ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়াও চলছে বহু দশক ধরে -এএফপি
দখল করা পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের দখল ও সহিংসতা বেড়েই চলেছে। এরই মধ্যে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপের কয়েকটি দেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি করছে।
সম্প্রতি পশ্চিম তীরের জেনিন শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হন ১৩ বছর বয়সী ইসলাম মাজরমেহ। বিবিসিকে তাঁর বাবা আবদেল আজিজ বলেন, ‘তারা কেন শিশুদের গুলি করল? আমি তো তার পাশেই দাঁড়িয়েছিলাম। আমাকে গুলি করতে পারত।’ ঘটনাস্থলেই সেনাদের নির্দেশে তিনি ছেলেকে টেনে পাশে সরালেও তখনও বুঝতে পারেননি যে, তাঁর সন্তান মারা গেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, সামরিক এলাকায় সন্দেহভাজনদের হুমকি ঠেকাতেই গুলি চালানো হয়েছিল। তবে ওই কিশোরের পক্ষ থেকে কোনো হুমকি থাকার বিষয় স্পষ্ট করেনি তারা।
অসলো শান্তি চুক্তির অধীনে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা ছিল জেনিন। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে শহরটি কার্যত ইসরায়েলি সেটেলারদের দখলে। ট্যাঙ্ক মোতায়েন, আশ্রয় শিবির ধ্বংস এবং স্নাইপার মোতায়েনের ফলে এখানকার বাসিন্দাদের এক-চতুর্থাংশ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। স্থানীয় মেয়র মোহাম্মদ জাররারের ভাষায়, ‘শহরের প্রায় চল্লিশ ভাগই এখন সামরিক এলাকা।
এটি কোনো নিরাপত্তা অভিযান নয়, বরং বিশাল রাজনৈতিক পরিকল্পনা। পশ্চিম তীরকে পুরোপুরি দখল করার কৌশল।’ অর্থনৈতিক দিক থেকেও চাপে রয়েছেন পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা। ইসরায়েল তাদের কর-রাজস্ব এমনকি বাকি সব বরাদ্দও আটকে রেখেছে, ফলে বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না শিক্ষক ও পুলিশদের। অন্যদিকে অব্যাহত রয়েছে ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণ।
মেয়র বলছেন, স্থানীয় জনগণকে এমনকি মৌলিক পরিষেবা দেওয়াও এখন কঠিন হয়ে গেছে। ন্যূনতম দৈনন্দিন চাহিদা পূরণে দলে দলে দেশ ছেড়ে যাচ্ছে তরুণরা। সাধারণ ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে প্রতিদিনই একটু একটু করে বাড়ছে ইসরায়েলি বসতি। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, সেনারা অনেক সময় বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা না ঠেকিয়ে উল্টো সমর্থন দিচ্ছে।
জেনিন বা নাবলুসের মতো শহর ও গ্রামে প্রতিদিনই হয়রানি সহ্য করতে হচ্ছে স্থানীয়দের। নাবলুসের কাছেই বাস করা আয়মান সুফান বলেন, ‘প্রতিদিন বসতি স্থাপনকারীরা এসে আমাদের চলে যেতে বলে। পুলিশ বা সেনারা কোনো ব্যবস্থা নেয় না, কারণ সেনা ও পুলিশ আসলে তাদেরই।’
এমন প্রেক্ষাপটে গতকাল রোববার ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউরোপীয় দেশ যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া। এই নিয়ে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া দেশের সংখ্যা ১৫০-এ পৌঁছাল। মেয়র জাররার বলেন, ‘ইসরায়েলি দখল হয়তো আরও বাড়বে। কিন্তু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যৎকে সুদৃঢ় করবে এবং তাদের অধিকারের প্রশ্নে বিশ্বকে সরব করবে।’ কিন্তু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র হবে না। এই ভূমি আমাদের। তাঁর সরকার পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন আরও জোরদার করেছে।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে পশ্চিম তীর দখলের পর থেকে পাঁচ লাখের বেশি ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী সেখানে বাস করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অঞ্চলটিতে ১০০টিরও বেশি নতুন আউটপোস্ট গড়ে উঠেছে, যা আন্তর্জাতিক ও ইসরায়েলি উভয় আইনেই অবৈধ। তবে ইসরায়েলি সরকারের নীরব অনুমোদন পাচ্ছে এসব স্থাপনা। ফিলিস্তিনিদের জন্য বাস্তবতা আরও কঠিন হয়ে উঠছে। নিহত শিশু ইসলাম মাজরমেহর বাবা আবদেল আজিজের কথাতেই ফুটে উঠেছে তাদের আকুতি– আজ হোক বা কাল হোক, ফিলিস্তিন মুক্ত হবেই।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বপ্ন বহু দশক ধরে আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়াও চলছে বহু দশক ধরে। ১৯৪৫ সালের পর জাতিসংঘের ১৪০টির বেশি সদস্যরাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। তার এ অবস্থান শুধু ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সম্পর্ককেই নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃত ভূরাজনীতি, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান মূলত ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ নীতির ওপর নির্ভরশীল। এর অর্থ হলো, ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি পক্ষের মধ্যে সরাসরি আলোচনা ও চুক্তির মাধ্যমে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়া উচিত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চিত স্বীকৃতি, ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবির পক্ষে পদক্ষেপ না নেওয়া, সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলকে সামরিক–অর্থনৈতিক দিক থেকে তার সহায়তা করা মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধক।
যুক্তরাষ্ট্রের এ পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান পশ্চিমা ও আরব জোটের মধ্যেও বিভাজন বাড়িয়েছে, শান্তিপ্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করেছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের আন্তর্জাতিক মর্যাদা সীমিত করেছে। বিপরীতে, ইসরায়েলকে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী, আন্তর্জাতিক পরিম-লে একগুঁয়ে ও বেপরোয়া রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এ নীতি।
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়াও চলছে বহু দশক ধরে -এএফপি
সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
দখল করা পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের দখল ও সহিংসতা বেড়েই চলেছে। এরই মধ্যে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপের কয়েকটি দেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি করছে।
সম্প্রতি পশ্চিম তীরের জেনিন শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হন ১৩ বছর বয়সী ইসলাম মাজরমেহ। বিবিসিকে তাঁর বাবা আবদেল আজিজ বলেন, ‘তারা কেন শিশুদের গুলি করল? আমি তো তার পাশেই দাঁড়িয়েছিলাম। আমাকে গুলি করতে পারত।’ ঘটনাস্থলেই সেনাদের নির্দেশে তিনি ছেলেকে টেনে পাশে সরালেও তখনও বুঝতে পারেননি যে, তাঁর সন্তান মারা গেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, সামরিক এলাকায় সন্দেহভাজনদের হুমকি ঠেকাতেই গুলি চালানো হয়েছিল। তবে ওই কিশোরের পক্ষ থেকে কোনো হুমকি থাকার বিষয় স্পষ্ট করেনি তারা।
অসলো শান্তি চুক্তির অধীনে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা ছিল জেনিন। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে শহরটি কার্যত ইসরায়েলি সেটেলারদের দখলে। ট্যাঙ্ক মোতায়েন, আশ্রয় শিবির ধ্বংস এবং স্নাইপার মোতায়েনের ফলে এখানকার বাসিন্দাদের এক-চতুর্থাংশ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। স্থানীয় মেয়র মোহাম্মদ জাররারের ভাষায়, ‘শহরের প্রায় চল্লিশ ভাগই এখন সামরিক এলাকা।
এটি কোনো নিরাপত্তা অভিযান নয়, বরং বিশাল রাজনৈতিক পরিকল্পনা। পশ্চিম তীরকে পুরোপুরি দখল করার কৌশল।’ অর্থনৈতিক দিক থেকেও চাপে রয়েছেন পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা। ইসরায়েল তাদের কর-রাজস্ব এমনকি বাকি সব বরাদ্দও আটকে রেখেছে, ফলে বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না শিক্ষক ও পুলিশদের। অন্যদিকে অব্যাহত রয়েছে ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণ।
মেয়র বলছেন, স্থানীয় জনগণকে এমনকি মৌলিক পরিষেবা দেওয়াও এখন কঠিন হয়ে গেছে। ন্যূনতম দৈনন্দিন চাহিদা পূরণে দলে দলে দেশ ছেড়ে যাচ্ছে তরুণরা। সাধারণ ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে প্রতিদিনই একটু একটু করে বাড়ছে ইসরায়েলি বসতি। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, সেনারা অনেক সময় বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা না ঠেকিয়ে উল্টো সমর্থন দিচ্ছে।
জেনিন বা নাবলুসের মতো শহর ও গ্রামে প্রতিদিনই হয়রানি সহ্য করতে হচ্ছে স্থানীয়দের। নাবলুসের কাছেই বাস করা আয়মান সুফান বলেন, ‘প্রতিদিন বসতি স্থাপনকারীরা এসে আমাদের চলে যেতে বলে। পুলিশ বা সেনারা কোনো ব্যবস্থা নেয় না, কারণ সেনা ও পুলিশ আসলে তাদেরই।’
এমন প্রেক্ষাপটে গতকাল রোববার ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউরোপীয় দেশ যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া। এই নিয়ে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া দেশের সংখ্যা ১৫০-এ পৌঁছাল। মেয়র জাররার বলেন, ‘ইসরায়েলি দখল হয়তো আরও বাড়বে। কিন্তু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যৎকে সুদৃঢ় করবে এবং তাদের অধিকারের প্রশ্নে বিশ্বকে সরব করবে।’ কিন্তু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র হবে না। এই ভূমি আমাদের। তাঁর সরকার পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন আরও জোরদার করেছে।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে পশ্চিম তীর দখলের পর থেকে পাঁচ লাখের বেশি ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী সেখানে বাস করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অঞ্চলটিতে ১০০টিরও বেশি নতুন আউটপোস্ট গড়ে উঠেছে, যা আন্তর্জাতিক ও ইসরায়েলি উভয় আইনেই অবৈধ। তবে ইসরায়েলি সরকারের নীরব অনুমোদন পাচ্ছে এসব স্থাপনা। ফিলিস্তিনিদের জন্য বাস্তবতা আরও কঠিন হয়ে উঠছে। নিহত শিশু ইসলাম মাজরমেহর বাবা আবদেল আজিজের কথাতেই ফুটে উঠেছে তাদের আকুতি– আজ হোক বা কাল হোক, ফিলিস্তিন মুক্ত হবেই।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বপ্ন বহু দশক ধরে আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়াও চলছে বহু দশক ধরে। ১৯৪৫ সালের পর জাতিসংঘের ১৪০টির বেশি সদস্যরাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। তার এ অবস্থান শুধু ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সম্পর্ককেই নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃত ভূরাজনীতি, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান মূলত ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ নীতির ওপর নির্ভরশীল। এর অর্থ হলো, ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি পক্ষের মধ্যে সরাসরি আলোচনা ও চুক্তির মাধ্যমে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়া উচিত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চিত স্বীকৃতি, ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবির পক্ষে পদক্ষেপ না নেওয়া, সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলকে সামরিক–অর্থনৈতিক দিক থেকে তার সহায়তা করা মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধক।
যুক্তরাষ্ট্রের এ পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান পশ্চিমা ও আরব জোটের মধ্যেও বিভাজন বাড়িয়েছে, শান্তিপ্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করেছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের আন্তর্জাতিক মর্যাদা সীমিত করেছে। বিপরীতে, ইসরায়েলকে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী, আন্তর্জাতিক পরিম-লে একগুঁয়ে ও বেপরোয়া রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এ নীতি।