image

মায়ানমারে নির্বাচন নাকি বন্দুকের মুখে

মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫
বিদেশী সংবাদ মাধ্যম

মায়ানমারে সামরিক জান্তা আয়োজিত জাতীয় নির্বাচনের প্রথম ধাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে রোববার। এ নির্বাচনে ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে ক্ষমতায় দেখতে চায় সেনা সরকার। এজন্য গৃহযুদ্ধের মধ্যেও নির্বাচনের এই তোড়জোড়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি কোনো নির্বাচন নয়; এটি বন্দুকের মুখে পরিচালিত একটি অযৌক্তিক নাটক। এই নির্বাচন মায়ানমারের সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ নয়। এটি এমন একটি চক্রান্ত, যা দমন, বিভাজন এবং সংঘাতকে স্থায়ী করবে। ভোটের দ্বিতীয় ধাপ ১১ জানুয়ারি ও তৃতীয় ধাপ ২৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। ফলাফল কখন ঘোষণা করা হবে তা স্পষ্ট নয়।

২০২১ সালের অভ্যুত্থানের ফলে ক্ষমতায় আসে বর্তমান সামরিক সরকার। এরপর থেকে মায়ানমারে গৃহযুদ্ধে আনুমানিক ৯০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৫ লাখ এবং প্রায় ২২ মিলিয়ন মানুষের মানবিক সহায়তার প্রয়োজন হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চীনের সহায়তায় জান্তা সরকার ধ্বংসাত্মক অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে বৈধতা দিতে চাইছে।

জাতিসংঘের বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুজ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এর থেকে ‘অবৈধ কিছুই’ হতে পারে না। একদিকে জান্তা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক নেতাদের কারাগারে আটক করছে। সবধরনের ভিন্নমতকে অপরাধী করে তুলছে। এটা কোনো নির্বাচন নয়।

২০১৫ ও ২০২০ সালে নিরঙ্কুশ জয় পাওয়া অং সান সু চির ন্যাশনাল লীগ অব ডেমোক্রেসিসহ (এনএলডি) প্রায় ৪০টি দল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সু চি এবং দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অনেকেই নির্বাসনে রয়েছেন। নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী দল স্প্রিং স্প্রাউটসের মুখপাত্র হটিন কিয়াও আয়ে মায়ানমার নাউ সংবাদ সংস্থাকে বলেন, ফলাফল প্রভাবিত করতেই ভোটকে তিন ধাপে ভাগ করে কর্তৃপক্ষ কৌশল নিয়েছে। এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনের বিশ্লেষক আমায়েল ভিয়ার বলছেন, ভোটারদের পছন্দের প্রার্থীর অভাব। ২০২০ সালে ৭৩ শতাংশ ভোটার যেসব দলের প্রার্থীদের ভোট দিয়েছিল, সেসব দলের কোনো অস্তিত্ব আর নেই।

তিনি বলেন, সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়নের অধীনে বিরোধী দলকে একত্রিত করা কঠিন। অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্সের মতে, বর্তমানে ২২ হাজারের বেশি লোক রাজনৈতিক মামলায় আটক রয়েছেন।

রাজধানীর একটি সুরক্ষিত ভোটকেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং বিবিসিকে বলেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। রোবাবর ভোটের দিন ইয়াঙ্গুন শহরের কেন্দ্রস্থলে স্টেশনগুলোতে রাতারাতি কঠোর নিরাপত্তা জারি করা হয়। প্রথমবারের মতো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে।

ভোট ঘিরে বেপরোয়া সামরিক সরকার: সামরিক জান্তা বলছে, তারা গণতান্ত্রিক শাসন ফিরিয়ে আনবে। অথচ নৃশংস গৃহযুদ্ধে তারা গত পাঁচ বছরেও জিততে পারেনি। ভোটগ্রহণে বাধা, ব্যাঘাত এবং সমালোচনাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে একটি নতুন আইনের অধীনে শত শত লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

দেশের বিশাল অংশে ভোট হচ্ছে না। কারণ পাহাড়ি সীমান্তবর্তী অঞ্চল এবং শুষ্ক কেন্দ্রীয় সমভূমিতে জাতিগত বিদ্রোহী এবং গণতন্ত্রপন্থি যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তারা। বিদ্রোহীরা স্বপ্ন দেখেছিলেন হয়তো জেনারেলদের পতন ঘটবে, কিন্তু তা হয়নি। পাল্টা সামরিক সরকার চীনের সহায়তায় অনেক দখলীয় অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের সমর্থন নির্বাচনের দ্বার খুলে দিয়েছে। জেনারেলরা আশা করছেন একটি নতুন সংসদকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কিছু অংশ স্বীকৃতি দেবে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মায়ানমার উপদেষ্টা রিচার্ড হর্সি সিএনএনকে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই অযৌক্তিক নির্বাচনকে সমর্থন বা বৈধতা দেবে না।

গৃহযুদ্ধে ধ্বংসস্তূপ মায়ানমার: ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক বাহিনী মায়ানমারের ক্ষমতা দখল করে। অং সান সু চির এনএলডি নির্বাচনে জয়ী হলে সেনারা কারচুপির অভিযোগ তুলে ক্ষমতায় বসে যায়। প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে নির্মম দমন-পীড়ন চালায় সামরিক জান্তা। ফলে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী মায়ানমারের সীমান্তবর্তী জঙ্গল এবং পাহাড়ে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর দখলে থাকা অঞ্চলে বাস্তুচ্যুত হয়। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীরা ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস’ গঠন করে। প্রায় পাঁচ বছরের সংঘাতের পর থেকে মায়ানমার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়েছে গ্রাম-শহর। জাতিসংঘের মতে, ৩০ লাখের বেশি মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। সেনাবাহিনীতে যোগদান এড়াতে হাজার হাজার তরুণ বিদেশে পালিয়ে গেছে, অথবা বিদ্রোহী-অধ্যুষিত এলাকায় পালিয়ে গেছে। মায়ানমার এখন বিশ্বের বৃহত্তম মেথামফেটামিন ও অবৈধ আফিম উৎপাদনকারী দেশ। সেনাশাসনে বিকশিত হয়েছে নানা অপরাধী চক্র।

চীন ও রাশিয়ার সুনজরে সামরিক সরকার: যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশ কখনও জান্তাকে মায়ানমারের বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। জাপান, মালয়েশিয়াসহ এই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি সরকার এই নির্বাচনের নিন্দা করেছে।

রাশিয়া এবং চীন দীর্ঘদিন ধরে মায়ানমারের দুটি বৃহত্তম সমর্থক এবং উভয় দেশই নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেছে। থাইল্যান্ড এবং ভারত তাদের সীমান্ত সংকটের অবসান ঘটাতে মায়ানমারের জেনারেলদের সঙ্গে কাজ করছে। চীন সীমান্তে অঞ্চল দখলকারী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে চাপ দেওয়ার জন্য অর্থনৈতিক শক্তি ব্যবহার করেছে। ইতোমধ্যে বেইজিংয়ের দূতরা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর দখলকৃত অঞ্চল সামরিক জান্তার নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় মধ্যস্থতা করছেন। এসব অঞ্চলের রত্ন পাথর ও রুবি খনির দিকেও নজর চীনের।

এদিকে, মায়ানমারে জান্তা সরকারের অধীন আনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে। প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে এই ধাপে দেশটির সেনাবাহিনী–সমর্থিত প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) বড় জয়ের পথে রয়েছে বলে দাবি করেছে সংশ্লিষ্ট দলীয় সূত্র। ২০২১ সালে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করে জান্তা সরকার। ক্ষমতা দখলের চার বছর পর পর্যায়ক্রমে মাসব্যাপী ভোট গ্রহণের আয়োজন করেছে জান্তা সরকার।

তবে এই নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র বিতর্ক ও সমালোচনা চলছে। গণতন্ত্রকামী পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর মতে, এই ভোট মায়ানমারে বেসামরিক শাসন ফেরানোর বদলে সামরিক শাসনকে আরও পোক্ত করার একটি অপকৌশল মাত্র। নাম প্রকাশ না করার শর্তে নেপিডো থেকে ইউএসডিপির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘সারা দেশ থেকে পাওয়া বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউএসডিপি অধিকাংশ আসনে জয়ী হচ্ছে।’ অবশ্য দেশটির ইউনিয়ন নির্বাচন কমিশন এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ফল প্রকাশ করেনি। নির্বাচনের পরবর্তী দুই ধাপ আগামী ১১ ও ২৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

মায়ানমারে প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণ সম্পন্ন, তরুণ ভোটারের উপস্থিতি কম

২০২০ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছিল; কিন্তু সেই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে ফলাফল বাতিল ও ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। বর্তমানে সু চির জনপ্রিয় সেই দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অন্যদিকে সু চি এখন কারাগারে সাজা ভোগ করছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধানসহ পশ্চিমা কূটনীতিকেরা এই নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের মতে, বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে এবং শুধু সামরিক মিত্রদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দিয়ে একপক্ষীয় এই ভোটের আয়োজন করা হয়েছে।

সু চিকে উৎখাতের পর মায়ানমারের প্রথম নির্বাচনে ভোট গ্রহণ চলছে

তবে জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং দাবি করেছেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। গত রোববার নেপিডোতে ভোট দেওয়ার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিচ্ছি। এটি সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে হচ্ছে। তাই আমরা নিজেদের সম্মান ক্ষুণ্ন হতে দেব না।’

গৃহযুদ্ধকবলিত মায়ানমারের ৩৩০টি টাউনশিপের মধ্যে মঙ্গলবার, (৩০ ডিসেম্বর ২০২৫) প্রথম দফায় ১০২টিতে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। তবে সংঘাতের কারণে দেশটির নিম্নকক্ষের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ আসনে ভোট গ্রহণ সম্ভব নয় বলে ইতিমধ্যে স্বীকার করেছে জান্তা সরকার।

‘আন্তর্জাতিক’ : আরও খবর

সম্প্রতি