image

সাত দশক ধরে সামরিক শাসনের আবর্তে মায়ানমার

বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫
বিদেশী সংবাদ মাধ্যম

স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে বেশির ভাগ সময় মিায়ানমার শাসন করেছে সামরিক বাহিনী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নানা আদর্শ ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত এই দেশকে পতনের হাত থেকে বাঁচাতে একমাত্র রক্ষাকর্তা হিসেবে বরাবরই নিজেদের তুলে ধরেছেন সামরিক শাসকেরা। সবশেষ এক যুগ আগে গণতন্ত্রের পথে আবার মিায়ানমার যাত্রা শুরু করলেও তা বেশি সময় স্থায়ী হয়নি।

পাঁচ বছর ধরে সামরিক জান্তার শাসনের মুখে মিায়ানমার গৃহযুদ্ধে জর্জরিত। এরই মধ্যে ২৮ ডিসেম্বর থেকে দেশটিতে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করেছে সরকার। এই নির্বাচন কতটা স্বচ্ছ হবে বা তাতে জনগণের মতের কতটা প্রতিফলন হবে, তা নিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে বহু বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই একে দেখছেন জান্তার ক্ষমতা পোক্ত করার একটি হাতিয়ার হিসেবে।

মিায়ানমারে সামরিক শাসন সম্পর্কে শুরু থেকে জানতে হলে ফিরতে হবে বেশ খানিকটা পেছনে। মিায়ানমার তখন পরিচিত বার্মা নামে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা পায় মিায়ানমার। মিায়ানমারের এই স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অং সান। তিনি দেশটির কারাবন্দী নেত্রী নোবেলজয়ী অং সান সু চির বাবা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের উৎখাত করতে জাপানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন অং সান। তবে যুদ্ধের মোড় ঘুরে মিত্রপক্ষের দিকে গেলে তিনি আবার দল বদলান। স্বাধীনতার জন্য লন্ডনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। স্বাধীনতার পর মিায়ানমারে বেশ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। তবে অভ্যন্তরীণ বিভক্তি এবং বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াইয়ের মুখে পড়ে বেসামরিক সরকার।

এমন পরিস্থিতিতে ১৯৫৮ সালে সামরিক বাহিনীকে দুই বছরের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর নির্বাচন হয়েছিল। তবে ১৯৬২ সালে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেয় সামরিক বাহিনী। অং সানের একসময়ের সহযোদ্ধা নে উইন দেশ রক্ষার কথা বলে এই পদক্ষেপ নেন। অং সান হত্যার পর এক রহস্যময় পরিস্থিতিতে তিনি সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়েছিলেন। নে উইন বলেছিলেন, সময়মতো তিনি মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন; তবে কথা রাখেননি। ২৬ বছর মিায়ানমার শাসন করেন তিনি। কায়েম করেন নামমাত্র সমাজতান্ত্রিক একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা। এতে বিশ্বে মিায়ানমার একঘরে হয়ে পড়ে। এর ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছিল। অর্থনীতি ধসে পড়ে। ক্ষমতা ধরে রাখতে ভিন্নমত দমনের পথে হাঁটে জান্তা।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রদের নেতৃত্বে গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের মুখে ১৯৮৮ সালে পদত্যাগ করেন নে উইন। তখন সামরিক বাহিনীর নতুন নেতৃত্ব আবার অভ্যুত্থান করে। আন্দোলনকারীদের কঠোর হাতে দমন করা হয়। হত্যার শিকার হন ৩ হাজারের বেশি মানুষ। কারাগারে স্থান হয় অনেকের। এরপর ১৯৯২ সালে সামরিক সরকারের দায়িত্ব নেন জেনারেল থান শোয়ে। ২০১১ সালে থান শোয়ে অবসর নেন। ক্ষমতা তুলে দেন বেসামরিক সরকারের হাতে। মিায়ানমারের নতুন নেতা হন প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন। তিনি সু চিকে কারাগার থেকে মুক্তি দেন। ২০১৫ সালে নির্বাচনে বিশাল জয় পায় সু চির দল। ২০২০ সালেও জয় পান তিনি। তবে এই নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে—এমন অভিযোগ এনে ২০২১ সালে ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী।

জান্তা সরকারের প্রধান হন জেনারেল মিন অং হ্লাইং। আবার কারাবন্দী করা হয় সু চিকে। বিভক্ত হয়ে পড়ে দেশ। শুরু হয় জান্তাবিরোধী সশস্ত্র বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহীরা চান না ২৮ ডিসেম্বরের নির্বাচন হোক। কারণ, এর মাধ্যমে সামরিক শাসন আরও পোক্ত হওয়া ছাড়া অন্য কিছু দেখছেন না তাঁরা। এমনই পরিস্থিতিতে শুরু হতে যাচ্ছে ভোট গ্রহণ। তা শেষ হলে ২০২৬ সালের শেষ নাগাদ হতে পারে ফল প্রকাশ।

এদিকে, জাতিসংঘ মঙ্গলবার জানিয়েছে, মিায়ানমারের জান্তা সরকার আসন্ন সেনানিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে জনগণকে ভোট দিতে বাধ্য করতে সহিংসতা চালাচ্ছে এবং ভয়ভীতিও প্রদর্শন করছে। অন্যদিকে মানুষকে ভোট থেকে বিরত রাখতে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোও একই ধরনের কৌশল ব্যবহার করছে।

জেনেভা থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানিয়েছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকারপ্রধান এক বিবৃতিতে বলেন, মিায়ানমারের সামরিক কর্তৃপক্ষকে ভোট দিতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে জনগণের প্রতি নৃশংস সহিংসতা বন্ধের পাশাপাশি ভিন্নমত প্রকাশের কারণে মানুষকে গ্রেপ্তার থামাতে হবে। মিায়ানমারের জান্তা আগামী রোববার থেকে ভোট আয়োজন করতে যাচ্ছে। তারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত এই নির্বাচনকে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন হিসেবে প্রচার করছে। দেশটির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের ও গৃহযুদ্ধ শুরুর পাঁচ বছর পর নির্বাচনের আয়োজন করা হচ্ছে।

অপর দিকে সাবেক বেসামরিক নেতা নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি এখনো কারাগারে রয়েছেন এবং তার জনপ্রিয় দলটিও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা ধাপে ধাপে এক মাসব্যাপী এই ভোটকে সামরিক শাসনের নতুন রূপ হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ফলকার টুর্ক গত মাসে এএফপিকে বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মিায়ানমারে নির্বাচন আয়োজন ‘অকল্পনীয়’। মঙ্গলবার তিনি সতর্ক করে বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে সাধারণ মানুষ সামরিক কর্তৃপক্ষ এবং সশস্ত্র বিরোধী গোষ্ঠী উভয়ের হুমকির মুখে পড়ছে।

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ‘নির্বাচন সুরক্ষা আইন’-এর অধীনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রয়োগের কারণে বহু মানুষকে আটক করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, অনেককে ‘অত্যন্ত কঠোর সাজা’ দেওয়া হয়েছে। ইয়াঙ্গুন অঞ্চলের হ্লাইংহায়া শহরতলির তিন যুবককে নির্বাচনবিরোধী পোস্টার টাঙানোর কারণে ৪২ থেকে ৪৯ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় জানিয়েছে, তারা ম্যান্ডালে অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাস্তুচ্যুত মানুষের কাছ থেকে রিপোর্ট পেয়েছে। তাদের সতর্ক করা হয়েছে, ভোট দিতে না গেলে তাদের ওপর হামলা চালানো হবে বা তাদের বাড়িঘর দখল করা হবে।

ভলকার টুর্ক জোর দিয়ে বলেন, বাস্তুচ্যুত মানুষকে অনিরাপদ অবস্থায় ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভোট দিতে বাধ্য করা মানবাধিকার লঙ্ঘন। তিনি আরও বলেন, মানুষ সামরিক সরকারবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীর কাছ থেকেও ‘মারাত্মক হুমকির’ মুখে পড়ছে। এর মধ্যে রয়েছেন ৯ জন নারী শিক্ষক, যাঁদের গত মাসে কিয়াইকতো থেকে অপহরণ করা হয়। তখন তাঁরা ব্যালটসংক্রান্ত প্রশিক্ষণে অংশ নিতে যাচ্ছিলেন। বিবৃতিতে বলা হয়, পরে তাঁদের অপরাধীদের পক্ষ থেকে সতর্কবার্তাসহ মুক্তি দেওয়া হয়। ভলকার টুর্ক বলেন, এই নির্বাচন স্পষ্টতই সহিংসতা ও দমন–পীড়নের পরিবেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যেখানে জনগণের স্বাধীন মতপ্রকাশ, সংগঠন বা শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগের কোনো পরিবেশ নেই।

‘আন্তর্জাতিক’ : আরও খবর

সম্প্রতি