বাতিল শিক্ষাক্রমের ব্যয়ের খোঁজে শিক্ষা প্রশাসন
স্থগিত হওয়া নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে ব্যয় হওয়া অর্থের হিসাব চাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই অনুযায়ী হিসাব কষার কাজ শুরু করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। মূলত মাউশি ও ডিপিই’র দুটি প্রকল্প এবং ‘ইউনিসেফ’র অর্থায়নে ওই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।
স্থগিত হওয়া শিক্ষাক্রমের পেছনে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসান সংবাদকে বলেছেন, ‘এ বিষয়ে আমরা কাজ করছি। তথ্য সংগ্রহ করছি। এখনই বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই তিনটি উৎসের মধ্যে শুধু মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) একটি প্রকল্পেই ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৮৫৫ কোটি ৮২ লাখ ১৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮২৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এটি মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৪৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে এই অর্থ ব্যয় হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
আর চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে এই স্কিমের অনুকূলে মোট ৬৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল; যার মধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। বরাদ্দ হওয়া বাকি অর্থ কীভাবে ‘ব্যয়’ হবে, নাকি অন্য কোনো খাতে ব্যবহার করা হবে তা নিয়ে ‘দ্বিধাদ্বন্ধে’ রয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।
মাউশির অধীনে বাস্তবায়ন হওয়া ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলাপমেন্ট প্রোগ্রামের’ (এসইডিপি) আওতায় ‘ডেসিমিনেশন অফ নিউ কারিকুলাম স্কিম’ গ্রহণ করা হয়েছিল। এই স্কিমের (নকশা বা কর্ম-পরিকল্পনা) মাধ্যমে ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাতিল হওয়া শিক্ষাক্রমের ব্যয় মেটানো হয়ে আসছিল।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখা থেকে জানা গেছে, এসইডিপি’র আওতায় মোট তিনটি স্কিম বাস্তবায়ন হচ্ছে। তিনটি স্কিমেরই মেয়াদ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুটি স্কিমের বাস্তবায়ন নিয়েই শিক্ষা প্রশাসনে ‘অসন্তোষ’ রয়েছে। স্কিমটি দু’টি হলো- ‘ডেসিমিনেশন অফ নিউ কারিকুলাম স্কিম’ এবং ‘স্ট্রেংদেনিং রিডিং হ্যাবিট অ্যান্ড রিডিং স্কিলস অ্যামাং সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস স্কিম’।
‘ডেসিমিনেশন অফ নিউ কারিকুলাম স্কিমের’ পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মাহফুজ আলী সম্প্রতি মাউশির এক সভায় বলেন, ‘এনসিটিবির সুপারিশ এবং অনিবার্য বাস্তবতায় স্কিমের পরিমার্জিত কার্যাবলি অনুমোদন, চলতি অর্থবছরের কার্যক্রম পরিচালনা এবং স্কিমের মেয়াদবৃদ্ধি বিষয়সমূহ ‘আইপিএস’ সভায় উত্থাপন করে নির্দেশনা গ্রহণের সিন্ধান্ত হয়।’
আলোচিত-সমালোচিত নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন না হওয়ায় ‘ডেসিমিনেশন অফ নিউ কারিকুলাম স্কিম’ এর বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখার কোনো যুক্তি দেখছেন না কর্মকর্তারা। তারা বলেন, যেহেতু নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল করা হয়েছে, সেহেতু এই স্কিমের কোনো কার্যকারিতা নেই।
সরকার ২০২৩ সালে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু করেছিল। প্রথম বছর প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণী এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমের পুরো পাঠদান শুরু হয়। চলতি শিক্ষাবর্ষে দ্বিতীয় ও তৃতীয় এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার বিতর্কিত এই শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন স্থগিত করেছে।
২০২৫ সালে চতুর্থ ও পঞ্চম এবং দশম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদানের সিন্ধান্ত ছিল। নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর ২০২২ থেকে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে চার লাখের মতো শিক্ষককে সাতদিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। অষ্টম ও নবম শ্রেণীতেও নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদানের জন্য গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর চার লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে বলে এনসিটিবি থেকে জানা গেছে।
অর্থের খোঁজে দুই কমিটি:
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাতিল হওয়া শিক্ষাক্রমের পেছনে ব্যয় হওয়া খরচের হিসাব কষতে গত ২৪ অক্টোবর পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে এনসিটিবি। আর এই কমিটিকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করতে চার সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করা হয় এনসিটিবির পক্ষ থেকে।
এর মধ্যে পাঁচ সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক হলেন এনসিটিবি’র প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। সদস্য হিসেবে আছেন উৎপাদন নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ আবু নাসের টুকু, ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ আব্দুল মুমিন মোছাব্বির ও বিতরণ নিয়ন্ত্রক হাফিজুর রহমান এবং সদস্য সচিব হিসেবে আছেন বিশেষজ্ঞ মীর রাহাত মাসুম।
কাগজপত্র সরবরাহের জন্য গঠিত কমিটিতে এনসিটিবি’র ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ সাইফা সুলতানা, গবেষণা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ প্রবীর চন্দ্র রায়, গবেষণা কর্মকর্তা শাহ্? জুলফিকার রহমান।
সরকার ২০১০ সালে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ প্রণয়ন করে। এর পর ২০১২ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনা হয়। ২০১৩ সালে ওই শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হয়। নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন স্থগিত হওয়ায় ২০১৩ সালের শিক্ষাক্রমেই ফেরত যাওয়া হয়েছে।
এদিকে ‘স্ট্রেংদেনিং রিডিং হ্যাবিট অ্যান্ড রিডিং স্কিলস অ্যামাং সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস স্কিম’ এর বাস্তবায়ন নিয়েও আগেই নানা সমালোচনা হয়ে আসছিল। কিন্তু স্কিম বা প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা সেটি অব্যাহত রাখেন।
মাউশির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘স্ট্রেংদেনিং রিডিং হ্যাবিট অ্যান্ড রিডিং স্কিলস অ্যামাং সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস স্কিম’ এর ‘মূল কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের মাঝে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা এবং এই কাজটি একটি পরামর্শক সংস্থার (বিশ^ সাহিত্য কেন্দ্র) দ্বারা ইতোপূর্বে বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হতে পরামর্শক সংস্থার পরিবর্তে মাউশি অধিদপ্তরের নিজস্ব জনবল দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারে নির্দেশনা প্রদান করা হয়।’ সেটি করতে হলে ‘স্কিম ডকুমেন্টস সংশোধন অনিবার্য’ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
স্কিম অফিস থেকে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি ‘স্ট্রেংদেনিং রিডিং হ্যাবিট অ্যান্ড রিডিং স্কিলস অ্যামাং সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস স্কিম’ এর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। আগামী ১ জানুয়ারি এই স্কিমের বাস্তবায়ন মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
এই স্কিমের অনুকূলে মোট প্রাক্কলিত বরাদ্দ রয়েছে ৭৮৮ কোটি সাত লাখ ৩১ হাজার টাকা। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ব্যয় হয়েছে ৯৯ কোটি ৯২ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। এটি মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের ১২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে এই স্কিমের অনুকূলে ২৭৭ কোটি টাকার বিপরীতে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।
বিগত সময়ে এই স্কিমের সিংহ ভাগ অর্থই ‘পরামর্শক সংস্থারটির’ পেছনে ব্যয় করা হয়েছে মাউশির সংম্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছে। তারা বলেন, মূলত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ‘বিশেষ নির্দেশে অপ্রয়োজনে’ একজন ‘বিশেষ ব্যক্তিকে সুবিধা’ দেয়ার জন্য ‘পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার’ কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়।
জানা গেছে, পাঠাভ্যাস কর্মসূচির আওতায় ২০২২ সালে সারা দেশের ৫৬১ উপজেলায় ১৫ হাজার বিদ্যালয়ের পাশাপাশি আরো প্রায় ১৭ হাজার ৭০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (মাধ্যমিক পর্যায়ের সব প্রতিষ্ঠান) পাঠাভ্যাস কর্মসূচি বিস্তৃত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মসূচির বই ৪৫ লাখ এবং পুরস্কারের জন্য ৩৮ লাখ কপি বই বিতরণের উদ্যোগ ছিল। মাধ্যমিক স্তরের সব প্রতিষ্ঠানের জন্য দুই ধরণের বই কিনতে মোট ৪০৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা ধরা হয়। তবে ওই টাকা ব্যয় হয়েছে কী না তা জানা যাইনি।
এর আগে এই স্কিমে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বই কেনার জন্য ৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু বই বাচাইয়ে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ বইয়ের তালিকায় অনুমোদন আটকে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এজন্য ওই বছর বই কেনা হয়নি।
মাউশির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, বিগত সময়ে পাঠাভ্যাস কর্মসূচির নামে বরাদ্দ ‘নয়-ছয়’ করা হয়েছে। একটি বিশেষ পরিবারের লোকজন কেন্দ্রীক কিছু বই নামমাত্র স্কুলে সরবরাহ করে বরাদ্দ হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। কর্মশালার নামেও অর্থ তছরুপ করা হয়েছে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।
বাতিল শিক্ষাক্রমের ব্যয়ের খোঁজে শিক্ষা প্রশাসন
শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪
স্থগিত হওয়া নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে ব্যয় হওয়া অর্থের হিসাব চাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই অনুযায়ী হিসাব কষার কাজ শুরু করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। মূলত মাউশি ও ডিপিই’র দুটি প্রকল্প এবং ‘ইউনিসেফ’র অর্থায়নে ওই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।
স্থগিত হওয়া শিক্ষাক্রমের পেছনে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসান সংবাদকে বলেছেন, ‘এ বিষয়ে আমরা কাজ করছি। তথ্য সংগ্রহ করছি। এখনই বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই তিনটি উৎসের মধ্যে শুধু মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) একটি প্রকল্পেই ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৮৫৫ কোটি ৮২ লাখ ১৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮২৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এটি মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৪৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে এই অর্থ ব্যয় হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
আর চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে এই স্কিমের অনুকূলে মোট ৬৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল; যার মধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। বরাদ্দ হওয়া বাকি অর্থ কীভাবে ‘ব্যয়’ হবে, নাকি অন্য কোনো খাতে ব্যবহার করা হবে তা নিয়ে ‘দ্বিধাদ্বন্ধে’ রয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।
মাউশির অধীনে বাস্তবায়ন হওয়া ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলাপমেন্ট প্রোগ্রামের’ (এসইডিপি) আওতায় ‘ডেসিমিনেশন অফ নিউ কারিকুলাম স্কিম’ গ্রহণ করা হয়েছিল। এই স্কিমের (নকশা বা কর্ম-পরিকল্পনা) মাধ্যমে ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাতিল হওয়া শিক্ষাক্রমের ব্যয় মেটানো হয়ে আসছিল।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখা থেকে জানা গেছে, এসইডিপি’র আওতায় মোট তিনটি স্কিম বাস্তবায়ন হচ্ছে। তিনটি স্কিমেরই মেয়াদ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুটি স্কিমের বাস্তবায়ন নিয়েই শিক্ষা প্রশাসনে ‘অসন্তোষ’ রয়েছে। স্কিমটি দু’টি হলো- ‘ডেসিমিনেশন অফ নিউ কারিকুলাম স্কিম’ এবং ‘স্ট্রেংদেনিং রিডিং হ্যাবিট অ্যান্ড রিডিং স্কিলস অ্যামাং সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস স্কিম’।
‘ডেসিমিনেশন অফ নিউ কারিকুলাম স্কিমের’ পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মাহফুজ আলী সম্প্রতি মাউশির এক সভায় বলেন, ‘এনসিটিবির সুপারিশ এবং অনিবার্য বাস্তবতায় স্কিমের পরিমার্জিত কার্যাবলি অনুমোদন, চলতি অর্থবছরের কার্যক্রম পরিচালনা এবং স্কিমের মেয়াদবৃদ্ধি বিষয়সমূহ ‘আইপিএস’ সভায় উত্থাপন করে নির্দেশনা গ্রহণের সিন্ধান্ত হয়।’
আলোচিত-সমালোচিত নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন না হওয়ায় ‘ডেসিমিনেশন অফ নিউ কারিকুলাম স্কিম’ এর বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখার কোনো যুক্তি দেখছেন না কর্মকর্তারা। তারা বলেন, যেহেতু নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল করা হয়েছে, সেহেতু এই স্কিমের কোনো কার্যকারিতা নেই।
সরকার ২০২৩ সালে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু করেছিল। প্রথম বছর প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণী এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমের পুরো পাঠদান শুরু হয়। চলতি শিক্ষাবর্ষে দ্বিতীয় ও তৃতীয় এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার বিতর্কিত এই শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন স্থগিত করেছে।
২০২৫ সালে চতুর্থ ও পঞ্চম এবং দশম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদানের সিন্ধান্ত ছিল। নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর ২০২২ থেকে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে চার লাখের মতো শিক্ষককে সাতদিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। অষ্টম ও নবম শ্রেণীতেও নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদানের জন্য গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর চার লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে বলে এনসিটিবি থেকে জানা গেছে।
অর্থের খোঁজে দুই কমিটি:
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাতিল হওয়া শিক্ষাক্রমের পেছনে ব্যয় হওয়া খরচের হিসাব কষতে গত ২৪ অক্টোবর পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে এনসিটিবি। আর এই কমিটিকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করতে চার সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করা হয় এনসিটিবির পক্ষ থেকে।
এর মধ্যে পাঁচ সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক হলেন এনসিটিবি’র প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। সদস্য হিসেবে আছেন উৎপাদন নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ আবু নাসের টুকু, ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ আব্দুল মুমিন মোছাব্বির ও বিতরণ নিয়ন্ত্রক হাফিজুর রহমান এবং সদস্য সচিব হিসেবে আছেন বিশেষজ্ঞ মীর রাহাত মাসুম।
কাগজপত্র সরবরাহের জন্য গঠিত কমিটিতে এনসিটিবি’র ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ সাইফা সুলতানা, গবেষণা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ প্রবীর চন্দ্র রায়, গবেষণা কর্মকর্তা শাহ্? জুলফিকার রহমান।
সরকার ২০১০ সালে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ প্রণয়ন করে। এর পর ২০১২ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনা হয়। ২০১৩ সালে ওই শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হয়। নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন স্থগিত হওয়ায় ২০১৩ সালের শিক্ষাক্রমেই ফেরত যাওয়া হয়েছে।
এদিকে ‘স্ট্রেংদেনিং রিডিং হ্যাবিট অ্যান্ড রিডিং স্কিলস অ্যামাং সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস স্কিম’ এর বাস্তবায়ন নিয়েও আগেই নানা সমালোচনা হয়ে আসছিল। কিন্তু স্কিম বা প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা সেটি অব্যাহত রাখেন।
মাউশির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘স্ট্রেংদেনিং রিডিং হ্যাবিট অ্যান্ড রিডিং স্কিলস অ্যামাং সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস স্কিম’ এর ‘মূল কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের মাঝে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা এবং এই কাজটি একটি পরামর্শক সংস্থার (বিশ^ সাহিত্য কেন্দ্র) দ্বারা ইতোপূর্বে বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হতে পরামর্শক সংস্থার পরিবর্তে মাউশি অধিদপ্তরের নিজস্ব জনবল দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারে নির্দেশনা প্রদান করা হয়।’ সেটি করতে হলে ‘স্কিম ডকুমেন্টস সংশোধন অনিবার্য’ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
স্কিম অফিস থেকে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি ‘স্ট্রেংদেনিং রিডিং হ্যাবিট অ্যান্ড রিডিং স্কিলস অ্যামাং সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস স্কিম’ এর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। আগামী ১ জানুয়ারি এই স্কিমের বাস্তবায়ন মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
এই স্কিমের অনুকূলে মোট প্রাক্কলিত বরাদ্দ রয়েছে ৭৮৮ কোটি সাত লাখ ৩১ হাজার টাকা। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ব্যয় হয়েছে ৯৯ কোটি ৯২ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। এটি মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের ১২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে এই স্কিমের অনুকূলে ২৭৭ কোটি টাকার বিপরীতে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।
বিগত সময়ে এই স্কিমের সিংহ ভাগ অর্থই ‘পরামর্শক সংস্থারটির’ পেছনে ব্যয় করা হয়েছে মাউশির সংম্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছে। তারা বলেন, মূলত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ‘বিশেষ নির্দেশে অপ্রয়োজনে’ একজন ‘বিশেষ ব্যক্তিকে সুবিধা’ দেয়ার জন্য ‘পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার’ কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়।
জানা গেছে, পাঠাভ্যাস কর্মসূচির আওতায় ২০২২ সালে সারা দেশের ৫৬১ উপজেলায় ১৫ হাজার বিদ্যালয়ের পাশাপাশি আরো প্রায় ১৭ হাজার ৭০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (মাধ্যমিক পর্যায়ের সব প্রতিষ্ঠান) পাঠাভ্যাস কর্মসূচি বিস্তৃত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মসূচির বই ৪৫ লাখ এবং পুরস্কারের জন্য ৩৮ লাখ কপি বই বিতরণের উদ্যোগ ছিল। মাধ্যমিক স্তরের সব প্রতিষ্ঠানের জন্য দুই ধরণের বই কিনতে মোট ৪০৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা ধরা হয়। তবে ওই টাকা ব্যয় হয়েছে কী না তা জানা যাইনি।
এর আগে এই স্কিমে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বই কেনার জন্য ৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু বই বাচাইয়ে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ বইয়ের তালিকায় অনুমোদন আটকে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এজন্য ওই বছর বই কেনা হয়নি।
মাউশির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, বিগত সময়ে পাঠাভ্যাস কর্মসূচির নামে বরাদ্দ ‘নয়-ছয়’ করা হয়েছে। একটি বিশেষ পরিবারের লোকজন কেন্দ্রীক কিছু বই নামমাত্র স্কুলে সরবরাহ করে বরাদ্দ হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। কর্মশালার নামেও অর্থ তছরুপ করা হয়েছে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।