নেপালে জেল ভেঙে পালাচ্ছে বন্দীরা
তরুণদের টানা দুই দিনের বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি। নেপালের সচিবালয় থেকে মঙ্গলবার,(০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫) বিকেলে এক বিবৃতিতে এ খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে তার পদত্যাগের পরও বিভিন্ন সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
বিক্ষোভ-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ
হেলিকপ্টারে সরিয়ে নেয়া হয় মন্ত্রীদের
অর্থমন্ত্রীকে সড়কে ধাওয়া, পিটুনি
ত্রিভুবন বিমানবন্দর অচল
নেপালি কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে গত বছরের জুলাইয়ে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন কমিউনিস্ট নেতা কে পি শর্ম ওলি। এরআগে ২০১৫-১৬, ২০১৮-২১ ও পরে ২০২১ সালে একবার সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি।
দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের পর নেপালেও প্রবল গণবিক্ষোভে সরকার পতনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। তাদের হাতে ছিল জাতীয় পতাকা। বের হয় মোটর শোভাযাত্রা। অনেকে রং ছিটিয়ে আনন্দ করেন। পার্লামেন্ট ভবনের চারপাশে মটরবাইক চক্কর দিতে দেখা গেছে। কেউ কেউ বাগান থেকে তুলে নেয়া গাছ বহন করছিল এবং ভবনের ভেতরে থাকা চিত্রকর্ম তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। পার্লামেন্ট ভবনের প্রবেশপথের চারপাশে বিক্ষোভকারীদের নাচতে এবং স্লোগান দিতেও দেখা গেছে। ভবনের ভেতরে ঢুকে আছে অনেকেই। ভবনের সব জানালাই ভেঙে ফেলেছে বিক্ষুব্ধ জনতা।
গ্রাফিতি এবং সরকারবিরোধী বক্তব্য স্প্রে করে লেখা হয়েছে পার্লামেন্ট ভবনের বাইরের দেয়ালে। পার্লামেন্টে ভবনের বাইরে বিক্ষোভে জড়ো হওয়াদের একজন বলেন, নেপালে অনেক দিন থেকেই পরিবর্তন দরকার ছিল। দুর্নীতি অনেকদিন ধরেই একটি বিষয় হয়ে ছিল। ক্ষমতায় পরিবর্তনের জন্য চূড়ান্ত সময় ঘনিয়ে এসেছিল। সেটি এখন ঘটেছে। আমরা এর জন্য লড়তে পেরে এবং এটি ঘটতে দেখে খুবই খুশি।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং সরকারের মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গতকাল সোমবার নেপালের রাজপথে নেমে আসেন কয়েক হাজার মানুষ। বিক্ষোভকারীদের বেশিরভাগই বয়সে তরুণ বা জেন-জি প্রজন্মের। রাজধানী কাঠমান্ডুসহ দেশটির অন্তত সাতটি শহরে এদিন ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভ দমনে কঠোর হন অলি সরকার। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে অন্তত ১৯ জন নিহত হন।
বিক্ষোভ দমনে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের অভিযোগ ওঠে সরকারের বিরুদ্ধে। এমনকি সরকারের একাধিক মন্ত্রী এ অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করেন।
মঙ্গলবার ভোর থেকে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভকারীরা আবার জড়ো হতে শুরু করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সকালে কাঠমান্ডুসহ কয়েকটি এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়। কিন্তু সেই কারফিউ তরুণদের মিছিল থামাতে পারেনি। এদিনও দুজন নিহত হওয়ার খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে।
প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলিকে অনুসরণ করে প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পুডেলও পদত্যাগ করতে পারেন বলে একাধিক সূত্রের বরাতে জানিয়েছে ভারতের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি। নেপালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী প্রধান আর রাষ্ট্রপতি সরকার প্রধান। রাষ্ট্রপতি পদত্যাগেই সরকারের পতন ঘটবে। পরিস্থিতি সে দিকেই যাচ্ছে বলে সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে।
বিক্ষোভ-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ
মঙ্গলবার সকালে কারফিউ উপেক্ষা করে কাঠমান্ডুতে নেপালের পার্লামেন্ট ভবন এলাকায় জড়ো হতে শুরু করেন বিক্ষোভকারীরা। তারা সর্বশেষ প্রেসিডেন্টের কার্যালয় শীতল নিবাসে আগুন দেন। ভোরে বিক্ষোভকারীরা মিছিল করে ভক্তপুরের বালকোট এলাকায় প্রধানমন্ত্রী অলির ব্যক্তিগত বাসভবনের দিকে রওনা দেন। পথে পুলিশ তাদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা পিছু হটতে অস্বীকৃতি জানান এবং বাধা উপেক্ষা করে সামনে অগ্রসর হন। শেষ পর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা অলির বাসভবন প্রাঙ্গণে ঢুকে দুটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন।
জেন-জি বিক্ষোভকারীরা ক্ষমতাসীন জোটের শরিক নেপালি কংগ্রেস পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। এছাড়া রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্যান্য মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতার বাড়ি ও প্রধান প্রধান দলীয় কার্যালয়েও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
ললিতপুরে তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী পৃথ্বী সুব্বা গুরুংয়ের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। উপ-প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বিষ্ণু পাউডেলের ভৈসেপাতির বাড়িতে ইটপাটকেল ছোড়া হয়। পদত্যাগ করা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখকের বাড়িতেও হামলা চালান বিক্ষোভকারীরা।
স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, বিভিন্ন এলাকায় মুখ্যমন্ত্রী, প্রাদেশিক মন্ত্রীসহ আরও অনেক নেতার বাড়িঘর বিক্ষোভকারীদের হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও নেপালি কংগ্রেসের প্রধান শের বাহাদুর দেউবার বুধানিলকণ্ঠার বাড়ির দিকে বিক্ষোভকারীরা এগোনোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাদের আটকে দেয়। বিরোধী দলের প্রধান ও সিপিএন (মাওবাদী কেন্দ্র) চেয়ারম্যান পুষ্প কমল দহলের খুমলতার এলাকার বাসভবনেও আজ ইটপাটকেল ছোড়া হয়।
হেলিকপ্টারে সরিয়ে নেয়া হয় মন্ত্রীদের
বিভিন্ন জায়গায় মন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বাসভবন ও দলীয় কার্যালয়ে বিক্ষোভকারীদের হামলার জেরে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করলে মঙ্গলবার সেনা হেলিকপ্টারে করে ভৈসেপাতিতে মন্ত্রীদের বাসভবন থেকে তাদের সরিয়ে নেয়া হয়।
জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের বলেছেন, পার্লামেন্ট ভবনের নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সামরিক ব্যারাকে নিরাপত্তা প্রদান করা হচ্ছে।
দুই মন্ত্রীর পদত্যাগ
আগের দিন বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সরকারের আচরণ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে মঙ্গলবার সকালে প্রথমে পদত্যাগের ঘোষণা দেন নেপালের কৃষি ও পশুপালনমন্ত্রী রাম নাথ আধিকারী। পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে রাম নাথ আধিকারী বিবিসি নেপালিকে বলেন, ‘গণতন্ত্রে প্রশ্ন করা ও শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করা নাগরিকদের সাধারণ অধিকার। অথচ আমরা দমন, হত্যাকাণ্ড আর বল প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র নয় বরং স্বৈরশাসনের দিকে এগোচ্ছি; এটি জেনে আমি হতবাক হয়েছি। যে প্রজন্মের দেশ গড়ার কাজে সহযোগিতা করার কথা, তাদের যুদ্ধের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে; এটি আমি মেনে নিতে পারিনি। এর সমাধান না খুঁজে পদে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।’
রাম নাথ আধিকারীর পর পদত্যাগপত্র জমা দেন নেপালের পানি সরবরাহমন্ত্রী প্রদীপ যাদব। পদত্যাগপত্রে প্রদীপ লেখেন, সরকারের দমনমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে জেন-জি তরুণদের প্রতি তিনি সমর্থন জানাচ্ছেন। এ সাবেক মন্ত্রী লেখেন, ‘প্রিয় তরুণ ভাই-বোনেরা, আপনারাই আমার প্রথম সহযাত্রী এবং শক্তির উৎস। আমি সবার প্রতি শান্ত থাকার এবং তরুণদের সঠিক পথে পরিচালিত হতে সহায়তা করার আহ্বান জানাই।’
এর আগে বিক্ষোভ চলাকালে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের কারণে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে মঙ্গলবার পদত্যাগ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক।
নেপালের অর্থমন্ত্রীকে সড়কে ধাওয়া, পিটুনি
বিক্ষোভকারীরা অর্থমন্ত্রী বিষ্ণু প্রসাদ পুডেলকে রাস্তায় ধাওয়া দিয়েছে। তিনি পালিয়ে যাওয়ার সময় বিক্ষোভকারীরা তাকে পিটুনি দেয়। পুডেলকে মারধর করার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, ৬৫ বছর বয়সী পুডেল কাঠমান্ডুর সড়ক দিয়ে দৌড়াচ্ছেন। তাকে পেছন থেকে তাড়া করছেন বেশ কয়েকজন। এর মধ্যে সামনে থেকে এক বিক্ষোভকারী লাফ দিয়ে এসে তাকে লাথি মারেন। এতে তিনি ভারসাম্য হারিয়ে পাশের একটি দেয়ালে ধাক্কা খান।
আগুনে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীর মৃত্যু
বিক্ষোভকারীদের দেয়া আগুনে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঝালানাথ কানালের স্ত্রীর মৃত্যুর খবর দিয়েছে একাধিক সংবাদমাধ্যম। মঙ্গলবার রাজধানী কাঠমান্ডুর দালু এলাকায় ঝালানাথ কানালের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন জেন-জি বিক্ষোভকারীরা। এতে দগ্ধ হন তার স্ত্রী রাজিয়ালাক্সমি চিত্রকর। হাসপাতালে নেয়ার পর তার মৃত্যু হয়।
ত্রিভুবন বিমানবন্দর অচল
নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়। এ ঘটনায় যাত্রীদের সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
ত্রিভুবন বিমানবন্দরের (টিআইএ) মহাব্যবস্থাপক হংস রাজ পাণ্ডে বলেন, বেলা ১২টা ৪৫ মিনিটের পর থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে। এর আগে কোটেশ্বর এলাকার কাছে ধোঁয়া দেখা যায়। চলাচল সমস্যার কারণে বিমানকর্মীরা সময়মতো বিমানবন্দরে পৌঁছাতে পারেননি। ফলে কোনো ফ্লাইট ছাড়তে পারেনি। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে দেশীয় বিমান সংস্থাগুলো সব ফ্লাইট স্থগিত করেছে। এর মধ্যে বুদ্ধ এয়ারও রয়েছে।
গত সপ্তাহে ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইন, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, এক্সসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম ও বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল অলির নেতৃত্বে থাকা নেপাল সরকার। নতুন নিয়মনীতি মেনে চলতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ দেখিয়ে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। তবে নিয়ম মানায় টিকটকসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান বিধিনিষেধের আওতার বাইরে ছিল। সরকারের এ নিষেধাজ্ঞার ফলে নেপালের ব্যবসা ও পর্যটন খাত মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে। প্রবাসে থাকা স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায় নাগরিকদের।
নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে গতকাল সোমবার রাজপথে নেমে বিক্ষোভ করেন নেপালের কয়েক হাজার মানুষ। কাঠমান্ডুসহ দেশটির অন্তত সাতটি শহরে এদিন ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভকারীরা একপর্যায়ে পুলিশের প্রতিবন্ধকতা ভেঙে পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকে পড়েন। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও জলকামান ব্যবহার করে পুলিশ। একপর্যায়ে গুলিও চালানো হয়।
বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে মঙ্গলবার অন্তত ১৯ জন নিহত এবং প্রায় ৪০০ মানুষ আহত হন। সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয় কাঠমান্ডুতে, সেখানে ১৭ জন নিহত হন। কাঠমান্ডুর বাইরে পোখারা, ভুটওয়াল, ভাইরাহাওয়া, ভরতপুর, ইতাহারি ও দামাক শহরে বিক্ষোভ করেছেন তরুণেরা।
তরুণদের বিক্ষোভের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। মঙ্গলবার সকালে নেপালের মন্ত্রিসভার মুখপাত্র এবং যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী পৃথিবী শুব্বা গুরুং নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার খবর জানান। কিন্তু তাতেও বিক্ষোভ থামেনি।
নেপালে জেল ভেঙে পালাচ্ছে বন্দীরা
মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
তরুণদের টানা দুই দিনের বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি। নেপালের সচিবালয় থেকে মঙ্গলবার,(০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫) বিকেলে এক বিবৃতিতে এ খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে তার পদত্যাগের পরও বিভিন্ন সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
বিক্ষোভ-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ
হেলিকপ্টারে সরিয়ে নেয়া হয় মন্ত্রীদের
অর্থমন্ত্রীকে সড়কে ধাওয়া, পিটুনি
ত্রিভুবন বিমানবন্দর অচল
নেপালি কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে গত বছরের জুলাইয়ে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন কমিউনিস্ট নেতা কে পি শর্ম ওলি। এরআগে ২০১৫-১৬, ২০১৮-২১ ও পরে ২০২১ সালে একবার সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি।
দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের পর নেপালেও প্রবল গণবিক্ষোভে সরকার পতনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। তাদের হাতে ছিল জাতীয় পতাকা। বের হয় মোটর শোভাযাত্রা। অনেকে রং ছিটিয়ে আনন্দ করেন। পার্লামেন্ট ভবনের চারপাশে মটরবাইক চক্কর দিতে দেখা গেছে। কেউ কেউ বাগান থেকে তুলে নেয়া গাছ বহন করছিল এবং ভবনের ভেতরে থাকা চিত্রকর্ম তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। পার্লামেন্ট ভবনের প্রবেশপথের চারপাশে বিক্ষোভকারীদের নাচতে এবং স্লোগান দিতেও দেখা গেছে। ভবনের ভেতরে ঢুকে আছে অনেকেই। ভবনের সব জানালাই ভেঙে ফেলেছে বিক্ষুব্ধ জনতা।
গ্রাফিতি এবং সরকারবিরোধী বক্তব্য স্প্রে করে লেখা হয়েছে পার্লামেন্ট ভবনের বাইরের দেয়ালে। পার্লামেন্টে ভবনের বাইরে বিক্ষোভে জড়ো হওয়াদের একজন বলেন, নেপালে অনেক দিন থেকেই পরিবর্তন দরকার ছিল। দুর্নীতি অনেকদিন ধরেই একটি বিষয় হয়ে ছিল। ক্ষমতায় পরিবর্তনের জন্য চূড়ান্ত সময় ঘনিয়ে এসেছিল। সেটি এখন ঘটেছে। আমরা এর জন্য লড়তে পেরে এবং এটি ঘটতে দেখে খুবই খুশি।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং সরকারের মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গতকাল সোমবার নেপালের রাজপথে নেমে আসেন কয়েক হাজার মানুষ। বিক্ষোভকারীদের বেশিরভাগই বয়সে তরুণ বা জেন-জি প্রজন্মের। রাজধানী কাঠমান্ডুসহ দেশটির অন্তত সাতটি শহরে এদিন ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভ দমনে কঠোর হন অলি সরকার। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে অন্তত ১৯ জন নিহত হন।
বিক্ষোভ দমনে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের অভিযোগ ওঠে সরকারের বিরুদ্ধে। এমনকি সরকারের একাধিক মন্ত্রী এ অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করেন।
মঙ্গলবার ভোর থেকে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভকারীরা আবার জড়ো হতে শুরু করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সকালে কাঠমান্ডুসহ কয়েকটি এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়। কিন্তু সেই কারফিউ তরুণদের মিছিল থামাতে পারেনি। এদিনও দুজন নিহত হওয়ার খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে।
প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলিকে অনুসরণ করে প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পুডেলও পদত্যাগ করতে পারেন বলে একাধিক সূত্রের বরাতে জানিয়েছে ভারতের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি। নেপালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী প্রধান আর রাষ্ট্রপতি সরকার প্রধান। রাষ্ট্রপতি পদত্যাগেই সরকারের পতন ঘটবে। পরিস্থিতি সে দিকেই যাচ্ছে বলে সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে।
বিক্ষোভ-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ
মঙ্গলবার সকালে কারফিউ উপেক্ষা করে কাঠমান্ডুতে নেপালের পার্লামেন্ট ভবন এলাকায় জড়ো হতে শুরু করেন বিক্ষোভকারীরা। তারা সর্বশেষ প্রেসিডেন্টের কার্যালয় শীতল নিবাসে আগুন দেন। ভোরে বিক্ষোভকারীরা মিছিল করে ভক্তপুরের বালকোট এলাকায় প্রধানমন্ত্রী অলির ব্যক্তিগত বাসভবনের দিকে রওনা দেন। পথে পুলিশ তাদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা পিছু হটতে অস্বীকৃতি জানান এবং বাধা উপেক্ষা করে সামনে অগ্রসর হন। শেষ পর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা অলির বাসভবন প্রাঙ্গণে ঢুকে দুটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন।
জেন-জি বিক্ষোভকারীরা ক্ষমতাসীন জোটের শরিক নেপালি কংগ্রেস পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। এছাড়া রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্যান্য মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতার বাড়ি ও প্রধান প্রধান দলীয় কার্যালয়েও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
ললিতপুরে তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী পৃথ্বী সুব্বা গুরুংয়ের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। উপ-প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বিষ্ণু পাউডেলের ভৈসেপাতির বাড়িতে ইটপাটকেল ছোড়া হয়। পদত্যাগ করা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখকের বাড়িতেও হামলা চালান বিক্ষোভকারীরা।
স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, বিভিন্ন এলাকায় মুখ্যমন্ত্রী, প্রাদেশিক মন্ত্রীসহ আরও অনেক নেতার বাড়িঘর বিক্ষোভকারীদের হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও নেপালি কংগ্রেসের প্রধান শের বাহাদুর দেউবার বুধানিলকণ্ঠার বাড়ির দিকে বিক্ষোভকারীরা এগোনোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাদের আটকে দেয়। বিরোধী দলের প্রধান ও সিপিএন (মাওবাদী কেন্দ্র) চেয়ারম্যান পুষ্প কমল দহলের খুমলতার এলাকার বাসভবনেও আজ ইটপাটকেল ছোড়া হয়।
হেলিকপ্টারে সরিয়ে নেয়া হয় মন্ত্রীদের
বিভিন্ন জায়গায় মন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বাসভবন ও দলীয় কার্যালয়ে বিক্ষোভকারীদের হামলার জেরে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করলে মঙ্গলবার সেনা হেলিকপ্টারে করে ভৈসেপাতিতে মন্ত্রীদের বাসভবন থেকে তাদের সরিয়ে নেয়া হয়।
জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের বলেছেন, পার্লামেন্ট ভবনের নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সামরিক ব্যারাকে নিরাপত্তা প্রদান করা হচ্ছে।
দুই মন্ত্রীর পদত্যাগ
আগের দিন বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সরকারের আচরণ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে মঙ্গলবার সকালে প্রথমে পদত্যাগের ঘোষণা দেন নেপালের কৃষি ও পশুপালনমন্ত্রী রাম নাথ আধিকারী। পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে রাম নাথ আধিকারী বিবিসি নেপালিকে বলেন, ‘গণতন্ত্রে প্রশ্ন করা ও শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করা নাগরিকদের সাধারণ অধিকার। অথচ আমরা দমন, হত্যাকাণ্ড আর বল প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র নয় বরং স্বৈরশাসনের দিকে এগোচ্ছি; এটি জেনে আমি হতবাক হয়েছি। যে প্রজন্মের দেশ গড়ার কাজে সহযোগিতা করার কথা, তাদের যুদ্ধের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে; এটি আমি মেনে নিতে পারিনি। এর সমাধান না খুঁজে পদে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।’
রাম নাথ আধিকারীর পর পদত্যাগপত্র জমা দেন নেপালের পানি সরবরাহমন্ত্রী প্রদীপ যাদব। পদত্যাগপত্রে প্রদীপ লেখেন, সরকারের দমনমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে জেন-জি তরুণদের প্রতি তিনি সমর্থন জানাচ্ছেন। এ সাবেক মন্ত্রী লেখেন, ‘প্রিয় তরুণ ভাই-বোনেরা, আপনারাই আমার প্রথম সহযাত্রী এবং শক্তির উৎস। আমি সবার প্রতি শান্ত থাকার এবং তরুণদের সঠিক পথে পরিচালিত হতে সহায়তা করার আহ্বান জানাই।’
এর আগে বিক্ষোভ চলাকালে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের কারণে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে মঙ্গলবার পদত্যাগ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক।
নেপালের অর্থমন্ত্রীকে সড়কে ধাওয়া, পিটুনি
বিক্ষোভকারীরা অর্থমন্ত্রী বিষ্ণু প্রসাদ পুডেলকে রাস্তায় ধাওয়া দিয়েছে। তিনি পালিয়ে যাওয়ার সময় বিক্ষোভকারীরা তাকে পিটুনি দেয়। পুডেলকে মারধর করার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, ৬৫ বছর বয়সী পুডেল কাঠমান্ডুর সড়ক দিয়ে দৌড়াচ্ছেন। তাকে পেছন থেকে তাড়া করছেন বেশ কয়েকজন। এর মধ্যে সামনে থেকে এক বিক্ষোভকারী লাফ দিয়ে এসে তাকে লাথি মারেন। এতে তিনি ভারসাম্য হারিয়ে পাশের একটি দেয়ালে ধাক্কা খান।
আগুনে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীর মৃত্যু
বিক্ষোভকারীদের দেয়া আগুনে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঝালানাথ কানালের স্ত্রীর মৃত্যুর খবর দিয়েছে একাধিক সংবাদমাধ্যম। মঙ্গলবার রাজধানী কাঠমান্ডুর দালু এলাকায় ঝালানাথ কানালের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন জেন-জি বিক্ষোভকারীরা। এতে দগ্ধ হন তার স্ত্রী রাজিয়ালাক্সমি চিত্রকর। হাসপাতালে নেয়ার পর তার মৃত্যু হয়।
ত্রিভুবন বিমানবন্দর অচল
নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়। এ ঘটনায় যাত্রীদের সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
ত্রিভুবন বিমানবন্দরের (টিআইএ) মহাব্যবস্থাপক হংস রাজ পাণ্ডে বলেন, বেলা ১২টা ৪৫ মিনিটের পর থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে। এর আগে কোটেশ্বর এলাকার কাছে ধোঁয়া দেখা যায়। চলাচল সমস্যার কারণে বিমানকর্মীরা সময়মতো বিমানবন্দরে পৌঁছাতে পারেননি। ফলে কোনো ফ্লাইট ছাড়তে পারেনি। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে দেশীয় বিমান সংস্থাগুলো সব ফ্লাইট স্থগিত করেছে। এর মধ্যে বুদ্ধ এয়ারও রয়েছে।
গত সপ্তাহে ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইন, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, এক্সসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম ও বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল অলির নেতৃত্বে থাকা নেপাল সরকার। নতুন নিয়মনীতি মেনে চলতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ দেখিয়ে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। তবে নিয়ম মানায় টিকটকসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান বিধিনিষেধের আওতার বাইরে ছিল। সরকারের এ নিষেধাজ্ঞার ফলে নেপালের ব্যবসা ও পর্যটন খাত মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে। প্রবাসে থাকা স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায় নাগরিকদের।
নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে গতকাল সোমবার রাজপথে নেমে বিক্ষোভ করেন নেপালের কয়েক হাজার মানুষ। কাঠমান্ডুসহ দেশটির অন্তত সাতটি শহরে এদিন ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভকারীরা একপর্যায়ে পুলিশের প্রতিবন্ধকতা ভেঙে পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকে পড়েন। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও জলকামান ব্যবহার করে পুলিশ। একপর্যায়ে গুলিও চালানো হয়।
বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে মঙ্গলবার অন্তত ১৯ জন নিহত এবং প্রায় ৪০০ মানুষ আহত হন। সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয় কাঠমান্ডুতে, সেখানে ১৭ জন নিহত হন। কাঠমান্ডুর বাইরে পোখারা, ভুটওয়াল, ভাইরাহাওয়া, ভরতপুর, ইতাহারি ও দামাক শহরে বিক্ষোভ করেছেন তরুণেরা।
তরুণদের বিক্ষোভের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। মঙ্গলবার সকালে নেপালের মন্ত্রিসভার মুখপাত্র এবং যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী পৃথিবী শুব্বা গুরুং নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার খবর জানান। কিন্তু তাতেও বিক্ষোভ থামেনি।