alt

‘১৬১৩ কোটি টাকা পাচার’: নাফিজ সরাফাত ও স্ত্রী সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা

সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট : শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৫

আওয়ামী লীগ আমলের বিতর্কিত ব্যবসায়ী, পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত এবং তার স্ত্রী-পুত্রসহ চারজনের বিরুদ্ধে ১৬১৩ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে মামলা করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশান থানায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলাটি করার কথা সিআইডির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

মামলায় বাকি আসামিরা হলেন- নাফিজ সরাফাতের স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শহীদ, ছেলে রাহীব সাফওয়ান সারাফাত চৌধুরী ও সহযোগী হাসান তাহের ইমাম। প্রাথমিক অনুসন্ধানের বরাতে সিআইডি বলছে, চৌধুরী নাফিজ সরাফত তার সহযোগী ডক্টর হাসান তাহের ইমামকে সঙ্গে নিয়ে ২০০৮ সালে ‘রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট’ নামে একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির লাইসেন্স নেন। ওই কোম্পানি ২০১৩ সালের মধ্যেই ১০টি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পায়, বর্তমানে রেইসের অধীনে ১৩টি ফান্ড রয়েছে।

নাফিজ সরাফাত ও তার সহযোগীরা এ মিউচুয়াল ফান্ডগুলোকে ‘অবৈধ ব্যক্তিগত স্বার্থে’ ব্যবহার করেছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে মামলায়। সেখানে বলা হয়েছে, ‘চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, তার স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শহীদ ও সহযোগী ডক্টর হাসান তাহের ইমামের সঙ্গে মিলে ফান্ডের অর্থ বিনিয়োগ করে তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) শেয়ার কেনেন এবং পরে ব্যাংকটির পরিচালক হয়ে যান। নাফিস সরাফাত ‘কৌশলে’ তার স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শহীদকে সাউথইস্ট ব্যাংকেরও পরিচালক বানান।

তারা ফান্ডের টাকায় ‘মাল্টি সিকিউরিটিজ’ নামের একটি ব্রোকার হাউজ কিনে তার ট্রেড লাইসেন্সের দ্বারা ‘প্রতারণার মাধ্যমে ফান্ডের অর্থ হাতিয়ে নেন’ বলে সিআইডির ভাষ্য। নাফিজ সরাফাত পদ্মা ব্যাংকের টাকা দিয়ে ‘পদ্মা ব্যাংক সিকিউরিটিজসহ’ তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে ‘স্ট্র্যাটেজিক ইক্যুইটি’ নামের ফান্ড ক্রয়/বিনিয়োগ করেন যার অধীন একাধিক ফান্ড রয়েছে।

অনুসন্ধানের বরাতে সিআইডি বলছে, ‘জাল-জালিয়াতির ব্যাপ্তি এতই বিস্তৃত ছিল যে, হিসাব বিও ও অন্যান্য ব্যাংক হিসাব খোলা ও পরিচালনাসহ রাজউক থেকে একাধিক প্লট হাতিয়ে নিয়ে বিভিন্ন নামীয় প্রতিষ্ঠান/বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে বিদেশে অর্থ পাচারের পথ সুগম করেছিলেন অভিযুক্তরা।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ‘বেস্ট হোল্ডিংসের’ বন্ডে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে চাপ প্রয়োগ, বিদেশে অর্থ পাচার এবং একাধিক বাড়ি-ফ্ল্যাট কেনাসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশিত হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট অনুসন্ধানে নামে বলে জানানো হয়েছে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।

সেখানে বলা হয়, অনুসন্ধানে নাফিজ সরাফাত এবং তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকে মোট ৭৮টি হিসাব পরিচালিত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব অ্যাকাউন্টে প্রায় ১ হাজার ৮০৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা জমা এবং প্রায় ১ হাজার ৮০৫ কোটি ৫৮ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

নাফিজ সরাফাত, তার স্ত্রী ও ছেলের নামে মোট ২১টি হিসাব চালু রয়েছে, সেখানে এখন মাত্র ২৯ লাখ ২১ হাজার টাকা রয়েছে। সেসব হিসাবের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টাকা লেনদেন হওয়ায় তথ্য ও দলিল সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করার কথা জানিয়েছে সিআইডি। এর ভিত্তিতে সিআইডি বলছে, নাফিজ সরাফাত ও তার স্ত্রীর মালিকানায় কানাডায় দুটি, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে নিবন্ধিত একটি কোম্পানি এবং আঞ্জুমান আরা শাহীদের নামে সিঙ্গাপুরে একটি কোম্পানির ১৫টি যৌথ হিসাব রয়েছে, যেখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে।

এছাড়া নাফিজ সরাফতের ছেলে রাহীব সাফওয়ান সারাফাত চৌধুরীর নামে কানাডা, সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন ব্যাংকে মোট ৭৬টি হিসাব পরিচালনার তথ্য পাওয়া গেছে। দুবাইয়ে নাফিজ সরাফাতের ৩ রুমের একটি ফ্ল্যাট ও ৫ রুমের একটি ভিলা রয়েছে। আর সিঙ্গাপুরে হাসান তাহের ইমামের মালিকানাধীন একটি কোম্পানির ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করার প্রমাণ পাওয়ার কথা বলছে সিআইডি।

অনুসন্ধানে বাংলাদেশেও তাদের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য পেয়েছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। সিআইডি বলছে, প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে ‘প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে’ মোট ১ হাজার ৬১৩ কোটি ৬৮ লাখ ৬৪ হাজার ৬৫৯ টাকা অর্জন, প্রতারণা, জালিয়াতি ও পাচারের অভিযোগে ‘মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে’ তারা মামলাটি দায়ের করেছে।

পদ্মা ব্যাংক লিমিটেডের কার্যালয় ‘স্থানান্তরের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ’ এবং গুলশানের ‘একটি প্লট হস্তান্তর করে অর্থ পাচারের’ অভিযোগে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে গত জুলাই মাসে দুটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। পদ্মা ব্যাংকের ৬৬ কোটি টাকার বেশি ‘আত্মসাতের অভিযোগে’ করা মামলায় নাফিজ সরাফাতসহ আসামি করা হয়েছে ১০ জনকে। আর গুলশানের একটি প্লট হস্তান্তরের মাধ্যমে চার কোটি টাকার বেশি ‘পাচারের’ মামলায় তার সঙ্গে আসামি করা হয়েছে সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনসহ আরও তিনজনকে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের গত তিন মেয়াদে আর্থিক খাতের অনিয়মে বারবার নাফিজ সরাফতের নাম এলেও তিনি ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। উত্থানের শুরুটা শেয়ারবাজারে ফান্ড ম্যানেজমেন্ট দিয়ে হলেও গত দেড় দশকে নাফিজ হোটেল, বিদ্যুৎ, মোবাইল টাওয়ার, আবাসন, মিডিয়া, অ্যাগ্রো, প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসার বিস্তার ঘটিয়েছেন। কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডেরও চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।

কানাডা বাংলাদেশ চেম্বার হাউজের (কানাডা) সভাপতি নাফিজ সরাফাত কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব ও আর্মি গলফ ক্লাবের সদস্য, ওয়ার্ল্ড চেজ ফেডারেশনের (বাংলাদেশ বিভাগ) সহ-সভাপতি, এমনকি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতিরও সদস্য পদে আসীন হয়েছিলেন তিনি।

বলা হয়, মাত্র দেড় দশকে নাফিজের এ বিপুল সাফল্যের পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য- যার মাধ্যমে তিনি অনিয়ম করেও পার পেয়ে গেছেন। শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবি ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার এবং বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সঙ্গে নাফিজ সরাফাতের সম্পর্কের কথা ব্যাংক ও পুঁজিবাজার খাতের সবারই জানা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুদক আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী অনেক ব্যবসায়ীর মত নাফিজ সরাফতের বিষয়েও অনুসন্ধান শুরু করে। তার বিরুদ্ধে তদন্তে নামে অর্থপাচার প্রতিরোধের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

গত বছরের আগস্টে নাফিজ সরাফতের বিরুদ্ধে ব্যাংক দখল ও শেয়ারবাজার থেকে অর্থ লোপাটের মাধ্যমে ৮০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এরপর নাফিজ সরাফত ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দেয় আদালত। এছাড়া তার পরিবারের ফ্ল্যাট, প্লট, বাড় ও জমি জব্দের আদেশ আসে। দুবাইয়ে থাকা নাফিজ সরাফতের ফ্ল্যাট ও ভিলা জব্দের আদেশ দেয়া হয়।

ছবি

দৌলতদিয়ার লিলি: চার বছরেও মেলেনি হদিস, পিবিআইয়ের চার্জশিটে নির্দোষ অভিযুক্তরা

মোহাম্মদপুরে অভিযান: ২১ জন গ্রেপ্তার

ছবি

ট্রাইব্যুনালে ফজলুরের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ

ছবি

এনায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে সিআইডির মানিলন্ডারিং মামলা

ছবি

বিমানে চিকিৎসক নিয়োগে ‘অনিয়মের’ অভিযোগ

ছবি

সালমান এফ রহমানের ৩৬ বিঘা জমি জব্দের আদেশ, ব্যাংকে ৫৪ কোটি টাকা অবরুদ্ধ

ছবি

কালিহাতীতে কিশোরীকে ধর্ষণ, মা ও মেয়েকে ধর্ষকের পরিবারের মারধর

নির্বাচনী হলফনামায় তথ্য গোপন করেছিলেন শেখ হাসিনা: সিলেটে দুদক চেয়ারম্যান

ছবি

রিকশা চালককে থানায় আটকে নির্যাতন, এসআইয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন

ছবি

মানিলন্ডারিং: সাকিবকে দুদকে তলব

ছবি

নবাবগঞ্জে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ, ধর্ষক গ্রেপ্তার

ছবি

আদালতে জবানবন্দি: জুবায়েদের ছাত্রী সৈকতকে জানায়, ‘ভাইরে কে জানি মাইরা ফেলছে’

ছবি

সৈয়দপুরে প্রতিবন্ধী যুবতী ধর্ষণ মামলায় আসামী অধরা

ছবি

সৈয়দপুরে প্রতিবন্ধী যুবতী ধর্ষণ মামলায় আসামী অধরা

ছবি

দৌলতপুরে চেয়ারম্যান হত্যা মামলার আসামী গ্রেপ্তার

ছবি

সাবেক ভূমিমন্ত্রীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট তিন ব্যক্তির শেয়ার অবরুদ্ধের আদেশ

ছবি

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফের বিরুদ্ধে মামলা করবে দুদক

ছবি

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও তার স্ত্রীর ৩৩ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ

ছবি

সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় কারাগারে ঢাবির ডেপুটি রেজিস্ট্রার লাভলু

ছবি

সীমান্তবর্তী জেলায় মহাসড়কে ডাকাতি, ১০ মাসে ৫৯৪টি ডাকাতির মামলা

ছবি

মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের এমডির বিরুদ্ধে মামলা

ছবি

প্রসিকিউশন ভবনের সামনে ককটেল সদৃশ্য ‘বোমা’ নিক্ষেপ

ছবি

১০ মাসে সারাদেশে ৩,২৩০ হত্যাকাণ্ড

ছবি

পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় মসজিদের ইমামের স্ত্রীকে হত্যা

ছবি

মামুন হত্যা: ৫ দিন পর মামলা, আসামি ‘অজ্ঞাত’

ছবি

৩৫৮ কোটি টাকা ‘ক্ষতি’, রেলের সাবেক ডিজিসহ ৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

ছবি

চট্টগ্রামে মোবাইল মেকানিককে হত্যায় গ্রেপ্তার ৩

ছবি

অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী ও তার ভাই ২৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ মামলায় আত্মসমর্পণ করে জামিন

ছবি

কুষ্টিয়ায় ট্রাকে আগুন

ছবি

যশোরে বোমা, ছুরি ও তলোয়ারসহ আটক ১

ছবি

হাইকোর্টের সামনে খণ্ডিত লাশ: ‘প্রেমঘটিত সংকট’ বলছে ডিবি

ছবি

চট্টগ্রামে ব্যবসায়ীকে ‘ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারার’ হুমকি

ছবি

বিচারকের ছেলে হত্যা মামলা: লিমন মিয়ার পাঁচ দিনের রিমান্ড, পুলিশ কমিশনারকে আদালতের নোটিশ

সখীপুরে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত থাকায় স্বেচ্ছাসেবক দল নেতাকে অব্যাহতি

ছবি

মোহনপুরে শটগান, স্পিড বোর্টসহ ৫ ডাকাত আটক

ছবি

চট্টগ্রামে জালিয়াতির অভিযোগে ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা

tab

‘১৬১৩ কোটি টাকা পাচার’: নাফিজ সরাফাত ও স্ত্রী সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা

সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট

শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৫

আওয়ামী লীগ আমলের বিতর্কিত ব্যবসায়ী, পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত এবং তার স্ত্রী-পুত্রসহ চারজনের বিরুদ্ধে ১৬১৩ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে মামলা করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশান থানায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলাটি করার কথা সিআইডির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

মামলায় বাকি আসামিরা হলেন- নাফিজ সরাফাতের স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শহীদ, ছেলে রাহীব সাফওয়ান সারাফাত চৌধুরী ও সহযোগী হাসান তাহের ইমাম। প্রাথমিক অনুসন্ধানের বরাতে সিআইডি বলছে, চৌধুরী নাফিজ সরাফত তার সহযোগী ডক্টর হাসান তাহের ইমামকে সঙ্গে নিয়ে ২০০৮ সালে ‘রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট’ নামে একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির লাইসেন্স নেন। ওই কোম্পানি ২০১৩ সালের মধ্যেই ১০টি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পায়, বর্তমানে রেইসের অধীনে ১৩টি ফান্ড রয়েছে।

নাফিজ সরাফাত ও তার সহযোগীরা এ মিউচুয়াল ফান্ডগুলোকে ‘অবৈধ ব্যক্তিগত স্বার্থে’ ব্যবহার করেছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে মামলায়। সেখানে বলা হয়েছে, ‘চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, তার স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শহীদ ও সহযোগী ডক্টর হাসান তাহের ইমামের সঙ্গে মিলে ফান্ডের অর্থ বিনিয়োগ করে তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) শেয়ার কেনেন এবং পরে ব্যাংকটির পরিচালক হয়ে যান। নাফিস সরাফাত ‘কৌশলে’ তার স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শহীদকে সাউথইস্ট ব্যাংকেরও পরিচালক বানান।

তারা ফান্ডের টাকায় ‘মাল্টি সিকিউরিটিজ’ নামের একটি ব্রোকার হাউজ কিনে তার ট্রেড লাইসেন্সের দ্বারা ‘প্রতারণার মাধ্যমে ফান্ডের অর্থ হাতিয়ে নেন’ বলে সিআইডির ভাষ্য। নাফিজ সরাফাত পদ্মা ব্যাংকের টাকা দিয়ে ‘পদ্মা ব্যাংক সিকিউরিটিজসহ’ তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে ‘স্ট্র্যাটেজিক ইক্যুইটি’ নামের ফান্ড ক্রয়/বিনিয়োগ করেন যার অধীন একাধিক ফান্ড রয়েছে।

অনুসন্ধানের বরাতে সিআইডি বলছে, ‘জাল-জালিয়াতির ব্যাপ্তি এতই বিস্তৃত ছিল যে, হিসাব বিও ও অন্যান্য ব্যাংক হিসাব খোলা ও পরিচালনাসহ রাজউক থেকে একাধিক প্লট হাতিয়ে নিয়ে বিভিন্ন নামীয় প্রতিষ্ঠান/বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে বিদেশে অর্থ পাচারের পথ সুগম করেছিলেন অভিযুক্তরা।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ‘বেস্ট হোল্ডিংসের’ বন্ডে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে চাপ প্রয়োগ, বিদেশে অর্থ পাচার এবং একাধিক বাড়ি-ফ্ল্যাট কেনাসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশিত হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট অনুসন্ধানে নামে বলে জানানো হয়েছে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।

সেখানে বলা হয়, অনুসন্ধানে নাফিজ সরাফাত এবং তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকে মোট ৭৮টি হিসাব পরিচালিত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব অ্যাকাউন্টে প্রায় ১ হাজার ৮০৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা জমা এবং প্রায় ১ হাজার ৮০৫ কোটি ৫৮ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

নাফিজ সরাফাত, তার স্ত্রী ও ছেলের নামে মোট ২১টি হিসাব চালু রয়েছে, সেখানে এখন মাত্র ২৯ লাখ ২১ হাজার টাকা রয়েছে। সেসব হিসাবের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টাকা লেনদেন হওয়ায় তথ্য ও দলিল সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করার কথা জানিয়েছে সিআইডি। এর ভিত্তিতে সিআইডি বলছে, নাফিজ সরাফাত ও তার স্ত্রীর মালিকানায় কানাডায় দুটি, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে নিবন্ধিত একটি কোম্পানি এবং আঞ্জুমান আরা শাহীদের নামে সিঙ্গাপুরে একটি কোম্পানির ১৫টি যৌথ হিসাব রয়েছে, যেখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে।

এছাড়া নাফিজ সরাফতের ছেলে রাহীব সাফওয়ান সারাফাত চৌধুরীর নামে কানাডা, সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন ব্যাংকে মোট ৭৬টি হিসাব পরিচালনার তথ্য পাওয়া গেছে। দুবাইয়ে নাফিজ সরাফাতের ৩ রুমের একটি ফ্ল্যাট ও ৫ রুমের একটি ভিলা রয়েছে। আর সিঙ্গাপুরে হাসান তাহের ইমামের মালিকানাধীন একটি কোম্পানির ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করার প্রমাণ পাওয়ার কথা বলছে সিআইডি।

অনুসন্ধানে বাংলাদেশেও তাদের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য পেয়েছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। সিআইডি বলছে, প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে ‘প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে’ মোট ১ হাজার ৬১৩ কোটি ৬৮ লাখ ৬৪ হাজার ৬৫৯ টাকা অর্জন, প্রতারণা, জালিয়াতি ও পাচারের অভিযোগে ‘মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে’ তারা মামলাটি দায়ের করেছে।

পদ্মা ব্যাংক লিমিটেডের কার্যালয় ‘স্থানান্তরের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ’ এবং গুলশানের ‘একটি প্লট হস্তান্তর করে অর্থ পাচারের’ অভিযোগে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে গত জুলাই মাসে দুটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। পদ্মা ব্যাংকের ৬৬ কোটি টাকার বেশি ‘আত্মসাতের অভিযোগে’ করা মামলায় নাফিজ সরাফাতসহ আসামি করা হয়েছে ১০ জনকে। আর গুলশানের একটি প্লট হস্তান্তরের মাধ্যমে চার কোটি টাকার বেশি ‘পাচারের’ মামলায় তার সঙ্গে আসামি করা হয়েছে সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনসহ আরও তিনজনকে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের গত তিন মেয়াদে আর্থিক খাতের অনিয়মে বারবার নাফিজ সরাফতের নাম এলেও তিনি ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। উত্থানের শুরুটা শেয়ারবাজারে ফান্ড ম্যানেজমেন্ট দিয়ে হলেও গত দেড় দশকে নাফিজ হোটেল, বিদ্যুৎ, মোবাইল টাওয়ার, আবাসন, মিডিয়া, অ্যাগ্রো, প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসার বিস্তার ঘটিয়েছেন। কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডেরও চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।

কানাডা বাংলাদেশ চেম্বার হাউজের (কানাডা) সভাপতি নাফিজ সরাফাত কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব ও আর্মি গলফ ক্লাবের সদস্য, ওয়ার্ল্ড চেজ ফেডারেশনের (বাংলাদেশ বিভাগ) সহ-সভাপতি, এমনকি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতিরও সদস্য পদে আসীন হয়েছিলেন তিনি।

বলা হয়, মাত্র দেড় দশকে নাফিজের এ বিপুল সাফল্যের পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য- যার মাধ্যমে তিনি অনিয়ম করেও পার পেয়ে গেছেন। শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবি ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার এবং বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সঙ্গে নাফিজ সরাফাতের সম্পর্কের কথা ব্যাংক ও পুঁজিবাজার খাতের সবারই জানা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুদক আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী অনেক ব্যবসায়ীর মত নাফিজ সরাফতের বিষয়েও অনুসন্ধান শুরু করে। তার বিরুদ্ধে তদন্তে নামে অর্থপাচার প্রতিরোধের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

গত বছরের আগস্টে নাফিজ সরাফতের বিরুদ্ধে ব্যাংক দখল ও শেয়ারবাজার থেকে অর্থ লোপাটের মাধ্যমে ৮০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এরপর নাফিজ সরাফত ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দেয় আদালত। এছাড়া তার পরিবারের ফ্ল্যাট, প্লট, বাড় ও জমি জব্দের আদেশ আসে। দুবাইয়ে থাকা নাফিজ সরাফতের ফ্ল্যাট ও ভিলা জব্দের আদেশ দেয়া হয়।

back to top