ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের বিরুদ্ধে প্লট দুর্নীতির আরেক মামলার রায় দিয়েছে আদালত। রায়ে শেখ হাসিনার ৫ বছর, তার বোন শেখ রেহানার ৭ বছর এবং রেহানার মেয়ে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের দুই বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। সোমবার,( ০১ ডিসেম্বর ২০২৫) ঢাকার চতুর্থ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক রবিউল আলম এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
মামলার অভিযোগ ছিল, ঢাকা শহরে বাড়ি বা ফ্ল্যাট বা আবাসন সুবিধা থাকার পরও ‘সেই তথ্য গোপন করে আইন ভেঙে দুর্নীতির মাধ্যমে’ শেখ রেহানা পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ নেন। শেখ হাসিনা ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ করে বোনকে প্লট বরাদ্দে ‘সহায়তা’ করেন। এবং ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক তার মা রেহানাকে প্লট পাইয়ে দিতে খালা শেখ হাসিনাকে ‘প্রভাবিত’ করেন।
দুদকের দায়ের করা এ মামলার ১৭ আসামির মধ্যে বাকি ১৪ জনের প্রত্যেককে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন বিচারক। আসামিদের সবাইকে এক লাখ টাকা করে অর্থদ- অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে রায়ে। সেই সঙ্গে শেখ রেহানার নামে পূর্বাচলের প্লট বরাদ্দ বাতিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
পূর্বাচলে প্লট দুর্নীতির অন্য তিন মামলায় গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে মোট ২১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় অন্য একটি আদালত। তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে দেয়া হয় পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড। তার আগে গত ১৭ নভেম্বর জুলাই গণঅভ্যুত্থান দমানোর চেষ্টায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
পূর্বাচলে প্লট দুর্নীতির আরও দুটি মামলা আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। ওই দুই মামলায় শেখ হাসিনা ও টিউলিপের সঙ্গে টিউলিপের ভাই রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এবং আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীও আসামি।
সোমবার যে মামলার রায় হলো তার ১৭ আসামির মধ্যে কেবল রাজউকের সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলম কারাগারে রয়েছেন। রায়ের সময় তাকে আদালতে হাজির করা হয়। হাসিনা, রেহানা, টিউলিপসহ বাকিদের পলাতক দেখিয়ে এ মামলার বিচার কাজ চলে। ফলে তাদের পক্ষে কোনো আইনজীবী মামলা লড়ার সুযোগ পাননি।
আদালতকে ‘সম্মান দেখিয়ে আত্মসমর্পণ করায়’ খুরশীদ আলমকে এর আগের তিন মামলায় লঘু শাস্তি হিসেবে এক বছর করে মোট তিন বছরের সাজা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সোমবারের রায়ে তাকে কৃপা দেখাননি বিচারক।
সে প্রসঙ্গ ধরে খুরশীদ আলমের আইনজীবী শাহীনুর রহমান রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার তিনটি মামলায় রায় হয়েছে। সেখানে খুরশীদ আলমের এক বছর করে সাজা হয়েছে। এই মামলার নেচারও প্রায় একই রকম ছিল। আশা করেছিলাম, সাজা হলেও আগের ন্যায় হবে। কিন্তু হয়েছে পাঁচ বছর। রায়ে অসন্তুষ্ট, সাজার বিরুদ্ধে আপিল করবো।’
অন্যদিকে দুদকের আইনজীবী খান মো. মাইনুল হাসান লিপনও রায়ে সন্তুষ্ট নন। তিনি বলেন, ‘আমরা আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রত্যাশা করেছিলাম, সেটা হয়নি। কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।’
মামলা বৃত্তান্ত
বিগত সরকারের আমলে পূর্বাচলের ২৭ নম্বর সেক্টরের কূটনৈতিক জোনের ২০৩ নম্বর সড়কের আশপাশের এলাকায় শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ছোট বোন শেখ রেহানা, রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীর নামে ১০ কাঠার ছয়টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়।
শেখ রেহানার প্লট নম্বর ১৩, ববির প্লট নম্বর ১১ ও রূপন্তীর প্লট নম্বর ১৯। আর শেখ হাসিনার প্লট নম্বর ৯, জয়ের ১৫ নম্বর এবং পুতুলের প্লট নম্বর ১৭।
শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। সেদিনই ভারতে পালিয়ে যান তিনি। তার পরিবারের অন্যরাও আছেন দেশের বাইরে। ওই সময় থেকেই একের পর এক মামলা হতে থাকে থানা ও আদালতে। ‘ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মের মাধ্যমে’ পূর্বাচলের প্লটগুলো বরাদ্দ নেয়ার অভিযোগে গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর হাসিনা ও রেহানা পরিবারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
তার আগে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে অনিয়ম নিয়ে সংবাদমাধ্যমে আসা অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয় হাইকোর্ট। ওই কমিটিকে আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪ সালের মধ্যে) রাজউকের প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগও তদন্ত করতে বলা হয়।
অনুসন্ধান শেষে ছয়টি প্লটের জন্য মোট ছয়টি মামলা করে দুদক। এর মধ্যে শেখ রেহানার প্লটের মামলাটি দায়ের করেন দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহ উদ্দিন। ১৩ জানুয়ারি দায়ের করা ওই মামলায় শেখ হাসিনা, টিউলিপসহ ১৫ জনকে আসামি করা হয়। তদন্ত শেষে গত ১০ মার্চ আরও দুজনের নাম যোগ করে মোট ১৭ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া। এরপর ১৩ এপ্রিল আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত।
আদালতে হাজির হতে গেজেট প্রকাশ করা হলেও তারা আদালতে হাজির হননি। আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষে গত ৩১ জুলাই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারক রবিউল আলম। একই আদালত ববি ও রূপন্তীর মামলাতেও অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন।
গত ১৩ আগস্ট মামলা তিনটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। সেদিন সাক্ষ্য দেন রেহানার প্লট মামলার বাদী দুদকের উপ-পরিচালক সালাহ উদ্দিন, রূপন্তীর প্লট মামলার বাদী দুদকের সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া এবং ববির প্লট মামলার বাদী সহকারী পরিচালক এস এম রাশেদুল হাসান। গত ১৮ নভেম্বর তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরার মধ্য দিয়ে রেহানার প্লট দুর্নীতির মামলার সাক্ষ্য শেষ হয়। ২৩ নভেম্বর আসামিদের আত্মপক্ষ শুনানির দিন ঠিক করা হয়।
কারাগারে থাকা মামলার একমাত্র আসামি খুরশীদ আলম নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার চান। এরপর ২৫ নভেম্বর এ মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হলে রায়ের দিন ঠিক করা হয়।
*কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ*
আসামিদের কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ তার বর্ণনা অভিযোগপত্রে দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা আফনান জান্নাত কেয়া।
শেখ রেহানা/রেহানা সিদ্দিক: রাজউক এলাকায় আবাসন সুবিধা থাকার পরও তা হলফনামায় গোপন করে পূর্বাচলে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেন। এক্ষেত্রে আইন ও নীতিমালা মানা হয়নি; রাজউকে কোনো আবেদন না করেই প্লটটি পেতে বোন হাসিনার কাছে আবদার করে বসেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা।
টিউলিপ সিদ্দিক: মা রেহানাকে প্লট পাইয়ে দিতে আইন ও বিধি-বিধান লঙ্ঘন করে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং খালা শেখ হাসিনার ওপর প্রভাব বিস্তার করেন।
শেখ হাসিনা: ক্ষমতার অপব্যবহার করে বোনকে প্লট বরাদ্দে সহায়তা করেন। এর মাধ্যমে তিনি পরিবারকে আর্থিকভাবে লাভবান করেছেন। তিনি ও তার দপ্তরের একান্ত সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন যোগসাজশ করে নিজে ও অপরকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর উদ্দেশে সরকারপ্রধানের দপ্তরের একটি নথি বিনষ্ট করেছেন অথবা গায়েব করেছেন।
মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন: প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি সংরক্ষিত কোটায় রেহানার নামে ১০ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দের বিষয়ে গৃহায়ন সচিবকে চিঠি দেন। তিনি ও শেখ হাসিনা যোগসাজশ করে নিজে ও অপরকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর উদ্দেশে সরকারপ্রধানের দপ্তরের একটি নথি বিনষ্ট করেছেন অথবা গায়েব করেছেন।
সাইফুল ইসলাম: গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের এ প্রশাসনিক কর্মকর্তা আইন ও বিধি-বিধানের তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে প্লট বরাদ্দ সংক্রান্ত নথিতে সই করেন।
পূরবী গোলদার: গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি আইন ও বিধি-বিধানকে পাশ কাটিয়ে প্লট বরাদ্দের প্রস্তাব ও হস্তান্তরে সহায়তা করেন।
অলিউল্লাহ: গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন-২) হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আইন ও বিধি-বিধানের তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে প্লট বরাদ্দ সংক্রান্ত নথিতে সই করেন।
কাজী ওয়াছি উদ্দিন: গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে অবৈধভাবে রেহানান নামে প্লট বরাদ্দ অনুমোদন ও হস্তান্তরে সহায়তা করেন। এর মাধ্যমে তিনি ‘বেআইনি অনুগ্রহ’ দেখান।
শরীফ আহমেদ: এই সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ করে জয়ের নামে প্লট বরাদ্দ ও হস্তান্তর করেন।
রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা, সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) খুরশীদ আলম, সাবেক সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাস, সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন ও সাবেক সদস্য (উন্নয়ন) অবসরপ্রাপ্ত মেজর প্রকৌশলী সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী যোগসাজশ করে সংস্থার এক সভায় রেহানার নামে অবৈধভাবে প্লট বরাদ্দ অনুমোদন করেন।
রাজউকের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-২) মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, উপ-পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) নায়েব আলী শরীফ এবং সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) মাজহারুল ইসলাম অবৈধভাবে প্লট বরাদ্দের নথিতে সই করেন।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
সোমবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের বিরুদ্ধে প্লট দুর্নীতির আরেক মামলার রায় দিয়েছে আদালত। রায়ে শেখ হাসিনার ৫ বছর, তার বোন শেখ রেহানার ৭ বছর এবং রেহানার মেয়ে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের দুই বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। সোমবার,( ০১ ডিসেম্বর ২০২৫) ঢাকার চতুর্থ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক রবিউল আলম এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
মামলার অভিযোগ ছিল, ঢাকা শহরে বাড়ি বা ফ্ল্যাট বা আবাসন সুবিধা থাকার পরও ‘সেই তথ্য গোপন করে আইন ভেঙে দুর্নীতির মাধ্যমে’ শেখ রেহানা পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ নেন। শেখ হাসিনা ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ করে বোনকে প্লট বরাদ্দে ‘সহায়তা’ করেন। এবং ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক তার মা রেহানাকে প্লট পাইয়ে দিতে খালা শেখ হাসিনাকে ‘প্রভাবিত’ করেন।
দুদকের দায়ের করা এ মামলার ১৭ আসামির মধ্যে বাকি ১৪ জনের প্রত্যেককে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন বিচারক। আসামিদের সবাইকে এক লাখ টাকা করে অর্থদ- অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে রায়ে। সেই সঙ্গে শেখ রেহানার নামে পূর্বাচলের প্লট বরাদ্দ বাতিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
পূর্বাচলে প্লট দুর্নীতির অন্য তিন মামলায় গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে মোট ২১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় অন্য একটি আদালত। তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে দেয়া হয় পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড। তার আগে গত ১৭ নভেম্বর জুলাই গণঅভ্যুত্থান দমানোর চেষ্টায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
পূর্বাচলে প্লট দুর্নীতির আরও দুটি মামলা আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। ওই দুই মামলায় শেখ হাসিনা ও টিউলিপের সঙ্গে টিউলিপের ভাই রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এবং আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীও আসামি।
সোমবার যে মামলার রায় হলো তার ১৭ আসামির মধ্যে কেবল রাজউকের সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলম কারাগারে রয়েছেন। রায়ের সময় তাকে আদালতে হাজির করা হয়। হাসিনা, রেহানা, টিউলিপসহ বাকিদের পলাতক দেখিয়ে এ মামলার বিচার কাজ চলে। ফলে তাদের পক্ষে কোনো আইনজীবী মামলা লড়ার সুযোগ পাননি।
আদালতকে ‘সম্মান দেখিয়ে আত্মসমর্পণ করায়’ খুরশীদ আলমকে এর আগের তিন মামলায় লঘু শাস্তি হিসেবে এক বছর করে মোট তিন বছরের সাজা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সোমবারের রায়ে তাকে কৃপা দেখাননি বিচারক।
সে প্রসঙ্গ ধরে খুরশীদ আলমের আইনজীবী শাহীনুর রহমান রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার তিনটি মামলায় রায় হয়েছে। সেখানে খুরশীদ আলমের এক বছর করে সাজা হয়েছে। এই মামলার নেচারও প্রায় একই রকম ছিল। আশা করেছিলাম, সাজা হলেও আগের ন্যায় হবে। কিন্তু হয়েছে পাঁচ বছর। রায়ে অসন্তুষ্ট, সাজার বিরুদ্ধে আপিল করবো।’
অন্যদিকে দুদকের আইনজীবী খান মো. মাইনুল হাসান লিপনও রায়ে সন্তুষ্ট নন। তিনি বলেন, ‘আমরা আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রত্যাশা করেছিলাম, সেটা হয়নি। কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।’
মামলা বৃত্তান্ত
বিগত সরকারের আমলে পূর্বাচলের ২৭ নম্বর সেক্টরের কূটনৈতিক জোনের ২০৩ নম্বর সড়কের আশপাশের এলাকায় শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ছোট বোন শেখ রেহানা, রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীর নামে ১০ কাঠার ছয়টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়।
শেখ রেহানার প্লট নম্বর ১৩, ববির প্লট নম্বর ১১ ও রূপন্তীর প্লট নম্বর ১৯। আর শেখ হাসিনার প্লট নম্বর ৯, জয়ের ১৫ নম্বর এবং পুতুলের প্লট নম্বর ১৭।
শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। সেদিনই ভারতে পালিয়ে যান তিনি। তার পরিবারের অন্যরাও আছেন দেশের বাইরে। ওই সময় থেকেই একের পর এক মামলা হতে থাকে থানা ও আদালতে। ‘ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মের মাধ্যমে’ পূর্বাচলের প্লটগুলো বরাদ্দ নেয়ার অভিযোগে গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর হাসিনা ও রেহানা পরিবারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
তার আগে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে অনিয়ম নিয়ে সংবাদমাধ্যমে আসা অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয় হাইকোর্ট। ওই কমিটিকে আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪ সালের মধ্যে) রাজউকের প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগও তদন্ত করতে বলা হয়।
অনুসন্ধান শেষে ছয়টি প্লটের জন্য মোট ছয়টি মামলা করে দুদক। এর মধ্যে শেখ রেহানার প্লটের মামলাটি দায়ের করেন দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহ উদ্দিন। ১৩ জানুয়ারি দায়ের করা ওই মামলায় শেখ হাসিনা, টিউলিপসহ ১৫ জনকে আসামি করা হয়। তদন্ত শেষে গত ১০ মার্চ আরও দুজনের নাম যোগ করে মোট ১৭ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া। এরপর ১৩ এপ্রিল আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত।
আদালতে হাজির হতে গেজেট প্রকাশ করা হলেও তারা আদালতে হাজির হননি। আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষে গত ৩১ জুলাই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারক রবিউল আলম। একই আদালত ববি ও রূপন্তীর মামলাতেও অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন।
গত ১৩ আগস্ট মামলা তিনটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। সেদিন সাক্ষ্য দেন রেহানার প্লট মামলার বাদী দুদকের উপ-পরিচালক সালাহ উদ্দিন, রূপন্তীর প্লট মামলার বাদী দুদকের সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া এবং ববির প্লট মামলার বাদী সহকারী পরিচালক এস এম রাশেদুল হাসান। গত ১৮ নভেম্বর তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরার মধ্য দিয়ে রেহানার প্লট দুর্নীতির মামলার সাক্ষ্য শেষ হয়। ২৩ নভেম্বর আসামিদের আত্মপক্ষ শুনানির দিন ঠিক করা হয়।
কারাগারে থাকা মামলার একমাত্র আসামি খুরশীদ আলম নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার চান। এরপর ২৫ নভেম্বর এ মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হলে রায়ের দিন ঠিক করা হয়।
*কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ*
আসামিদের কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ তার বর্ণনা অভিযোগপত্রে দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা আফনান জান্নাত কেয়া।
শেখ রেহানা/রেহানা সিদ্দিক: রাজউক এলাকায় আবাসন সুবিধা থাকার পরও তা হলফনামায় গোপন করে পূর্বাচলে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেন। এক্ষেত্রে আইন ও নীতিমালা মানা হয়নি; রাজউকে কোনো আবেদন না করেই প্লটটি পেতে বোন হাসিনার কাছে আবদার করে বসেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা।
টিউলিপ সিদ্দিক: মা রেহানাকে প্লট পাইয়ে দিতে আইন ও বিধি-বিধান লঙ্ঘন করে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং খালা শেখ হাসিনার ওপর প্রভাব বিস্তার করেন।
শেখ হাসিনা: ক্ষমতার অপব্যবহার করে বোনকে প্লট বরাদ্দে সহায়তা করেন। এর মাধ্যমে তিনি পরিবারকে আর্থিকভাবে লাভবান করেছেন। তিনি ও তার দপ্তরের একান্ত সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন যোগসাজশ করে নিজে ও অপরকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর উদ্দেশে সরকারপ্রধানের দপ্তরের একটি নথি বিনষ্ট করেছেন অথবা গায়েব করেছেন।
মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন: প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি সংরক্ষিত কোটায় রেহানার নামে ১০ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দের বিষয়ে গৃহায়ন সচিবকে চিঠি দেন। তিনি ও শেখ হাসিনা যোগসাজশ করে নিজে ও অপরকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর উদ্দেশে সরকারপ্রধানের দপ্তরের একটি নথি বিনষ্ট করেছেন অথবা গায়েব করেছেন।
সাইফুল ইসলাম: গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের এ প্রশাসনিক কর্মকর্তা আইন ও বিধি-বিধানের তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে প্লট বরাদ্দ সংক্রান্ত নথিতে সই করেন।
পূরবী গোলদার: গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি আইন ও বিধি-বিধানকে পাশ কাটিয়ে প্লট বরাদ্দের প্রস্তাব ও হস্তান্তরে সহায়তা করেন।
অলিউল্লাহ: গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন-২) হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আইন ও বিধি-বিধানের তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে প্লট বরাদ্দ সংক্রান্ত নথিতে সই করেন।
কাজী ওয়াছি উদ্দিন: গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে অবৈধভাবে রেহানান নামে প্লট বরাদ্দ অনুমোদন ও হস্তান্তরে সহায়তা করেন। এর মাধ্যমে তিনি ‘বেআইনি অনুগ্রহ’ দেখান।
শরীফ আহমেদ: এই সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ করে জয়ের নামে প্লট বরাদ্দ ও হস্তান্তর করেন।
রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা, সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) খুরশীদ আলম, সাবেক সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাস, সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন ও সাবেক সদস্য (উন্নয়ন) অবসরপ্রাপ্ত মেজর প্রকৌশলী সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী যোগসাজশ করে সংস্থার এক সভায় রেহানার নামে অবৈধভাবে প্লট বরাদ্দ অনুমোদন করেন।
রাজউকের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-২) মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, উপ-পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) নায়েব আলী শরীফ এবং সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) মাজহারুল ইসলাম অবৈধভাবে প্লট বরাদ্দের নথিতে সই করেন।