আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার জন্য গত ৬ মাসে দুইবার চেষ্টা করা হলেও কলকাতার সেই ফ্ল্যাটে সেদিন হত্যার পরিকল্পনা ছিল না বলে জানতে পেরেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তারা জানিয়েছে, খুনিদের পরিকল্পনা ছিল দুই দিন জীবিত রেখে ‘ন্যুড’ ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে টাকা আদায় করার। কিন্তু ফ্ল্যাটে ঢোকার পর ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তাকে চেতনানাশক ক্লোরোফরম প্রয়োগ করা হলে জ্ঞান হারান আজীম। সেই জ্ঞান আর ফেরেনি। এরপর তারা লাশ গুমে মনোযোগ দেয় খুনিরা।
শনিবার (২৫ মে) রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ। মামলাটির তদন্তকারী ডিবির ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার আবদুল আহাদসহ অন্যান্য কর্মকর্তারাও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। হত্যাটি নিয়ে অনেককিছু জানা গেলেও এখন পর্যন্ত হত্যার সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি বলে উল্লেখ করেছেন হারুন, যদিও এর মধ্যে হত্যার কারণ হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে চোরাচালান, স্বর্ণের চালান ভাগাভাগির ২০০ কোটি টাকা নিয়ে দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন বিষয় ওঠে এসেছে। এক প্রশ্নে ডিবি প্রধান বলেন, পুরো বিষয়টি তদন্তের জন্য ঢাকা ডিবির একটি দল ভারতে যাবে। এখন ঢাকায় ভারতীয় তদন্তকারীরা কাজ করছেন। তাদের কাজ শেষ হলে তিনিসহ ডিবির কর্মকর্তারা ভারতে যাবেন।
হারুন বলেন, ‘কথা ছিল প্রথমে কিন্তু তাকে হত্যা করবে না। প্রথম পরিকল্পনা ছিল হানি ট্র্যাপে ফেলার মতোই। তাকে ভয় দেখাবে, তার ন্যুড ছবি তুলবে। এসব করে তাকে দুই দিন ব্ল্যাকমেইল করবে। এরপর তার বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভারতে আসবে শাহীন। ‘তাদের উদ্দেশ্য ছিল তাকে হত্যা করবে। কিন্তু দুই দিন তাকে রাখবে টাকা নেয়ার জন্য। ওই টাকার অংশ কামলাদের দেবে। কামলা মানে যারা হত্যায় জড়িত ছিল।’
ধস্তাধস্তির মধ্যেই চেতনানাশকের প্রভাবে এমপি আজীমের মৃত্যু হওয়ার কারণে তাদের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি জানিয়ে ডিবি প্রধান বলেন, ‘তারা যেটা জানিয়েছে, ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তার মুখে চেতনানাশক ক্লোরোফর্ম দিয়ে দেয়। এরপর তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলে তারা তার ন্যুড ছবিও তুলেছে।
‘কিন্তু এরপর এমপি আজীমের আর জ্ঞান ফেরেনি। যার কারণে তাদের দুই দিনের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের প্ল্যান ভেস্তে গেছে। তখন তারা আগের প্ল্যানে আসে। তখন তারা তার মোবাইলগুলো নিয়ে এমনভাবে বিভ্রান্ত করার একটা প্ল্যান করে যাতে বোঝা না যায় যে এই জায়গাতেই খুনটা হয়েছে। আর লাশ টুকরো করে গুম করার প্ল্যান বাস্তবায়ন করে।’
ব্ল্যাকমেইলিংয়ের জন্য বাংলাদেশি তরুণী সেলেস্টি রহমানকে ব্যবহার করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে হারুন অর রশীদ বলেন, ‘না’। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, হত্যার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিভ্রান্ত করতে আজীমের মোবাইল ফোনগুলো নিয়ে বের হয় খুনিরা। একজন চারটা ফোন নিয়ে বেনাপোলে আসেন। সেখানে সংসদ সদস্যের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের লোকদের ফোন দেয়া হয়।
পরিকল্পনা ছিল ফোন দিয়ে সেই ব্যক্তি বলবেন, ‘শেষ’, যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই হত্যার জন্য সেই বিপক্ষের লোকদের সন্দেহ করে। হারুন বলেন, ‘এদের একজন জাহিদ ধরা পড়েছে ভারতে। আমরা ভারতে যাব, ওই আসামি জাহিদের সঙ্গে কথা বলব। তার কথার সঙ্গে পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলো মেলাব। আমরা অনেকগুলো বিষয় নিয়ে কাজ করছি।’
দেশে মামলা হয়েছে অপহরণের। আজীম যে হত্যার শিকার হয়েছেন, তার কী প্রমাণ পাওয়া গেছে, এই প্রশ্নে জবাব আসে, ‘আমরা প্রমাণ তো পেয়েছি। সেটা এখন বলব না। কলকাতার পুলিশ নিশ্চয়ই আলামত পেয়েছে, যার কারণে সেখানে তাদের বিরুদ্ধে হত্যার মামলা হয়েছে।’
হত্যার কারণ কী?
কেন এমপি আজীমকে হত্যা করা হলো জানতে চাইলে হারুন অর রশীদ বলেন, ‘যে কোনো হত্যার পেছনে কারণ তো অবশ্যই আছে। পূর্ব শত্রুতা, টাকা-পয়সার লেনদেন, রাজনৈতিক বিষয় থাকতে পারে।’ ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে এই হত্যা কিনা জানতে চাইলে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ‘কী কারণে এমপি আজীমকে হত্যা করা হলো তা সুনির্দিষ্টভাবে আমরা বলতে পারছি না। কিন্তু সাপোর্টিং অনেকগুলো বিষয় আমরা জেনেছি। ‘যেমন তাকে ন্যুড ছবি তুলে দুই দিন আটকে রেখে কিছু টাকা আদায় করা যায় কিনা, তাদের এমন প্ল্যান ছিল। তাকে হত্যা করার প্ল্যান এর আগেও দুইবার হয়েছে।
টাকা-পয়সা ছাড়াও ওই এলাকায় আধিপত্যের বিস্তার নিয়ে একটা বিষয় ছিল জানিয়ে হারুন বলেন, ‘যেহেতু সেটা একটা বর্ডার এরিয়া, একই এলাকায় বাড়ি তাদের।’ স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ে তাদের দ্বন্দ্বের একটা কথা উঠেছে। এ রকম কিছু ছিল কিনা জানতে চাইলে হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আমরা যেটা পেয়েছি বললাম তো আপনাকে। একচুয়ালি কী বিষয় আপনারা আমাকে যতই স্পেসিফিক কোশ্চেন করেন, আমি তো বলতে পারব না। আপনারা যতগুলো কারণ বলছেন সবগুলো বিষয়ই আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করব। কিন্তু এখন স্পেসিফিকভাবে কিছু বলতে পারব না।
‘আমরা ভারতে যাই, গেলে আরও তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’ হত্যায় জড়িতদের অন্তত চারজন চরমপন্থি পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা জানিয়ে হারুন অর রশীদ বলেন, ‘হত্যাটি এক্সিকিউশন যারা করেছেন তাদের ৪-৫ জনই গলাকাটা পার্টি অর্থাৎ পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। এই যে শিমুল ভুঁইয়া, জিহাদ, সিয়াম এবং আরেক মূল বাস্তবায়নকারী মুস্তাফিজ এরা সবাই।
‘তাদের লিডার আমানউল্লাহ ওরফে শিমুল ভুঁইয়া। আমার কাছে খবর এসেছে সে পাঁচ-ছয়টা গলা কেটেছে যা রেকর্ডেড। এর বাইরে আরো থাকতে পারে। এমপির সঙ্গে তাদেরও শত্রুতা তো অবশ্যই রয়েছে।’
হুন্ডির টাকা নিয়ে দ্বন্দ্বে এই হত্যাকাণ্ডে আসামিদের কাছ থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে কিনা- এমন প্রশ্নে ডিবি কর্মকর্তা হারুন পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘কোনো আসামিরা বলেছে? ‘এটা আমি কয়েকবারই বলেছি। এমপি সাহেবের সঙ্গে মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামানের বন্ধুত্ব ছিল। আর যারা বাস্তবায়ন করেছে তারাও তো পরিচিত, একই এলাকায় বাড়ি।’
আগেও দুইবার হত্যার পরিকল্পনা
হারুন বলেন, ‘এমপি আজীমকে হত্যা করার জন্য আগেও দুইবার পরিকল্পনা হয়েছে। নির্বাচনের আগেও একবার পরিকল্পনা হয়েছে। তখন পরিকল্পনা ছিল এদেশে হত্যা করার। জানুয়ারি মাসের ১৭-১৮ তারিখে তারা দ্বিতীয়বার পরিকল্পনা করে। তখন এমপি আজীম সাহেবও ভারতে যান, আর চক্রটিও তখন ভারতে ছিল। কিন্তু যেভাবেই হোক সেই প্ল্যানটি বাস্তবায়ন হয়নি। তৃতীয় ধাপে সেই প্ল্যানটি বাস্তবায়ন হয়।’
তদন্তে জানা গেছে, আখতারুজ্জামান শাহীন ১০ মে দেশে চলে আসেন এবং আজীম যান ১২ মে। হারুন জানান, গত ৩০ এপ্রিল হত্যার প্রধান পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান শাহীন, চরমপন্থি নেতা শিমুল ভুঁইয়া ওরফে আমানউল্লাহ এবং সেলেস্টি রহমান কলকাতায় গিয়ে নিউটাউনের ওই ফ্ল্যাটে ওঠেন। খুনের দায়িত্ব শিমুল ভুঁইয়াকে দিয়ে ১০ মে ঢাকায় ফেরেন আখতারুজ্জামান শাহীন। এরপর ২০ মে তিনি ঢাকা থেকে দিল্লি, সেখান থেকে নেপালের কাঠমান্ডু যান। ২২ মে তিনি কাঠমান্ডু থেকে দুবাই হয়ে যে দেশের পাসপোর্ট সে দেশে গিয়েছেন। আখতারুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।
খালে জাল ফেলেও মেলেনি আজীমের দেহাংশ
কলকাতা থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানিয়েছেন এমপি আজীমের মরদেহের অংশের সন্ধান মেলেনি এখনো। শনিবার দুপুর ১২টার পর দ্বিতীয় দিনের মতো ভাঙড়ের কৃষ্ণমাটি এলাকার জিরানগাছা খালে তল্লাশি চালায় ভারতীয় সিআইডি ও পোলেরহাট থানার পুলিশ। তল্লাশির পরেও মরদেহের কোনো অংশ খুঁজে না পাওয়ায় দুপুর ২টার দিকে অভিযান বন্ধ করে দেন কর্মকর্তারা। এদিনও ভাঙড়ের কৃষ্ণমাটি এলাকার জিরানগাছা খালে দুর্যোগ মোকাবিলা দল নামানো হয়। সেই সঙ্গে মরদেহের সন্ধান পেতে খালে জাল ফেলা হয়, নামানো হয় নৌকাও। মরদেহের অংশ খুঁজতে ড্রোনও ব্যবহার করা হয়।
এদিন স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে তল্লাশি অভিযান শুরু হয়। কিন্তু সফলতা পাননি তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তবে একটি কালো ব্যাগ উদ্ধার হয়েছে। যদিও তার ভেতরে কিছু পাওয়া যায়নি। পরে দুপুর ২টা ১০ মিনিটে অভিযান বন্ধ করে দেন কর্মকর্তারা। এর আগে শুক্রবার এমপি আজীমের মরদেহের সন্ধানে জোর অভিযান চালানো হয়। সেদিন ১২ দিনের হেফাজতে থাকা এই হত্যা মামলার আসামি জিহাদ হাওলাদারকে সঙ্গে নিয়ে কৃষ্ণমাটি এলাকায় অভিযান চালায় সিআইডি।
গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে চুয়াডাঙ্গার দর্শনার গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান এমপি আজীম। ওঠেন পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার মণ্ডলপাড়া লেনে গোপাল বিশ্বাস নামে এক বন্ধুর বাড়িতে। পরদিন ডাক্তার দেখানোর কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন। এরপর থেকেই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ আনোয়ারুল আজীম।
বাড়ি থেকে বেরোনোর পাঁচ দিন পরে গত ১৮ মে বরাহনগর থানায় আনোয়ারুল আজীম নিখোঁজের বিষয়ে একটি জিডি করেন বন্ধু গোপাল বিশ্বাস। এরপরও খোঁজ মেলে না তিনবারের এই সংসদ সদস্যের। বুধবার হঠাৎ খবর ছড়ায়, কলকাতার পার্শ্ববর্তী নিউটাউন এলাকায় বহুতল সঞ্জীবা গার্ডেনস নামে একটি আবাসিক ভবনের একটি ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজীম খুন হয়েছেন। ঘরের ভেতর পাওয়া গেছে রক্তের ছাপ। তবে মেলেনি মরদেহ।
শনিবার, ২৫ মে ২০২৪
আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার জন্য গত ৬ মাসে দুইবার চেষ্টা করা হলেও কলকাতার সেই ফ্ল্যাটে সেদিন হত্যার পরিকল্পনা ছিল না বলে জানতে পেরেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তারা জানিয়েছে, খুনিদের পরিকল্পনা ছিল দুই দিন জীবিত রেখে ‘ন্যুড’ ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে টাকা আদায় করার। কিন্তু ফ্ল্যাটে ঢোকার পর ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তাকে চেতনানাশক ক্লোরোফরম প্রয়োগ করা হলে জ্ঞান হারান আজীম। সেই জ্ঞান আর ফেরেনি। এরপর তারা লাশ গুমে মনোযোগ দেয় খুনিরা।
শনিবার (২৫ মে) রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ। মামলাটির তদন্তকারী ডিবির ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার আবদুল আহাদসহ অন্যান্য কর্মকর্তারাও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। হত্যাটি নিয়ে অনেককিছু জানা গেলেও এখন পর্যন্ত হত্যার সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি বলে উল্লেখ করেছেন হারুন, যদিও এর মধ্যে হত্যার কারণ হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে চোরাচালান, স্বর্ণের চালান ভাগাভাগির ২০০ কোটি টাকা নিয়ে দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন বিষয় ওঠে এসেছে। এক প্রশ্নে ডিবি প্রধান বলেন, পুরো বিষয়টি তদন্তের জন্য ঢাকা ডিবির একটি দল ভারতে যাবে। এখন ঢাকায় ভারতীয় তদন্তকারীরা কাজ করছেন। তাদের কাজ শেষ হলে তিনিসহ ডিবির কর্মকর্তারা ভারতে যাবেন।
হারুন বলেন, ‘কথা ছিল প্রথমে কিন্তু তাকে হত্যা করবে না। প্রথম পরিকল্পনা ছিল হানি ট্র্যাপে ফেলার মতোই। তাকে ভয় দেখাবে, তার ন্যুড ছবি তুলবে। এসব করে তাকে দুই দিন ব্ল্যাকমেইল করবে। এরপর তার বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভারতে আসবে শাহীন। ‘তাদের উদ্দেশ্য ছিল তাকে হত্যা করবে। কিন্তু দুই দিন তাকে রাখবে টাকা নেয়ার জন্য। ওই টাকার অংশ কামলাদের দেবে। কামলা মানে যারা হত্যায় জড়িত ছিল।’
ধস্তাধস্তির মধ্যেই চেতনানাশকের প্রভাবে এমপি আজীমের মৃত্যু হওয়ার কারণে তাদের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি জানিয়ে ডিবি প্রধান বলেন, ‘তারা যেটা জানিয়েছে, ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তার মুখে চেতনানাশক ক্লোরোফর্ম দিয়ে দেয়। এরপর তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলে তারা তার ন্যুড ছবিও তুলেছে।
‘কিন্তু এরপর এমপি আজীমের আর জ্ঞান ফেরেনি। যার কারণে তাদের দুই দিনের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের প্ল্যান ভেস্তে গেছে। তখন তারা আগের প্ল্যানে আসে। তখন তারা তার মোবাইলগুলো নিয়ে এমনভাবে বিভ্রান্ত করার একটা প্ল্যান করে যাতে বোঝা না যায় যে এই জায়গাতেই খুনটা হয়েছে। আর লাশ টুকরো করে গুম করার প্ল্যান বাস্তবায়ন করে।’
ব্ল্যাকমেইলিংয়ের জন্য বাংলাদেশি তরুণী সেলেস্টি রহমানকে ব্যবহার করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে হারুন অর রশীদ বলেন, ‘না’। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, হত্যার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিভ্রান্ত করতে আজীমের মোবাইল ফোনগুলো নিয়ে বের হয় খুনিরা। একজন চারটা ফোন নিয়ে বেনাপোলে আসেন। সেখানে সংসদ সদস্যের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের লোকদের ফোন দেয়া হয়।
পরিকল্পনা ছিল ফোন দিয়ে সেই ব্যক্তি বলবেন, ‘শেষ’, যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই হত্যার জন্য সেই বিপক্ষের লোকদের সন্দেহ করে। হারুন বলেন, ‘এদের একজন জাহিদ ধরা পড়েছে ভারতে। আমরা ভারতে যাব, ওই আসামি জাহিদের সঙ্গে কথা বলব। তার কথার সঙ্গে পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলো মেলাব। আমরা অনেকগুলো বিষয় নিয়ে কাজ করছি।’
দেশে মামলা হয়েছে অপহরণের। আজীম যে হত্যার শিকার হয়েছেন, তার কী প্রমাণ পাওয়া গেছে, এই প্রশ্নে জবাব আসে, ‘আমরা প্রমাণ তো পেয়েছি। সেটা এখন বলব না। কলকাতার পুলিশ নিশ্চয়ই আলামত পেয়েছে, যার কারণে সেখানে তাদের বিরুদ্ধে হত্যার মামলা হয়েছে।’
হত্যার কারণ কী?
কেন এমপি আজীমকে হত্যা করা হলো জানতে চাইলে হারুন অর রশীদ বলেন, ‘যে কোনো হত্যার পেছনে কারণ তো অবশ্যই আছে। পূর্ব শত্রুতা, টাকা-পয়সার লেনদেন, রাজনৈতিক বিষয় থাকতে পারে।’ ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে এই হত্যা কিনা জানতে চাইলে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ‘কী কারণে এমপি আজীমকে হত্যা করা হলো তা সুনির্দিষ্টভাবে আমরা বলতে পারছি না। কিন্তু সাপোর্টিং অনেকগুলো বিষয় আমরা জেনেছি। ‘যেমন তাকে ন্যুড ছবি তুলে দুই দিন আটকে রেখে কিছু টাকা আদায় করা যায় কিনা, তাদের এমন প্ল্যান ছিল। তাকে হত্যা করার প্ল্যান এর আগেও দুইবার হয়েছে।
টাকা-পয়সা ছাড়াও ওই এলাকায় আধিপত্যের বিস্তার নিয়ে একটা বিষয় ছিল জানিয়ে হারুন বলেন, ‘যেহেতু সেটা একটা বর্ডার এরিয়া, একই এলাকায় বাড়ি তাদের।’ স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ে তাদের দ্বন্দ্বের একটা কথা উঠেছে। এ রকম কিছু ছিল কিনা জানতে চাইলে হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আমরা যেটা পেয়েছি বললাম তো আপনাকে। একচুয়ালি কী বিষয় আপনারা আমাকে যতই স্পেসিফিক কোশ্চেন করেন, আমি তো বলতে পারব না। আপনারা যতগুলো কারণ বলছেন সবগুলো বিষয়ই আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করব। কিন্তু এখন স্পেসিফিকভাবে কিছু বলতে পারব না।
‘আমরা ভারতে যাই, গেলে আরও তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’ হত্যায় জড়িতদের অন্তত চারজন চরমপন্থি পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা জানিয়ে হারুন অর রশীদ বলেন, ‘হত্যাটি এক্সিকিউশন যারা করেছেন তাদের ৪-৫ জনই গলাকাটা পার্টি অর্থাৎ পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। এই যে শিমুল ভুঁইয়া, জিহাদ, সিয়াম এবং আরেক মূল বাস্তবায়নকারী মুস্তাফিজ এরা সবাই।
‘তাদের লিডার আমানউল্লাহ ওরফে শিমুল ভুঁইয়া। আমার কাছে খবর এসেছে সে পাঁচ-ছয়টা গলা কেটেছে যা রেকর্ডেড। এর বাইরে আরো থাকতে পারে। এমপির সঙ্গে তাদেরও শত্রুতা তো অবশ্যই রয়েছে।’
হুন্ডির টাকা নিয়ে দ্বন্দ্বে এই হত্যাকাণ্ডে আসামিদের কাছ থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে কিনা- এমন প্রশ্নে ডিবি কর্মকর্তা হারুন পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘কোনো আসামিরা বলেছে? ‘এটা আমি কয়েকবারই বলেছি। এমপি সাহেবের সঙ্গে মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামানের বন্ধুত্ব ছিল। আর যারা বাস্তবায়ন করেছে তারাও তো পরিচিত, একই এলাকায় বাড়ি।’
আগেও দুইবার হত্যার পরিকল্পনা
হারুন বলেন, ‘এমপি আজীমকে হত্যা করার জন্য আগেও দুইবার পরিকল্পনা হয়েছে। নির্বাচনের আগেও একবার পরিকল্পনা হয়েছে। তখন পরিকল্পনা ছিল এদেশে হত্যা করার। জানুয়ারি মাসের ১৭-১৮ তারিখে তারা দ্বিতীয়বার পরিকল্পনা করে। তখন এমপি আজীম সাহেবও ভারতে যান, আর চক্রটিও তখন ভারতে ছিল। কিন্তু যেভাবেই হোক সেই প্ল্যানটি বাস্তবায়ন হয়নি। তৃতীয় ধাপে সেই প্ল্যানটি বাস্তবায়ন হয়।’
তদন্তে জানা গেছে, আখতারুজ্জামান শাহীন ১০ মে দেশে চলে আসেন এবং আজীম যান ১২ মে। হারুন জানান, গত ৩০ এপ্রিল হত্যার প্রধান পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান শাহীন, চরমপন্থি নেতা শিমুল ভুঁইয়া ওরফে আমানউল্লাহ এবং সেলেস্টি রহমান কলকাতায় গিয়ে নিউটাউনের ওই ফ্ল্যাটে ওঠেন। খুনের দায়িত্ব শিমুল ভুঁইয়াকে দিয়ে ১০ মে ঢাকায় ফেরেন আখতারুজ্জামান শাহীন। এরপর ২০ মে তিনি ঢাকা থেকে দিল্লি, সেখান থেকে নেপালের কাঠমান্ডু যান। ২২ মে তিনি কাঠমান্ডু থেকে দুবাই হয়ে যে দেশের পাসপোর্ট সে দেশে গিয়েছেন। আখতারুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।
খালে জাল ফেলেও মেলেনি আজীমের দেহাংশ
কলকাতা থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানিয়েছেন এমপি আজীমের মরদেহের অংশের সন্ধান মেলেনি এখনো। শনিবার দুপুর ১২টার পর দ্বিতীয় দিনের মতো ভাঙড়ের কৃষ্ণমাটি এলাকার জিরানগাছা খালে তল্লাশি চালায় ভারতীয় সিআইডি ও পোলেরহাট থানার পুলিশ। তল্লাশির পরেও মরদেহের কোনো অংশ খুঁজে না পাওয়ায় দুপুর ২টার দিকে অভিযান বন্ধ করে দেন কর্মকর্তারা। এদিনও ভাঙড়ের কৃষ্ণমাটি এলাকার জিরানগাছা খালে দুর্যোগ মোকাবিলা দল নামানো হয়। সেই সঙ্গে মরদেহের সন্ধান পেতে খালে জাল ফেলা হয়, নামানো হয় নৌকাও। মরদেহের অংশ খুঁজতে ড্রোনও ব্যবহার করা হয়।
এদিন স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে তল্লাশি অভিযান শুরু হয়। কিন্তু সফলতা পাননি তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তবে একটি কালো ব্যাগ উদ্ধার হয়েছে। যদিও তার ভেতরে কিছু পাওয়া যায়নি। পরে দুপুর ২টা ১০ মিনিটে অভিযান বন্ধ করে দেন কর্মকর্তারা। এর আগে শুক্রবার এমপি আজীমের মরদেহের সন্ধানে জোর অভিযান চালানো হয়। সেদিন ১২ দিনের হেফাজতে থাকা এই হত্যা মামলার আসামি জিহাদ হাওলাদারকে সঙ্গে নিয়ে কৃষ্ণমাটি এলাকায় অভিযান চালায় সিআইডি।
গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে চুয়াডাঙ্গার দর্শনার গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান এমপি আজীম। ওঠেন পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার মণ্ডলপাড়া লেনে গোপাল বিশ্বাস নামে এক বন্ধুর বাড়িতে। পরদিন ডাক্তার দেখানোর কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন। এরপর থেকেই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ আনোয়ারুল আজীম।
বাড়ি থেকে বেরোনোর পাঁচ দিন পরে গত ১৮ মে বরাহনগর থানায় আনোয়ারুল আজীম নিখোঁজের বিষয়ে একটি জিডি করেন বন্ধু গোপাল বিশ্বাস। এরপরও খোঁজ মেলে না তিনবারের এই সংসদ সদস্যের। বুধবার হঠাৎ খবর ছড়ায়, কলকাতার পার্শ্ববর্তী নিউটাউন এলাকায় বহুতল সঞ্জীবা গার্ডেনস নামে একটি আবাসিক ভবনের একটি ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজীম খুন হয়েছেন। ঘরের ভেতর পাওয়া গেছে রক্তের ছাপ। তবে মেলেনি মরদেহ।