পর্যটন স্পট কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন ভ্রমণে গিয়ে পর্যটকরা টিকেট জালিয়াতি, প্রতারণা ও ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছেন। প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে অনেকেই টাকা-পয়সা হারিয়ে বিপাকে পড়ছেন।
ছিনতাই ও ভাসমান অপরাধীদের কবলে দেশি-বিদেশি পর্যটক
ছিনতাইকারী ও ইভটিজারসহ ১১৭ জন গ্রেপ্তার: ট্যুরিস্ট পুলিশ
১১ মাসে পানিতে ডুবে ২০ জনের মৃত্যু
পর্যটন স্পটের আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে ট্যুরিস্ট পুলিশ কাজ করছেন: অতিরিক্ত ডিআইজি
শেষ পর্যন্ত প্রতারিত পর্যটকরা ট্যুরিস্ট পুলিশের সহযোগিতায় কোনোমতে বেঁচে যান।
আবার অনেকেই সব হারিয়ে শুধু অভিযোগ করে বাড়ি ফিরে গেছেন। অনেকেই ছিনতাইকারী ও ভাসমান অপরাধীদের কবলে পড়েছেন। পর্যটন মৌসুমে প্রায় দিনই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। ট্যুরিস্ট পুলিশ ঢাকার সদর দপ্তর ও রিজিয়নের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এসব তথ্য জানা গেছে।
ট্যুরিস্ট পুলিশের ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয় ও কক্সবাজার রিজিয়ন অফিস সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার ওশান কমিউনিকেশন অ্যান্ড ট্রাভেলস-এর সত্ত্বাধিকারী ইদ্রিস আলী নিজেকে জাহাজের মালিক পরিচয় দিয়ে সম্প্রতি পঞ্চগড়ের বোদা থানার কলেজ পাড়ার শিক্ষক কামরুল ইসলাম ও তার মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন ভ্রমণের নেয়ার কথা বলে গত ১৭ ডিসেম্বর ৪৭টি টিকেট বাবদ ১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা ও হোটেল বুকিং বাবদ ৩১ হাজার টাকাসহ মোট ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা নেয়।
এরপর প্রতারক ইদ্রিস আলী সেন্টমার্টিনগামী জাহাজের টিকেট দিবো-দিচ্ছি বলে মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রদেরকে ঘুরাতে থাকে। গত ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের সঙ্গে এ প্রতারণা করে আসছিল।
একপর্যায়ে পঞ্চগড় থেকে কক্সবাজার যাওয়া শিক্ষক কামরুল ও তার মাদ্রাসার ছাত্ররা প্রতারক ইদ্রিস আলীকে কক্সবাজার শহরের হলিডে মোড় এলাকায় অবস্থিত ওশান কমিউনিকেশন ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস নামক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে জাহাজের টিকেটের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে টিকেটের ব্যবস্থা করতে পারেনি বলে জানায় এবং পর্যটকদের কাছ থেকে নেয়া টাকা ফেরত দিতে অপরাগতা প্রকাশ করে।
এমতাবস্থায় উল্লিখিত শিক্ষক ও তার মাদ্রাসার ছাত্ররা ট্যুরিস্ট পুলিশের সহায়তা চাইলে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রতারক ইদ্রিস আলী ও তার সহযোগী আরশাদ উল্লাহকে আটক করে। পরে অন্যান্য ট্যুর অপারেটরদের মধ্যস্থতায় পর্যটকদের কাছ থেকে নেয়া এক লাখ ৮৫ হাজার টাকা ফেরত দেয় বলে ট্যুরিস্ট পুলিশ জানিয়েছেন।
অপরদিকে সিরাজগঞ্জের একটি সরকারি মহিলা কলেজের একজন অধ্যক্ষের কাছ থেকে জাহাজের টিকেট বুকিং বাবদ ব্যাংক ও বিকাশের মাধ্যমে ২ লাখ ১২ হাজার ৬৫০ টাকা নেয়। বিমানবাহিনীর একজন স্কোয়াড্রন লিডারের কাছ থেকে জাহাজের টিকেটের নামে ১১ হাজার ২শ’ টাকা এবং আরও অনেকের কাছ থেকে প্রতারক ও জালিয়াত চক্র টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জেলা ট্যুরিস্ট পুলিশ জানিয়েছেন।
এভাবে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়ে নানা পেশার মানুষ প্রতিনিয়ত নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু অভিযোগ ট্যুরিস্ট পুলিশের কাছে গেলে তারা ঘটনাটি মীমাংসা করে দেয়ার চেষ্টা করেন, না পারলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
গত পহেলা ডিসেম্বর থেকে কক্সবাজার টু সেন্টমার্টিনগামী পর্যটকদের জাহাজের টিকেট কালোবাজারিসহ বিভিন্ন ট্যুর অপারেশন ব্যবসায়ীদের নানা অনিয়মে ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ট্যুরিস্ট পুলিশ কাজ করছেন এবং আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ককক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়ে বারবিকিউ মাছ খেতে গেলে তাদেরকে পচা মাছ ফ্রাই করে দেয়া হয়। এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা ও অভিযান চালানো হচ্ছে।
কক্সবাজার রিজিয়নের ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ জানান, কক্সবাজারে প্রায় সাড়ে ৪শ’ আবাসিক হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে ।
চলতি পর্যটন মৌসুমে লাখের বেশি পর্যটক সমুদ্র সৈকতসহ বিভিন্ন স্পটে ভ্রমণে এসেছে। পর্যটকদের হয়রানি ও ছিনতাইয়ের অভিযোগে এ পর্যন্ত ৩৪ জন ছিনতাইকারী, ৬৮ জন ভাসমান অপরাধী, ১১ জন ইভটিজার ও ৪ জন মাদক ব্যবসায়ীসহ ১১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
সৈকতে বেড়াতে গিয়ে এ বছর পানিতে ডুবে মারা গেছে ২০ জন। আর ১৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। শিশু ভিকটিম উদ্ধার হয়েছে ১০ জন।
সেন্টমার্টিনগামী ১১টি জাহাজের টিকেট জালিয়াতি সংক্রান্তে স্থানীয় রাফসান ট্যুরিস্ট অ্যান্ড ট্রাভেলস বিডি-এর কাছ থেকে ১ লাখ ৪৪ হাজার ১শ’ টাকা আদায় করা হয়েছে। এছাড়াও টিকেট জালিয়াতির অভিযোগে নাটাই-ঘুড়ি নামক ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রক্রিয়াধীন।
ওশান কমিউনিকেশন ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস কর্তৃপক্ষ পঞ্চগড় থেকে কক্সবাজার যাওয়া ৪৫ জন মাদ্রাসা ছাত্রের কক্সবাজার টু সেন্টমার্টিন ভ্রমণে জাহাজের ৪৭টি টিকেট বিক্রি করলেও তাদেরকে সেন্টমার্টিন পাঠাতে না পারায় উক্ত প্রতিষ্ঠানের সত্ত্বাধিকারী ইদ্রিস আলীকে ট্যুরিস্ট পুলিশ হেফাজতে নিয়ে টিকেট ও হোটেল বুকিং বাবদ নেয়া ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। পর্যটকদের হয়রানি থেকে বাঁচাতে জেলা ট্যুরিস্ট পুলিশ সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ট্যুরিস্ট পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সেন্টমার্টিনগামী জাহাজে টিকেট জালিয়াতির অভিযোগে ট্যুরিস্ট পুলিশের সহায়তায় একটি জাহাজকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
পর্যটক হয়রানি ও কার্ড ছাড়া ক্যামেরা পরিচালনার অভিযোগে সৈকত থেকে ২৯টি ক্যামেরা জব্দ করা হয়েছে।
কক্সবাজারে হোটেলে মাদক বিক্রির অভিযোগে ৩ মাদক ব্যবসায়ীকে হোটেল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এক পর্যটকের ১০ হাজার ৫শ’ টাকা ও মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
এক রাশিয়ান পর্যটক কক্সবাজারে গিয়ে বিপাকে পড়েছিল। পরে ট্যুরিস্ট পুলিশ তৎপরতা চালিয়ে উক্ত রাশিয়ান মিস মনিকা কবিরের হারানো হ্যান্ডব্যাগ ২ দিনের মধ্যে মালামালসহ উদ্ধার করেছে।
এক জার্মান নাগরিককে মিনারেল পানির পরিবর্তে টিউবওয়েলের পানি দেয়ার অভিযোগে হোটেলের কর্মীকে আটক করে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
এভাবে চলতি বছরের গত ফেব্রুয়ারি থেকে রোববার, (২৮ ডিসেম্বর ২০২৫) পর্যন্ত ট্যুরিস্ট পুলিশের অনুসন্ধানে কক্সবাজার পর্যটন স্পটগুলোর নানা জালিয়াতির কাহিনী বেরিয়ে আসে। ট্যুরিস্ট পুলিশ বিভিন্ন সময়ে অভিযোগের ভিত্তিতে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে। আবার এমন অনেক অভিযোগ রয়েছে যা পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছে না। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ট্যুরিস্ট পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
ট্যুরিস্ট পুলিশের কক্সবাজার রিজিয়ন অফিস সূত্রে আরও জানা গেছে, কক্সবাজার পর্যটক এলাকার অনেক জায়গায় সেখানকার প্রভাবশালীরা দখল করে স্থাপনা বানিয়ে অবৈধ বাণিজ্য করছিল। ট্যুরিস্ট পুলিশ সেগুলোও উচ্ছেদ করেছেন। শুধু তাই না, পরিবেশ রক্ষায় বিচ ক্লিনিং কর্মসূচি পালন করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ।
সৈকতে পর্যটকদের গোসলের গোপন ভিডিও ধারণ করে টিকটকসহ নানাভাবে প্রচারণার অভিযোগে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।
ট্যুরিস্ট পুলিশ প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মাইনুল হাসান এই প্রতিবেদককে জানান, ট্যুরিস্ট পুলিশ পর্যটকদের হয়রানি ঠেকাতে প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যে- পর্যটন স্পটগুলোতে ট্যুরিস্ট পুলিশের টহল জোরদার, মোবাইলকোর্ট পরিচালনায় সহযোগিতা, স্থানীয় পর্যটনবান্ধব জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ, পর্যটন স্পটে সিসি ক্যামরা স্থাপন ও মনিটরিং করা, হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টের মালিক-কর্মচারীসহ স্থানীয় স্টেকহোল্ডারদের সচেতন ও প্রশিক্ষণ প্রদান, পর্যটকদের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয় নিয়ে প্রচার ও প্রচারণা চালানো, হেল্প ডেস্ক, ওয়াচ টাওয়ার স্থাপনের মাধ্যমে পর্যটকদের কাছে তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা, পর্যটন স্পট কেন্দ্রিক কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
এখন ট্যুরিস্ট পুলিশের নানামুখী তৎপরতায় পর্যটক হয়রানি কিছুটা হলেও কমেছে। আর বিদেশি পর্যটকরা যাতে নিরাপদে দেশের বিভিন্ন স্পটে যেতে পারেন তার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের সদর দপ্তর থেকে জানা গেছে, পর্যটকদের নিরাপত্তা বাড়াতে পুলিশের জনবল আরও বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বেশি জনবল হলে স্পটগুলোতে দিনে-রাতে পালাক্রমে নিরাপত্তা আরও জোরদার করা যাবে। এখন জেলা পুলিশ, র্যাব সদস্য ও আমর্ড পুলিশ নিরাপত্তায় সহায়তা করছেন বলে জানা গেছে।