image

নির্বাচনের আগে হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে মায়ানমার সেনাবাহিনী

মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫
বিদেশী সংবাদ মাধ্যম

মায়ানমারে কয়েক দিন পরই জাতীয় নির্বাচন। দেশটির জান্তা সরকারের তফসিল অনুযায়ী ২৮ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচন ঘিরে নানা বিতর্ক ও সমালোচনার মধ্যেই দেশটির বিদ্রোহী–নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন এলাকায় তীব্র বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে মায়ানমারের সামরিক বাহিনী। এতে চরম দুর্দশায় রয়েছেন ওই সব এলাকার মানুষ। যেমন বলা চলে লাং জা কিমের কথাই। গত মাসের শেষের দিকে এক রাতে চিন রাজ্যে তাঁর গ্রামের ওপর দিয়ে উড়ে যায় যুদ্ধবিমান। কাছেই ধোঁয়া উড়তে দেখা যাচ্ছিল। হাতের কাছে যা কিছু ছিল, তা নিয়েই পালিয়ে যান তিনি। গত কয়েক সপ্তাহে জান্তার হামলার মুখে কিমের মতোই বিদ্রোহী–নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো থেকে পালিয়েছেন হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ।

বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহে বাংলাদেশ–সংলগ্ন মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে হামলা চালিয়ে অন্তত ৩০ জনকে হত্যা করেছে জান্তা বাহিনী। এ ছাড়া গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে চিন রাজ্যে অন্তত তিনটি স্কুল ও ছয়টি চার্চে হামলা চালানো হয়েছে। এতে ছয় শিশুসহ ১২ জন নিহত হয়েছেন। এসব বিষয় নিয়ে বিবিসির কাছে কোনো মন্তব্য করেনি জান্তা সরকার।

চিন রাজ্যের অনেকেই বলছেন, জান্তা বাহিনী এখন যে হামলা চালাচ্ছে, তা তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। মায়ানমারে জান্তার সঙ্গে বিদ্রোহীদের এই সংঘাতের শুরু ২০২১ সালে অং সান সু চি সরকারের পতনের পর। ওই বছর নির্বাচিত সু চিকে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। তার পর থেকে চরম দমনপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে জান্তা সরকার।

আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে জান্তা সরকার নিজেদের ক্ষমতা আরও পোক্ত করতে চায় বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। বিভিন্ন দেশ থেকেও আপত্তি জানানো হয়েছে। সু চির দল দ্য ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। হামলার মুখে ঘরবাড়ি ছাড়া রাল উক থাং বলছিলেন, ‘আমরা নির্বাচন চাই না। জান্তা সরকার চালাতে জানে না। সু চির সময় কিছুটা হলেও গণতন্ত্র ছিল।’ নির্বাচন হলে সেখানে কারচুপি হবে বলে বিশ্বাস করেন ইয়াং জা কিম। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি জান্তাসমর্থিত দলকে ভোট না দিই, তাহলে আমাদের ভোট চুরি করে, ওই দলগুলোকে দিয়ে দেওয়া হবে।’ আর চিন রাজ্যের বিদ্রোহী গোষ্ঠী চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের ভাইস চেয়ারম্যান সুই খারের ভাষায়, ‘এই নির্বাচন শুধুই সামরিক স্বৈরশাসন দীর্ঘ করার জন্য। মানুষের পছন্দ–অপছন্দের জন্য নয়।’

সুই খার বলেন, বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত চিন রাজ্যের উত্তরাংশে শত শত জান্তা সেনা অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছেন। যুদ্ধবিমান, ড্রোন ও কামানের গোলার মাধ্যমে তাঁদের সহায়তা করা হচ্ছে। যদিও চীনের এই উত্তরাংশে প্রবেশ করাটা সামরিক বাহিনীর জন্য কষ্টসাধ্য। কারণ, সেখানে বিদ্রোহীদের ঘাঁটিগুলো ঘন জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত। সেখানকার একটি হাসপাতালে গিয়ে কয়েকজন আহত বিদ্রোহী যোদ্ধাকে দেখা যায়। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের অঙ্গচ্ছেদও করতে হয়েছে। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের সময় এই বিদ্রোহীদের অনেকেই ছিলেন স্কুলপড়ুয়া। এখন প্রাপ্তবয়স্কের কাতারে পা রাখা এসব তরুণ সাধারণ জীবন ছেড়ে জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।

এমনই একজন ১৮ বছর বয়সী অ্যাবেল। ডান পা হারিয়েছেন তিনি। হাতেও গুরুতর আঘাত লেগেছে। হাসপাতালে তাঁর পাশের বিছানায় শুয়ে ছিলেন ১৯ বছর বয়সী সি সি মাউং। তাঁরও একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘শত্রু সেনারা পিছু হটছিল। আমরা সামনে এগোতে থাকি। তখন আমি একটি স্থল মাইনের ওপর পা দিয়ে ফেলি। বিস্ফোরণে আমরা আহত হই। এরপর আকাশপথে হামলা চালানো হয়। আমি একটি পা হারিয়েছি। কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জন্য একটি ভালো জীবন উপহার দিতে যদি প্রাণ দিতেও হয়, তাতেও আমি খুশি।’

এদিকে, গত মাসে এক গভীর রাতে ইয়াং জা কিম তাঁর পাশের গ্রামে একটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান। এর পরপরই তাঁর মাথার ওপর দিয়ে যুদ্ধবিমান উড়ে যায়। দূরে ধোঁয়া দেখে তিনি ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসেন। ইয়াং জা কিম বলেন, ‘আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম, জান্তা সরকারের যুদ্ধবিমানগুলো আমাদের ওপরও বোমা ফেলবে। তাই আমরা কিছু খাবার, জামাকাপড়সহ হাতের কাছে যা পেলাম, তা নিয়ে গ্রামের পাশের জঙ্গলে দৌড়ে পালাই।’

মায়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় চিন প্রদেশে নিজ গ্রাম কে-হাইমুয়ালে বিবিসির সঙ্গে কথা বলেন এই নারী। গত ২৬ নভেম্বর ঘটে যাওয়া ওই দুর্বিষহ ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার সময় ইয়াং জা কিমের চোখেমুখে উৎকণ্ঠার ছাপ দেখা যাচ্ছিল।

মায়ানমারের সাধারণ মানুষদের সঙ্গে প্রাণখুলে কথা বলা সহজ নয়। সামরিক সরকার বিদেশি সাংবাদিকদের দেশটিতে অবাধে প্রবেশের অনুমতি দেয় না। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে, অর্থাৎ গত নির্বাচনের পরপরই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারা ক্ষমতা দখল করে। এর পর থেকেই নিজেদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ দমনে নির্বিচারে সাধারণ মানুষের ওপর আগ্রাসন চালাচ্ছে।

২৮ ডিসেম্বর থেকে মায়ানমারে জাতীয় নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শুরু হতে যাচ্ছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক দমন–পীড়ন শুরু করেছে মায়ানমারের জান্তা সরকার। বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলো নতুন করে নিজেদের দখলে নিতে ব্যাপক বিমান হামলা ও স্থল অভিযান চালাচ্ছে সেনাবাহিনী। এ কারণে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় আক্রান্ত এলাকার কয়েক হাজার সাধারণ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁদেরই একজন ইয়াং জা কিম। কিম যখন বিবিসির কাছে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর পাশে মাদুর পেতে বসে ছিলেন আরও চার নারী। এ সময় তাঁরাও কাঁদতে শুরু করেন। সে রাতে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছাতে গিয়ে তাঁদের যে দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তার ছাপ তাঁদের চোখেমুখে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।

বিমান হামলার পরপরই বাড়ি ছেড়ে পালানো কিম আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিতে চান না। এই নারী বলেন, ‘যদি আমরা ধরা পড়ি এবং ভোট দিতে রাজি না হই, তবে তারা আমাদের জেলে ঢোকাবে এবং নির্যাতন করবে। আমাদের যাতে ভোট দিতে না হয়, সে জন্যই আমরা পালিয়ে এসেছি।’

জান্তা বাহিনী সর্বশেষ গত সপ্তাহে চিন রাজ্যের দক্ষিণে রাখাইন রাজ্যের একটি হাসপাতালে হামলা চালায়। রাখাইনের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো বলছে, এতে অন্তত ৩০ জন নিহত ও ৭০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। মায়ানমারের চিন প্রদেশের কেউ কেউ জান্তা সরকারের সর্বশেষ এই হামলা ও দমন–পীড়নকে গত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বলে বর্ণনা করেছেন। বাড়িঘর ছেড়ে পালানো মানুষদের অনেকে প্রদেশের অন্যান্য অংশে আশ্রয় নিয়েছেন। আর ইয়াং জা কিমসহ কিছু মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের মিজোরাম রাজ্যে প্রবেশ করেছেন।

তাঁরা সেখানকার ভাফাই গ্রামের ব্যাডমিন্টন খেলার পরিত্যক্ত একটি মাঠে আশ্রয় নিয়েছেন। সঙ্গে করে সামান্য যেসব জিনিস আনতে পেরেছেন, তা প্লাস্টিকের বস্তায় রেখে দিয়েছেন। ওই গ্রামের বাসিন্দারা তাঁদের খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে সাহায্য করছেন।

৮০ বছর বয়সী রাল উক থাংকেও এই বয়সে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছানোর আগপর্যন্ত দিনের পর দিন জঙ্গলে তাঁবু টাঙিয়ে থেকেছেন তিনি। রাল উক থাং বলেন, ‘আমরা আমাদের এই সরকারকে ভয় পাই। তারা অত্যন্ত নিষ্ঠুর। তাদের সেনাবাহিনী অতীতে আমাদের ও অন্যান্য গ্রামে ঢুকে মানুষকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করেছে এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে।’

মায়ানমারের সাধারণ মানুষদের সঙ্গে প্রাণখুলে কথা বলা সহজ নয়। সামরিক সরকার বিদেশি সাংবাদিকদের দেশটিতে অবাধে প্রবেশের অনুমতি দেয় না। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অর্থাৎ গত নির্বাচনের পরপরই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারা ক্ষমতা দখল করে। এর পর থেকেই নিজেদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ দমনে নির্বিচারে সাধারণ মানুষের ওপর আগ্রাসন চালাচ্ছে। জান্তা বাহিনী সর্বশেষ গত সপ্তাহে চিন রাজ্যের দক্ষিণে রাখাইন রাজ্যের একটি হাসপাতালে হামলা চালায়। রাখাইনের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো বলছে, এতে অন্তত ৩০ জন নিহত ও ৭০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।

‘আন্তর্জাতিক’ : আরও খবর

সম্প্রতি