জাতিসংঘের প্রথম ও একমাত্র সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে আফ্রিকার দেশ সোমালিয়ার ভূখণ্ড থেকে আলাদা হওয়া সোমালিল্যাল্ড প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটা এ অঞ্চলের অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষকদের সম্ভবত বিস্মিত করেনি।
ইসরায়েল গত শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) সোমালিল্যান্ডকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বিতর্ক সৃষ্ট করেছে। এ দিন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিয়ন সার সোমালিল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আবদিরাহমান মোহামেদ আবদুল্লাহির সঙ্গে স্বীকৃতির একটি যৌথ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন।
সোমালিল্যান্ড ১৯৯১ সালে সোমালিয়ার কাছ থেকে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে। এরপর তিন দশক পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বিশ্বের কোনো দেশ তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। তাই অঞ্চলটি সব সময় একধরনের কূটনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল। ইসরায়েলের স্বীকৃতির মাধ্যমে তা কিছুটা কমল।
ইসরায়েলের স্বীকৃতিকে ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ বলে মন্তব্য করেছেন আবদুল্লাহি। সোমালিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অঞ্চলটিকে ইসরায়েল সরল কোনো বিবেচনা থেকে স্বীকৃতি দেয়নি। বরং স্বীকৃতির পর্দার আড়ালে সাবধানী হিসাব-নিকাশ এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভূরাজনীতির সমীকরণ কাজ করেছে। স্বীকৃতি না দিলেও যুক্তরাজ্য, ইথিওপিয়া, তুরস্ক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) মতো কিছু দেশ সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। রাজধানী হার্গিসায় এসব দেশের লিয়াজোঁ অফিস রয়েছে।
স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে সোমালিল্যান্ড নিয়ে কয়েক দশকের আন্তর্জাতিক সংযম ভাঙল ইসরায়েল। দেশটি বুঝেশুনেই এটি করেছে। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে ইসরায়েল নিজেকে এমন একটি স্বঘোষিত দেশের প্রধান সুবিধাভোগী হিসেবে হাজির করেছে, যেটি অনেক দিন ধরে আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের আসন দাবি করে আসছিল।সোমালিল্যান্ডকে জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের স্বীকৃতি নিয়ে আরব নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন সৌদি আরবে নিযুক্তত জিবুতির রাষ্ট্রদূত দিয়া-এদ্দিন সাইদ বামাখরামা। তাঁর মতে, এ পদক্ষেপ গভীরভাবে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে।
বামাখরামার ভাষায়, ‘একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা শুধু একটি আইনি পদক্ষেপ বা বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা নয়। বরং এর কাঠামোগত গভীর প্রভাব রয়েছে। এ ধরনের প্রভাবের মধ্যে একই জাতির নাগরিকদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা বৃদ্ধি, রাষ্ট্রের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোকে ক্ষয় করা এবং দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের দ্বার উন্মুক্ত করা অন্যতম।’সমালোচকেরা মনে করেন, ইসরায়েল অনেক দিন ধরে নানা ছদ্মবেশে এ অঞ্চলে আরও ভাগাভাগি করার পক্ষে লবিং করে আসছে।
সোমালিল্যান্ডকে ইসরায়েলের স্বীকৃতিকে অনেক আরব দেশ একটি কৌশলের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখছে। ইসরায়েলের কৌশলটি হলো—শক্তিশালী কেন্দ্রশাসিত আরব ও মুসলিম দেশকে দুর্বল করতে সীমান্তবর্তী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে উৎসাহিত করা। অনেক আরব দেশ মনে করে, সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়া ইসরায়েলের পুরোনো এক কৌশলের ধারাবাহিকতার অংশ। ইসরায়েলের কৌশলটি হলো—শক্তিশালী কেন্দ্রশাসিত আরব ও মুসলিম দেশকে দুর্বল করতে সীমান্তবর্তী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে উসকে দেওয়া। সোমালিল্যান্ডের স্বীকৃতিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং সোমালিয়ার ফেডারেল সরকারের কাঠামোর মধ্যে গৃহীত জাতীয় সমঝোতার চেষ্টাকে ক্ষুণ্ন করার উপায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
জিবুতির রাষ্ট্রদূত বামাখরামা বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সব সময় এমন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। কারণ, তারা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতার বিপদ এবং এর ভয়াবহ মাশুলের চেয়ে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে প্রাধান্য দিয়েছে।’ সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক নজির লঙ্ঘন করেছে। এর মধ্য দিয়ে দেশটি ‘স্বীকৃতি দেওয়াকে’ আঞ্চলিক সংহতি ভাঙার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে—বিভিন্ন পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ উঠেছে। ইসরায়েল এর আগেও বিভিন্ন রাষ্ট্রবহির্ভূত শক্তি বা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়েছে।
এ সমর্থনকে তাঁরা ঝুঁকিতে থাকা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে হেফাজত করার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছে। উদাহরণ হিসেবে লেভান্ট (সিরিয়াসহ ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরবর্তী) অঞ্চলের দ্রুজ এবং লেবাননের ম্যারোনাইট সম্প্রদায়ের কথা বলা যায়।
ইসরায়েলের এই ‘পেরিফেরি ডকট্রিন’ বা প্রান্তীয় নীতির মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে দুটি উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। একদিকে ইসরায়েলের আঞ্চলিক মিত্র তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে জাতিগত বা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর স্বশাসনের ধারণার স্বীকৃতি মেলে। এটা ইসরায়েলের ইহুদি রাষ্ট্র হওয়ার বৈধতাকেও সমর্থন করে। তবে সোমালিল্যান্ডের ক্ষেত্রে স্পষ্টত ভিন্ন নীতি প্রয়োগ করা হচ্ছে। এখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়ার যুক্তি নেই। কারণ, সোমালিল্যান্ড প্রধানত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। এখানে যুক্তিটি আগাপাশতলা ভূরাজনৈতিক।
ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্য ও আশপাশের অঞ্চলে নিজেদের কৌশলগত অবস্থানকে গভীর করতে চাইছে। কারণ, অঞ্চলটিতে দেশটি ঐতিহাসিকভাবে নিঃসঙ্গ। সোমালিল্যান্ডের স্বীকৃতিকে ‘আব্রাহাম চুক্তির চেতনার’ সঙ্গে মিলিয়ে দেখছেন নেতানিয়াহু। এর অর্থ হলো—হর্ন অব আফ্রিকার স্বঘোষিত দেশটির জনসংখ্যা নয়, বরং নিজেদের নিরাপত্তা, সমুদ্রের নিয়ন্ত্রণ এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহই ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য।
নিজেদের জাতীয় পতাকা হাতে ইসরায়েলের স্বীকৃতি উদ্?যাপন করছেন সোমালিল্যান্ডের নাগরিকেরা। রাজধানী হার্গিসায়, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫
নিজেদের জাতীয় পতাকা হাতে ইসরায়েলের স্বীকৃতি উদ্?যাপন করছেন
সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের প্রথম বড় অর্জন—কূটনৈতিক বলয়ে প্রভাব বিস্তার। ইসরায়েলের দাবি, আব্রাহাম চুক্তিতে সোমালিয়ার যোগ না দেওয়া কৃত্রিম বাধা হিসেবে কাজ করছিল। এখন তা দূর হলো।
ইসরায়েলের দাবি, স্বাধীনভাবে কার্যকর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসম্পন্ন প্রায় ৬০ লাখ মানুষের দেশ সোমালিল্যান্ড আব্রাহাম চুক্তিতে যোগ দিতে খুব আগ্রহী ছিল।
সোমালিল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহি জানান, ‘আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তির পথে একটি পদক্ষেপ’ হিসেবে তাঁর দেশ আব্রাহাম চুক্তিতে যোগ দেবে। তবে, এই শান্তি এমনিতে আসেনি, এসেছে সম্পূর্ণ বিনিময়ের মধ্য দিয়ে, তা হলো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
ইসরায়েল এখন ‘সোমালিল্যান্ড মডেল’-কে সামনে এনে নানা যুক্তি দিতে পারবে। দেশটি হয়তো বলবে, সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ও ভূখণ্ডগত স্বার্থ পূরণ হলে আরও অনেক আরব ও মুসলিম দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ইচ্ছুক।
সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের দ্বিতীয় বড় অর্জন-হর্ন অব আফ্রিকায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সম্ভাবনা। এডেন উপসাগরের কৌশলগত স্থান এবং বাবা আল-মান্দাব প্রণালিতে সোমালিল্যান্ডের অবস্থা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্রপথের নজরদারি করার জন্য এটি বেশ উপযুক্ত।
ইসরায়েলের এ যুক্তি আরব লিগ ও ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) ঐক্যবদ্ধ অবস্থানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। বিভিন্ন আরব ও মুসলিম দেশের সংস্থা দুটির দীর্ঘদিনের অবস্থান ছিল—ফিলিস্তিন সংঘাতের অবসান না করে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা যাবে না। কিন্তু এখন তা আরও বেশি নাজুক হয়ে পড়েছে।
সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিয়ে ইসরায়েলের দ্বিতীয় বড় অর্জন—হর্ন অব আফ্রিকায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সম্ভাবনা। এডেন উপসাগরের কৌশলগত স্থান এবং বাব আল-মান্দাব প্রণালিতে সোমালিল্যান্ডের অবস্থান কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্রপথের নজরদারি করার জন্য এটি বেশ উপযুক্ত। সোমালিল্যান্ডে ইসরায়েলের উপস্থিতি ক্রমশ ঝুঁকি বৃদ্ধি করবে।
কারণ, অঞ্চলটির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি ছোট সাগরের ওপরে ইয়েমেন। ইয়েমেনের ভূখণ্ডের একটি বড় অংশ হুতিরা নিয়ন্ত্রণ করে। হুতিরা এমন একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী যারা ‘ইসরায়েলের ধ্বংস’ কামনা করে।
ইসরায়েল হয়তো দাবি করবে, সোমালিল্যান্ডে তাদের সামরিক বা গোয়েন্দা উপস্থিতি হুতি হামলার হুমকি মোকাবিলায় সমুদ্রপথের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করবে। কিন্তু অঞ্চলটির অন্যান্য দেশ তা মনে করে না। তারা মনে করে, এতে করে উত্তেজনা বরং বাড়তে পারে। সৌদি আরবে নিযুক্ত জিবুতির রাষ্ট্রদূত বামাখরামা সতর্ক করে বলেন, সোমালিল্যান্ডে ইসরায়েলের সামরিক উপস্থিতি এই অঞ্চলকে কার্যত ‘বারুদভর্তি বিস্ফোরকের কূপে’ পরিণত করবে।
এই কূটনীতিক বলেন, ‘ইসরায়েল ভূরাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল স্থানটিতে যদি সামরিক ঘাঁটি তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে...তাহলে তা লোহিত সাগরের তীরবর্তী দেশ মিসর, সৌদি আরব, সোমালিয়া, ইয়েমেন, সুদান ও জিবুতির বিরুদ্ধে তেল-আবিবের কৌশলগত সাফল্য হিসেবে গণ্য হবে।’
আন্তর্জাতিক: ইয়েমেন সংঘাতে মুখোমুখি অবস্থানে সৌদি-আরব আমিরাত
অর্থ-বাণিজ্য: ই-রিটার্ন দিতে অসমর্থ হলে জানাতে হবে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে
অর্থ-বাণিজ্য: ভারত থেকে ৫০ হাজার টন চাল কেনার প্রস্তাব অনুমোদিত
অর্থ-বাণিজ্য: পিপলস লিজিংয়ের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ
অর্থ-বাণিজ্য: বাণিজ্যমেলা শুরু হবে ৩ জানুয়ারি
অর্থ-বাণিজ্য: ৩০ লাখের বেশি করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দিয়েছেন