বিভিন্ন জেলায় শিক্ষা ভবন নির্মাণ কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ঢাকা ও সিলেটে প্রায় ৬৬ কোটি টাকা অগ্রিম নিয়ে ‘লাপাত্তা’ ঠিকাদাররা। এর ফলে ওইসব কাজের বেশির ভাগই বন্ধ রয়েছে; কিছু কিছু কাজ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ‘বিক্রি’ করে দেয়া হচ্ছে। আবার আতœগোপনে থেকেও কোনো কোনো ঠিকাদার কাজ করছেন।
শিক্ষায় অবকাঠামো নির্মাণের সিংহ ভাগ কাজই আওয়ামী লীগ ও সংযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা নিয়ন্ত্রণ করতেন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অধিকাংশ ঠিকাদারই আতœগোপনে চলে গেছেন।
রাজধানীর আবদুল গণি সড়কের পাশে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) প্রধান কার্যালয় অবস্থিত। সেখানে ১০তম ভবনের ছাদে কয়েকটি কক্ষ নির্মাণের কাজ দেয়া হয়েছিল ‘বিতর্কিত’ ঠিকাদার সাইফুল ইসলাম সেন্টুকে। কাজ শুরু করার আগেই তাকে ‘অগ্রিম’ বিল দেয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর থেকে ওই ঠিকাদার ‘লাপাত্তা’ হয়ে যায়। কাজও বন্ধ রয়েছে।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে ইইডির প্রধান প্রকৌশলী (রুটিন দায়িত্ব) রায়হান বাদশা বলেন, তিনি গণমাধ্যমে কোনো কথা বলবেন না।
অগ্রিম বিল নিয়ে লাপাত্তা ঠিকাদাররা
ইইডির প্রধান কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিগত সরকারের আমলে ঢাকায়ও শতাধিক শিক্ষা ভবন নির্মাণের নামে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৫৫ কোটি টাকার মতো অগ্রিম বিল পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বেশির ভাগ ঠিকাদার আতœগোপনে চলে গেছেন। তাতে ওইসব অবকাঠামো নির্মাণ কাজ স্থবির হয়ে পড়ে।
একাধিক প্রকৌশলী জানিয়েছেন, রাজধানীর দক্ষিণ খাতে হাজী বেলায়েত আলী হাইস্কুলে একাডেমিক ভবন নির্মাণের জন্য প্রায় এক কোটি টাকা, উত্তরা গার্লস স্কুলে ভবন নির্মাণের জন্য প্রায় দুই কোটি টাকা এবং দক্ষিণ খানের আনোয়ারা ডিগ্রি কলেজে ভবন নির্মাণের নামে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে প্রায় এক কোটি টাকা অগ্রিম বিল দেয়া হয়েছে।
এক ঠিকাদারেই প্রকল্পের ‘সর্বনাশ’
সরকার ৬৪ জেলার ১০০টি উপজেলায় একটি করে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের সিন্ধান্ত নিয়েছিল ২০১৩ সালে। ২০১৪ সালের শুরুতেই দুই বছর মেয়াদী এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয়। এরপর তিন দফা মেয়াদ ও প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হলেও বাস্তবায়ন শেষ হচ্ছে না। কারণ ১০০টি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ কাজের অন্তত ১২টিই দেয়া হয় যুবলীগ নেতার মালিকানাধীন ‘ডালি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকও আতœগোপনে চলে গেছেন বলে প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন।
তারা জানান, ‘ডালির’ কব্জায় থাকা ১২টি কাজের মধ্যে রাজবাড়ী জেলার একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম মোটামুটি শেষ পর্যায়ের রয়েছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্মাণ কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, টাঙ্গাইল, মৌলভীবাজার, কুমিল্লা, মুন্সিগঞ্জে একটি করে এবং বাগেরহাটে দুটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ কাজ অনেকটা বন্ধই রয়েছে বলে প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
ইইডি সূত্রে জানা গেছে, ‘ডালি’ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিকেও ‘মোটা অঙ্কের’ টাকা অগ্রিম বিল দেয়া হয়েছে। বিল নিয়েও প্রতিষ্ঠানটি ঠিকমতো কাজ করেনি। সরকার পরিবর্তনের পর প্রতিষ্ঠানটি ‘দেওলিয়া’ হয়ে গেছে। এখন মালিক ‘লাপাত্তা’।
‘ডালি’ নামের প্রতিষ্ঠানকে ওইসব কাজ পেতে সহায়তা করেছিল শিক্ষা খাতের আলোচিত ঠিকাদার যুবলীগ নেতা শফিকুল ইসলাম। ২০২২ সালের মার্চে শফিক মারা যান। মূলত এর পর থেকেই কাজে স্থবিরতা দেখা দেয়।
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৯২৪ কোটি তিন লাখ টাকা। এর পরে ১ম সংশোধিত ব্যয় দাঁড়ায় দুই হাজার ২৮১ কোটি ৬৯ লাখ ৩৩ হাজার টাকা করা হয়। বিশেষ সংশোধিত ব্যয় বেড়ে দুই হাজার ৩৩৫ কোটি ৬৯ লাখ ৩৩ হাজার টাকা এবং ২য় সংশোধিত ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ৫২০ কোটি ৩৯ লাখ ৭৭ হাজার টাকা।
প্রকল্পের অনুমোদিত সময় ছিল জানুয়ারি ২০১৪ থেকে জুন ২০১৬ পর্যন্ত। এরপরে ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। ডিসেম্বর ২০২১ মেয়াদেও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। এ অবস্থায় ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়।
এই প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ১৬২ দশমিক ১২ একর ভূমি অধিগ্রহণ ও ১১ দশমিক ১১ লাখ ঘনমিটার ভূমি উন্নয়ন এবং প্রকৌশল সরঞ্জাম ও আসবাবপত্র কেনা; ছয় দশমিক ৮৫ লাখ বর্গমিটার একাডেমিক কাম প্রশাসনিক ভবন, ওয়ার্কশপ ভবন ও সার্ভিস সেন্টার নির্মাণ করা; ৪৯ হাজার ৬৫০ রানিং মিটার সীমানা প্রাচীর, ১৯ হাজার ১৫০ রানিং মিটার অভ্যন্তরীণ রাস্তা ও ১০০টি জলাধারসহ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নির্মাণ করা হচ্ছে।
সিলেট জোনে অচলাবস্থা
ইইডির সিলেট জোন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষাভবন নির্মাণ ও পুরনো ভবন সংস্কার কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। ওই সব কাজের জন্যও ঠিকাদাদের মোটা অঙ্কের অগ্রিম বিল দেয়া হয়েছিল। এখন পর্যন্ত ঠিকাদারদের কাছে সিলেট জোন অফিসের প্রায় ১৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা পাওয়া রয়েছে।
কিন্তু অগ্রিম বিল নেয়ার পর দু’জন ঠিকাদার মারা গেছেন, তিনজন ঠিকাদার যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছেন; বেশির ভাগ ঠিকাদার আতœগোপনে চলে গেছেন।
ওইসব কাজ বা অগ্রিম পরিশোধ করা টাকা আদায়ে ‘শক্ত’ অবস্থান নিয়েছিলেন সিলেটে ইইডির নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার নাজমুল ইসলাম। কিন্তু ঠিকাদারদের সঙ্গে আতাত করে ইইডি কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে ওই নির্বাহী প্রকৌশলীকে ‘অসুস্থ’ বানিয়ে ‘অনির্দিষ্টকালের’ জন্য ছুটিতে পাঠিয়েছেন সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা। খন্দকার নাজমুল ইসলাম প্রায় দুই মাস ধরেই ‘অসুস্থতার ছুটি’তে আছেন। এরপর পাশের একটি জেলার এক নির্বাহী প্রকৌশলীকে সিলেট জোন অফিসের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হলেও ওই কর্মকর্তা সেখানে ‘ঝামেলায়’ জড়াতে চাচ্ছেন না। তিনি কাজেও আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
জানা গেছে, বিগত সরকারের আমলে সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমার আবদুল আহাদ উচ্চ বিদ্যালয় ও রেঙ্গা হাজীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে কাজের জন্য প্রায় ৮০ লাখ টাকা, সিলেট সদরেরর শাহজালাল বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি অবকাঠামো নির্মাণ কাজের জন্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা অগ্রিম পরিশোধ করা হয়েছে।
সিলেট জোন অফিসের বিভিন্ন অনিয়ম খতিয়ে দেখতে গত ২ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ নওয়ারা জাহানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। একই বিভাগের যুগ্ম সচিব মিজানুর রহমানকে সদস্য ও উপসচিব মোহাম্মদ আলতাফ হোসেনকে সদস্য সচিব করা হয়।
পরবর্তীতে অভিযুক্ত এক প্রকৌশলীর ‘প্রভাবে’ সৈয়দ নওয়ারা জাহানকে বাদ দিয়ে মিজানুর রহমানকে তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়। মিজানুর রহমানের সঙ্গে সিলেট জোন অফিসের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী) নজরুল হাকিমের ‘ভালো’ সর্ম্পক রয়েছে বলে একাধিক প্রকৌশলী সংবাদকে জানিয়েছেন। এই তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।
‘অডিট’ বিহীন কেনাকাটা
ইইডির অভ্যন্তরীণ কেনাকাটায় দীর্ঘদিন ধরে ‘অডিট’ হচ্ছে না। একটি পক্ষ অডিট কার্যক্রমে অনীহা দেখাচ্ছে। তারা গুপচি কেনাকাটায় ‘ইচ্ছেমতো’ বিল ভাউচার দেখানো, ঠিকাদারি লাইসেন্স প্রদানের মাধ্যমে আদায় হওয়া টাকা নয়ছয় ও ‘ঘুষ’ আদায় অবারিত রাখতে অডিট কার্যক্রমে বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ইইডির মাসিক সমন্বয় সভায় বেশ কয়েকবার অভ্যন্তরীণ অডিট বিভাগ চালুর দাবি জানিয়ে আসছেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সমির কুমার রজক দাস। তবে তিনি ‘স্বাধীন’ অর্থাৎ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের অডিট চান না। তিনি ইইডির অধীনে একটি বিভাগ খুলে সংস্থার অডিট নিস্পত্বি করার পক্ষে।
জানা গেছে, পক্ষটি নিজেদের স্বার্থের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং অভ্যন্তরীণ অডিট কার্যক্রম ধামাচাপা রাখতে একজন কনিষ্ঠ কর্মকর্তাকে সংস্থার প্রধান হিসাব রক্ষক কর্মকর্তার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অন্তত আটজন হিসাব কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করে ওই কর্মকর্তাকে ওই পদে বসানো হয়।
বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪
বিভিন্ন জেলায় শিক্ষা ভবন নির্মাণ কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ঢাকা ও সিলেটে প্রায় ৬৬ কোটি টাকা অগ্রিম নিয়ে ‘লাপাত্তা’ ঠিকাদাররা। এর ফলে ওইসব কাজের বেশির ভাগই বন্ধ রয়েছে; কিছু কিছু কাজ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ‘বিক্রি’ করে দেয়া হচ্ছে। আবার আতœগোপনে থেকেও কোনো কোনো ঠিকাদার কাজ করছেন।
শিক্ষায় অবকাঠামো নির্মাণের সিংহ ভাগ কাজই আওয়ামী লীগ ও সংযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা নিয়ন্ত্রণ করতেন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অধিকাংশ ঠিকাদারই আতœগোপনে চলে গেছেন।
রাজধানীর আবদুল গণি সড়কের পাশে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) প্রধান কার্যালয় অবস্থিত। সেখানে ১০তম ভবনের ছাদে কয়েকটি কক্ষ নির্মাণের কাজ দেয়া হয়েছিল ‘বিতর্কিত’ ঠিকাদার সাইফুল ইসলাম সেন্টুকে। কাজ শুরু করার আগেই তাকে ‘অগ্রিম’ বিল দেয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর থেকে ওই ঠিকাদার ‘লাপাত্তা’ হয়ে যায়। কাজও বন্ধ রয়েছে।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে ইইডির প্রধান প্রকৌশলী (রুটিন দায়িত্ব) রায়হান বাদশা বলেন, তিনি গণমাধ্যমে কোনো কথা বলবেন না।
অগ্রিম বিল নিয়ে লাপাত্তা ঠিকাদাররা
ইইডির প্রধান কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিগত সরকারের আমলে ঢাকায়ও শতাধিক শিক্ষা ভবন নির্মাণের নামে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৫৫ কোটি টাকার মতো অগ্রিম বিল পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বেশির ভাগ ঠিকাদার আতœগোপনে চলে গেছেন। তাতে ওইসব অবকাঠামো নির্মাণ কাজ স্থবির হয়ে পড়ে।
একাধিক প্রকৌশলী জানিয়েছেন, রাজধানীর দক্ষিণ খাতে হাজী বেলায়েত আলী হাইস্কুলে একাডেমিক ভবন নির্মাণের জন্য প্রায় এক কোটি টাকা, উত্তরা গার্লস স্কুলে ভবন নির্মাণের জন্য প্রায় দুই কোটি টাকা এবং দক্ষিণ খানের আনোয়ারা ডিগ্রি কলেজে ভবন নির্মাণের নামে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে প্রায় এক কোটি টাকা অগ্রিম বিল দেয়া হয়েছে।
এক ঠিকাদারেই প্রকল্পের ‘সর্বনাশ’
সরকার ৬৪ জেলার ১০০টি উপজেলায় একটি করে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের সিন্ধান্ত নিয়েছিল ২০১৩ সালে। ২০১৪ সালের শুরুতেই দুই বছর মেয়াদী এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয়। এরপর তিন দফা মেয়াদ ও প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হলেও বাস্তবায়ন শেষ হচ্ছে না। কারণ ১০০টি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ কাজের অন্তত ১২টিই দেয়া হয় যুবলীগ নেতার মালিকানাধীন ‘ডালি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকও আতœগোপনে চলে গেছেন বলে প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন।
তারা জানান, ‘ডালির’ কব্জায় থাকা ১২টি কাজের মধ্যে রাজবাড়ী জেলার একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম মোটামুটি শেষ পর্যায়ের রয়েছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্মাণ কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, টাঙ্গাইল, মৌলভীবাজার, কুমিল্লা, মুন্সিগঞ্জে একটি করে এবং বাগেরহাটে দুটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ কাজ অনেকটা বন্ধই রয়েছে বলে প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
ইইডি সূত্রে জানা গেছে, ‘ডালি’ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিকেও ‘মোটা অঙ্কের’ টাকা অগ্রিম বিল দেয়া হয়েছে। বিল নিয়েও প্রতিষ্ঠানটি ঠিকমতো কাজ করেনি। সরকার পরিবর্তনের পর প্রতিষ্ঠানটি ‘দেওলিয়া’ হয়ে গেছে। এখন মালিক ‘লাপাত্তা’।
‘ডালি’ নামের প্রতিষ্ঠানকে ওইসব কাজ পেতে সহায়তা করেছিল শিক্ষা খাতের আলোচিত ঠিকাদার যুবলীগ নেতা শফিকুল ইসলাম। ২০২২ সালের মার্চে শফিক মারা যান। মূলত এর পর থেকেই কাজে স্থবিরতা দেখা দেয়।
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৯২৪ কোটি তিন লাখ টাকা। এর পরে ১ম সংশোধিত ব্যয় দাঁড়ায় দুই হাজার ২৮১ কোটি ৬৯ লাখ ৩৩ হাজার টাকা করা হয়। বিশেষ সংশোধিত ব্যয় বেড়ে দুই হাজার ৩৩৫ কোটি ৬৯ লাখ ৩৩ হাজার টাকা এবং ২য় সংশোধিত ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ৫২০ কোটি ৩৯ লাখ ৭৭ হাজার টাকা।
প্রকল্পের অনুমোদিত সময় ছিল জানুয়ারি ২০১৪ থেকে জুন ২০১৬ পর্যন্ত। এরপরে ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। ডিসেম্বর ২০২১ মেয়াদেও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। এ অবস্থায় ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়।
এই প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ১৬২ দশমিক ১২ একর ভূমি অধিগ্রহণ ও ১১ দশমিক ১১ লাখ ঘনমিটার ভূমি উন্নয়ন এবং প্রকৌশল সরঞ্জাম ও আসবাবপত্র কেনা; ছয় দশমিক ৮৫ লাখ বর্গমিটার একাডেমিক কাম প্রশাসনিক ভবন, ওয়ার্কশপ ভবন ও সার্ভিস সেন্টার নির্মাণ করা; ৪৯ হাজার ৬৫০ রানিং মিটার সীমানা প্রাচীর, ১৯ হাজার ১৫০ রানিং মিটার অভ্যন্তরীণ রাস্তা ও ১০০টি জলাধারসহ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নির্মাণ করা হচ্ছে।
সিলেট জোনে অচলাবস্থা
ইইডির সিলেট জোন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষাভবন নির্মাণ ও পুরনো ভবন সংস্কার কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। ওই সব কাজের জন্যও ঠিকাদাদের মোটা অঙ্কের অগ্রিম বিল দেয়া হয়েছিল। এখন পর্যন্ত ঠিকাদারদের কাছে সিলেট জোন অফিসের প্রায় ১৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা পাওয়া রয়েছে।
কিন্তু অগ্রিম বিল নেয়ার পর দু’জন ঠিকাদার মারা গেছেন, তিনজন ঠিকাদার যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছেন; বেশির ভাগ ঠিকাদার আতœগোপনে চলে গেছেন।
ওইসব কাজ বা অগ্রিম পরিশোধ করা টাকা আদায়ে ‘শক্ত’ অবস্থান নিয়েছিলেন সিলেটে ইইডির নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার নাজমুল ইসলাম। কিন্তু ঠিকাদারদের সঙ্গে আতাত করে ইইডি কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে ওই নির্বাহী প্রকৌশলীকে ‘অসুস্থ’ বানিয়ে ‘অনির্দিষ্টকালের’ জন্য ছুটিতে পাঠিয়েছেন সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা। খন্দকার নাজমুল ইসলাম প্রায় দুই মাস ধরেই ‘অসুস্থতার ছুটি’তে আছেন। এরপর পাশের একটি জেলার এক নির্বাহী প্রকৌশলীকে সিলেট জোন অফিসের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হলেও ওই কর্মকর্তা সেখানে ‘ঝামেলায়’ জড়াতে চাচ্ছেন না। তিনি কাজেও আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
জানা গেছে, বিগত সরকারের আমলে সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমার আবদুল আহাদ উচ্চ বিদ্যালয় ও রেঙ্গা হাজীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে কাজের জন্য প্রায় ৮০ লাখ টাকা, সিলেট সদরেরর শাহজালাল বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি অবকাঠামো নির্মাণ কাজের জন্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা অগ্রিম পরিশোধ করা হয়েছে।
সিলেট জোন অফিসের বিভিন্ন অনিয়ম খতিয়ে দেখতে গত ২ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ নওয়ারা জাহানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। একই বিভাগের যুগ্ম সচিব মিজানুর রহমানকে সদস্য ও উপসচিব মোহাম্মদ আলতাফ হোসেনকে সদস্য সচিব করা হয়।
পরবর্তীতে অভিযুক্ত এক প্রকৌশলীর ‘প্রভাবে’ সৈয়দ নওয়ারা জাহানকে বাদ দিয়ে মিজানুর রহমানকে তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়। মিজানুর রহমানের সঙ্গে সিলেট জোন অফিসের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী) নজরুল হাকিমের ‘ভালো’ সর্ম্পক রয়েছে বলে একাধিক প্রকৌশলী সংবাদকে জানিয়েছেন। এই তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।
‘অডিট’ বিহীন কেনাকাটা
ইইডির অভ্যন্তরীণ কেনাকাটায় দীর্ঘদিন ধরে ‘অডিট’ হচ্ছে না। একটি পক্ষ অডিট কার্যক্রমে অনীহা দেখাচ্ছে। তারা গুপচি কেনাকাটায় ‘ইচ্ছেমতো’ বিল ভাউচার দেখানো, ঠিকাদারি লাইসেন্স প্রদানের মাধ্যমে আদায় হওয়া টাকা নয়ছয় ও ‘ঘুষ’ আদায় অবারিত রাখতে অডিট কার্যক্রমে বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ইইডির মাসিক সমন্বয় সভায় বেশ কয়েকবার অভ্যন্তরীণ অডিট বিভাগ চালুর দাবি জানিয়ে আসছেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সমির কুমার রজক দাস। তবে তিনি ‘স্বাধীন’ অর্থাৎ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের অডিট চান না। তিনি ইইডির অধীনে একটি বিভাগ খুলে সংস্থার অডিট নিস্পত্বি করার পক্ষে।
জানা গেছে, পক্ষটি নিজেদের স্বার্থের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং অভ্যন্তরীণ অডিট কার্যক্রম ধামাচাপা রাখতে একজন কনিষ্ঠ কর্মকর্তাকে সংস্থার প্রধান হিসাব রক্ষক কর্মকর্তার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অন্তত আটজন হিসাব কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করে ওই কর্মকর্তাকে ওই পদে বসানো হয়।