টিয়ার গ্যাসের তীব্র ঝাঁজ থেকে বাঁচতে চাচার সঙ্গে ঘরের জানালা বন্ধ করতে গিয়ে গুলিতে সাফকাত সামির (১১) নামে এক শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। গুলি তার চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বের হয়েছে। সে বাসার কাছে একটি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করত। গুলি থেকে রেহাই পায়নি তার দশম শ্রেণীতে লেখাপড়া করা চাচাও। তার ডান কাঁধে গুলি লেগেছে। কাছে ১৪টি সেলাই লেগেছে। গত ১৯ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মিরপুর-১৪ নম্বর এলাকায় দোতলার নিজ বাসায় এই নির্মম মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। ঘটনার পর থেকে এক মাত্র শিশু সন্তানকে হারিয়ে পরিবারে এখন চলছে শোকের মাতম। শিশুটির রক্তাক্ত গেঞ্জি হাতে নিয়ে কাঁদছে মা।
কাফরুল থানায় অভিযোগ করতে গেলেও পুলিশ অভিযোগ নিতে অস্বীকার করেন। মুচলেকা রেখে লাশ নিয়ে গেছেন।
অন্যদিকে স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপ ও ভীতিকর পরিস্থিতির কারণে ময়নাতদন্ত ছাড়াই রাজধানীর অদূরে আশুলিয়ায় নানার বাড়িতে নিয়ে তড়িঘড়ি করে দাফন করা হয়েছে। তাদের গ্রামের বাড়িতে নোয়াখালীর চাটখিলে। বুধবার (২৪ জুলাই) সকালে মিরপুর-১৪ নম্বরে শিশুটির বাসায় গেলে এই প্রতিবেদককে তার মা বাবা ও পরিবারের স্বজনরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই সব তথ্য জানিয়েছেন।
তাদের মধ্যে এখনো অজানা ভিতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতেও যেন ভয় পাচ্ছেন।
শিশু সামির মা ও বাবা বুধবার সকালে মিরপুর-১৪ নম্বরের বাসায় সংবাদ প্রতিবেদককে জানান, শুক্রবার সন্ধ্যার পরে তাদের বাসার অদূরে কাফরুল থানার কাছের প্রধান সড়ক থেকে টিয়ার গ্যাসের ঝাঁজালো গন্ধে ঘরে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ে। ওই সময় শিশুটির (দশম শ্রেণীতে পড়ে) ছোট চাচা মশিউর রহমান ঘরের জানালা বন্ধ করতে যায়। তখন চাচার সঙ্গে শিশু সামির টি টেবিলে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে জানালা বন্ধ করতে না করতে বিকট শব্দ হয়। তখন গুলি এসে শিশুটির চোখে লেগে মাথার পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। আর তার চাচার ডান কাঁধে লাগে। রক্তাক্ত অবস্থায় তাদেরকে বাসার অদূরে মিরপুর-১৪ নম্বরে রাস্তার উত্তর পাশে অবস্থিত মার্কস মেডিকেল কলেজ হসপিটালে নেয়ার পর জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেন। আর তার চাচাকে কাঁধে সেলাই দিয়ে চিকিৎসা ও ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দেন।
আহত দশম শ্রেণীর ছাত্র মশিউর রহমান বলেন, তার ডান কাঁধে গুলি লেগেছে। আর নিহত সামির চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বের হয়।
মা ও বাবা জানান, জানালা বন্ধ করতে গেলে হঠাৎ বাইরে থেকে করা গুলি দোতলা বাসার পূর্ব ও উত্তর কর্নারের জানালা দিয়ে ঢুকে শিশুর চোখে লাগে। তখন সে ঘরে লুটিয়ে পড়ে। হাসপাতালে নিতে নিতে তার মৃত্যু হয়। জানালা বন্ধ করতে যাওয়াই তাদের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারা গুলি করছে তা তারা বলতে পারেনি। তবে রাস্তা থেকে গ্যাস ও গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দা আলাউদ্দিন জানান, ঘটনাটি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার সময়। মাগরিবের নামাজের পরপরই ঘটেছে। এই সময় ওই এলাকায় আরও একজন শ্রমিক নিহত হয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, তার মাথায় গুলি লেগে রাস্তায় পড়ে মারা গেছে। ওই লোকের বাড়ি কিশোরগঞ্জের তাড়াইল এলাকায়। তবে কেউ নাম বলতে পারেনি।
শিশুটির বাবা সংবাদকে জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিলের দেল্লাই বাজার এলাকায়। মিরপুর-১৪ নম্বর হাউজিং স্ট্রেটের কোয়াটারে দোতলায় বসবাস করেন।
শুক্রবার সারাদিন শিশু সামির বাসায় ছিল। সে স্থানীয় জামিউল মাদ্রাসায় লেখাপড়া করত। বিকেলে বাসা থেকে বের করে খেলতে নামার কথা ছিল। কিন্তু আতঙ্কের কারণে বাবা তাকে বাসা থেকে বের হতে দেয়নি। সন্ধ্যায় বের হয়ে চটপটি খাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সন্ধ্যায় এলোপাতাড়ি গুলি করা হলে জানালা বন্ধ করতে গেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শিশুটি মারা গেছে।
থানায় অভিযোগ করতে গেলেও পুলিশ অভিযোগ নেয়নি। তাৎক্ষণিকভাবে কোনো উপায় না পেয়ে শিশুটিকে আশুলিয়ায় নানার বাড়িতে নিয়ে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত হয়নি। মামলা ও অভিযোগ করা সম্পর্কে তাদের পর্যাপ্ত ধারণাও নেই।
শিশুটির বাবা মো. সাকিবুর রহমান বুধবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে সংবাদকে জানান, শিশুটি মারা যাওয়ার পর থানা পুলিশ অভিযোগ না নিয়ে মুচলেকা রেখে তাদেরকে লাশ নিয়ে দাফন করতে বলেছে। এরপর মিরপুরে বাসার কাছে প্রথম জানাজা হয়। এরপর আশুলিয়ায় দ্বিতীয় জানাজা শেষে শনিবার সকালে শিশুটিতে দাফন করা হয়। ঘটনার পর থেকে তারা এখনো ভয়ে আছেন। তাদেরকে কেউ আবার হয়রানি করে কিনা তা নিয়ে ভীতিকর অবস্থায় দিন কাটছেন।
কাফরুল থানার ওসি গোলাম মাওলা সংবাদকে মুঠোফোনে জানান, তিনি গত ২২ জুলাই ওসি হিসেবে যোগদান করেছেন। বিষয়টি তার জানা নেই। প্রতিবেদক ঘটনাটি তাকে জানালে তিনি বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানিয়েছেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) খন্দকার মহিদ উদ্দিনের সঙ্গে ঘটনাটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে দেখছি।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, রাস্তায় সংঘর্ষ, গুলি। আর এলোপাতাড়ি গুলিতে বাসায় শিশুটি গুলিবিদ্ধ হয়ে করুণ মৃত্যু হয়েছে। এর দায় কে নিবে?
গত কয়েক দিনে মিরপুরে সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনার সময় অনেকেই মারা গেছেন। নিরাপরাধ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। বাসা বাড়িতেও মানুষ নিরাপদ নয়।