শীতকালীন ঝড়ের প্রভাবে দ্বিতীয় দিলের মতো ভারী বৃষ্টিপাতের কবলে পড়েছে গাজা উপত্যকা। এ অবস্থায় বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের আশ্রয়কেন্দ্রে শত শত তাঁবু প্লাবিত হয়েছে। আনাদোলু এজেন্সি জানিয়েছে, শুক্রবার, (১২ ডিসেম্বর ২০২৫) ভোর থেকে রাত পর্যন্ত একটানা বৃষ্টিপাতের ফলে তাঁবুগুলো ডুবে যায়। এর ফলে ইসরায়েলের দুই বছরের গণহত্যার কারণে ইতোমধ্যেই বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। গাজার সিভিল ডিফেন্স বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, দক্ষিণের রাফাহতে কয়েক ডজন তাঁবু সম্পূর্ণরূপে ডুবে গেছে।
সংস্থার মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল সতর্ক করে বলেছেন, অঞ্চলজুড়ে বাস্তুচ্যুত শিবিরে বসবাসকারী ২ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি পরিবার ঠান্ডা আবহাওয়া এবং জীর্ণ তাঁবুতে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ঝড়ের প্রকোপ অব্যাহত থাকলে, বিশেষ করে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর জন্য কোনো অস্থায়ী আশ্রয়স্থল না থাকলে, মানবিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
এর আগে গত মঙ্গলবার গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস সতর্ক করে দিয়েছিল, একটি মেরু নিম্নচাপ বুধবার থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অঞ্চলজুড়ে প্রভাব ফেলবে। এটি লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত পরিবারকে হুমকির মুখে ফেলবে। আনাদোলু এজেন্সি জানায়, ইসরায়েলের যুদ্ধে বেঁচে যাওয়াদের আবাসস্থলে হাজার হাজার তাঁবু প্লাবিত হয়েছে। এর ফলে বিছানা, পোশাক ও খাদ্য ভিজে গেছে। শত শত ফিলিস্তিনি পরিবারকে উষ্ণতা বা আশ্রয় ছাড়া ঠান্ডার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
শীতের রাত। এরপর আবার তুমুল বর্ষণ। ভেসে গেছে আরাফাত আল-গান্দুরের ছোট তাঁবুটি। পাঁচ সন্তান নিয়ে দিশাহারা অবস্থা আরাফাত ও তাঁর স্ত্রী নূরের। সকালের সূর্য ওঠার পর একটু স্বস্তির শ্বাস ফেলতে পারছেন তাঁরা। নূর বললেন, একসময় শীতকাল ভালোই লাগত। তবে এখন সেটিই দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। দুর্বিষহ হবেই না কেন? এটা ফিলিস্তিনের গাজা। দুই বছর ধরে ইসরায়েলের জাতিগত নিধন আর ধ্বংসযজ্ঞের মুখে সেখানে বলতে গেলে আর কোনো ঘরবাড়িই অবশিষ্ট নেই। ছেঁড়া-ফাটা তাঁবু দিয়ে শীত আর কতটা আটকানো যায়। আর গত বুধবার রাতে যে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে, তা আগামী শনিবার পর্যন্ত চলবে—এমনটাই পূর্বাভাস।
আরাফাতের পরিবার বাস্তুচ্যুত। থাকেন মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহে। ইসরায়েলি হামলার মুখে উত্তর গাজা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন তাঁরা। গত বুধবার রাতের বৃষ্টিতে দেইর আল-বালাহর আল-বাসা ও আল-বারাকা এলাকা ভেসে গেছে। পানি জমে দেখা দিয়েছে বন্যা। একই অবস্থা খান ইউনিসে আল-মাওয়াসিসহ নুসেইরাত ও উত্তর গাজার বিভিন্ন এলাকায়। এসব এলাকায় দেখা গেছে, ফিলিস্তিনিদের বহু তাঁবু ভেঙে পড়েছে। ভেতরে পানি-কাদায় একাকার। তীব্র শীতে ভেজা পোশাকে জবুথবু হয়ে আছে শিশুরা। তারা এখন কোথায় থাকবে, কী খাবে নেই তার কোনো ঠিকঠিকানা। রাস্তাঘাটে জমে গেছে পানি। বৃষ্টিপাতের পর গাজাবাসীর কাছ থেকে ২ হাজার ৫০০টির বেশি সাহায্যের আবেদন পেয়েছে স্থানীয় সিভিল ডিফেন্স।
দীর্ঘ সময় ধরে ইসরায়েলের অবরোধের ফলে তাঁবুর মতো শীতের কাপড়েরও সংকট রয়েছে গাজায়। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে শিশুরা। তীব্র শীতে বুধবার রাতেই ৯ মাস বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তার পরিবার থাকে খান ইউনিস এলাকায় একটি তাঁবুতে। শিশুটির মা আল-জাজিরাকে বললেন, সন্তানকে বাঁচাতে সব ধরনের চেষ্টা করেছেন, তারপর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। অসহায় ওই মায়ের কথায়, ‘বৃষ্টি হচ্ছিল। তীব্র শীত। ওকে (শিশু) গরম রাখার জন্য খুব কম জিনিসই ছিল আমার কাছে। খাওয়ানোর পর ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। ভালোমতো কাপড়ে জড়িয়ে দিলাম। তবে শীত ঠেকানোর জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। বৃষ্টি বাড়ছিল, সঙ্গে শীতও। সারা রাত ভয় করছিল—কী হয় না হয়। একসময় দেখলাম আমার ছোট্ট বাচ্চাটা নিথর, প্রাণহীন।’
গাজায় এখন ১৫ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত। বর্তমানে যুদ্ধবিরতি চললেও অনেক ক্ষেত্রে এই মানুষগুলোর জন্য তাঁবু উপত্যকাটিতে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরায়েলি বাহিনী। এমন পরিস্থিতিতে সতর্ক করে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ বলেছে, মানবিক সহায়তা প্রবেশ না করতে দিলে শীত-বৃষ্টিতে গাজায় অসুস্থতা ও সংক্রমণে ঝুঁকি বাড়বে।
গাজার বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ৩ লাখ তাঁবু প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন উপত্যকাটির গণমাধ্যম কার্যালয়ের পরিচালক ইসমাইল আল-তাওয়াবতা। তিনি বলেন, ইসরায়েলের হামলা ও ঝড়বাদলের কারণে হাজার হাজার তাঁবুর ক্ষতি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ৩ লাখ তাঁবুর দরকার হলেও এসেছে মাত্র ২০ হাজার। বৃষ্টিতে গাজার পানি সরবরাহ ব্যবস্থারও ক্ষতি হয়েছে।
নিজেদের দুর্দশার কথা আল-জাজিরাকে বলছিলেন ৬৬ বছর বয়সী বাসমা আল-শেখ খলিল। তাঁর সবচেয়ে দুশ্চিন্তা ছোট ছোট নাতি-নাতনিদের নিয়ে। তাদের কথা বলতে বলতে অশ্রু ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। ভেজা চোখে বললেন, ‘গ্রীষ্ম কি শীত—সব ঋতুই এখন আমাদের জন্য দুর্বিষহ। আল্লাহ ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই।’
গাজার গণমাধ্যম অফিস বলছে, উপত্যকায় ঝড় বায়রনের প্রভাবে প্রায় দুই লাখ ৮৮ হাজার ফিলিস্তিনি পরিবার আশ্রয়হীন। আড়াই লাখ তাঁবু ও ভ্রাম্যমাণ ঘর গাজায় প্রবেশের কথা ছিল। ছয় হাজার ‘ত্রাণবোঝাই’ ট্রাক সীমান্তে আটকে আছে। গণমাধ্যম অফিসের পরিচালক ইসমাইল আল-থাওয়াবতা বলেন, ‘আমরা বিশ্ব, (মার্কিন প্রেসিডেন্ট) ডোনাল্ড ট্রাম্প ও (জাতিসংঘের) নিরাপত্তা পরিষদের কাছে জরুরি আবেদন জানাই, যাতে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়।’
এদিকে, গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগের সঙ্গে কাজ করা দলগুলো গাজা সিটির আল-শিফা হাসপাতাল প্রাঙ্গণে একটি গণকবরের সন্ধান পেয়েছে। ওই হাসপাতালে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েল বারবার আক্রমণ করে। বেসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগ ওই স্থান থেকে ৩০টিরও বেশি মৃতদেহ উদ্ধারে কাজ করছে। এ অবস্থায় গত বুধবার এক দিনে আরও দুই ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের হামলায় নিহত হয়েছেন।
এছাড়া ইসরায়েলের হেফাজতে এক ফিলিস্তিনি বন্দি মারা গেছেন। সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে গত বুধবার সংবাদ সংস্থা ওয়াফা জানায়, ২১ বছর বয়সী আব্দুল রহমান সুফিয়ান মুহাম্মদ আল-সাবাতিন নামের ওই ফিলিস্তিনি যুবক বেথলেহেমের পশ্চিমে হুসান শহরের বাসিন্দা ছিলেন। ডিটেইনিজ অ্যাফেয়ার্স কমিশন ও ফিলিস্তিনি প্রিজনার্স সোসাইটি তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে।
জেরুজালেমের শায়ারে জেদেক মেডিকেল সেন্টারে তিনি মারা যান। আল-সাবাতিনকে গত ২৪ জুন আটক করা হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ইসরায়েলের হেফাজতে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের হেফাজতে মারা যাওয়া বন্দির সংখ্যা ৮৫ তে দাঁড়াল।
মিডিয়া অফিসের পূর্ববর্তী তথ্য অনুসারে, দুই বছরের যুদ্ধে ইসরায়েল অবকাঠামো ধ্বংস করে ফেলার পর ফিলিস্তিনিদের সবচেয়ে মৌলিক আশ্রয়ের চাহিদা মেটাতে প্রায় ৩ লাখ তাঁবু এবং প্রিফেব্রিকেটেড আবাসন ইউনিটের প্রয়োজন। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলি যুদ্ধের ফলে গাজা পুনর্গঠনের খরচ প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার খরচ হতে পারে। এই আগ্রাসনে ৭০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ১০ অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির অধীনে এই হামলা বন্ধ হয়।
সারাদেশ: চিকিৎসক সংকটে চালুহয়নি ডেন্টাল মেশিন