সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। বিদ্রোহী যোদ্ধাদের রাজধানী দামেস্ক দখলের মুখে রোববার (৮ ডিসেম্বর) ব্যক্তিগত বিমানে তিনি দেশত্যাগ করেন। এরমধ্য দিয়ে পতন হলো সিরিয়ায় পিতা-পুত্রের ৫৪ বছরের স্বৈরশাসন। বিদ্রোহীরা বলছেন, বাশারের প্রধানমন্ত্রীর হাতেই থাকছে সিরিয়ার শাসনভার।
টানা ২৪ বছর ক্ষমতায় ছিলেন বাশার আল-আসাদ। এর আগে তার বাবা হাফিজ আল-আসাদ টানা ৩০ বছর সিরিয়া শাসন করেন। অবশেষে অবসান হলো পিতা-পুত্রের ৫৪ বছরের সিরিয়া শাসন। এতে নতুন রূপ নিতে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্য। সিরিয়ার এ নাটকীয় পট পরিবর্তনের ফলে সেখানে ক্ষমতায় বিপজ্জনক শূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত বিশৃঙ্খলা এবং আরও সহিংসতার জন্ম দেবে।
এর আগে, গত ৭ ডিসেম্বর শনিবার রাত থেকে দামেস্কের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ শুরু হলে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়। বিক্ষোভকারীরা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো দখলে নিতে থাকেন। ফলে রাজধানীর ওপর প্রায় নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে সরকার।
ইসলামিক সিরীয় সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) এক টেলিভিশন বিবৃতিতে জানায়, তারা দামেস্ক মুক্ত করেছে এবং প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের দুই যুগের ‘দুঃশাসনের’ অবসান ঘটিয়েছে। ‘স্বৈরশাসক’ বাশারকে উৎখাত করা হয়েছে বলেও তারা ঘোষণা দেয়।
দামেস্কের সেডনায়া কারাগার, যা শাসকগোষ্ঠীর নৃশংস নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত, সেখানে বিক্ষোভকারীরা অভিযান চালিয়ে সব বন্দীকে মুক্ত করে। বিরোধী বাহিনী ইতোমধ্যে আলেপ্পোর কেন্দ্রীয় অংশের বেশিরভাগ এলাকা এবং ইদলিব প্রদেশের পুরো অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। গত বৃহস্পতিবারের তীব্র সংঘর্ষের পর হামা শহরের কেন্দ্রীয় এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেয় তারা।
দক্ষিণ সিরিয়ার দারা প্রদেশের নিয়ন্ত্রণও গত শুক্রবার বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর হাতে আসে। সেদিনই তারা সুয়াইদা প্রদেশ দখল করে এবং স্থানীয় বাহিনী কুনেইত্রা প্রদেশের রাজধানীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। বিদ্রোহীরা বলছে, আসাদ সরকারের নিপীড়নের শিকার শত শত মানুষ যারা কারাবন্দী ও বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে ছিলেন তারা এখন নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরতে পারেন।
সিরিয়া বিভিন্ন শহর থেকে ইরান সমর্থিত লেবানেরর সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করেছে। এই পরিস্থিতিকে একজন বিশ্লেষক ‘৫৪ বছরের স্বৈরশাসনের চূড়ান্ত মুহূর্ত’ হিসেবে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির কাছে বর্ণনা করেছেন।
সিরীয় প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-জালালি জনগণের নির্বাচিত যেকোনো নেতৃত্বকে ‘সহযোগিতা’ করতে প্রস্তুত বলে এক ফেসইবুক পোস্টে জানান। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, এইচটিএসের নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জুলানি তার বাহিনীকে দামেস্কের সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে না যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যতক্ষণ না তাদের ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’ ক্ষমতা হস্তান্তর করা না হবে, ততক্ষণ তারা প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই থাকবে। ‘বাতাসে ফাঁকা গুলি ছোঁড়াও নিষিদ্ধ’।
গত কয়েক দিনে আলেপ্পো, হোমসসহ সিরিয়ার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের নিয়ন্ত্রণ নেন বিদ্রোহীরা। তারা ধীরে ধীরে দামেস্কের দিকে এগোতে থাকেন। শনিবার রাতে দামেস্কের উপকণ্ঠে পৌঁছে যান বিদ্রোহীরা। আর রোববার সকালে তারা দামেস্কে ঢুকে পড়েন।
তাদের প্রবেশ শুরুর ঘোষণার পরপর প্রেসিডেন্টের দেশ ছাড়ার খবর পাওয়া যায়, কিন্তু শুরুতে সে খবর অস্বীকার করা হয়েছিল। তবে বাশার চলে যাওয়ার পর বিমানবন্দর থেকে সরকারি বাহিনী সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে তিনি কোথায় আছেন, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। ফ্লাইটরাডার ২৪-এর তথ্যানুযায়ী, দামেস্ক থেকে ছাড়া ইলিউশিন ৭৫ উড়োজাহাজটি প্রথমে সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে উড়ে যায়। কিন্তু সেখান থেকে পরে ঘুরে (ইউটার্ন) উড়ে যেতে শুরু করে। কয়েক মিনিট পর সেটি অদৃশ্য হয়ে যায়। অদৃশ্য হওয়ার সময় উড়োজাহাজটি হোমসের ওপর ছিল। তবে উড়োজাহাজটিতে বাশার আল-আসাদ ছিলেন কি না, তা নিশ্চিত হতে পারেনি রয়টার্স।
শনিবার দামেস্ক থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে জেরমানা শহরতলির কেন্দ্রে থাকা বাশার আল-আসাদের বাবা হাফিজ আল-আসাদের একটি ভাস্কর্য ভেঙে ফেলেন বিক্ষুব্ধ জনতা। তাদের বেশিরভাগই আরেক শহরতলি দ্রুজের বাসিন্দা। রোববার জনতা দামেস্কে হাফিজের আরেকটি ভাস্কর্য ভেঙে ফেলেন। এই ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার ছবি প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
বাশার আল-আসাদের পলায়নের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর উল্লাসে ফেটে পড়েন জনতা। অনেকেই ঘর ছেড়ে নেমে আসেন রাস্তায়। সংবাদকর্মীদের দেখলেই উচ্ছাস প্রকাশ করে নিজেদের ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে অনুরোধ করছেন। তবে ভিন্ন চিত্রও দেখা গেছে দামেস্ক, হামা, আলেপ্পো ও হোমসে। অনেক বাসিন্দাদেরই শঙ্কিত দেখা গেছে, কারণ তারা চিন্তিত যে, আগামীতে কি ঘটতে যাচ্ছে।
বাশার আল-আসাদের প্রধানতম মিত্র রাশিয়া রোববার বিবৃতিতে তার দেশত্যাগের কথা জানিয়েছে। তবে বাশার কোন দেশে গেছেন বা কোথায় অবস্থান করছেন, সে বিষয়ে বিবৃতিতে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। বাশারের দেশ ছাড়ার বিষয়ে আলোচনায়ও রাশিয়া যুক্ত ছিল না।
প্রতিবেশী সিরিয়া ১৩ বছর ধরে যে শান্তি ও প্রশান্তি চেয়েছে তা যেন অর্জন করতে পারে সেই আশা ব্যক্ত করেছে তুরস্ক। শনিবার একে পার্টির প্রাদেশিক কংগ্রেসে ভাষণে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেব এরদোয়ান জোর দিয়ে বলেছেন, তুরস্কের ‘এমনকি কোনো দেশের নুড়ির দিকেও’ নজর নেই এবং ‘সিরিয়া শুধুই সিরীয়দের’। তুরস্ক বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়েছে এবং সিরিয়ার সীমান্তে প্রভাবশালী অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে।
জার্মানির শীর্ষ কূটনীতিক অ্যানালেনা বেয়ারবক সিরিয়ার নেতার পতনকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জনগণের জন্য ‘বড় স্বস্তি’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, বাশার ‘খুন, নির্যাতন ও তার নিজের জনগণের বিরুদ্ধে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করেছে’। তাকে এজন্য জবাবদিহি করতে হবে।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের পতনের খবরকে স্বাগত জানিয়েছে ফ্রান্স। এবং দেশটিতে যুদ্ধ শেষ করার আহ্বান জানিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘এখন সিরিয়ায় ঐক্যের সময় এসেছে’। এতে সিরিয়ার জন্য আগামীতে ‘চরমপন্থার’ বিরুদ্ধেও সতর্ক করা হয়েছে।
উত্তর ও পূর্ব সীমান্তে সেনাবাহিনীর শক্তিশালী ইউনিট মোতায়েন করেছে লেবানন। দেশটির সামরিক বাহিনী বলছে, সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। রোববার সব থেকে তাদের নিজ দেশের সীমান্তের দিকে লেবাননে সিরীয় উদ্বাস্তুদের আগমন ঘটেছে।
সিরিয়া বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত গেইর ও পেডারসেন বলেছেন, “সিরিয়ার ইতিহাসে আনন্দাশ্রুর মুহূর্ত’। দেশটি প্রায় ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধে অকথ্য অত্যাচার, নির্মমতা সহ্য করেছে। যা দাগ কেটেছে। অবশেষে আজ তার অবসান ঘটেছে। শান্তি, মর্যাদার নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে বলে আশা নিয়ে অপেক্ষা করছি।’
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সিরীয় প্রেসিডেন্টের পতনকে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য ‘ঐতিহাসিক দিন’ বলেছেন। তিনি ‘সম্ভাব্য হুমকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অফিসিয়াল এক্স অ্যাকাউন্টে নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘আসাদ সরকারের পতন সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। তবে সর্তক থাকতে হবে আগামীর পথ কণ্টকার্কীণ।’ সিরিয়ার সঙ্গে ‘শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক’ স্থাপনের ‘আকাক্সক্ষা’ প্রকাশ করেন তিনি।
বাশার আল-আসাতের পলায়নের মধ্যে দিয়ে সিরিয়ায় ৬১ বছরের বাথ পার্টি শাসনের অবসান ঘটেছে। ১৯৬৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টির শাসন শেষ হলো রাজধানী দামেস্কে বিরোধীবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে।
১৯৭০ সালে বাথ পার্টির অভ্যন্তরীণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন হাফেজ আল-আসাদ। ১৯৭১ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হন। তার মৃত্যুর পর ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট হন তার ছেলে বাশার আল-আসাদ।
বাশারও বাবার কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও দমনমূলক রাজনৈতিক কাঠামো বজায় রেখেছিলেন। যদিও ক্ষমতা গ্রহণের পর সিরিয়ার মানুষ আশা করেছিল তিনি আলাদা মনোভাবের হতে পারেন, ঠিক বাবার মতো নয়। হবেন অনেক বেশি খোলামেলা এবং কম নৃশংস। কিন্তু মানুষের সেই আশা ছিল স্বল্পস্থায়ী।
২০১১ সালে বিরোধীদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ নৃশংসভাবে দমন করার কারণে আসাদকে সিরিয়ার মানুষ চিরকাল মনে রাখবে। কারণ, এরপরই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই যুদ্ধে ৫ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এছাড়া আরও ৬০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে শরণার্থী হয়েছে।
সোমবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। বিদ্রোহী যোদ্ধাদের রাজধানী দামেস্ক দখলের মুখে রোববার (৮ ডিসেম্বর) ব্যক্তিগত বিমানে তিনি দেশত্যাগ করেন। এরমধ্য দিয়ে পতন হলো সিরিয়ায় পিতা-পুত্রের ৫৪ বছরের স্বৈরশাসন। বিদ্রোহীরা বলছেন, বাশারের প্রধানমন্ত্রীর হাতেই থাকছে সিরিয়ার শাসনভার।
টানা ২৪ বছর ক্ষমতায় ছিলেন বাশার আল-আসাদ। এর আগে তার বাবা হাফিজ আল-আসাদ টানা ৩০ বছর সিরিয়া শাসন করেন। অবশেষে অবসান হলো পিতা-পুত্রের ৫৪ বছরের সিরিয়া শাসন। এতে নতুন রূপ নিতে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্য। সিরিয়ার এ নাটকীয় পট পরিবর্তনের ফলে সেখানে ক্ষমতায় বিপজ্জনক শূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত বিশৃঙ্খলা এবং আরও সহিংসতার জন্ম দেবে।
এর আগে, গত ৭ ডিসেম্বর শনিবার রাত থেকে দামেস্কের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ শুরু হলে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়। বিক্ষোভকারীরা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো দখলে নিতে থাকেন। ফলে রাজধানীর ওপর প্রায় নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে সরকার।
ইসলামিক সিরীয় সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) এক টেলিভিশন বিবৃতিতে জানায়, তারা দামেস্ক মুক্ত করেছে এবং প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের দুই যুগের ‘দুঃশাসনের’ অবসান ঘটিয়েছে। ‘স্বৈরশাসক’ বাশারকে উৎখাত করা হয়েছে বলেও তারা ঘোষণা দেয়।
দামেস্কের সেডনায়া কারাগার, যা শাসকগোষ্ঠীর নৃশংস নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত, সেখানে বিক্ষোভকারীরা অভিযান চালিয়ে সব বন্দীকে মুক্ত করে। বিরোধী বাহিনী ইতোমধ্যে আলেপ্পোর কেন্দ্রীয় অংশের বেশিরভাগ এলাকা এবং ইদলিব প্রদেশের পুরো অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। গত বৃহস্পতিবারের তীব্র সংঘর্ষের পর হামা শহরের কেন্দ্রীয় এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেয় তারা।
দক্ষিণ সিরিয়ার দারা প্রদেশের নিয়ন্ত্রণও গত শুক্রবার বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর হাতে আসে। সেদিনই তারা সুয়াইদা প্রদেশ দখল করে এবং স্থানীয় বাহিনী কুনেইত্রা প্রদেশের রাজধানীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। বিদ্রোহীরা বলছে, আসাদ সরকারের নিপীড়নের শিকার শত শত মানুষ যারা কারাবন্দী ও বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে ছিলেন তারা এখন নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরতে পারেন।
সিরিয়া বিভিন্ন শহর থেকে ইরান সমর্থিত লেবানেরর সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করেছে। এই পরিস্থিতিকে একজন বিশ্লেষক ‘৫৪ বছরের স্বৈরশাসনের চূড়ান্ত মুহূর্ত’ হিসেবে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির কাছে বর্ণনা করেছেন।
সিরীয় প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-জালালি জনগণের নির্বাচিত যেকোনো নেতৃত্বকে ‘সহযোগিতা’ করতে প্রস্তুত বলে এক ফেসইবুক পোস্টে জানান। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, এইচটিএসের নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জুলানি তার বাহিনীকে দামেস্কের সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে না যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যতক্ষণ না তাদের ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’ ক্ষমতা হস্তান্তর করা না হবে, ততক্ষণ তারা প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই থাকবে। ‘বাতাসে ফাঁকা গুলি ছোঁড়াও নিষিদ্ধ’।
গত কয়েক দিনে আলেপ্পো, হোমসসহ সিরিয়ার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের নিয়ন্ত্রণ নেন বিদ্রোহীরা। তারা ধীরে ধীরে দামেস্কের দিকে এগোতে থাকেন। শনিবার রাতে দামেস্কের উপকণ্ঠে পৌঁছে যান বিদ্রোহীরা। আর রোববার সকালে তারা দামেস্কে ঢুকে পড়েন।
তাদের প্রবেশ শুরুর ঘোষণার পরপর প্রেসিডেন্টের দেশ ছাড়ার খবর পাওয়া যায়, কিন্তু শুরুতে সে খবর অস্বীকার করা হয়েছিল। তবে বাশার চলে যাওয়ার পর বিমানবন্দর থেকে সরকারি বাহিনী সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে তিনি কোথায় আছেন, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। ফ্লাইটরাডার ২৪-এর তথ্যানুযায়ী, দামেস্ক থেকে ছাড়া ইলিউশিন ৭৫ উড়োজাহাজটি প্রথমে সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে উড়ে যায়। কিন্তু সেখান থেকে পরে ঘুরে (ইউটার্ন) উড়ে যেতে শুরু করে। কয়েক মিনিট পর সেটি অদৃশ্য হয়ে যায়। অদৃশ্য হওয়ার সময় উড়োজাহাজটি হোমসের ওপর ছিল। তবে উড়োজাহাজটিতে বাশার আল-আসাদ ছিলেন কি না, তা নিশ্চিত হতে পারেনি রয়টার্স।
শনিবার দামেস্ক থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে জেরমানা শহরতলির কেন্দ্রে থাকা বাশার আল-আসাদের বাবা হাফিজ আল-আসাদের একটি ভাস্কর্য ভেঙে ফেলেন বিক্ষুব্ধ জনতা। তাদের বেশিরভাগই আরেক শহরতলি দ্রুজের বাসিন্দা। রোববার জনতা দামেস্কে হাফিজের আরেকটি ভাস্কর্য ভেঙে ফেলেন। এই ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার ছবি প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
বাশার আল-আসাদের পলায়নের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর উল্লাসে ফেটে পড়েন জনতা। অনেকেই ঘর ছেড়ে নেমে আসেন রাস্তায়। সংবাদকর্মীদের দেখলেই উচ্ছাস প্রকাশ করে নিজেদের ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে অনুরোধ করছেন। তবে ভিন্ন চিত্রও দেখা গেছে দামেস্ক, হামা, আলেপ্পো ও হোমসে। অনেক বাসিন্দাদেরই শঙ্কিত দেখা গেছে, কারণ তারা চিন্তিত যে, আগামীতে কি ঘটতে যাচ্ছে।
বাশার আল-আসাদের প্রধানতম মিত্র রাশিয়া রোববার বিবৃতিতে তার দেশত্যাগের কথা জানিয়েছে। তবে বাশার কোন দেশে গেছেন বা কোথায় অবস্থান করছেন, সে বিষয়ে বিবৃতিতে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। বাশারের দেশ ছাড়ার বিষয়ে আলোচনায়ও রাশিয়া যুক্ত ছিল না।
প্রতিবেশী সিরিয়া ১৩ বছর ধরে যে শান্তি ও প্রশান্তি চেয়েছে তা যেন অর্জন করতে পারে সেই আশা ব্যক্ত করেছে তুরস্ক। শনিবার একে পার্টির প্রাদেশিক কংগ্রেসে ভাষণে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেব এরদোয়ান জোর দিয়ে বলেছেন, তুরস্কের ‘এমনকি কোনো দেশের নুড়ির দিকেও’ নজর নেই এবং ‘সিরিয়া শুধুই সিরীয়দের’। তুরস্ক বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়েছে এবং সিরিয়ার সীমান্তে প্রভাবশালী অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে।
জার্মানির শীর্ষ কূটনীতিক অ্যানালেনা বেয়ারবক সিরিয়ার নেতার পতনকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জনগণের জন্য ‘বড় স্বস্তি’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, বাশার ‘খুন, নির্যাতন ও তার নিজের জনগণের বিরুদ্ধে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করেছে’। তাকে এজন্য জবাবদিহি করতে হবে।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের পতনের খবরকে স্বাগত জানিয়েছে ফ্রান্স। এবং দেশটিতে যুদ্ধ শেষ করার আহ্বান জানিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘এখন সিরিয়ায় ঐক্যের সময় এসেছে’। এতে সিরিয়ার জন্য আগামীতে ‘চরমপন্থার’ বিরুদ্ধেও সতর্ক করা হয়েছে।
উত্তর ও পূর্ব সীমান্তে সেনাবাহিনীর শক্তিশালী ইউনিট মোতায়েন করেছে লেবানন। দেশটির সামরিক বাহিনী বলছে, সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। রোববার সব থেকে তাদের নিজ দেশের সীমান্তের দিকে লেবাননে সিরীয় উদ্বাস্তুদের আগমন ঘটেছে।
সিরিয়া বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত গেইর ও পেডারসেন বলেছেন, “সিরিয়ার ইতিহাসে আনন্দাশ্রুর মুহূর্ত’। দেশটি প্রায় ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধে অকথ্য অত্যাচার, নির্মমতা সহ্য করেছে। যা দাগ কেটেছে। অবশেষে আজ তার অবসান ঘটেছে। শান্তি, মর্যাদার নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে বলে আশা নিয়ে অপেক্ষা করছি।’
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সিরীয় প্রেসিডেন্টের পতনকে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য ‘ঐতিহাসিক দিন’ বলেছেন। তিনি ‘সম্ভাব্য হুমকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অফিসিয়াল এক্স অ্যাকাউন্টে নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘আসাদ সরকারের পতন সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। তবে সর্তক থাকতে হবে আগামীর পথ কণ্টকার্কীণ।’ সিরিয়ার সঙ্গে ‘শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক’ স্থাপনের ‘আকাক্সক্ষা’ প্রকাশ করেন তিনি।
বাশার আল-আসাতের পলায়নের মধ্যে দিয়ে সিরিয়ায় ৬১ বছরের বাথ পার্টি শাসনের অবসান ঘটেছে। ১৯৬৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টির শাসন শেষ হলো রাজধানী দামেস্কে বিরোধীবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে।
১৯৭০ সালে বাথ পার্টির অভ্যন্তরীণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন হাফেজ আল-আসাদ। ১৯৭১ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হন। তার মৃত্যুর পর ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট হন তার ছেলে বাশার আল-আসাদ।
বাশারও বাবার কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও দমনমূলক রাজনৈতিক কাঠামো বজায় রেখেছিলেন। যদিও ক্ষমতা গ্রহণের পর সিরিয়ার মানুষ আশা করেছিল তিনি আলাদা মনোভাবের হতে পারেন, ঠিক বাবার মতো নয়। হবেন অনেক বেশি খোলামেলা এবং কম নৃশংস। কিন্তু মানুষের সেই আশা ছিল স্বল্পস্থায়ী।
২০১১ সালে বিরোধীদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ নৃশংসভাবে দমন করার কারণে আসাদকে সিরিয়ার মানুষ চিরকাল মনে রাখবে। কারণ, এরপরই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই যুদ্ধে ৫ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এছাড়া আরও ৬০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে শরণার্থী হয়েছে।