গুমের শিকার ব্যক্তিদের সম্ভাব্য চার ধরনের পরিণতি হয়েছিল বলে জানিয়েছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে কমিশনের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান কমিশনের প্রধান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কমিশনে জমা অভিযোগগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের চারটি সম্ভাব্য পরিণতি হয়েছে। সেগুলো হলো—ভুক্তভোগীকে হত্যা, বিচারের আগেই গণমাধ্যমে উপস্থাপন করে সাধারণত জঙ্গি তকমা দিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো, সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা এবং অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে মামলা না দিয়ে ছেড়ে দেওয়া।
৪ জুন প্রধান উপদেষ্টার কাছে কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনে গুমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও অপরাধীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকায় বহু প্রমাণ ধ্বংস হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতা, সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ভীতিকর পরিবেশের মধ্যেও অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ ও অভিজ্ঞতা জানাতে সাহস করেছেন। গোপন আটক কেন্দ্রের অস্তিত্ব এখন অস্বীকার করা যাচ্ছে না। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা কিছু আটক কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন এবং ভুক্তভোগীদের বক্তব্য শুনেছেন, যা গণমাধ্যমের কল্যাণে বিশ্ববাসী দেখেছে।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর গঠিত গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন বলপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, শনাক্তকরণ ও পরিস্থিতি নির্ধারণে কাজ করছে। এ পর্যন্ত দেশে ১৬টি গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন করেছে কমিশন। বিভিন্ন সময় তথ্য পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক অভিযানও চালানো হয়েছে। অভিযোগ থেকে ১৩১টির বিষয়ে আইন মোতাবেক এফআইআর বা জিডি রেকর্ড করে পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে পাঠানো হয়েছে।
দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে প্রায় ১ হাজার ৮৫০ অভিযোগ বিশ্লেষণ করে ২৫৩ জন ভুক্তভোগীর তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়—গুমের সময় সমসাময়িক প্রমাণ, ফেরার সময় রাষ্ট্রীয় সংস্থার গ্রেপ্তার দেখানো এবং জীবিত ফিরে আসায় গোপন আটক কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা। তিনটি পর্যায়ে অকাট্য প্রমাণ মিলেছে।
কমিশনপ্রধান বলেন, ২৫৩ জনের একটি তথ্যভিত্তিক দলিল রয়েছে, যাঁরা বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসলেও অভিজ্ঞতায় সাদৃশ্য রয়েছে। এটি কাকতালীয় বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সাংগঠনিক ও পদ্ধতিগত কাঠামোর ইঙ্গিত দেয়। এতে স্পষ্ট হয়, গুম একটি সুশৃঙ্খল প্রাতিষ্ঠানিক রূপে পরিচালিত হয়েছে, যার উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক দমন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন ও শাসন দীর্ঘায়িত করা। মেধাবী শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সাধারণ মানুষ এর শিকার হয়েছেন। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে অস্ত্র বানিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি সাধারণ নাগরিকদের বেআইনি পন্থায় ভারতীয় বাহিনীর কাছেও তুলে দেওয়া হয়েছে।
২৫৩ জনের অভিজ্ঞতা এক দশকেরও বেশি সময়জুড়ে বিস্তৃত। বয়স, পেশা ও সময়কাল ভিন্ন হলেও অভিজ্ঞতায় সাদৃশ্য রয়েছে। বেশিরভাগই বিরোধী দলের বা ভিন্নমতের সমর্থক ছিলেন। একই ধরনের নির্যাতন, প্রচার, অভিযোগ ও ভাষায় বর্ণনা তাদের অভিজ্ঞতাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে তুলে ধরে। এটি কোনো জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানে বিচ্ছিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, বরং একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক দমনযন্ত্র।
কমিশন জানিয়েছে, তাদের কাছে জমা ৮১ শতাংশ অভিযোগ জীবিত ভুক্তভোগীদের এবং ১৯ শতাংশ অভিযোগ ফেরত না আসা ব্যক্তিদের। এবারের প্রতিবেদনে গুম থেকে না ফেরার ১২ জনের বিষয়ে অগ্রগতি তুলে ধরা হয়েছে। তাঁদের গুমের জন্য কারা দায়ী, কমিশন তা প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করেছে। অনুসন্ধানের স্বার্থে বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি। আরও অনেক গুমের ঘটনায় অগ্রগতি থাকলেও এখনই তথ্য প্রকাশ সম্ভব নয়। কারণ, কললিস্ট না পাওয়া ও তথ্যের ঘাটতির কারণে বিলম্ব হচ্ছে।
দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে কমিশন দুটি সুপারিশ দিয়েছে। এক, সন্ত্রাসবিরোধী মামলার অপব্যবহার ঠেকাতে সেগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেওয়া। দুই, বর্তমান ‘কাউন্টার টেররিজম মেথড’ ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার মতো উপযোগী পদ্ধতি অনুসন্ধান করা।
কমিশনপ্রধান বলেন, সন্ত্রাসবাদ একটি বাস্তব হুমকি। তবে এই হুমকি মোকাবিলায় রাষ্ট্রের উচিত মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতি ও আইনসম্মত প্রক্রিয়ায় অটল থাকা। যখন রাষ্ট্র সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণাকে রাজনৈতিক দমনের ঢাল বানায়, তখন আইনের শাসন, প্রতিষ্ঠান ও জনগণের বিশ্বাস ভেঙে পড়ে।
বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫
গুমের শিকার ব্যক্তিদের সম্ভাব্য চার ধরনের পরিণতি হয়েছিল বলে জানিয়েছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে কমিশনের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান কমিশনের প্রধান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কমিশনে জমা অভিযোগগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের চারটি সম্ভাব্য পরিণতি হয়েছে। সেগুলো হলো—ভুক্তভোগীকে হত্যা, বিচারের আগেই গণমাধ্যমে উপস্থাপন করে সাধারণত জঙ্গি তকমা দিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো, সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা এবং অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে মামলা না দিয়ে ছেড়ে দেওয়া।
৪ জুন প্রধান উপদেষ্টার কাছে কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনে গুমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও অপরাধীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকায় বহু প্রমাণ ধ্বংস হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতা, সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ভীতিকর পরিবেশের মধ্যেও অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ ও অভিজ্ঞতা জানাতে সাহস করেছেন। গোপন আটক কেন্দ্রের অস্তিত্ব এখন অস্বীকার করা যাচ্ছে না। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা কিছু আটক কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন এবং ভুক্তভোগীদের বক্তব্য শুনেছেন, যা গণমাধ্যমের কল্যাণে বিশ্ববাসী দেখেছে।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর গঠিত গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন বলপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, শনাক্তকরণ ও পরিস্থিতি নির্ধারণে কাজ করছে। এ পর্যন্ত দেশে ১৬টি গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন করেছে কমিশন। বিভিন্ন সময় তথ্য পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক অভিযানও চালানো হয়েছে। অভিযোগ থেকে ১৩১টির বিষয়ে আইন মোতাবেক এফআইআর বা জিডি রেকর্ড করে পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে পাঠানো হয়েছে।
দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে প্রায় ১ হাজার ৮৫০ অভিযোগ বিশ্লেষণ করে ২৫৩ জন ভুক্তভোগীর তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়—গুমের সময় সমসাময়িক প্রমাণ, ফেরার সময় রাষ্ট্রীয় সংস্থার গ্রেপ্তার দেখানো এবং জীবিত ফিরে আসায় গোপন আটক কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা। তিনটি পর্যায়ে অকাট্য প্রমাণ মিলেছে।
কমিশনপ্রধান বলেন, ২৫৩ জনের একটি তথ্যভিত্তিক দলিল রয়েছে, যাঁরা বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসলেও অভিজ্ঞতায় সাদৃশ্য রয়েছে। এটি কাকতালীয় বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সাংগঠনিক ও পদ্ধতিগত কাঠামোর ইঙ্গিত দেয়। এতে স্পষ্ট হয়, গুম একটি সুশৃঙ্খল প্রাতিষ্ঠানিক রূপে পরিচালিত হয়েছে, যার উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক দমন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন ও শাসন দীর্ঘায়িত করা। মেধাবী শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সাধারণ মানুষ এর শিকার হয়েছেন। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে অস্ত্র বানিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি সাধারণ নাগরিকদের বেআইনি পন্থায় ভারতীয় বাহিনীর কাছেও তুলে দেওয়া হয়েছে।
২৫৩ জনের অভিজ্ঞতা এক দশকেরও বেশি সময়জুড়ে বিস্তৃত। বয়স, পেশা ও সময়কাল ভিন্ন হলেও অভিজ্ঞতায় সাদৃশ্য রয়েছে। বেশিরভাগই বিরোধী দলের বা ভিন্নমতের সমর্থক ছিলেন। একই ধরনের নির্যাতন, প্রচার, অভিযোগ ও ভাষায় বর্ণনা তাদের অভিজ্ঞতাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে তুলে ধরে। এটি কোনো জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানে বিচ্ছিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, বরং একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক দমনযন্ত্র।
কমিশন জানিয়েছে, তাদের কাছে জমা ৮১ শতাংশ অভিযোগ জীবিত ভুক্তভোগীদের এবং ১৯ শতাংশ অভিযোগ ফেরত না আসা ব্যক্তিদের। এবারের প্রতিবেদনে গুম থেকে না ফেরার ১২ জনের বিষয়ে অগ্রগতি তুলে ধরা হয়েছে। তাঁদের গুমের জন্য কারা দায়ী, কমিশন তা প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করেছে। অনুসন্ধানের স্বার্থে বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি। আরও অনেক গুমের ঘটনায় অগ্রগতি থাকলেও এখনই তথ্য প্রকাশ সম্ভব নয়। কারণ, কললিস্ট না পাওয়া ও তথ্যের ঘাটতির কারণে বিলম্ব হচ্ছে।
দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে কমিশন দুটি সুপারিশ দিয়েছে। এক, সন্ত্রাসবিরোধী মামলার অপব্যবহার ঠেকাতে সেগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেওয়া। দুই, বর্তমান ‘কাউন্টার টেররিজম মেথড’ ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার মতো উপযোগী পদ্ধতি অনুসন্ধান করা।
কমিশনপ্রধান বলেন, সন্ত্রাসবাদ একটি বাস্তব হুমকি। তবে এই হুমকি মোকাবিলায় রাষ্ট্রের উচিত মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতি ও আইনসম্মত প্রক্রিয়ায় অটল থাকা। যখন রাষ্ট্র সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণাকে রাজনৈতিক দমনের ঢাল বানায়, তখন আইনের শাসন, প্রতিষ্ঠান ও জনগণের বিশ্বাস ভেঙে পড়ে।