ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
কোনো বৈরী দেশকে শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। সেই কৌশলের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এতে ভুক্তভোগী হচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, পশ্চিমাদের একতরফা নিষেধাজ্ঞায় গত ৫৫ বছরে বিশ্বজুড়ে তিন কোটি ৮০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। খবর আল জাজিরার।
দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণাপত্রটিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ফ্রান্সিসকো রদ্রিগেজ। গবেষণাটিতে ১৯৭০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে সম্পর্কিত মোট মৃত্যুর সংখ্যা হিসাব করা হয়েছে।
সব লেখকের অনুমান অনুযায়ী, এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের একতরফা নিষেধাজ্ঞায় তিন কোটি ৮০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কেবল নব্বয়ের দশকের কয়েক বছরে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালেই নিষেধাজ্ঞার কারণে মৃত্যু হয়েছে আট লাখেরও বেশি মানুষের।
ফলাফল অনুসারে, প্রতিবছর যুদ্ধে সরাসরি নিহতদের তুলনায় নিষেধাজ্ঞার কারণে কয়েক গুণ বেশি মানুষ মারা যায়– যা গড়ে প্রতিবছর প্রায় এক কোটি। নিহতদের অর্ধেকেরও বেশি শিশু ও বৃদ্ধ, যারা অপুষ্টির জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু ২০১২ সাল থেকে নিষেধাজ্ঞার কারণে ১০ লাখেরও বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ১৯৭০-এর দশকে গড়ে প্রতিবছর পশ্চিমা বিশ্ব প্রায় ১৫টি দেশের ওপর একতরফা নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ তাদের নিষেধাজ্ঞার ব্যবহার নাটকীয়ভাবে বাড়িয়েছে। ১৯৯০ ও ২০০০ দশকের যে কোনো বছরে গড়ে ৩০টি দেশ পশ্চিমা একতরফা নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিল। আর এখন ২০২০-এর দশকে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ এরও বেশি।
এখন পর্যন্ত গবেষকরা সাধারণত একেকটি দেশের প্রেক্ষাপটে আলাদাভাবে নিষেধাজ্ঞার মানবিক প্রভাব বোঝার চেষ্টা করেছেন। এটি অত্যন্ত কঠিন কাজ এবং এতে সামগ্রিক চিত্র পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে, গবেষণায় একটা জিনিস স্পষ্ট যে নিষেধাজ্ঞার মানবিক খেসারত প্রায়ই ভয়াবহ হয়ে ওঠে। গবেষকরা প্রমাণ করেছেন, নব্বইয়ের দশকে ইরাকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দেশটিতে ব্যাপক অপুষ্টি, পানীয় জলের সংকট, ওষুধ ও বিদ্যুৎ ঘাটতি তৈরি করেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক যুদ্ধ দেশটিকে তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে ফেলে দিয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু ২০১৭-২০১৮ সালের মধ্যেই এসব নিষেধাজ্ঞার কারণে অতিরিক্ত ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আলজাজিরায় যৌথভাবে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক জেসন হিকেল, ম্যাকুয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব সোশ্যাল সায়েন্সের ফেলো ডিলান সুলিভান এবং ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির গবেষক ওমর তৈয়ব।
তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ বহুদিন ধরেই একতরফা নিষেধাজ্ঞাকে সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এর মাধ্যমে তারা অনুন্নত ও উন্নয়নশীল এমন সব দেশের সরকারকে শাস্তি দিতে চেয়েছে, যারা পশ্চিমা প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীন পথ খুঁজতে চেয়েছে। তাদের মতে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নির্ভর করে দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা (ডলার ও ইউরো), আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেম এবং স্যাটেলাইট, ক্লাউড কম্পিউটিং ও সফটওয়্যারের মতো অপরিহার্য প্রযুক্তির একচেটিয়া দখলের ওপর।
দেশগুলো যদি আরও স্বাধীন পথে হাঁটতে চায়, তবে তাদের নিজেদের বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। রাশিয়ার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, এমন একটি পথ বেছে নেওয়া সম্ভব এবং কার্যকরও হতে পারে। এরই মধ্যে বেশ কিছু দেশ এই পথে এগোচ্ছে। বিশেষ করে চীনে যে নতুন ব্যবস্থাগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলো এখন অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিকল্প হয়ে উঠছে। এগুলো পশ্চিমা-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসা এবং নিষেধাজ্ঞার ফাঁদ এড়িয়ে চলার একটি সম্ভাব্য পথ খুলে দিচ্ছে।
লেখকদের মতে, সার্বভৌম উন্নয়ন অর্জন করতে আগ্রহী দেশগুলোর জন্য এসব পদক্ষেপ দরকার এবং নৈতিক দিক থেকে বাধ্যবাধকতাও বটে। আমরা এমন এক বিশ্ব মেনে নিতে পারি না, যেখানে প্রতিবছর পশ্চিমা আধিপত্য বজায় রাখার জন্য পাঁচ লাখ মানুষের প্রাণ যায়। এ ধরনের সহিংসতার ওপর নির্ভরশীল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ভেঙে একটি ন্যায্য ও বিকল্প ব্যবস্থা প্রতিস্থাপন করতে হবে।
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
রোববার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
কোনো বৈরী দেশকে শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। সেই কৌশলের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এতে ভুক্তভোগী হচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, পশ্চিমাদের একতরফা নিষেধাজ্ঞায় গত ৫৫ বছরে বিশ্বজুড়ে তিন কোটি ৮০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। খবর আল জাজিরার।
দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণাপত্রটিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ফ্রান্সিসকো রদ্রিগেজ। গবেষণাটিতে ১৯৭০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে সম্পর্কিত মোট মৃত্যুর সংখ্যা হিসাব করা হয়েছে।
সব লেখকের অনুমান অনুযায়ী, এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের একতরফা নিষেধাজ্ঞায় তিন কোটি ৮০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কেবল নব্বয়ের দশকের কয়েক বছরে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালেই নিষেধাজ্ঞার কারণে মৃত্যু হয়েছে আট লাখেরও বেশি মানুষের।
ফলাফল অনুসারে, প্রতিবছর যুদ্ধে সরাসরি নিহতদের তুলনায় নিষেধাজ্ঞার কারণে কয়েক গুণ বেশি মানুষ মারা যায়– যা গড়ে প্রতিবছর প্রায় এক কোটি। নিহতদের অর্ধেকেরও বেশি শিশু ও বৃদ্ধ, যারা অপুষ্টির জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু ২০১২ সাল থেকে নিষেধাজ্ঞার কারণে ১০ লাখেরও বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ১৯৭০-এর দশকে গড়ে প্রতিবছর পশ্চিমা বিশ্ব প্রায় ১৫টি দেশের ওপর একতরফা নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ তাদের নিষেধাজ্ঞার ব্যবহার নাটকীয়ভাবে বাড়িয়েছে। ১৯৯০ ও ২০০০ দশকের যে কোনো বছরে গড়ে ৩০টি দেশ পশ্চিমা একতরফা নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিল। আর এখন ২০২০-এর দশকে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ এরও বেশি।
এখন পর্যন্ত গবেষকরা সাধারণত একেকটি দেশের প্রেক্ষাপটে আলাদাভাবে নিষেধাজ্ঞার মানবিক প্রভাব বোঝার চেষ্টা করেছেন। এটি অত্যন্ত কঠিন কাজ এবং এতে সামগ্রিক চিত্র পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে, গবেষণায় একটা জিনিস স্পষ্ট যে নিষেধাজ্ঞার মানবিক খেসারত প্রায়ই ভয়াবহ হয়ে ওঠে। গবেষকরা প্রমাণ করেছেন, নব্বইয়ের দশকে ইরাকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দেশটিতে ব্যাপক অপুষ্টি, পানীয় জলের সংকট, ওষুধ ও বিদ্যুৎ ঘাটতি তৈরি করেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক যুদ্ধ দেশটিকে তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে ফেলে দিয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু ২০১৭-২০১৮ সালের মধ্যেই এসব নিষেধাজ্ঞার কারণে অতিরিক্ত ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আলজাজিরায় যৌথভাবে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক জেসন হিকেল, ম্যাকুয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব সোশ্যাল সায়েন্সের ফেলো ডিলান সুলিভান এবং ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির গবেষক ওমর তৈয়ব।
তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ বহুদিন ধরেই একতরফা নিষেধাজ্ঞাকে সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এর মাধ্যমে তারা অনুন্নত ও উন্নয়নশীল এমন সব দেশের সরকারকে শাস্তি দিতে চেয়েছে, যারা পশ্চিমা প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীন পথ খুঁজতে চেয়েছে। তাদের মতে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নির্ভর করে দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা (ডলার ও ইউরো), আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেম এবং স্যাটেলাইট, ক্লাউড কম্পিউটিং ও সফটওয়্যারের মতো অপরিহার্য প্রযুক্তির একচেটিয়া দখলের ওপর।
দেশগুলো যদি আরও স্বাধীন পথে হাঁটতে চায়, তবে তাদের নিজেদের বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। রাশিয়ার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, এমন একটি পথ বেছে নেওয়া সম্ভব এবং কার্যকরও হতে পারে। এরই মধ্যে বেশ কিছু দেশ এই পথে এগোচ্ছে। বিশেষ করে চীনে যে নতুন ব্যবস্থাগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলো এখন অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিকল্প হয়ে উঠছে। এগুলো পশ্চিমা-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসা এবং নিষেধাজ্ঞার ফাঁদ এড়িয়ে চলার একটি সম্ভাব্য পথ খুলে দিচ্ছে।
লেখকদের মতে, সার্বভৌম উন্নয়ন অর্জন করতে আগ্রহী দেশগুলোর জন্য এসব পদক্ষেপ দরকার এবং নৈতিক দিক থেকে বাধ্যবাধকতাও বটে। আমরা এমন এক বিশ্ব মেনে নিতে পারি না, যেখানে প্রতিবছর পশ্চিমা আধিপত্য বজায় রাখার জন্য পাঁচ লাখ মানুষের প্রাণ যায়। এ ধরনের সহিংসতার ওপর নির্ভরশীল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ভেঙে একটি ন্যায্য ও বিকল্প ব্যবস্থা প্রতিস্থাপন করতে হবে।