image

সোমালিল্যান্ড কেন হঠাৎ বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে?

ইসরায়েল কেন প্রথম দেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিল

সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫
বিদেশী সংবাদ মাধ্যম

হর্ন অব আফ্রিকা- বিশ্বের সবচেয়ে উত্তপ্ত রাজনৈতিক অঞ্চলের একটি, যা সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে মনোযোগ কেড়েছে। তবে এবারের বিষয়টি শুধু আফ্রিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নয়। স্বঘোষিত সোমালিল্যান্ড এখন অঞ্চলটি নিয়ে কূটনৈতিক বিতর্ক, কৌশলগত হিসাব এবং আন্তর্জাতিক শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

সোমালিল্যান্ড ১৯৯১ সালে সোমালিয়া থেকে আলাদা হয়ে একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে, কিন্তু জাতিসংঘসহ কোনো আন্তর্জাতিক শক্তি ও রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে এটিকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে দেশটি দীর্ঘদিন ধরে ‘অধিকারহীন’ রাষ্ট্র হিসেবে থেকে যায়। কিন্তু এই অবস্থান হঠাৎ করেই বদলেছে শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) ইসরায়েলের স্বীকৃতি ঘোষণার পর। ইসরায়েল সোমালিল্যান্ডকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

সৌদি আরব ও আরব বিশ্বের প্রতিক্রিয়া: ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ সৌদি আরব, মিশর ও তুরস্কে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সৌদি আরব স্পষ্ট জানায় যে তারা সোমালিয়ার সার্বভৌমত্ব ও ঐক্যের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছে ও কোনো ‘সমান্তরাল রাষ্ট্র’কে গ্রহণ করবে না। মিশরও একই অবস্থান নেয়। আর তুরস্কের মতে, এটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের পথকে বাধাগ্রস্ত করার একটি সুদূরপ্রসারী চাল বা কূটকৌশল হতে পারে।

কূটনীতিকরা মনে করছেন, এই বিতর্ক আর কেবল আফ্রিকার অভ্যন্তরীণ ইস্যু নয়। এটি মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা সংযোগের কৌশলগত ও নিরাপত্তা বিষয়ক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন। সৌদি আরব এবং মিশরের উদ্বেগের মূল কারণ হলো, লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরের নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণে নতুন শক্তির প্রবেশ।

কৌশলগত অবস্থান: লোহিত সাগর ও বাণিজ্যপথ: সোমালিল্যান্ডের ভৌগোলিক অবস্থান আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর আগ্রহের প্রধান কারণ। অঞ্চলটি এডেন উপসাগর এবং লোহিত সাগরের মুখে অবস্থিত- যে পথ দিয়ে পৃথিবীর বৃহৎ অংশের জ্বালানি ও বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করে।

গাজা যুদ্ধ, ইয়েমেন সংঘাত এবং হুথি বিদ্রোহীদের হামলা এই অঞ্চলের নিরাপত্তাকে অস্থিতিশীল করেছে। এই পরিস্থিতিতে সোমালিল্যান্ডকে সম্ভাব্য স্থিতিশীল সামরিক ও নৌঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, যা লোহিত সাগরে কৌশলগত উপস্থিতি বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।

সোমালিল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি: সোমালিল্যান্ডের নিজস্ব প্রশাসন, নির্বাচন ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে। তারা নিজেকে সোমালিয়ার তুলনায় স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক অঞ্চল হিসেবে তুলে ধরছে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলে তারা বিদেশি বিনিয়োগ, উন্নয়ন সহায়তা ও বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে পারবে।

বড় শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা: চীন সাধারণত বিদ্যমান রাষ্ট্রসীমার প্রতি অনুগত থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো কৌশলগত স্বার্থের কারণে সোমালিল্যান্ডে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিশেষ করে, লোহিত সাগরের নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের দিক থেকে এই অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়াও আঞ্চলিক রাজনৈতিক ও সামরিক সুযোগের দৃষ্টিকোণ থেকে নজর রাখছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সোমালিল্যান্ডকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক শক্তির একটি নতুন কৌশলগত মঞ্চ তৈরি হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান: এদিকে, সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে মার্কিন প্রশাসন দ্বিধাবিভক্ত বলে জানা গেছে। এমনকি, শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) নিউইয়র্ক পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরোধিতা করেছেন মার্কিনপ্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। তবে গত আগস্টে, হোয়াইট হাউজে এক সংবাদ সম্মেলনে সোমালিল্যান্ড প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প ইঙ্গিত দেন যে, তিনি এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, আরেকটি জটিল বিষয়, সোমালিল্যান্ড। কিন্তু আমরা এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি।

কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন যে, সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিলে সোমালিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র সোমালিয়ায় সৈন্য মোতায়েন করেছে, যারা ইসলামিক আন্দোলন আল-শাবাবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সোমালি বাহিনীকে সমর্থন করে। তবে মার্কিন প্রশাসনে সোমালিল্যান্ডের পক্ষে কথা বলছেন এমন প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও আছেন। তাদের মধ্যে একজন মার্কিন রিপাবলিকান পার্টির প্রভাবশালী নেতা সিনেটর টেড ক্রুজ। তিনি সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ওয়াশিংটনের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন। পাশাপাশি তিনি সোমালিল্যান্ড ও ইসরায়েলের মধ্যে গভীর সম্পর্ক স্থাপনের পক্ষেও বরাবরই সোচ্চার ছিলেন।

সোমালিয়ার তীব্র প্রতিক্রিয়া: সোমালিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার ইসরায়েলের ঘোষণার বিরুদ্ধে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। তারা মনে করে, সোমালিল্যান্ড হলো সোমালিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ ও একতরফাভাবে কোনো দেশকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত নয়।

সামগ্রিক প্রভাব: সোমালিল্যান্ড এখন আর কেবল একটি স্বঘোষিত অঞ্চল নয়; এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথ, কৌশলগত শক্তির প্রতিযোগিতা এবং মধ্যপ্রাচ্য-আফ্রিকা সংযোগের কেন্দ্র। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী কয়েক বছর এই অঞ্চলটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি স্পর্শকাতর পরীক্ষা হবে, যেখানে স্থানীয় স্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং শক্তির দ্বন্দ্ব মিলিতভাবে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে।

এদিকে, ইসরায়েল কেন সোমালিয়া থেকে স্বাধীন হতে চাওয়া সোমালিল্যান্ডকে প্রথম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিল—এই প্রশ্ন ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র আলোচনা ও সমালোচনা শুরু হয়েছে। আফ্রিকার হর্ন অঞ্চলের স্বঘোষিত স্বাধীন রাষ্ট্র সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে ইসরায়েল শুধু একটি কূটনৈতিক সিদ্ধান্তই নেয়নি, বরং মধ্যপ্রাচ্য ও লোহিত সাগর ঘিরে চলমান ভূরাজনৈতিক উত্তেজনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই স্বীকৃতির পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক—এই তিনটি প্রধান কারণ। সোমালিল্যান্ডের অবস্থান অত্যন্ত কৌশলগত। এটি এডেন উপসাগরের তীরে অবস্থিত এবং ইয়েমেনের খুব কাছেই, যেখানে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা সক্রিয়। চলতি বছরে হুতি ও ইসরায়েলের মধ্যে একাধিকবার হামলা ও পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে। গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের প্রতিবাদে হুতিরা লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালায়। জবাবে ইয়েমেনের সানা ও হোদেইদায় হুতি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় হামলা চালায় ইসরায়েল।

এই প্রেক্ষাপটে ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের গবেষক ডেভিড মাকোভস্কি প্রশ্ন তুলেছেন—সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে কি ইসরায়েল সেখানে সামরিক সুবিধা বা গোয়েন্দা উপস্থিতির পথ খুলেছে বিশেষ করে হুতি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলায় এটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ইসরায়েলের গণমাধ্যম ‘চ্যানেল ১২’ জানিয়েছে, সোমালিল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আব্দিরাহমান মোহাম্মদ আবদুল্লাহি গোপনে একাধিকবার ইসরায়েল সফর করেছেন।

গত অক্টোবরে তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ ও মোসাদের প্রধান ডেভিড বারনিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে নেতানিয়াহু এই স্বীকৃতির ক্ষেত্রে মোসাদের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন।

তবে এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছে সোমালিয়া ও আফ্রিকান ইউনিয়ন। মিসর ও ফিলিস্তিনসহ কয়েকটি আরব দেশও এর সমালোচনা করেছে। অতীতে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোর করে সোমালিল্যান্ডে স্থানান্তরের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, যদিও সোমালিল্যান্ডের কর্মকর্তারা এই ধরনের কোনো যোগাযোগের কথা অস্বীকার করেছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি ইসরায়েলের জন্য অর্থনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। সোমালিল্যান্ডের বন্দরনগরী বেরবেরা ইসরায়েলকে লোহিত সাগরে প্রবেশের সুযোগ দিতে পারে। এমন হলে বৈশ্বিক বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাব আল-মানদেব প্রণালির ওপর নজরদারি চালাতে পারবে ইসরায়েল। তবে সব মিলিয়ে, সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিয়ে ইসরায়েল ইতিহাস তৈরি করলেও এর পূর্ণ প্রভাব ও ফলাফল এখনো স্পষ্ট নয়।

‘আন্তর্জাতিক’ : আরও খবর

সম্প্রতি