বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজায় ফলের দোকানি ফরিদ শেখকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাকিল আহম্মেদের আদালতে মামলাটি করা হয়। নিহত যুবক ফরিদ শেখের বাবা সুলতান মিয়ার জবানবন্দি গ্রহণ করে আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, গত ৪ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে আন্দোলন চলাকালে ফরিদ শেখ যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজার দক্ষিণ পাশের রাস্তা দিয়ে তার ফলের দোকানে যাচ্ছিলেন। এ সময় শেখ হাসিনার নির্দেশে গণহত্যা চালানোর সময় পুলিশের গুলির আঘাতে মারাত্মক জখম হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। আশপাশের লোকজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। ফরিদ শেখের পাকস্থলির ডান পাশে লেগে বাম পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় গুলি। মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬ আগস্ট বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে ফরিদ শেখ মারা যান।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন- সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক আবদুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ, অতিরিক্ত যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার, সাবেক কমিশনার ডিএমপি হাবিবুর রহমান, জাসদের হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ. আরাফাত, যাত্রাবাড়ী থানার ওসি আবুল হাসানসহ অজ্ঞাতনামা ২৫০ জন।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ও সংঘর্ষে নিহতের ঘটনায় রাজধানীসহ সারাদেশে সাবেক প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও ৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ১৯ আগস্ট সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এই মামলা করা হয়। এর মধ্যে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় ১টি, সূত্রপুর ১টি, আদাবর থানায় ১টি, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ১টি, রংপুরে ১টি, বগুড়ায় ১টি ও জয়পুরহাটে ১টি। ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেষ হাসিনা সরকারের পতনের পর তার বিরুদ্ধে মঙ্গলবার পযর্ন্ত ২৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যার বেশিরভাগই মামলা হয়েছে ঢাকায়। এর মধ্যে ২৭টি খুনের মামলা এবং একটি অপহরণ মামলা রয়েছে। এর আগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও তিনটি গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়, যেগুলোর তদন্ত চলছে।
ঢাকায় তিন মামলা
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজায় ফলের দোকানি ফরিদ শেখকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সূত্রাপুর থানায় মামলা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজধানীর লক্ষ্মীবাজার এলাকায় কবি নজরুল কলেজের ছাত্র ওমর ফারুককে গুলি করে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মঙ্গলবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তরিকুল ইসলামের আদালতে মামলাটি করেন নিহত কলেজছাত্রের মা কুলছুমা আক্তার। এ সময় আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে সূত্রাপুর থানা পুলিশকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই ওমর ফারুক মোহাম্মাদপুর থানাধীন কালভার্ট ফুট ওভারব্রিজের নিচে আন্দোলোনকারীদের মাঝখানে পড়ে যান। এ সময় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাকে গুলি করে হত্যা করে।
আদাবর থানায় মামলা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজধানীর আদাবরে গুলিতে এক পোশাককর্মীর মৃত্যুর ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৫ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিহত সোহেল রানার ভাই ইব্রাহীম মঙ্গলবার ঢাকার হাকিম আদালতে এ মামলার আবেদন করেন। অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম সুলতান সোহাগ উদ্দিন বাদীর জবানবন্দি শুনে আদাবর থানা পুলিশকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করার আদেশ দেন বলে বাদীপক্ষের আইনজীবী এস এম ইব্রাহীম খলিল জানান। মামলার আরজিতে বলা হয়, সোহেল পেশায় ছিলেন পোশাক কারখানার কর্মী। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ৫ আগস্ট আদাবর থানা এলাকায় তিনি গুলিবিদ্ধ হন।
সোনারগাঁয়ে মামলা
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে সোনারগাঁ থানায় মামলাটি করেন নিহত জনির বাবা ইয়াসিন। সোনারগাঁ থানার ওসি এসএম কামরুজ্জামান এতথ্য জানান। মামলায় আরও আসামি করা হয়েছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, ওবায়দুল কাদের, হাসান মাহমুদ, সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, নজরুল ইসলাম বাবু, গোলাম দস্তগীর গাজী, আবদুল্লাহ আল কায়সার হাসনাতসহ ১৮৭ জনকে। এছাড়া অজ্ঞাত আরও ১০০-১২০ জনকে আসামি করা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় কাঁচপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে পরিবহন শ্রমিক জনি নিহতের ঘটনায় এ মামলা হয়।
মামলায় উল্লেখ করা হয়, নিহত জনি নাফ গাড়িতে হেলপারের কাজ করতেন। ২০ জুলাই আন্দোলন পণ্ড করতে আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এক জোট হয়ে পিস্তল, শটগান, ককটেল, লাঠি নিয়ে কাঁচপুর নার্সারির সামনে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এ সময় ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ও মারধর করে তারা। এতে ওইদিন বিকেল ৫টার দিকে কাঁচপুর সেতুর ঢালে বুকে দুটি গুলিবিদ্ধ হন জনি। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি।
রংপুরে সুভাষ সিংহ ও নাঈমুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা
রংপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গুলিতে সাজ্জাদ হোসেন নিহতের ঘটনায় আরও একটি মামলা হয়েছে। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানা ছাড়াও সাংবাদিক সুভাষ সিংহ রায় ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খানকে আসামি করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে নিহত সাজ্জাদ হোসেনের সহধর্মিণী জিতু বেগম বাদী হয়ে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালত কোতোয়ালীতে মামলাটি করেন।
মামলার আবেদনে বলা হয়, নিহত সাজ্জাদ হোসেন একজন ব্যবসায়ী। গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রংপুর নগরীর রাজা রাম মোহন মার্কেটের সামনে ১ থেকে ১০ নম্বর আসামির নির্দেশে অন্য নামীয় ও অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়। এ সময় সাজ্জাদ হোসেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পরে তার মরদেহ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়ার পথে আসামিদের বাধার মুখে পড়েন বাদী। পরে বাধ্য হয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই তার মরদেহ দাফন করা হয়।
বগুড়ায় মামলা
বগুড়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এক রিকশাচালক নিহতের ঘটনায় আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৮২ জনের নামে হত্যা মামলা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। নিহত কমর উদ্দিনের স্ত্রী তহমিনা বেগম বাদী হয়ে বগুড়া সদর থানায় মঙ্গলবার মামলাটি করেন। মামলায় শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরকে হত্যার ‘নির্দেশদাতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ৪ আগস্ট বিকেল ৫টার দিকে বগুড়া শহরের নওয়াববাড়ী সড়কে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের ও মজিবর রহমানের নির্দেশে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্যসহ অন্য ছয় নেতার নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালানো হয়। এ সময় তারা ককটেল ও পেট্রলবোমা হামলা করেন। কমর উদ্দিন ছাত্র-জনতাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে আসামি আনোয়ার হোসেন ও আমিনুল ইসলাম আগ্নেয়াস্ত্র তাক করেন। আনোয়ার হোসেন গুলি করেন। আমিনুল ইসলাম গুলি করে কমর উদ্দিনের মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
জয়পুরহাটে মামলা
জয়পুরহাট সদর থানার সামনে বিজয় মিছিলের দিন মেহেদী (২৫) নামে এক যুবক গুলিতে নিহত হন। এ ঘটনায় হত্যা মামলা হয়েছে। এতে আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনা এবং ওবায়দুল কাদেরসহ ২১৭ জনকে। মামলায় আরও আসামি করা হয়, জয়পুরহাটের সাবেক দুই সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের। দুপুরে নিহতের স্ত্রী জেসমিন আক্তার সৃষ্টি বাদী হয়ে জয়পুরহাট চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি করেন। মামলাটি এজাহার হিসেবে নথিভুক্ত করতে জয়পুরহাট সদর থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। নিহত মেহেদী শহরের নতুনহাট এলাকার মৃত্যু আলতাফ হোসেন শেখের ছেলে। পেশায় একজন অটোচালক ছিলেন।
মামলার বিবরণে জানা গেছে, ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর কয়েকশ’ ছাত্র-জনতা জয়পুরহাট সদর থানার বাইরে অবস্থান নিয়ে বিজয় স্লোগান দিচ্ছিল। এর কিছুক্ষণ পর থানার ভেতরে অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ককটেল ও গুলি ছুঁড়তে থাকেন। এতে গুলিবিদ্ধ হন মেহেদী। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।
গত ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্টের মধ্যে সহিংসতায় বাংলাদেশে অন্তত ৬৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে গত শুক্রবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়-ইউএনএইচসিআর। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলনের মধ্যে জেলায় জেলায় সহিংসতায় মাত্র তিন সপ্তাহে কয়েকশ’ মানুষের প্রাণহানির তথ্য আসে। আগস্টের শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারবিরোধী থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। ৫ আগস্ট আন্দোলনকারীদের ঢাকামুখী লংমার্চের মধ্যে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে চলে যান।
মঙ্গলবার, ২০ আগস্ট ২০২৪
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজায় ফলের দোকানি ফরিদ শেখকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাকিল আহম্মেদের আদালতে মামলাটি করা হয়। নিহত যুবক ফরিদ শেখের বাবা সুলতান মিয়ার জবানবন্দি গ্রহণ করে আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, গত ৪ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে আন্দোলন চলাকালে ফরিদ শেখ যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজার দক্ষিণ পাশের রাস্তা দিয়ে তার ফলের দোকানে যাচ্ছিলেন। এ সময় শেখ হাসিনার নির্দেশে গণহত্যা চালানোর সময় পুলিশের গুলির আঘাতে মারাত্মক জখম হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। আশপাশের লোকজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। ফরিদ শেখের পাকস্থলির ডান পাশে লেগে বাম পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় গুলি। মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬ আগস্ট বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে ফরিদ শেখ মারা যান।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন- সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক আবদুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ, অতিরিক্ত যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার, সাবেক কমিশনার ডিএমপি হাবিবুর রহমান, জাসদের হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ. আরাফাত, যাত্রাবাড়ী থানার ওসি আবুল হাসানসহ অজ্ঞাতনামা ২৫০ জন।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ও সংঘর্ষে নিহতের ঘটনায় রাজধানীসহ সারাদেশে সাবেক প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও ৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ১৯ আগস্ট সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এই মামলা করা হয়। এর মধ্যে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় ১টি, সূত্রপুর ১টি, আদাবর থানায় ১টি, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ১টি, রংপুরে ১টি, বগুড়ায় ১টি ও জয়পুরহাটে ১টি। ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেষ হাসিনা সরকারের পতনের পর তার বিরুদ্ধে মঙ্গলবার পযর্ন্ত ২৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যার বেশিরভাগই মামলা হয়েছে ঢাকায়। এর মধ্যে ২৭টি খুনের মামলা এবং একটি অপহরণ মামলা রয়েছে। এর আগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও তিনটি গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়, যেগুলোর তদন্ত চলছে।
ঢাকায় তিন মামলা
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজায় ফলের দোকানি ফরিদ শেখকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সূত্রাপুর থানায় মামলা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজধানীর লক্ষ্মীবাজার এলাকায় কবি নজরুল কলেজের ছাত্র ওমর ফারুককে গুলি করে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মঙ্গলবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তরিকুল ইসলামের আদালতে মামলাটি করেন নিহত কলেজছাত্রের মা কুলছুমা আক্তার। এ সময় আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে সূত্রাপুর থানা পুলিশকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই ওমর ফারুক মোহাম্মাদপুর থানাধীন কালভার্ট ফুট ওভারব্রিজের নিচে আন্দোলোনকারীদের মাঝখানে পড়ে যান। এ সময় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাকে গুলি করে হত্যা করে।
আদাবর থানায় মামলা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজধানীর আদাবরে গুলিতে এক পোশাককর্মীর মৃত্যুর ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৫ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিহত সোহেল রানার ভাই ইব্রাহীম মঙ্গলবার ঢাকার হাকিম আদালতে এ মামলার আবেদন করেন। অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম সুলতান সোহাগ উদ্দিন বাদীর জবানবন্দি শুনে আদাবর থানা পুলিশকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করার আদেশ দেন বলে বাদীপক্ষের আইনজীবী এস এম ইব্রাহীম খলিল জানান। মামলার আরজিতে বলা হয়, সোহেল পেশায় ছিলেন পোশাক কারখানার কর্মী। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ৫ আগস্ট আদাবর থানা এলাকায় তিনি গুলিবিদ্ধ হন।
সোনারগাঁয়ে মামলা
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে সোনারগাঁ থানায় মামলাটি করেন নিহত জনির বাবা ইয়াসিন। সোনারগাঁ থানার ওসি এসএম কামরুজ্জামান এতথ্য জানান। মামলায় আরও আসামি করা হয়েছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, ওবায়দুল কাদের, হাসান মাহমুদ, সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, নজরুল ইসলাম বাবু, গোলাম দস্তগীর গাজী, আবদুল্লাহ আল কায়সার হাসনাতসহ ১৮৭ জনকে। এছাড়া অজ্ঞাত আরও ১০০-১২০ জনকে আসামি করা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় কাঁচপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে পরিবহন শ্রমিক জনি নিহতের ঘটনায় এ মামলা হয়।
মামলায় উল্লেখ করা হয়, নিহত জনি নাফ গাড়িতে হেলপারের কাজ করতেন। ২০ জুলাই আন্দোলন পণ্ড করতে আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এক জোট হয়ে পিস্তল, শটগান, ককটেল, লাঠি নিয়ে কাঁচপুর নার্সারির সামনে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এ সময় ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ও মারধর করে তারা। এতে ওইদিন বিকেল ৫টার দিকে কাঁচপুর সেতুর ঢালে বুকে দুটি গুলিবিদ্ধ হন জনি। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি।
রংপুরে সুভাষ সিংহ ও নাঈমুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা
রংপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গুলিতে সাজ্জাদ হোসেন নিহতের ঘটনায় আরও একটি মামলা হয়েছে। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানা ছাড়াও সাংবাদিক সুভাষ সিংহ রায় ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খানকে আসামি করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে নিহত সাজ্জাদ হোসেনের সহধর্মিণী জিতু বেগম বাদী হয়ে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালত কোতোয়ালীতে মামলাটি করেন।
মামলার আবেদনে বলা হয়, নিহত সাজ্জাদ হোসেন একজন ব্যবসায়ী। গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রংপুর নগরীর রাজা রাম মোহন মার্কেটের সামনে ১ থেকে ১০ নম্বর আসামির নির্দেশে অন্য নামীয় ও অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়। এ সময় সাজ্জাদ হোসেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পরে তার মরদেহ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়ার পথে আসামিদের বাধার মুখে পড়েন বাদী। পরে বাধ্য হয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই তার মরদেহ দাফন করা হয়।
বগুড়ায় মামলা
বগুড়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এক রিকশাচালক নিহতের ঘটনায় আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৮২ জনের নামে হত্যা মামলা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। নিহত কমর উদ্দিনের স্ত্রী তহমিনা বেগম বাদী হয়ে বগুড়া সদর থানায় মঙ্গলবার মামলাটি করেন। মামলায় শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরকে হত্যার ‘নির্দেশদাতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ৪ আগস্ট বিকেল ৫টার দিকে বগুড়া শহরের নওয়াববাড়ী সড়কে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের ও মজিবর রহমানের নির্দেশে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্যসহ অন্য ছয় নেতার নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালানো হয়। এ সময় তারা ককটেল ও পেট্রলবোমা হামলা করেন। কমর উদ্দিন ছাত্র-জনতাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে আসামি আনোয়ার হোসেন ও আমিনুল ইসলাম আগ্নেয়াস্ত্র তাক করেন। আনোয়ার হোসেন গুলি করেন। আমিনুল ইসলাম গুলি করে কমর উদ্দিনের মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
জয়পুরহাটে মামলা
জয়পুরহাট সদর থানার সামনে বিজয় মিছিলের দিন মেহেদী (২৫) নামে এক যুবক গুলিতে নিহত হন। এ ঘটনায় হত্যা মামলা হয়েছে। এতে আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনা এবং ওবায়দুল কাদেরসহ ২১৭ জনকে। মামলায় আরও আসামি করা হয়, জয়পুরহাটের সাবেক দুই সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের। দুপুরে নিহতের স্ত্রী জেসমিন আক্তার সৃষ্টি বাদী হয়ে জয়পুরহাট চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি করেন। মামলাটি এজাহার হিসেবে নথিভুক্ত করতে জয়পুরহাট সদর থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। নিহত মেহেদী শহরের নতুনহাট এলাকার মৃত্যু আলতাফ হোসেন শেখের ছেলে। পেশায় একজন অটোচালক ছিলেন।
মামলার বিবরণে জানা গেছে, ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর কয়েকশ’ ছাত্র-জনতা জয়পুরহাট সদর থানার বাইরে অবস্থান নিয়ে বিজয় স্লোগান দিচ্ছিল। এর কিছুক্ষণ পর থানার ভেতরে অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ককটেল ও গুলি ছুঁড়তে থাকেন। এতে গুলিবিদ্ধ হন মেহেদী। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।
গত ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্টের মধ্যে সহিংসতায় বাংলাদেশে অন্তত ৬৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে গত শুক্রবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়-ইউএনএইচসিআর। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলনের মধ্যে জেলায় জেলায় সহিংসতায় মাত্র তিন সপ্তাহে কয়েকশ’ মানুষের প্রাণহানির তথ্য আসে। আগস্টের শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারবিরোধী থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। ৫ আগস্ট আন্দোলনকারীদের ঢাকামুখী লংমার্চের মধ্যে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে চলে যান।