গাজায় ক্ষুধার্ত প্যালেস্টাইনিদের একটি ত্রাণ শিবির
গাজায় মানবিক ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোর সশস্ত্র নিরাপত্তায় নিয়োজিত সংস্থাটি এমন একটি মার্কিন বাইকার গ্যাংয়ের সদস্যদের কাজে লাগাচ্ছে, যাদের চরম ইসলাম বিদ্বেষের ইতিহাস আছে। বিবিসির এক নিজস্ব তদন্তে এ তথ্য উঠে এসেছে।
গাজার হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন সাইটগুলোতে খাবারের সন্ধানে শত শত বেসামরিক মানুষ সম্প্রতি বিশৃঙ্খলা আর গোলাগুলির মধ্যে পড়ে নিহত হয়েছেন। এই সাইটগুলোতে নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে ‘ইউজি সলিউশনস’ নামে একটি বেসরকারি ঠিকাদার সংস্থা।
এই সংস্থার হয়ে গাজাতে কাজ করছেন, ‘ইনফিডেলস মোটরসাইকেল ক্লাবে’র এমন দশজন সদস্যের পরিচয় বিবিসি নিউজ নিশ্চিত হয়েছে।
বিবিসি বলছে, ইসরায়েল ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থিত এই বিতর্কিত ত্রাণ অভিযানের সাইটগুলোর তদারকিতে এই গ্যাং-এর অন্তত সাতজন সদস্য শীর্ষ পদে নিযুক্ত আছেন।
ইউজি সলিউশনস (ইউজিএস) অবশ্য এই কাজের জন্য নিযুক্ত তাদের কর্মীদের যোগ্য বলেই মনে করছে।
তারা বলেছে, ‘কারও ব্যক্তিগত শখ বা হবি কিংবা কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন কিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকার ভিত্তিতে’ তারা কর্মীদের ছাঁটাই করে না।
গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) দাবি করছে, যে কোনো ধরনের বিদ্বেষমূলক বা বৈষম্যমূলক আচরণ বা পক্ষপাতের প্রতি তাদের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি রয়েছে।
ইরাক যুদ্ধে লড়েছিলেন, এমন কয়েকজন মার্কিন সাবেক সেনা ২০০৬ সালে ‘ইনফিডেলস মোটরসাইকেল ক্লাব’ বা ‘ইনফিডেলস এমসি’ গড়ে তোলেন, যে ক্লাবের সদস্যরা নিজেদের ‘ক্রুসেডার’ বা ধর্মযোদ্ধা বলে মনে করেন এবং ‘ক্রুসেডার ক্রস’কে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেন।
মধ্যযুগে যে খ্রিষ্টান ধর্মযোদ্ধারা জেরুজালেম দখল করার জন্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, ‘ক্রস’কে সেই ক্রুসেডারদের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়।
এখনও এই গ্যাংটি তাদের ফেইসবুক পেইজে বিভিন্ন মুসলিম বিরোধী ‘হেইট স্পিচ’ হোস্ট করছে। এর আগে তারা মুসলিমদের পবিত্র রমজান মাসকে হেয় করতে শূকর রোস্ট করার ইভেন্টও আয়োজন করেছিল।
আমেরিকায় ‘সিএআইআর’ (কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস) নামে একটি মুসলিম সিভিল রাইটস গোষ্ঠীর সহকারী পরিচালক এডওয়ার্ড আহমেদ মিচেল বলেন, “ইনফিডেলস বাইকার ক্লাবকে গাজায় মানবিক ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব দেয়া আর সুদানে কেকেকে-কে মানবিক ত্রাণ বিলি করতে দেয়া আসলে একই জিনিস।” তিনি বলেন, “এটার কোনো অর্থই হয় না”।
তিনি আরও বলেন, “এর ফলে সহিংসতা তৈরি হতে বাধ্য, আর গাজাতে আমরা ঠিক সেটাই ঘটতে দেখছি।”
এই গ্যাংটির নেতা হলেন জনি ‘ট্যাজ’ মালফোর্ড, যিনি মার্কিন সেনাবাহিনীর একজন সাবেক সার্জেন্ট। ঘুষ নেয়া, চুরি ও সামরিক কর্তৃপক্ষের সামনে মিথ্যা বিবৃতি দেয়ার অপরাধে তাকে শাস্তিও পেতে হয়েছিল।
এখন এই ব্যক্তিই ‘কান্ট্রি টিম লিডার’ হিসেবে গাজাতে ইউজি সলিউশনস-এর ঠিকাদারির ভার সামলাচ্ছেন।
বিবিসির পক্ষ থেকে ইনফিডেলস এমসিকে ইমেইল করা হয়েছিল তাদের বক্তব্য জানতে চেয়ে। উত্তরে মি মালফোর্ড তার গ্রুপের অন্য নেতাদের নির্দেশ দেন কোনো জবাব না দিতে। কিন্তু ভুল করে তিনি ‘রিপ্লাই অল’ বাটনে ক্লিক করায় সেই ইমেইলের প্রাপকদের মধ্যে বিবিসিও ছিল।
এর ফলে ইনফিডেলস এমসি’র অন্য আরও অনেক সদস্যের নাম ও ইমেইল বিবিসির হাতে আসে, যাদের কয়েকজন গাজাতে কাজ করছিলেন।
ইনফিডেলস এমসি’র নেতৃত্ব সম্বন্ধে যে সব তথ্য পাবলিক ডোমেইনে আছে, তার সঙ্গে এই নামগুলো মিলিয়ে এবং ইউজি সলিউশনসে যারা এদের সঙ্গে কাজ করেছেন তাদের কাছ থেকে পাওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বিবিসি ইনফিডেলস এমসি’র এমন দশজন সদস্যকে চিহ্নিত করেছে, যাদেরকে মি. মালফোর্ড গাজাতে নিযুক্ত করেছিলেন।
এদের মধ্যে তিনজন, মি. জ্যারেট, মি. সিব বা মি. লফটন, ওই সংস্থার সশস্ত্র নিরাপত্তা টিমগুলোর লিডার বা ডেপুটি টিম লিডারের পদে ছিলেন। কেউই তাদের বক্তব্য জানতে চেয়ে করা ইমেইলের জবাব দেননি।
ইউজিএসের পক্ষ থেকে বিবিসিকে বলা হয়েছে, তারা নিয়োগ করার আগে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কর্মীর ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেক’ করে থাকে এবং এই ঝাড়াই-বাছাইয়ে উত্তীর্ণদেরই কেবল কাজে নিযুক্ত করা হয়।
তবে, পুরনো নিউজ রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে আমেরিকায় মদ্যপান করে গাড়ি চালানোর অভিযোগে মি. জ্যারেট দু’বছর আগে গ্রেফতার হয়েছিলেন। তারও এক দশক আগে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ড্রাইভিং করার জন্য তার বিরুদ্ধে চার্জ আনা হয়েছিল।
তবে এই দুটি ঘটনার কোনোটিতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন কি না, তা জানা যায়নি।
ইউজি সলিউশনসের প্রতিষ্ঠাতা তথা সিইও, জেমসন গোভোনি নিজেও এ বছরের গোড়ার দিকে নর্থ ক্যারোলাইনাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কোর্টের নথি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি একটি হিট-অ্যান্ড-রান কেসে জড়িত ছিলেন এবং পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারি এড়াতে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়েছিলেন।
আমেরিকার বাসিন্দা মি. গোভোনি অবশ্য ইনফিডেলস এমসি’র সদস্য নন। তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
এখনও অবধি মি. মালফোর্ডই ছিলেন ইউজি সলিউশনসের নিযুক্ত একমাত্র ঠিকাদার, যাকে ইনফিডেলস সদস্য হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছিল।
কিন্তু বিবিসির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, নিজের বাইকার গ্যাং-এর সদস্যদের তিনি কী রকম ঢালাওভাবে গাজাতে চাকরি দিয়েছিলেন, বিশেষ করে ইউজিএসের সশস্ত্র নিরাপত্তা টিমগুলোর মোটা মাইনের কাজে।
তার সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট থেকে দেখা যাচ্ছে গত মে মাসে, মানে গাজায় যাওয়ার ঠিক দু’সপ্তাহ আগেও মি. মালফোর্ড লিখেছেন মার্কিন সেনাবাহিনীর যে সাবেক সদস্যরা তাকে ফেইসবুকে ‘ফলো’ করেন তাদের তিনি গাজায় কাজে লাগাতে আগ্রহী।
“যারা এখনও গুলি চালাতে সক্ষম, চলাফেরা ও কমিউনিকেট করতে পারেন” তাদের এই চাকরির জন্য আবেদন করতে আহ্বানও জানানো হয়।
একজন সাবেক কন্ট্রাক্টরের দেয়া হিসাব অনুযায়ী, গাজাতে ইউজি সলিউশনসের হয়ে কাজ করার জন্য যে ৩২০ জনের মতো লোককে নিযুক্ত করা হয়েছিল, তার মধ্যে অন্তত ৪০ জনই ছিল ইনফিডেলস এমসি’র সদস্য।
বিবিসি যে সব নথি দেখেছে, তা থেকে জানা যায় ইউজি সলিউশনস প্রত্যেক কন্ট্রাক্টরকে তাদের খরচ-খরচা সমেত রোজ ৯৮০ ডলার (৭২০ ব্রিটিশ পাউন্ড) করে বেতন দিচ্ছে।
জিএইচএফ’র তথাকথিত ‘নিরাপদ ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র’গুলোতে যারা টিম লিডারের ভূমিকায় আছেন, তাদের ক্ষেত্রে এটাই বেড়ে দাঁড়াচ্ছে দৈনিক ১৫৮০ ডলার (১১৬০ ব্রিটিশ পাউন্ড)।
একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা টিমের প্রধান জশ মিলার সম্প্রতি গাজাতে একদল কন্ট্রাক্টরের একটি গ্রুপ ফটোও পোস্ট করেছিলেন, যাদের হাতে ধরা ব্যানারে লেখা ছিল ‘মেক গাজা গ্রেট এগেইন’।
সেই ব্যানারে তার মালিকানাধীন এমন একটি কোম্পানির লোগো বিজ্ঞাপিত হয়েছিল, যারা টি-শার্ট ও অন্যান্য জামাকাপড় বেচে। আর তাতে ‘এমব্রেস ভায়োলেন্স’ কিংবা ‘সার্ফ অল ডে, রকেটস অল নাইট। গাজা সামার ২৫’ এই জাতীয় স্লোগানও লেখা থাকে।
জশ মিলারের কোম্পানি অনলাইনে এমন একটি ভিডিও পোস্ট করেছিল, যাতে বন্দুক দিয়ে সহিংসতার দৃশ্য ছিল এবং অপরাধীদের গুলি করে মারার জন্যও সওয়াল করা হয়েছিল। তাতে ক্যাপশন ছিল, ‘মনে রেখো, ততক্ষণ গুলি করে যাও যতক্ষণ পর্যন্ত তারা আর বিপদ নয়!’
মি. মিলারের আঙুলগুলোতে ‘ক্রুসেডার’ শব্দটা ট্যাটু করা আছে, আর তার বুড়ো আঙুলে লেখা আছে ‘১০৯৫’।
এই ১০৯৫ খ্রিষ্টাব্দেই পোপ দ্বিতীয় আর্বান ‘নীচ জাতি’ মুসলিমদের আক্রমণ করার মধ্যে দিয়ে প্রথম ক্রুসেডের সূচনা করেন। মি. মিলারও তার বক্তব্য জানতে চেয়ে করা অনুরোধের জবাব দেননি।
ইনফিডেলস এমসি’র ফেইসবুক পেইজে ‘১০৯৫’ লেখা টুপি বিক্রির একটি পোস্টে বলা হয়েছে এটি ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের সূচনাকে চিহ্নিত করছে।
ক্রুসেডকে তারা বর্ণনা করেছে এভাবে: “মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণ থেকে জেরুজালেম ও ‘হোলি ল্যান্ড’ পুনর্দখল করতে এটি ছিল পশ্চিম ইউরোপের শক্তিগুলোর নেতৃত্বে একটি সামরিক অভিযান।”
প্রসঙ্গত, আজকের যেটা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে মোটামুটি সেই এলাকাটাকেই ‘হোলি ল্যান্ড’ বা পবিত্র ভূমি বলে অভিহিত করা হয়।
বাইকার গ্যাংটির নেতৃত্ব দেয়া ছাড়াও জনি মালফোর্ড ‘ইনফিডেলস এমসি’ নামে ফ্লোরিডার একটি কোম্পানির রেজিস্টার্ড এজেন্ট হিসেবেও তালিকাভুক্ত। তার বুকের ওপর ‘১০৯৫’ সালটি ট্যাটু করা রয়েছে।
তার ডান হাতে ‘ক্রুসেডার ক্রস’ ট্যাটু করা আছে। বাঁ হাতেও একই জিনিস আছে, সঙ্গে লেখা আছে ‘ইনফিডেলস’।
গাজায় ক্ষুধার্ত প্যালেস্টাইনিদের একটি ত্রাণ শিবির
বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
গাজায় মানবিক ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোর সশস্ত্র নিরাপত্তায় নিয়োজিত সংস্থাটি এমন একটি মার্কিন বাইকার গ্যাংয়ের সদস্যদের কাজে লাগাচ্ছে, যাদের চরম ইসলাম বিদ্বেষের ইতিহাস আছে। বিবিসির এক নিজস্ব তদন্তে এ তথ্য উঠে এসেছে।
গাজার হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন সাইটগুলোতে খাবারের সন্ধানে শত শত বেসামরিক মানুষ সম্প্রতি বিশৃঙ্খলা আর গোলাগুলির মধ্যে পড়ে নিহত হয়েছেন। এই সাইটগুলোতে নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে ‘ইউজি সলিউশনস’ নামে একটি বেসরকারি ঠিকাদার সংস্থা।
এই সংস্থার হয়ে গাজাতে কাজ করছেন, ‘ইনফিডেলস মোটরসাইকেল ক্লাবে’র এমন দশজন সদস্যের পরিচয় বিবিসি নিউজ নিশ্চিত হয়েছে।
বিবিসি বলছে, ইসরায়েল ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থিত এই বিতর্কিত ত্রাণ অভিযানের সাইটগুলোর তদারকিতে এই গ্যাং-এর অন্তত সাতজন সদস্য শীর্ষ পদে নিযুক্ত আছেন।
ইউজি সলিউশনস (ইউজিএস) অবশ্য এই কাজের জন্য নিযুক্ত তাদের কর্মীদের যোগ্য বলেই মনে করছে।
তারা বলেছে, ‘কারও ব্যক্তিগত শখ বা হবি কিংবা কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন কিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকার ভিত্তিতে’ তারা কর্মীদের ছাঁটাই করে না।
গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) দাবি করছে, যে কোনো ধরনের বিদ্বেষমূলক বা বৈষম্যমূলক আচরণ বা পক্ষপাতের প্রতি তাদের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি রয়েছে।
ইরাক যুদ্ধে লড়েছিলেন, এমন কয়েকজন মার্কিন সাবেক সেনা ২০০৬ সালে ‘ইনফিডেলস মোটরসাইকেল ক্লাব’ বা ‘ইনফিডেলস এমসি’ গড়ে তোলেন, যে ক্লাবের সদস্যরা নিজেদের ‘ক্রুসেডার’ বা ধর্মযোদ্ধা বলে মনে করেন এবং ‘ক্রুসেডার ক্রস’কে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেন।
মধ্যযুগে যে খ্রিষ্টান ধর্মযোদ্ধারা জেরুজালেম দখল করার জন্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, ‘ক্রস’কে সেই ক্রুসেডারদের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়।
এখনও এই গ্যাংটি তাদের ফেইসবুক পেইজে বিভিন্ন মুসলিম বিরোধী ‘হেইট স্পিচ’ হোস্ট করছে। এর আগে তারা মুসলিমদের পবিত্র রমজান মাসকে হেয় করতে শূকর রোস্ট করার ইভেন্টও আয়োজন করেছিল।
আমেরিকায় ‘সিএআইআর’ (কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস) নামে একটি মুসলিম সিভিল রাইটস গোষ্ঠীর সহকারী পরিচালক এডওয়ার্ড আহমেদ মিচেল বলেন, “ইনফিডেলস বাইকার ক্লাবকে গাজায় মানবিক ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব দেয়া আর সুদানে কেকেকে-কে মানবিক ত্রাণ বিলি করতে দেয়া আসলে একই জিনিস।” তিনি বলেন, “এটার কোনো অর্থই হয় না”।
তিনি আরও বলেন, “এর ফলে সহিংসতা তৈরি হতে বাধ্য, আর গাজাতে আমরা ঠিক সেটাই ঘটতে দেখছি।”
এই গ্যাংটির নেতা হলেন জনি ‘ট্যাজ’ মালফোর্ড, যিনি মার্কিন সেনাবাহিনীর একজন সাবেক সার্জেন্ট। ঘুষ নেয়া, চুরি ও সামরিক কর্তৃপক্ষের সামনে মিথ্যা বিবৃতি দেয়ার অপরাধে তাকে শাস্তিও পেতে হয়েছিল।
এখন এই ব্যক্তিই ‘কান্ট্রি টিম লিডার’ হিসেবে গাজাতে ইউজি সলিউশনস-এর ঠিকাদারির ভার সামলাচ্ছেন।
বিবিসির পক্ষ থেকে ইনফিডেলস এমসিকে ইমেইল করা হয়েছিল তাদের বক্তব্য জানতে চেয়ে। উত্তরে মি মালফোর্ড তার গ্রুপের অন্য নেতাদের নির্দেশ দেন কোনো জবাব না দিতে। কিন্তু ভুল করে তিনি ‘রিপ্লাই অল’ বাটনে ক্লিক করায় সেই ইমেইলের প্রাপকদের মধ্যে বিবিসিও ছিল।
এর ফলে ইনফিডেলস এমসি’র অন্য আরও অনেক সদস্যের নাম ও ইমেইল বিবিসির হাতে আসে, যাদের কয়েকজন গাজাতে কাজ করছিলেন।
ইনফিডেলস এমসি’র নেতৃত্ব সম্বন্ধে যে সব তথ্য পাবলিক ডোমেইনে আছে, তার সঙ্গে এই নামগুলো মিলিয়ে এবং ইউজি সলিউশনসে যারা এদের সঙ্গে কাজ করেছেন তাদের কাছ থেকে পাওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বিবিসি ইনফিডেলস এমসি’র এমন দশজন সদস্যকে চিহ্নিত করেছে, যাদেরকে মি. মালফোর্ড গাজাতে নিযুক্ত করেছিলেন।
এদের মধ্যে তিনজন, মি. জ্যারেট, মি. সিব বা মি. লফটন, ওই সংস্থার সশস্ত্র নিরাপত্তা টিমগুলোর লিডার বা ডেপুটি টিম লিডারের পদে ছিলেন। কেউই তাদের বক্তব্য জানতে চেয়ে করা ইমেইলের জবাব দেননি।
ইউজিএসের পক্ষ থেকে বিবিসিকে বলা হয়েছে, তারা নিয়োগ করার আগে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কর্মীর ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেক’ করে থাকে এবং এই ঝাড়াই-বাছাইয়ে উত্তীর্ণদেরই কেবল কাজে নিযুক্ত করা হয়।
তবে, পুরনো নিউজ রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে আমেরিকায় মদ্যপান করে গাড়ি চালানোর অভিযোগে মি. জ্যারেট দু’বছর আগে গ্রেফতার হয়েছিলেন। তারও এক দশক আগে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ড্রাইভিং করার জন্য তার বিরুদ্ধে চার্জ আনা হয়েছিল।
তবে এই দুটি ঘটনার কোনোটিতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন কি না, তা জানা যায়নি।
ইউজি সলিউশনসের প্রতিষ্ঠাতা তথা সিইও, জেমসন গোভোনি নিজেও এ বছরের গোড়ার দিকে নর্থ ক্যারোলাইনাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কোর্টের নথি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি একটি হিট-অ্যান্ড-রান কেসে জড়িত ছিলেন এবং পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারি এড়াতে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়েছিলেন।
আমেরিকার বাসিন্দা মি. গোভোনি অবশ্য ইনফিডেলস এমসি’র সদস্য নন। তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
এখনও অবধি মি. মালফোর্ডই ছিলেন ইউজি সলিউশনসের নিযুক্ত একমাত্র ঠিকাদার, যাকে ইনফিডেলস সদস্য হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছিল।
কিন্তু বিবিসির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, নিজের বাইকার গ্যাং-এর সদস্যদের তিনি কী রকম ঢালাওভাবে গাজাতে চাকরি দিয়েছিলেন, বিশেষ করে ইউজিএসের সশস্ত্র নিরাপত্তা টিমগুলোর মোটা মাইনের কাজে।
তার সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট থেকে দেখা যাচ্ছে গত মে মাসে, মানে গাজায় যাওয়ার ঠিক দু’সপ্তাহ আগেও মি. মালফোর্ড লিখেছেন মার্কিন সেনাবাহিনীর যে সাবেক সদস্যরা তাকে ফেইসবুকে ‘ফলো’ করেন তাদের তিনি গাজায় কাজে লাগাতে আগ্রহী।
“যারা এখনও গুলি চালাতে সক্ষম, চলাফেরা ও কমিউনিকেট করতে পারেন” তাদের এই চাকরির জন্য আবেদন করতে আহ্বানও জানানো হয়।
একজন সাবেক কন্ট্রাক্টরের দেয়া হিসাব অনুযায়ী, গাজাতে ইউজি সলিউশনসের হয়ে কাজ করার জন্য যে ৩২০ জনের মতো লোককে নিযুক্ত করা হয়েছিল, তার মধ্যে অন্তত ৪০ জনই ছিল ইনফিডেলস এমসি’র সদস্য।
বিবিসি যে সব নথি দেখেছে, তা থেকে জানা যায় ইউজি সলিউশনস প্রত্যেক কন্ট্রাক্টরকে তাদের খরচ-খরচা সমেত রোজ ৯৮০ ডলার (৭২০ ব্রিটিশ পাউন্ড) করে বেতন দিচ্ছে।
জিএইচএফ’র তথাকথিত ‘নিরাপদ ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র’গুলোতে যারা টিম লিডারের ভূমিকায় আছেন, তাদের ক্ষেত্রে এটাই বেড়ে দাঁড়াচ্ছে দৈনিক ১৫৮০ ডলার (১১৬০ ব্রিটিশ পাউন্ড)।
একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা টিমের প্রধান জশ মিলার সম্প্রতি গাজাতে একদল কন্ট্রাক্টরের একটি গ্রুপ ফটোও পোস্ট করেছিলেন, যাদের হাতে ধরা ব্যানারে লেখা ছিল ‘মেক গাজা গ্রেট এগেইন’।
সেই ব্যানারে তার মালিকানাধীন এমন একটি কোম্পানির লোগো বিজ্ঞাপিত হয়েছিল, যারা টি-শার্ট ও অন্যান্য জামাকাপড় বেচে। আর তাতে ‘এমব্রেস ভায়োলেন্স’ কিংবা ‘সার্ফ অল ডে, রকেটস অল নাইট। গাজা সামার ২৫’ এই জাতীয় স্লোগানও লেখা থাকে।
জশ মিলারের কোম্পানি অনলাইনে এমন একটি ভিডিও পোস্ট করেছিল, যাতে বন্দুক দিয়ে সহিংসতার দৃশ্য ছিল এবং অপরাধীদের গুলি করে মারার জন্যও সওয়াল করা হয়েছিল। তাতে ক্যাপশন ছিল, ‘মনে রেখো, ততক্ষণ গুলি করে যাও যতক্ষণ পর্যন্ত তারা আর বিপদ নয়!’
মি. মিলারের আঙুলগুলোতে ‘ক্রুসেডার’ শব্দটা ট্যাটু করা আছে, আর তার বুড়ো আঙুলে লেখা আছে ‘১০৯৫’।
এই ১০৯৫ খ্রিষ্টাব্দেই পোপ দ্বিতীয় আর্বান ‘নীচ জাতি’ মুসলিমদের আক্রমণ করার মধ্যে দিয়ে প্রথম ক্রুসেডের সূচনা করেন। মি. মিলারও তার বক্তব্য জানতে চেয়ে করা অনুরোধের জবাব দেননি।
ইনফিডেলস এমসি’র ফেইসবুক পেইজে ‘১০৯৫’ লেখা টুপি বিক্রির একটি পোস্টে বলা হয়েছে এটি ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের সূচনাকে চিহ্নিত করছে।
ক্রুসেডকে তারা বর্ণনা করেছে এভাবে: “মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণ থেকে জেরুজালেম ও ‘হোলি ল্যান্ড’ পুনর্দখল করতে এটি ছিল পশ্চিম ইউরোপের শক্তিগুলোর নেতৃত্বে একটি সামরিক অভিযান।”
প্রসঙ্গত, আজকের যেটা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে মোটামুটি সেই এলাকাটাকেই ‘হোলি ল্যান্ড’ বা পবিত্র ভূমি বলে অভিহিত করা হয়।
বাইকার গ্যাংটির নেতৃত্ব দেয়া ছাড়াও জনি মালফোর্ড ‘ইনফিডেলস এমসি’ নামে ফ্লোরিডার একটি কোম্পানির রেজিস্টার্ড এজেন্ট হিসেবেও তালিকাভুক্ত। তার বুকের ওপর ‘১০৯৫’ সালটি ট্যাটু করা রয়েছে।
তার ডান হাতে ‘ক্রুসেডার ক্রস’ ট্যাটু করা আছে। বাঁ হাতেও একই জিনিস আছে, সঙ্গে লেখা আছে ‘ইনফিডেলস’।