীল থাকবে। এক্ষেত্রে তাদের বিশেষ নির্দেশনা দেয়া আছে।’