image

ইয়েমেন সংঘাতে মুখোমুখি অবস্থানে সৌদি-আরব আমিরাত

ইয়েমেনে ৯০ দিনের জরুরি অবস্থা জারি, সমস্ত বন্দর অবরোধের ঘোষণা

বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫
বিদেশী সংবাদ মাধ্যম

ইয়েমেনের দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে এবার নতুন মাত্রার উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এক সময় একই জোটে থাকা সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এখন কার্যত বিপরীত অবস্থানে। সাম্প্রতিক বিমান হামলা ও কূটনৈতিক বক্তব্যে এই বিভাজন প্রকাশ্যে এসেছে, যা ওই অঞ্চলের যুদ্ধকে আরও জটিল করে তুলছে। যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক ইনডিপেনডেন্ট জানিয়েছে, মঙ্গলবার ভোরে সৌদি আরব ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলে বিমান হামলা চালায়। এই হামলার লক্ষ্য ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত –সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ‘সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল’ (এসটিসি)।

সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের দাবি—হাদরামাউতের বন্দরনগরী মুকাল্লায় এসটিসির জন্য অস্ত্র ও সাঁজোয়া যান নামানো হচ্ছিল, যা তাদের ‘সীমারেখা’ অতিক্রমের সমান। সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, জাহাজগুলোর ট্র্যাকিং সিস্টেম বন্ধ ছিল এবং এসব অস্ত্র তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করছিল। অন্যদিকে, এসটিসি এই হামলা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের দাবি, হামলায় হাদরামাউতে মোতায়েন এসটিসির অভিজাত ইউনিটগুলোকে লক্ষ্য করা হয়েছে। যদিও সৌদি কর্তৃপক্ষ বলছে, রাতের আঁধারে হামলা চালানো হয়েছে যাতে বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি না হয়।

এই সংঘর্ষ সৌদি আরব ও ইউএইর মধ্যে বাড়তে থাকা মতবিরোধকে প্রকাশ্যে এনেছে। হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন একসঙ্গে লড়াই করলেও, ইয়েমেনের ভেতরে দুই দেশ ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে আসছে। সৌদি আরবের অভিযোগ, এসটিসিকে আমিরাতের সমর্থন ইয়েমেন ও পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। রিয়াদ একে নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি হিসেবেও উল্লেখ করেছে।

এই উত্তেজনার মধ্যেই ইয়েমেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের প্রেসিডেনশিয়াল লিডারশিপ কাউন্সিলের প্রধান রাশাদ আল-আলিমি আরব আমিরাতের সঙ্গে যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি বাতিল করেন এবং দেশটি থেকে আমিরাতের সেনা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তিনি সাময়িক সময়ের জন্য আকাশ ও নৌ অবরোধও ঘোষণা করেন।

বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ ইয়েমেনে এসটিসির দ্রুত সম্প্রসারণ দেশটিকে কার্যত বিভক্ত করার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। দক্ষিণে গুরুত্বপূর্ণ তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল ও বন্দর, আর উত্তরে রাজধানী সানাসহ হুতিদের শক্ত ঘাঁটি—এই বাস্তবতায় ইয়েমেন আবারও এক গভীর ও বহুমাত্রিক সংকটের দিকে এগোচ্ছে।

এসটিসি সাম্প্রতিক সময়ে ইয়েমেনের হারদামাউত এবং আল-মাহরা প্রদেশের আরও অঞ্চল দখল করে নিচ্ছে। এমন সব জায়গায় গত কয়েকদিন লড়াই হয়েছে যেখানে গত এক যুগেও কোনো লড়াই হয়নি। সালে হুতি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানা দখল করে। ওই সময় তারা নতুন সরকার এবং জ্বালানির মূল্য কমানোর দাবি করে। কিন্তু এরপর তারা রাজপ্রাসাদ দখল করে ফেলে। এতে করে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবু রাব্বু মানসুর রাজি পদত্যাগ করে সৌদি আরবে পালিয়ে যান। এরপর ২০১৫ সালে সৌদি সামরিক জোট গঠন করে। তারা হুতিদের অবকাঠামো লক্ষ্য করে হাজার হাজার বিমান হামলা চালিয়েছে। এতে সমানভাবে সহায়তা করেছে আমিরাত। কিন্তু একই সময় দক্ষিণাঞ্চলে এসটিসিকে সহায়তা করে গেছে আবুধাবি। এতে করে সেখানকার পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে গেছে।

সৌদির শঙ্কা যদি এসটিসি দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে আলাদা দেশ গঠন করে তাহলে এটির প্রভাব তাদের দেশেরও পড়তে পারে। এমনকি দখল হয়ে যেতে পারে সৌদির বিভিন্ন অঞ্চলও। আর এ কারণে আমিরাতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে সৌদি। সৌদি আরবের শঙ্কা, এসটিসি একতরফাভাবে স্বাধীন দেশ গঠন করে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে যেতে পারে। যার সুযোগ নিতে পারে হুতিরা। তারা উত্তরাঞ্চলের পর দক্ষিণাঞ্চলও দখল করতে পারে। হারদামাউত প্রদেশ ইয়েমেনের সবচেয়ে বড় প্রদেশ। এটি তেলসমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। সৌদির আরও শঙ্কা এসটির কারণে আরব-লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগরের সামুদ্রিক পথ, জ্বালানি সরবরাহ এবং বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল হুমকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে।

আমিরাত কেন এসটিসিকে সমর্থন দেয়: আমিরাত আরব সাগর, লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরে এসটিসির মাধ্যমে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চায়। এছাড়া এসটিসি একটি ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী। আমিরাত মূলত ইসলামপন্থি দল পছন্দ করে না। তাই তারা ইয়েমেনে এক গোষ্ঠীকে দেখতে চায় যারা ইসলাম নিয়ে কাজ করবে না। এছাড়া এসটিসির হারদামাউত প্রদেশ দখলও অন্যতম কার। এটি তেলসমৃদ্ধ প্রদেশ হওয়ায় আমিরাত এসটিসিকে অঞ্চলটি দখল রাখতে সহায়তা করছে। এতে করে ইয়েমেনের তেলের ওপরও তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে।

এদিকে, ইয়েমেনের পূর্বাঞ্চলীয় হাদরামাউত এবং মাহরা প্রদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী দক্ষিণ ট্রানজিশনাল কাউন্সিলকে (এসটিসি) সমর্থন জানানোর পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র এবং যুদ্ধযান পাঠাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এ অবস্থায় ইয়েমেনে দেশব্যাপী ৯০ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) জারি করা সরকারি ডিক্রিতে বলা হয়েছে, ‘৩০ ডিসেম্বর থেকে প্রজাতন্ত্রে ৯০ দিনের জরুরি অবস্থা কার্যকর হচ্ছে, যার মেয়াদ বৃদ্ধি করা সম্ভব।’

ইয়েমেনি প্রেসিডেন্সিয়াল লিডারশিপ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান রাশাদ আল-আলিমি টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে বলেন, ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত আমিরাতের বাহিনীকে ইয়েমেনির সমস্ত ভূখ- থেকে সরে যেতে হবে।’ সেই সঙ্গে ইয়েমেনের আল-আলিমি সমস্ত বন্দর, বিমানবন্দর ও সীমান্ত ক্রসিংয়ে ৭২ ঘণ্টার জন্য বিমান, সমুদ্র এবং স্থল অবরোধের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।

ডিক্রিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী এসটিসি’র সঙ্গে সংযুক্ত হাদরামাউত এবং আল-মাহরাহ প্রদেশের সামরিক ইউনিটগুলোকে ‘সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের কমান্ডের সঙ্গে সম্পূর্ণ সমন্বয় সাধন করতে’ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোনো সংঘর্ষ ছাড়াই, অর্থাৎ শান্তিপূর্ণভাবে অবিলম্বে তাদের নির্ধারিত অবস্থান এবং শিবিরে ফিরে যেতে ও হোমল্যান্ড শিল্ড ফোর্সেসের কাছে সমস্ত অস্ত্র-শস্ত্র হস্তান্তর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত ৯ ডিসেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের অনুগত এসটিসি’র চেয়ারম্যান আইদারুস আল-জুবাইদি ইয়েমেনের হাদরামাউত এবং আল-মাহরাহ গভর্নরেটের নিয়ন্ত্রণ দখলের ঘোষণা দেন। সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কর্মকা-কে অযৌক্তিক উত্তেজনা বৃদ্ধি হিসেবে বর্ণনা করেছে এবং এসটিসিকে দুটি গভর্নরেট থেকে তাদের বাহিনী প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে।

২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় একটি সরকারি সূত্র সাবা সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছে, ইয়েমেনের প্রেসিডেন্সিয়াল লিডারশিপ কাউন্সিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে হাদরামাউতের জনসংখ্যাকে রক্ষা করার জন্য সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের কাছ থেকে সামরিক সহায়তার অনুরোধ করেছেন।

‘আন্তর্জাতিক’ : আরও খবর

সম্প্রতি