image

যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা সামনে আনলেন জেলেনস্কি, পুতিন কি মানবেন

শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫
বিদেশী সংবাদ মাধ্যম

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে তৈরি করা একটি খসড়া পরিকল্পনার সর্বশেষ সংস্করণের শর্তে বেশ কিছু ছাড় পেয়েছে কিয়েভ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি গত মঙ্গলবার এই পরিকল্পনার কথা সামনে এনেছেন। তবে মস্কো এই নতুন শর্তগুলো মেনে নেবে কি না, তা নিয়ে এখনো বড় ধরনের প্রশ্ন রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের মধ্যে সমঝোতা হওয়া ২০ দফার পরিকল্পনাটি বর্তমানে মস্কোর পর্যালোচনায় রয়েছে। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, পূর্ব ইউক্রেন থেকে কিয়েভকে পুরোপুরি সেনা সরিয়ে নেওয়ার যে কঠোর অবস্থানে ক্রেমলিন অনড় রয়েছে, তা থেকে তার সরে আসার সম্ভাবনা কম। জেলেনস্কি স্বীকার করেছেন যে খসড়া নথির সব দফা তাঁর পছন্দ নয়। তবে কিয়েভ সফলভাবে সেই শর্তগুলো বাদ দিতে পেরেছে, যেখানে দোনেৎস্ক অঞ্চল থেকে অবিলম্বে ইউক্রেনীয় সেনা প্রত্যাহার অথবা রাশিয়ার দখল করা ভূখণ্ডকে রুশ ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল।

তবে জেলেনস্কি ইঙ্গিত দিয়েছেন, এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে কিয়েভের জন্য কিছু এলাকা থেকে তাদের সেনা সরিয়ে নেওয়ার পথ তৈরি হবে। এর মধ্যে দোনেৎস্ক অঞ্চলের সেই ২০ শতাংশ এলাকাও রয়েছে, যা বর্তমানে ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে আছে; সেখানে একটি ‘অসামরিক অঞ্চল’ গড়ে তোলা হবে। এ ছাড়া ন্যাটোতে যোগদানের আবেদন প্রত্যাহার করে নেওয়ার যে শর্ত আগে ছিল, নতুন খসড়া থেকে সেটিও বাদ দেওয়া হয়েছে। গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সঙ্গে দুই ঘণ্টার এক ব্রিফিংয়ে জেলেনস্কি এই পরিকল্পনা তুলে ধরেন। পরিকল্পনার সর্বশেষ সংস্করণ সম্পর্কে জেলেনস্কি বলেন, ‘দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝঝিয়া এবং খেরসন অঞ্চলে চুক্তি স্বাক্ষরের দিন পর্যন্ত যে অবস্থানে সেনারা মোতায়েন থাকবে, সেটিকে কার্যত লাইন অব কন্টাক্ট বা নিয়ন্ত্রণরেখা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।’

জেলেনস্কি আরও বলেন, যুদ্ধ বন্ধে প্রয়োজনীয় সেনাবিন্যাস নির্ধারণ এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর রূপরেখা তৈরির লক্ষ্যে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ বা কার্যনির্বাহী দল গঠন করা হবে। এই পরিকল্পনা থেকে এটিই প্রতীয়মান হচ্ছে যে ইউক্রেন আগে যেসব বিষয়ে অনীহা প্রকাশ করেছিল, যেমন সেনা প্রত্যাহার এবং অসামরিক অঞ্চল গঠন—নতুন প্রস্তাবে সেই পথই উন্মুক্ত করছে। তবে এই প্রক্রিয়াকে কিছুটা বিলম্বিত করার সুযোগ রাখা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জেলেনস্কি বলেন, ‘আমরা এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে আছি, যেখানে রাশিয়া চায় আমরা দোনেৎস্ক অঞ্চল থেকে সরে আসি, আর অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র একটি সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছে।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘তারা মূলত একটি অসামরিক অঞ্চল বা মুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের খোঁজ করছে; অর্থাৎ এমন একটি কাঠামো, যা উভয় পক্ষকেই সন্তুষ্ট করতে পারবে।’

নেটো, ভূখণ্ড ও পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রসঙ্গ: ২০২২ সালে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া চার বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতার চেষ্টা করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই দীর্ঘ যুদ্ধে ইতিমধ্যে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে পূর্ব ইউক্রেন এবং ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ বাহিনী বর্তমানে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে এবং ক্রমাগত অগ্রসর হচ্ছে। প্রায় প্রতি রাতেই ইউক্রেনের শহর ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন কেন্দ্রগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে তারা। বুধবার রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, তারা দক্ষিণ জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলের আরও একটি এলাকা দখল করেছে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর, ২০২২ সালে ইউক্রেনের আরও চারটি অঞ্চল—দোনেৎস্ক, খেরসন, লুহানস্ক ও জাপোরিঝঝিয়া—নিজেদের ভূখণ্ড ভুক্ত করার দাবি করে মস্কো।

এদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের আপসের ইঙ্গিত দেননি। উল্টো তিনি ইউক্রেনীয় সেনা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক ছাড় দেওয়ার যে কঠোর দাবি তুলেছেন, কিয়েভ ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা একে ‘আত্মসমর্পণ’ হিসেবেই দেখছে। জেলেনস্কি স্পষ্ট জানিয়েছেন, সেনা প্রত্যাহারের মতো কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে ইউক্রেনে গণভোটের প্রয়োজন হবে। তিনি বলেন, ‘যদি মুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে আলোচনা হয়, তবে আমাদের গণভোটে যেতে হবে।’ নতুন পরিকল্পনায় রুশ সেনাদের দখলে থাকা জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন ও রাশিয়ার যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে জেলেনস্কি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এই স্থাপনায় তিনি রাশিয়ার কোনো ধরনের তদারকি চান না।

প্রস্তাব গেছে পুতিনের কাছে: প্রস্তাবের বিস্তারিত বিবরণ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে পাঠিয়েছেন তাঁর বিশেষ দূত কিরিল দিমিত্রিভ। তবে ক্রেমলিনের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, মস্কো বর্তমানে তাদের প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে এবং এখনই এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করবে না।

যুদ্ধ বন্ধে জনমত জরিপ: ইউক্রেন যুদ্ধ ২০২৬ সালেই শেষ হবে বলে মনে করছেন অধিকাংশ রুশ নাগরিক। রাশিয়ার সরকারি গবেষণাকেন্দ্রের এক জরিপেও বিষয়টি উঠে এসেছে। রাশিয়ার শীর্ষস্থানীয় জনমত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘ভিটিএসআইওএম’ গত বুধবার বার্ষিক জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। বিদায়ী বছরের অভিজ্ঞতা এবং আগামী বছরের প্রত্যাশা নিয়ে করা জরিপে দেখা গেছে, ২০২৬ সাল নিয়ে রুশ নাগরিকদের মধ্যে ‘ক্রমবর্ধমান ইতিবাচক’ মনোভাব তৈরি হয়েছে।

এদিকে, সামরিক সাফল্য দেখানো এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় প্রভাব ফেলতে ইউক্রেন নিয়ে নিজেদের দাবি আরও জোরালো করছে রাশিয়া। গত শুক্রবার চলতি বছরের শেষ সংবাদ সম্মেলনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, রাশিয়ার বাহিনী পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক অঞ্চলের সিভেরস্ক এবং উত্তর খারকিভ অঞ্চলের ভভচানস্ক দখল করেছে। খবর- আলজাজিরার।

পুতিন দাবি করেন, দোনেৎস্কের লিমান ও কোস্তিয়ানতিনিভকার অন্তত অর্ধেক এলাকা এবং দক্ষিণের জাপোরিঝিয়া অঞ্চলের হুলিয়াইপোল রাশিয়ার দখলে। যদিও ইউক্রেনপন্থি বিশ্লেষকরা এ দাবি মানতে নারাজ। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) জানায়, উপগ্রহ চিত্র ও উন্মুক্ত উৎসের প্রমাণ পুতিনের দাবির সঙ্গে মিলছে না।

আইএসডব্লিউ বলেছে, এসব শহর পুরোপুরি বা বড় আকারে দখলের কোনো প্রমাণ তারা পায়নি। বরং হুলিয়াইপোলের মাত্র ৭ দশমিক ৩ শতাংশ এবং লিমানের ২ দশমিক ৯ শতাংশ এলাকায় রুশ বাহিনীর উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে। এ ছাড়া কোস্তিয়ানতিনিভকার ক্ষেত্রেও রাশিয়ার অগ্রগতি ৫ শতাংশের বেশি নয়। গত ১৮ ডিসেম্বর রুশ সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ বিদেশি সামরিক কর্মকর্তাদের জানান, চলতি বছরে রাশিয়া ইউক্রেনের ছয় হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করেছে। এর এক সপ্তাহ আগে প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রেই বেলউসভ বলেছিলেন, দখল করা এলাকা ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার।

তবে আইএসডব্লিউর হিসাবে, রাশিয়া সর্বোচ্চ চার হাজার ৯৮৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা এবং ১৯৬টি বসতি দখল করেছে। এ সংখ্যা রুশ কর্মকর্তাদের দাবি করা ৩০০টির চেয়ে অনেক কম। রাশিয়ার এই অতিরঞ্জিত দাবিগুলো এমন একসময়ে এসেছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা জোরদার করেছে। গত মঙ্গলবার রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছাতে চায় এবং ইউক্রেন পূর্ণ সহযোগিতা করছে।

তবে গত বুধবার প্রকাশিত ২০ দফা পরিকল্পনায় দেখা যায়, সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় ভূখণ্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে কোনো ঐকমত্য হয়নি।

রাশিয়া দাবি করছে, দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝিয়া ও খেরসন অঞ্চল সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দিতে হবে, সঙ্গে আগের দখল করা ক্রিমিয়াও। ইউক্রেন তা মানতে রাজি নয়।

ইউরোপের ওপর মস্কোর ছায়া: রাশিয়ার হুমকি ইউরোপকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে। গত মাসে লন্ডনের হোয়াইটহলে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের এক বৈঠকে বলা হয়, যুক্তরাজ্য ও তার মিত্ররা সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয়। এই বৈঠকে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা ছিলেন অভিজ্ঞ সামরিক, সরকারি, ন্যাটো কর্মকর্তা, গবেষক ও প্রতিরক্ষা শিল্পের পেশাজীবী। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাদের মূল্যায়ন– রাশিয়া ইউরোপের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

‘আন্তর্জাতিক’ : আরও খবর

» পারমাণবিক সাবমেরিন থেকে নতুন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা ভারতের

সম্প্রতি