alt

আল-জাজিরার অনুসন্ধান

বিদেশে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের ৩৬০ বিলাসবহুল বাড়ি

সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট : বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

গত আগস্টে বাংলাদেশে এমন এক গণঅভ্যুত্থান হয়েছে যখন বাংলাদেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির বিষয়ে সবাই সোচ্চার হয়ে উঠেছে। গত ৫ আগস্ট তীব্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের জেরে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তবে এই অভ্যুত্থানের আগে থেকেই আল জাজিরা আওয়ামী লীগ সরকারের একজন রাজনীতিবিদকে অনুসরণের চেষ্টা করেছিল। তিনি হলেন ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং দুবাইয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। তার ব্যাপারে অনুসন্ধান করে বিপুল সম্পদের তথ্য বের করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।

আল জাজিরার এক অনুসন্ধানী টিম ছদ্মবেশে তার অন্দরমহলে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে এবং তার বিপুল অর্থের সামাজ্য সম্পর্কে চমকপ্রদ সব তথ্য খুঁজে বের করেছে। অভ্যুত্থানের অনেক আগেই আল জাজিরার অনুসন্ধানী টিম আই ইউনিট একটি তথ্য পেয়েছিল। বাংলাদেশের একজন মন্ত্রী যিনি বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বাবদ পান আনুমানিক দেড় লাখ টাকার মতো। কিন্তু তিনি লন্ডনে বিপুল পরিমাণ সম্পদের এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন।

তার ব্যাপারে তথ্য জানতে আই ইউনিট একটি ছদ্মবেশী দল গঠন করে। ২০২৩ সালে অর্থাৎ গণঅভ্যুত্থানের আগের বছর এই অনুসন্ধান চালানো হয়। সে সময় আল জাজিরার ওই দলটি মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ লোকজনের কাছে পৌঁছায় এবং লন্ডনে অবস্থিত তার ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের বাড়িতে আমন্ত্রণ পায়।

সে সময় মন্ত্রী অতিথিদের বলেন, এটা খুবই নিরিবিলি একটি বাড়ি। আমার নিরাপত্তার জন্য খুবই সুরক্ষিত এমন একটি বাড়ির প্রয়োজন ছিল। পাঁচতলা ওই বাড়িটিতে তিনি একটি সিনেমাহলও বানিয়েছেন। সেখানে তার একটি নতুন রোলস রয়েস গাড়িও তিনি অতিথিদের দেখান।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুবই কাছের এবং বিশ্বস্ত এই সাবেক মন্ত্রী তারই ছত্রছায়ায় বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন। ২০১৪ সালে তিনি সংসদ সদস্য ও ভূমি প্রতিমন্ত্রী হন। ২০১৯ সালে শেখ হাসিনা তাকে পদোন্নতি দিয়ে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী বানিয়ে আবারও ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন।

আল জাজিরার ওই প্রতিবেদনে দেখা যায় সাবেক এই মন্ত্রী বলছেন, আমার বাবা প্রধানমন্ত্রীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং সত্যি কথা বলতে আমিও। তিনি (শেখ হাসিনা) আমার বস। সাইফুজ্জামানের সম্পদের বৃহত্তম উৎস ব্যবসা এবং বাংলাদেশের অন্যতম ইউসিবি ব্যাংকে তার শেয়ার।

বাংলাদেশের কঠোর মুদ্রানীতি অনুযায়ী, দেশটির নাগরিকরা বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি বিদেশে নিতে পারেন না। বাংলাদেশের অর্থনীতির সুরক্ষার জন্যই এই নীতি। তাহলে সাবেক এই মন্ত্রী কীভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়লেন?

আই ইউনিট মন্ত্রীর বৈশ্বিক সম্পদের খোঁজে নেমে চমকপ্রদ সব তথ্য পেয়েছে। প্রথমে দেখা হয় ব্রিটেনে তার কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। ফলাফল ছিল চমকে ওঠার মতো। তিনি ডেভেলপারদের কাছ থেকে বাড়ি কেনার জন্য বেশ কিছু কোম্পানি তৈরি করেন। ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তিনি যুক্তরাজ্যে ২৬৫টি বাড়ি কিনেছিলেন। তিনি মূলত বাড়িগুলোর বেশির ভাগই বার্কলি গ্রুপের মতো শীর্ষ ডেভেলপারদের কাছ থেকে কিনেছেন। আবাসন সংকটের কারণে তিনি প্রচুর লাভ করেছেন। কিন্তু তার কেনাকাটা সেখানেই থেমে থাকেনি।

২০২১ সালে ১ কোটি ৬০ লাখ ডলারে লন্ডনে আরও বিলাসবহুল সম্পদ কেনেন তিনি। তার বেশির ভাগ সম্পদই লাভের জন্য তিনি ভাড়া দিয়ে থাকেন। এরপর ২০২২ সালে আরও ৮৯টি বাড়ি কিনলে তার মোট বাড়ির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬০টি, যার বাজারমূল্য ২৫ কোটি ডলার।

লন্ডনে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর হয়ে কাজ করেন চট্টগ্রামের রিপন মাহমুদ। শেখ হাসিনা দেশের বাইরে তার ব্যবসার কথা জানতেন বলেও উল্লেখ করেছেন সাইফুজ্জামান। তিনি আল-জাজিরার অনুসন্ধানী দলকে বলেছেন, আমার এখানে ব্যবসা আছে, সেটা তিনি জানতেন।

রাজনৈতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তিদের সম্পদের পরিমাণ নিয়ে যুক্তরাজ্যে কঠোর যাচাই-বাছাইয়ের মুখোমুখি হতে হয়। তাহলে তিনি কীভাবে এই যাচাইপ্রক্রিয়া অতিক্রম করেছেন তা জানতে তার একটি সম্পত্তি দেখতে আল-জাজিরার একটি গোপন টিম পাঠানো হয়।

সেখানে রিপন মাহমুদ বলেন, আমাদের গ্রাহকের লন্ডনে ৩০০টি বাড়ি আছে। তিনি লন্ডনে আসেন, কয়েকটি বাড়ি কেনেন, আবার চলে যান। লকডাউনের সময় যুক্তরাজ্যে নতুন বাড়ি কেনার জন্য তিনি ২০ কোটি পাউন্ড ব্যয় করেছেন। তবে তার এই বিপুল পরিমাণ সম্পদের বিষয়ে তিনি বাংলাদেশের ট্যাক্স কর্তৃপক্ষ এবং নির্বাচনী হলফনামায় সঠিক তথ্য প্রদান করেননি। অর্থাৎ তিনি বড় অঙ্কের ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছেন।

রিপন মাহমুদ মূলত একজন স্টেট এজেন্ট যিনি সাইফুজ্জামানকে এই বিশাল সম্পদ কেনার ব্যাপারে সহযোগিতা করে গেছেন। তিনি সাইফুজ্জামানের মতো ধনী গ্রাহকদের সঙ্গে কাজ করেন। তিনি বলেন, আসলে আমার গ্রাহকরা এমনি, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা বিশ্বাস করেই টাকা বিনিয়োগ করেন।

আল-জাজিরার অনুসন্ধানী দলের সদস্যরাও নিজেদের ধনী বিদেশি বিনিয়োগকারী হিসেবেই অভিনয় করেছেন এবং রিপন মাহমুদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য নিয়েছেন। তারা জানান, চীন থেকে ১০ কোটি ডলার যুক্তরাজ্যের বাজারে স্থানান্তর করতে চান। এভাবেই তারা সাইফুজ্জামানের সম্পদের গোপন তথ্য বের করেন।

এ বিষয়ে বোঝানোর জন্য সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রসঙ্গ টেনে রিপন বলেন, আমার ভালো বন্ধু সাইফুজ্জামান। আপনি যেটা আমার কাছে চাচ্ছেন প্রায় ঠিক সেটাই আমি তার জন্য করেছি। সে সময় রিপনকে সাইফুজ্জামান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় যে তিনি কি দুবাইয়ের তিনি বলেন না, পরবর্তীতে জানতে চাওয়া হয় যে তাহলে কি তিনি চীনের তখনও তিনি বলেন না। উনিও কি বিদেশি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ তিনি বিদেশি এবং তিনি একজন মন্ত্রী, তিনি একজন ক্ষমতাধর মন্ত্রী। তিনি বুদ্ধিমান। তিনি বড় প্রকল্পে যান না। আপনি বুঝতে পারছেন আমি কী বলছি। যখন আপনি বড় প্রকল্পে যান, কর্তৃপক্ষ সতর্ক হয়ে যায়। বড় টাকা, বড় সংখ্যা সবাইকে সতর্ক করে দেয়। আপনি বুঝতেই পারছেন কী বলছি। তিনি এক কোটি আনেন এবং বলেন, আমি নগদে কিনিনি। ব্যাংক আমাকে এই টাকা দিয়েছে।

শুধু লন্ডনেই নয় যুক্তরাষ্ট্রেও সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পত্তি আছে। সেখানে তিনি নয়টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। পাঁচটি নিউইয়র্কের প্রধান এলাকায় এবং চারটি নদীর ওপারে নিউ জার্সিতে।

সাইফুজ্জামান নিজেই তার বিলাসী জীবনের গল্প বলেছেন। তিনি অনুসন্ধানী দলের এক সদস্যকে বলেন, আপনার জুতাটি আমার পছন্দ হয়েছে। ওই সদস্য তাকে জানান এটি টেইলর-মেডের জুতা। সেসময় তিনি জানান তারও টেইলর-মেডের জুতা পছন্দ। তিনি বলেন, আমি হেরডসেও কাস্টমস মেড (নির্দিষ্ট গ্রাহকের জন্য বিশেষভাবে তৈরি) জুতা অর্ডার করেছি। এটি তৈরি হতে চার মাস সময় লাগে। আমি কিনেছি প্রতিটি তিন হাজার পাউন্ডের বেশি দিয়ে।

সবাই এর দাম শুনে হতবাক হয়ে গেলে তিনি এই বিশেষ জুতা সম্পর্কে বলেন, এগুলো উটপাখি ও কুমিরের বুকের চামড়া দিয়ে তৈরি। সম্পূর্ণ বুকের চামড়া দিয়ে তৈরি জুতাগুলোর দাম ছয় হাজার পাউন্ড। আর অর্ধেক কুমিরের বুকের চামড়া ও বাছুরের চামড়ার অর্ধেক দিয়ে তৈরি জুতার দাম পড়ে তিন হাজার পাউন্ড। এটা খুবই ভালো। চার মাস লাগে তৈরি হতে।

প্রতিবার তিনি লন্ডনে গেলে দুই থেকে তিন হাজার পাউন্ড স্যুট কিনতে ব্যয় করেন বলেও জানান এই সাবেক ভূমিমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমি স্যুট পছন্দ করি। সুপার ২০০, সুপার ১৮০ এগুলোর দাম ছয় হাজার পাউন্ড। কেনালি বন্ড স্ট্রিটে গিয়ে তিনি শুধু কেনেন। এরপর তারাই বাসায় পৌঁছে দেয়।

তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, মন্ত্রী সাহেব আপনি এখানে এত টাকা কিভাবে বিনিয়োগ করলেন? তিনি বলেন, আমার দুবাইয়ে একটা ব্যবসা আছে। আমি দুবাই থেকে এখানে টাকা আনি। তারপর এখান থেকে একটা ঋণ নিই।

কয়েক দফা সাক্ষাতের পর রিপন স্বীকার করেন, তার সবচেয়ে বড় গ্রাহক সাইফুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে আসবেন বলেও জানান এবং তিনি বাংলাদেশের ভূমিমন্ত্রী সেটাও উল্লেখ করেন। রিপনই চার বছর আগে লন্ডনে সাইফুজ্জামানের জন্য সবকিছু ঠিক করেছেন। প্রতিবছর তিনি রিপনের মাধ্যমেই ১০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেন।

রিপনের মাধ্যমেই সাইফুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আল জাজিরার টিম। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ছাড়াও দুবাইয়ে তার সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। ২০২০ সালের মধ্যে সেখানে অন্তত ৫৪টি সম্পদের মালিক হয়েছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী।

ছবি

মামদানির নিউইয়র্ক পরিকল্পনায় বাদ সাধতে পারেন ট্রাম্প

ছবি

গাজায় মৃত্যু ৬৯ হাজার ছাড়িয়েছে, ইসরায়েলি সেনার মৃতদেহ উদ্ধার করলো হামাস

ছবি

পাকিস্তানে বিতর্কিত ২৭তম সংবিধান সংশোধনী বিল সিনেটে উপস্থাপন

ছবি

সংবিধান সংশোধনীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানজুড়ে বিক্ষোভের ঘোষণা বিরোধী জোটের

ছবি

লেবাননে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানাল ইউরোপীয় ইউনিয়ন

ছবি

সিরিয়া- যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের নতুন অধ্যায়, ওয়াশিংটনে আল শারা

ছবি

তীব্র দূষণের ঝুঁকিতে গাজার জনস্বাস্থ্য

ছবি

কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ খরার মুখোমুখি ইংল্যান্ড

ছবি

মামদানির প্রচারকৌশলে এগোনোর চেষ্টা ট্রাম্পের

ছবি

২৬ মার্কিন ধনকুবেরের সোয়া দুই কোটি ডলারও মামদানির জয় ঠেকাতে পারেনি

ছবি

আফগানিস্তান-পাকিস্তান শান্তি আলোচনা ব্যর্থ, যুদ্ধবিরতি এখনও বহাল

ছবি

পুতিনের সঙ্গে এখনও বৈঠকের সুযোগ আছে : ট্রাম্প

ছবি

ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামোতে রাশিয়ার ভয়াবহ হামলা

ছবি

সন্ত্রাসী তালিকা থেকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের নাম মুছলো যুক্তরাষ্ট্র

ছবি

অ্যান্টার্কটিকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে

ছবি

ভেস্তে গেলো আফগানিস্তান-পাকিস্তান আলোচনা

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে তুরস্কের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

ছবি

বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তেজনা চায় না ভারত : রাজনাথ সিং

ছবি

প্রভাবশালী মার্কিন ডানপন্থিরা মামদানিকে আইএসের সঙ্গে জড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন

ছবি

ইরানে ইসরায়েলি হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করলেন ট্রাম্প

ছবি

ট্রাম্প-মামদানি কি সমানে সমান

ছবি

কেন দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন সুদানের নাগরিকরা

ছবি

গাজার নিরাপত্তায় আইএসএফ গঠনের প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের

ছবি

সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলো জাতিসংঘ

ছবি

ইতিহাসের সবচেয়ে গরম বছরগুলোর একটি হতে যাচ্ছে ২০২৫

ছবি

ইতিহাসে সর্বোচ্চ বেতন-ভাতা মাস্কের

ছবি

পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার প্রস্তুতির নির্দেশ পুতিনের

ছবি

মামদানির জয়, নিউইয়র্কের ইহুদিদের দেশে চলে আসতে বললেন ইসরায়েলি মন্ত্রী

ছবি

মামদানি সম্মানজনক আচরণ করলে তাঁকে সহায়তা করব: ট্রাম্প

ছবি

গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন, যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ প্রায় শেষ

ছবি

১৭ হাজার নারী সংগীত শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেবে সৌদি আরব

ছবি

নিউইয়র্কে ইতিহাস: পাঁচ নারী নিয়ে মেয়র মামদানির প্রশাসনের সূচনা

ছবি

নিউইয়র্কের মেয়র মামদানি: নতুন ইতিহাস, ট্রাম্পের জন্য বড় ধাক্কা

ছবি

যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রথম দিনই দিয়েছিলাম: ভারত

ছবি

যুক্তরাষ্ট্রে উড্ডয়নের পরপরই বিমান বিধ্বস্ত, নিহত অন্তত ৩

ছবি

মামদানিকে সমর্থন দেয়া ইহুদিদের ‘স্টুপিড’ বললেন ট্রাম্প

tab

আল-জাজিরার অনুসন্ধান

বিদেশে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের ৩৬০ বিলাসবহুল বাড়ি

সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট

বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

গত আগস্টে বাংলাদেশে এমন এক গণঅভ্যুত্থান হয়েছে যখন বাংলাদেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির বিষয়ে সবাই সোচ্চার হয়ে উঠেছে। গত ৫ আগস্ট তীব্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের জেরে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তবে এই অভ্যুত্থানের আগে থেকেই আল জাজিরা আওয়ামী লীগ সরকারের একজন রাজনীতিবিদকে অনুসরণের চেষ্টা করেছিল। তিনি হলেন ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং দুবাইয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। তার ব্যাপারে অনুসন্ধান করে বিপুল সম্পদের তথ্য বের করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।

আল জাজিরার এক অনুসন্ধানী টিম ছদ্মবেশে তার অন্দরমহলে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে এবং তার বিপুল অর্থের সামাজ্য সম্পর্কে চমকপ্রদ সব তথ্য খুঁজে বের করেছে। অভ্যুত্থানের অনেক আগেই আল জাজিরার অনুসন্ধানী টিম আই ইউনিট একটি তথ্য পেয়েছিল। বাংলাদেশের একজন মন্ত্রী যিনি বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বাবদ পান আনুমানিক দেড় লাখ টাকার মতো। কিন্তু তিনি লন্ডনে বিপুল পরিমাণ সম্পদের এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন।

তার ব্যাপারে তথ্য জানতে আই ইউনিট একটি ছদ্মবেশী দল গঠন করে। ২০২৩ সালে অর্থাৎ গণঅভ্যুত্থানের আগের বছর এই অনুসন্ধান চালানো হয়। সে সময় আল জাজিরার ওই দলটি মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ লোকজনের কাছে পৌঁছায় এবং লন্ডনে অবস্থিত তার ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের বাড়িতে আমন্ত্রণ পায়।

সে সময় মন্ত্রী অতিথিদের বলেন, এটা খুবই নিরিবিলি একটি বাড়ি। আমার নিরাপত্তার জন্য খুবই সুরক্ষিত এমন একটি বাড়ির প্রয়োজন ছিল। পাঁচতলা ওই বাড়িটিতে তিনি একটি সিনেমাহলও বানিয়েছেন। সেখানে তার একটি নতুন রোলস রয়েস গাড়িও তিনি অতিথিদের দেখান।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুবই কাছের এবং বিশ্বস্ত এই সাবেক মন্ত্রী তারই ছত্রছায়ায় বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন। ২০১৪ সালে তিনি সংসদ সদস্য ও ভূমি প্রতিমন্ত্রী হন। ২০১৯ সালে শেখ হাসিনা তাকে পদোন্নতি দিয়ে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী বানিয়ে আবারও ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন।

আল জাজিরার ওই প্রতিবেদনে দেখা যায় সাবেক এই মন্ত্রী বলছেন, আমার বাবা প্রধানমন্ত্রীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং সত্যি কথা বলতে আমিও। তিনি (শেখ হাসিনা) আমার বস। সাইফুজ্জামানের সম্পদের বৃহত্তম উৎস ব্যবসা এবং বাংলাদেশের অন্যতম ইউসিবি ব্যাংকে তার শেয়ার।

বাংলাদেশের কঠোর মুদ্রানীতি অনুযায়ী, দেশটির নাগরিকরা বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি বিদেশে নিতে পারেন না। বাংলাদেশের অর্থনীতির সুরক্ষার জন্যই এই নীতি। তাহলে সাবেক এই মন্ত্রী কীভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়লেন?

আই ইউনিট মন্ত্রীর বৈশ্বিক সম্পদের খোঁজে নেমে চমকপ্রদ সব তথ্য পেয়েছে। প্রথমে দেখা হয় ব্রিটেনে তার কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। ফলাফল ছিল চমকে ওঠার মতো। তিনি ডেভেলপারদের কাছ থেকে বাড়ি কেনার জন্য বেশ কিছু কোম্পানি তৈরি করেন। ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তিনি যুক্তরাজ্যে ২৬৫টি বাড়ি কিনেছিলেন। তিনি মূলত বাড়িগুলোর বেশির ভাগই বার্কলি গ্রুপের মতো শীর্ষ ডেভেলপারদের কাছ থেকে কিনেছেন। আবাসন সংকটের কারণে তিনি প্রচুর লাভ করেছেন। কিন্তু তার কেনাকাটা সেখানেই থেমে থাকেনি।

২০২১ সালে ১ কোটি ৬০ লাখ ডলারে লন্ডনে আরও বিলাসবহুল সম্পদ কেনেন তিনি। তার বেশির ভাগ সম্পদই লাভের জন্য তিনি ভাড়া দিয়ে থাকেন। এরপর ২০২২ সালে আরও ৮৯টি বাড়ি কিনলে তার মোট বাড়ির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬০টি, যার বাজারমূল্য ২৫ কোটি ডলার।

লন্ডনে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর হয়ে কাজ করেন চট্টগ্রামের রিপন মাহমুদ। শেখ হাসিনা দেশের বাইরে তার ব্যবসার কথা জানতেন বলেও উল্লেখ করেছেন সাইফুজ্জামান। তিনি আল-জাজিরার অনুসন্ধানী দলকে বলেছেন, আমার এখানে ব্যবসা আছে, সেটা তিনি জানতেন।

রাজনৈতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তিদের সম্পদের পরিমাণ নিয়ে যুক্তরাজ্যে কঠোর যাচাই-বাছাইয়ের মুখোমুখি হতে হয়। তাহলে তিনি কীভাবে এই যাচাইপ্রক্রিয়া অতিক্রম করেছেন তা জানতে তার একটি সম্পত্তি দেখতে আল-জাজিরার একটি গোপন টিম পাঠানো হয়।

সেখানে রিপন মাহমুদ বলেন, আমাদের গ্রাহকের লন্ডনে ৩০০টি বাড়ি আছে। তিনি লন্ডনে আসেন, কয়েকটি বাড়ি কেনেন, আবার চলে যান। লকডাউনের সময় যুক্তরাজ্যে নতুন বাড়ি কেনার জন্য তিনি ২০ কোটি পাউন্ড ব্যয় করেছেন। তবে তার এই বিপুল পরিমাণ সম্পদের বিষয়ে তিনি বাংলাদেশের ট্যাক্স কর্তৃপক্ষ এবং নির্বাচনী হলফনামায় সঠিক তথ্য প্রদান করেননি। অর্থাৎ তিনি বড় অঙ্কের ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছেন।

রিপন মাহমুদ মূলত একজন স্টেট এজেন্ট যিনি সাইফুজ্জামানকে এই বিশাল সম্পদ কেনার ব্যাপারে সহযোগিতা করে গেছেন। তিনি সাইফুজ্জামানের মতো ধনী গ্রাহকদের সঙ্গে কাজ করেন। তিনি বলেন, আসলে আমার গ্রাহকরা এমনি, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা বিশ্বাস করেই টাকা বিনিয়োগ করেন।

আল-জাজিরার অনুসন্ধানী দলের সদস্যরাও নিজেদের ধনী বিদেশি বিনিয়োগকারী হিসেবেই অভিনয় করেছেন এবং রিপন মাহমুদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য নিয়েছেন। তারা জানান, চীন থেকে ১০ কোটি ডলার যুক্তরাজ্যের বাজারে স্থানান্তর করতে চান। এভাবেই তারা সাইফুজ্জামানের সম্পদের গোপন তথ্য বের করেন।

এ বিষয়ে বোঝানোর জন্য সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রসঙ্গ টেনে রিপন বলেন, আমার ভালো বন্ধু সাইফুজ্জামান। আপনি যেটা আমার কাছে চাচ্ছেন প্রায় ঠিক সেটাই আমি তার জন্য করেছি। সে সময় রিপনকে সাইফুজ্জামান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় যে তিনি কি দুবাইয়ের তিনি বলেন না, পরবর্তীতে জানতে চাওয়া হয় যে তাহলে কি তিনি চীনের তখনও তিনি বলেন না। উনিও কি বিদেশি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ তিনি বিদেশি এবং তিনি একজন মন্ত্রী, তিনি একজন ক্ষমতাধর মন্ত্রী। তিনি বুদ্ধিমান। তিনি বড় প্রকল্পে যান না। আপনি বুঝতে পারছেন আমি কী বলছি। যখন আপনি বড় প্রকল্পে যান, কর্তৃপক্ষ সতর্ক হয়ে যায়। বড় টাকা, বড় সংখ্যা সবাইকে সতর্ক করে দেয়। আপনি বুঝতেই পারছেন কী বলছি। তিনি এক কোটি আনেন এবং বলেন, আমি নগদে কিনিনি। ব্যাংক আমাকে এই টাকা দিয়েছে।

শুধু লন্ডনেই নয় যুক্তরাষ্ট্রেও সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পত্তি আছে। সেখানে তিনি নয়টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। পাঁচটি নিউইয়র্কের প্রধান এলাকায় এবং চারটি নদীর ওপারে নিউ জার্সিতে।

সাইফুজ্জামান নিজেই তার বিলাসী জীবনের গল্প বলেছেন। তিনি অনুসন্ধানী দলের এক সদস্যকে বলেন, আপনার জুতাটি আমার পছন্দ হয়েছে। ওই সদস্য তাকে জানান এটি টেইলর-মেডের জুতা। সেসময় তিনি জানান তারও টেইলর-মেডের জুতা পছন্দ। তিনি বলেন, আমি হেরডসেও কাস্টমস মেড (নির্দিষ্ট গ্রাহকের জন্য বিশেষভাবে তৈরি) জুতা অর্ডার করেছি। এটি তৈরি হতে চার মাস সময় লাগে। আমি কিনেছি প্রতিটি তিন হাজার পাউন্ডের বেশি দিয়ে।

সবাই এর দাম শুনে হতবাক হয়ে গেলে তিনি এই বিশেষ জুতা সম্পর্কে বলেন, এগুলো উটপাখি ও কুমিরের বুকের চামড়া দিয়ে তৈরি। সম্পূর্ণ বুকের চামড়া দিয়ে তৈরি জুতাগুলোর দাম ছয় হাজার পাউন্ড। আর অর্ধেক কুমিরের বুকের চামড়া ও বাছুরের চামড়ার অর্ধেক দিয়ে তৈরি জুতার দাম পড়ে তিন হাজার পাউন্ড। এটা খুবই ভালো। চার মাস লাগে তৈরি হতে।

প্রতিবার তিনি লন্ডনে গেলে দুই থেকে তিন হাজার পাউন্ড স্যুট কিনতে ব্যয় করেন বলেও জানান এই সাবেক ভূমিমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমি স্যুট পছন্দ করি। সুপার ২০০, সুপার ১৮০ এগুলোর দাম ছয় হাজার পাউন্ড। কেনালি বন্ড স্ট্রিটে গিয়ে তিনি শুধু কেনেন। এরপর তারাই বাসায় পৌঁছে দেয়।

তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, মন্ত্রী সাহেব আপনি এখানে এত টাকা কিভাবে বিনিয়োগ করলেন? তিনি বলেন, আমার দুবাইয়ে একটা ব্যবসা আছে। আমি দুবাই থেকে এখানে টাকা আনি। তারপর এখান থেকে একটা ঋণ নিই।

কয়েক দফা সাক্ষাতের পর রিপন স্বীকার করেন, তার সবচেয়ে বড় গ্রাহক সাইফুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে আসবেন বলেও জানান এবং তিনি বাংলাদেশের ভূমিমন্ত্রী সেটাও উল্লেখ করেন। রিপনই চার বছর আগে লন্ডনে সাইফুজ্জামানের জন্য সবকিছু ঠিক করেছেন। প্রতিবছর তিনি রিপনের মাধ্যমেই ১০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেন।

রিপনের মাধ্যমেই সাইফুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আল জাজিরার টিম। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ছাড়াও দুবাইয়ে তার সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। ২০২০ সালের মধ্যে সেখানে অন্তত ৫৪টি সম্পদের মালিক হয়েছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী।

back to top