পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির এখন দেশটির আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সংবিধানের ২৭তম সংশোধনীর মাধ্যমে শাহবাজ শরিফ সরকার তাঁকে আজীবন যেকোনো অপরাধ বা প্রশাসনিক অভিযোগের ক্ষেত্রে আইনগত দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করেছে। পাকিস্তানের রাজনীতির ইতিহাসে দেশটির সেনাবাহিনী সব সময়ই অত্যন্ত প্রভাবশালী। নতুন আইনে সেই ক্ষমতা আরও বেড়েছে।
কয়েক সপ্তাহ ধরে আলোচনা-সমালোচনা ও তুমুল বিতর্কের পর বুধবার, (১৯ নভেম্বর ২০২৫) সংবিধানের ২৭তম সংশোধনী বিল পাকিস্তানের পার্লামেন্টে অনুমোদন পায়। পরদিন বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি ওই বিলে স্বাক্ষর করে সেটিকে আইনে পরিণত করেন। নতুন সংশোধনীতে দেশটির সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা সীমিত করা হয়েছে। সমালোচকেরা এর বিরোধিতা করে বলছেন, এই পদক্ষেপের ফলে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে।
নতুন সংশোধনীতে দেশটির সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা সীমিত করা হয়েছে। সমালোচকেরা এর বিরোধিতা করে বলছেন, এই পদক্ষেপের ফলে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে।
অন্যদিকে সংশোধনের পক্ষের লোকজন বলছেন, এর ফলে সেনাবাহিনীতে স্বচ্ছতা ও প্রশাসনিক কাঠামো নিশ্চিত হবে এবং আদালতের বিচারপ্রক্রিয়ার জট কমাতে সাহায্য করবে।
স্বাধীনতার পর থেকেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে দেশটির সেনাবাহিনী প্রভাবশালী ভূমিকা রেখে আসছে। পরমাণু শক্তিধর দেশটিতে সেনাবাহিনী কখনো সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে, আবার কখনো পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছে। (পাকিস্তানে) সামরিক ও বেসামরিক ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য বলে আর কিছু নেই। তারা পুনরায় ক্ষমতার পাল্লা সামরিক বাহিনীর দিকে ঝুঁকে পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে এবং এমন একসময়ে সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতায়িত করেছে, যখন সেটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন ছিল।
মুনিজায়ে জাহাঙ্গীর, সাংবাদিক ও পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের উপপ্রধান এর ফলে দেশটি কখনো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে একটু বেশি এগিয়েছে, আবার কখনো জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ও জেনারেল জিয়া উল হকের নেতৃত্বে সরাসরি সামরিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে থেকেছে। বিশ্লেষকেরা দেশটির রাজনীতিতে এই নাগরিক ও সামরিক শক্তির ভারসাম্যকে ‘হাইব্রিড শাসন’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
কেউ কেউ নতুন সংশোধনীকে ‘হাইব্রিড শাসনের’ ভারসাম্যের পাল্লা সামরিক বাহিনীর দিকে ঝুঁকে পড়ার স্পষ্ট সংকেত হিসেবে দেখছেন। ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘আমার কাছে মনে হচ্ছে, পাকিস্তান এখন আর হাইব্রিড শাসনব্যবস্থার মধ্যে নেই, বরং হাইব্রিড শাসনপরবর্তী ব্যবস্থায় চলে গেছে। এই সংশোধন হলো তার সাম্প্রতিকতম এবং সম্ভতব এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী সংকেত।
সংবিধানের নতুন সংশোধনী অনুযায়ী, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির এখন থেকে দেশটির নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রধানের দায়িত্বও পালন করবেন। ২০২২ সালের নভেম্বরে তিনি সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কুগেলম্যান আরও বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আমরা এমন একটি পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছি, যেখানে বেসামরিক ও সামরিক শক্তির ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। সম্ভবত এর থেকে বেশি ভারসাম্যহীন আর হতে পারে না।’
সংবিধানের নতুন সংশোধনী অনুযায়ী, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির এখন থেকে দেশটির নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রধানের দায়িত্বও পালন করবেন। ২০২২ সালের নভেম্বরে তিনি সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এ বছর ২০ মে আসিম মুনির পাঁচ তারকা মর্যাদায় উন্নীত হন। এর মাত্র ১০ দিন আগে ভারতের সঙ্গে ৪ দিনের যুদ্ধ শেষে যুদ্ধবিরতিতে উপনীত হয়েছিল পাকিস্তান।
মুনির পাকিস্তানের দ্বিতীয় সামরিক কর্মকর্তা, যিনি পাঁচ তারকা মর্যাদা পেয়েছেন। তাঁর আগে ১৯৬০–এর দশকে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান এই খেতাব পান। এ পর্যন্ত পাকিস্তানের বিমানবাহিনী বা নৌবাহিনীর কেউ পাঁচ তারকা মর্যাদা পাননি।
নতুন সংশোধনীতে আসিম মুনিরের ফিল্ড মার্শাল খেতাব এবং তাঁর সামরিক পোশাক (ইউনিফর্ম) আজীবন থাকবে। অর্থাৎ, তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়া বা অবসর গ্রহণের পরও তাঁর ফিল্ড মার্শাল পদমর্যাদা বহাল থাকবে।
‘যখন রাষ্ট্রই সেই বেঞ্চগুলো গঠন করে দেবে, তখন একজন বাদী হিসেবে ন্যায্য বিচার পাওয়ার আশা আমরা কি করতে পারি?’ শুধু তা–ই নয়, সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে আজীবনের জন্য যেকোনো অপরাধ বা প্রশাসনিক অভিযোগ থেকে আইনগত দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, তাঁর বিরুদ্ধে কখনো কোনো বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হবে না।
এ ছাড়া অবসর নেওয়ার পরও তাঁকে ‘দায়িত্ব ও কর্তব্য’ দেওয়া হবে, যা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারণ করা হবে। সংশোধনীর সমর্থকেরা মনে করেন, এর ফলে পাকিস্তানের সামরিক কমান্ড কাঠামোতে স্বচ্ছতা বাড়বে। পাকিস্তানের সরকারি সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি) প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের বরাত দিয়ে বলেছে, এসব পরিবর্তন একটি বিস্তৃত সংস্কারপরিকল্পনার (এজেন্ডা) অংশ, যেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আধুনিক যুদ্ধের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হয়ে উঠতে পারে।
তবে বিলের সমর্থকেরা যত ব্যাখ্যাই দিন, সমালোচকেরা বলছেন, এটাকে সামরিক বাহিনীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। সাংবাদিক ও পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের উপপ্রধান মুনিজায়ে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘(পাকিস্তানে) সামরিক ও বেসামরিক ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য বলে আর কিছু নেই। তারা আবার ক্ষমতার ভারসাম্যের পাল্লা সামরিক বাহিনীর দিকে ঝুঁকে পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে এবং এমন একসময়ে সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতায়িত করেছে, যখন সেটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন ছিল।’ সংবিধানের ২৭তম সংশোধনীতে দ্বিতীয় যে ক্ষেত্রের পরিবর্তন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হচ্ছে, সেটা হলো আদালত ও বিচার বিভাগ। নতুন সংশোধনীর অধীনে একটি নতুন কেন্দ্রীয় সাংবিধানিক আদালত (এফসিসি) গঠন করা হবে। সংবিধানসংক্রান্ত মামলাগুলো এখন সুপ্রিম কোর্ট থেকে কেন্দ্রীয় সাংবিধানিক আদালতের হাতে চলে যাবে। প্রেসিডেন্ট নতুন এই আদালতের প্রথম প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগ দেবেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট দেশটির সরকারের অনেক নীতিমালা আটকে দিয়েছেন।
কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীকে পদচ্যুতও করেছেন। নতুন সংস্কারের ফলে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়েছে।
এ নিয়ে সাংবাদিক মুনিজায়ে বলেন, ‘এটি ন্যায্য বিচার পাওয়ার অধিকারের কাঠামো ও প্রকৃতিকে চিরতরে বদলে দেবে। কারণ, শুধু বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেই নয়, বরং সংবিধানিক বেঞ্চ নির্ধারণেও প্রশাসনের প্রভাব অনেক বেড়ে গেছে।’ যখন রাষ্ট্রই সেই বেঞ্চগুলো গঠন করে দেবে, তখন একজন বাদী হিসেবে ন্যায্য বিচার পাওয়ার আশা আমরা কি করতে পারি, প্রশ্ন এই সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীর।
আরেক সাংবাদিক ও রাজনীতিবিশ্লেষক আরিফা নূর বলেন, ‘এখন বিচার বিভাগ প্রশাসনের প্রতি খুবই অনুগত হবে। মোদ্দাকথা হলো, বর্তমানে বিচার বিভাগের স্বাধীনভাবে পরিচালিত হওয়ার আর কোনো সুযোগ সত্যিই থাকল না।’ এই সংশোধনী পাস হওয়ার আগে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানসম্পর্কিত মামলাগুলো শুনতেন এবং সিদ্ধান্ত দিতেন। এখন বিচার বিভাগ প্রশাসনের প্রতি খুবই অনুগত হবে। মোদ্দাকথা হলো, এখন বিচার বিভাগের স্বাধীনভাবে পরিচালিত হওয়ার আর কোনো সুযোগ সত্যিই থাকল না।
এখন বিচারকদের সংবিধানসংক্রান্ত মামলাগুলোতে আর সময় দিতে হবে না। ফলে তাঁরা ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলায় অধিক সময় দিতে পারবেন বলে মনে করছেন কেউ কেউ। তাঁরা মনে করেন, এর ফলে আদালতে বিচারাধীন মামলার যে জট তৈরি হয়েছে, তা কমবে এবং দুটি আলাদা আদালত হওয়ার কারণে আদালতের কার্যপ্রক্রিয়া অনেকটা সহজ হবে। কোনো কোনো আইনজীবীর কাছে এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য হলেও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী করাচির সালাহউদ্দিন আহমেদ এই যুক্তিকে অসংগতিপূর্ণ মনে করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানে যেসব মামলার বিচারকাজ আটকে আছে, সেগুলোর অধিকাংশই সুপ্রিম কোর্টে নয়, বরং অন্যান্য আদালতে।
সালাহউদ্দিন আরও বলেন, ‘পরিসংখ্যানগতভাবে যদি সত্যিই আপনি মামলার বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত করা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে সেই মামলাগুলোর সংস্কারে মনোনিবেশ করতে হতো।’
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির এখন দেশটির আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সংবিধানের ২৭তম সংশোধনীর মাধ্যমে শাহবাজ শরিফ সরকার তাঁকে আজীবন যেকোনো অপরাধ বা প্রশাসনিক অভিযোগের ক্ষেত্রে আইনগত দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করেছে। পাকিস্তানের রাজনীতির ইতিহাসে দেশটির সেনাবাহিনী সব সময়ই অত্যন্ত প্রভাবশালী। নতুন আইনে সেই ক্ষমতা আরও বেড়েছে।
কয়েক সপ্তাহ ধরে আলোচনা-সমালোচনা ও তুমুল বিতর্কের পর বুধবার, (১৯ নভেম্বর ২০২৫) সংবিধানের ২৭তম সংশোধনী বিল পাকিস্তানের পার্লামেন্টে অনুমোদন পায়। পরদিন বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি ওই বিলে স্বাক্ষর করে সেটিকে আইনে পরিণত করেন। নতুন সংশোধনীতে দেশটির সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা সীমিত করা হয়েছে। সমালোচকেরা এর বিরোধিতা করে বলছেন, এই পদক্ষেপের ফলে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে।
নতুন সংশোধনীতে দেশটির সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা সীমিত করা হয়েছে। সমালোচকেরা এর বিরোধিতা করে বলছেন, এই পদক্ষেপের ফলে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে।
অন্যদিকে সংশোধনের পক্ষের লোকজন বলছেন, এর ফলে সেনাবাহিনীতে স্বচ্ছতা ও প্রশাসনিক কাঠামো নিশ্চিত হবে এবং আদালতের বিচারপ্রক্রিয়ার জট কমাতে সাহায্য করবে।
স্বাধীনতার পর থেকেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে দেশটির সেনাবাহিনী প্রভাবশালী ভূমিকা রেখে আসছে। পরমাণু শক্তিধর দেশটিতে সেনাবাহিনী কখনো সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে, আবার কখনো পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছে। (পাকিস্তানে) সামরিক ও বেসামরিক ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য বলে আর কিছু নেই। তারা পুনরায় ক্ষমতার পাল্লা সামরিক বাহিনীর দিকে ঝুঁকে পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে এবং এমন একসময়ে সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতায়িত করেছে, যখন সেটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন ছিল।
মুনিজায়ে জাহাঙ্গীর, সাংবাদিক ও পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের উপপ্রধান এর ফলে দেশটি কখনো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে একটু বেশি এগিয়েছে, আবার কখনো জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ও জেনারেল জিয়া উল হকের নেতৃত্বে সরাসরি সামরিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে থেকেছে। বিশ্লেষকেরা দেশটির রাজনীতিতে এই নাগরিক ও সামরিক শক্তির ভারসাম্যকে ‘হাইব্রিড শাসন’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
কেউ কেউ নতুন সংশোধনীকে ‘হাইব্রিড শাসনের’ ভারসাম্যের পাল্লা সামরিক বাহিনীর দিকে ঝুঁকে পড়ার স্পষ্ট সংকেত হিসেবে দেখছেন। ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘আমার কাছে মনে হচ্ছে, পাকিস্তান এখন আর হাইব্রিড শাসনব্যবস্থার মধ্যে নেই, বরং হাইব্রিড শাসনপরবর্তী ব্যবস্থায় চলে গেছে। এই সংশোধন হলো তার সাম্প্রতিকতম এবং সম্ভতব এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী সংকেত।
সংবিধানের নতুন সংশোধনী অনুযায়ী, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির এখন থেকে দেশটির নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রধানের দায়িত্বও পালন করবেন। ২০২২ সালের নভেম্বরে তিনি সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কুগেলম্যান আরও বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আমরা এমন একটি পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছি, যেখানে বেসামরিক ও সামরিক শক্তির ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। সম্ভবত এর থেকে বেশি ভারসাম্যহীন আর হতে পারে না।’
সংবিধানের নতুন সংশোধনী অনুযায়ী, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির এখন থেকে দেশটির নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রধানের দায়িত্বও পালন করবেন। ২০২২ সালের নভেম্বরে তিনি সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এ বছর ২০ মে আসিম মুনির পাঁচ তারকা মর্যাদায় উন্নীত হন। এর মাত্র ১০ দিন আগে ভারতের সঙ্গে ৪ দিনের যুদ্ধ শেষে যুদ্ধবিরতিতে উপনীত হয়েছিল পাকিস্তান।
মুনির পাকিস্তানের দ্বিতীয় সামরিক কর্মকর্তা, যিনি পাঁচ তারকা মর্যাদা পেয়েছেন। তাঁর আগে ১৯৬০–এর দশকে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান এই খেতাব পান। এ পর্যন্ত পাকিস্তানের বিমানবাহিনী বা নৌবাহিনীর কেউ পাঁচ তারকা মর্যাদা পাননি।
নতুন সংশোধনীতে আসিম মুনিরের ফিল্ড মার্শাল খেতাব এবং তাঁর সামরিক পোশাক (ইউনিফর্ম) আজীবন থাকবে। অর্থাৎ, তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়া বা অবসর গ্রহণের পরও তাঁর ফিল্ড মার্শাল পদমর্যাদা বহাল থাকবে।
‘যখন রাষ্ট্রই সেই বেঞ্চগুলো গঠন করে দেবে, তখন একজন বাদী হিসেবে ন্যায্য বিচার পাওয়ার আশা আমরা কি করতে পারি?’ শুধু তা–ই নয়, সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে আজীবনের জন্য যেকোনো অপরাধ বা প্রশাসনিক অভিযোগ থেকে আইনগত দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, তাঁর বিরুদ্ধে কখনো কোনো বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হবে না।
এ ছাড়া অবসর নেওয়ার পরও তাঁকে ‘দায়িত্ব ও কর্তব্য’ দেওয়া হবে, যা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারণ করা হবে। সংশোধনীর সমর্থকেরা মনে করেন, এর ফলে পাকিস্তানের সামরিক কমান্ড কাঠামোতে স্বচ্ছতা বাড়বে। পাকিস্তানের সরকারি সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি) প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের বরাত দিয়ে বলেছে, এসব পরিবর্তন একটি বিস্তৃত সংস্কারপরিকল্পনার (এজেন্ডা) অংশ, যেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আধুনিক যুদ্ধের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হয়ে উঠতে পারে।
তবে বিলের সমর্থকেরা যত ব্যাখ্যাই দিন, সমালোচকেরা বলছেন, এটাকে সামরিক বাহিনীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। সাংবাদিক ও পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের উপপ্রধান মুনিজায়ে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘(পাকিস্তানে) সামরিক ও বেসামরিক ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য বলে আর কিছু নেই। তারা আবার ক্ষমতার ভারসাম্যের পাল্লা সামরিক বাহিনীর দিকে ঝুঁকে পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে এবং এমন একসময়ে সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতায়িত করেছে, যখন সেটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন ছিল।’ সংবিধানের ২৭তম সংশোধনীতে দ্বিতীয় যে ক্ষেত্রের পরিবর্তন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হচ্ছে, সেটা হলো আদালত ও বিচার বিভাগ। নতুন সংশোধনীর অধীনে একটি নতুন কেন্দ্রীয় সাংবিধানিক আদালত (এফসিসি) গঠন করা হবে। সংবিধানসংক্রান্ত মামলাগুলো এখন সুপ্রিম কোর্ট থেকে কেন্দ্রীয় সাংবিধানিক আদালতের হাতে চলে যাবে। প্রেসিডেন্ট নতুন এই আদালতের প্রথম প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগ দেবেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট দেশটির সরকারের অনেক নীতিমালা আটকে দিয়েছেন।
কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীকে পদচ্যুতও করেছেন। নতুন সংস্কারের ফলে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়েছে।
এ নিয়ে সাংবাদিক মুনিজায়ে বলেন, ‘এটি ন্যায্য বিচার পাওয়ার অধিকারের কাঠামো ও প্রকৃতিকে চিরতরে বদলে দেবে। কারণ, শুধু বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেই নয়, বরং সংবিধানিক বেঞ্চ নির্ধারণেও প্রশাসনের প্রভাব অনেক বেড়ে গেছে।’ যখন রাষ্ট্রই সেই বেঞ্চগুলো গঠন করে দেবে, তখন একজন বাদী হিসেবে ন্যায্য বিচার পাওয়ার আশা আমরা কি করতে পারি, প্রশ্ন এই সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীর।
আরেক সাংবাদিক ও রাজনীতিবিশ্লেষক আরিফা নূর বলেন, ‘এখন বিচার বিভাগ প্রশাসনের প্রতি খুবই অনুগত হবে। মোদ্দাকথা হলো, বর্তমানে বিচার বিভাগের স্বাধীনভাবে পরিচালিত হওয়ার আর কোনো সুযোগ সত্যিই থাকল না।’ এই সংশোধনী পাস হওয়ার আগে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানসম্পর্কিত মামলাগুলো শুনতেন এবং সিদ্ধান্ত দিতেন। এখন বিচার বিভাগ প্রশাসনের প্রতি খুবই অনুগত হবে। মোদ্দাকথা হলো, এখন বিচার বিভাগের স্বাধীনভাবে পরিচালিত হওয়ার আর কোনো সুযোগ সত্যিই থাকল না।
এখন বিচারকদের সংবিধানসংক্রান্ত মামলাগুলোতে আর সময় দিতে হবে না। ফলে তাঁরা ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলায় অধিক সময় দিতে পারবেন বলে মনে করছেন কেউ কেউ। তাঁরা মনে করেন, এর ফলে আদালতে বিচারাধীন মামলার যে জট তৈরি হয়েছে, তা কমবে এবং দুটি আলাদা আদালত হওয়ার কারণে আদালতের কার্যপ্রক্রিয়া অনেকটা সহজ হবে। কোনো কোনো আইনজীবীর কাছে এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য হলেও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী করাচির সালাহউদ্দিন আহমেদ এই যুক্তিকে অসংগতিপূর্ণ মনে করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানে যেসব মামলার বিচারকাজ আটকে আছে, সেগুলোর অধিকাংশই সুপ্রিম কোর্টে নয়, বরং অন্যান্য আদালতে।
সালাহউদ্দিন আরও বলেন, ‘পরিসংখ্যানগতভাবে যদি সত্যিই আপনি মামলার বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত করা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে সেই মামলাগুলোর সংস্কারে মনোনিবেশ করতে হতো।’