alt

পশ্চিমবঙ্গ ভোটের ফল এবং মমতার ভবিষ্যৎ

রজত রায়, কলকাতা : সোমবার, ০৩ মে ২০২১

পাঁচ রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন হলেও কোনও সন্দেহ নেই যে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের দিকেই গোটা ভারত তো বটেই, উপমহাদেশের অন্য দেশগুলিও অধীর আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়ে ছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশ। কারণটাও অজানা নয়। একদা বামদূর্গ বলে সুবিদিত এবং পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক জননেত্রীর শাসনাধীন পশ্চিমবঙ্গ ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সুবাদে বি জে পির উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আঁতুরঘর বলে চিহ্নিত হয়েও বিজেপির নাগালের বাইরে ছিল।

২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের সময় তারা প্রথম বার বিরাটভাবে আত্মপ্রকাশ করে। তারপরেই তারা এবারের নির্বাচনে রাজ্যের ক্ষমতা দখলের জন্য ঝাঁপায়। যে ভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ এবং অন্য হেভিওয়েট নেতারা পশ্চিমবঙ্গে প্রচারে ঘন ঘন এসেছেন, ঘাঁটি গেড়ে বসেন, তাতে বোঝাই যাচ্ছিল যে এই রাজ্যের গুরুত্ব তাঁদের কাছে অপরিসীম।

তামিলনাড়ু, কেরালায় হার অনিবার্য্য, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বিজয় করা গেলে শুধু মুখ রক্ষাই হবে না, দেশ জুড়ে করোনা মোকাবিলায় মোদি সরকারের ব্যর্থতার দায় অনেকটাই ঝেড়ে ফেলা যাবে। সেই সঙ্গে ক্ষমতায় এলে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী, তার কিছু নমুনা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নির্বাচনী প্রচারে এসে জানিয়ে গেছেন। ফলে, আশঙ্কার কালো মেঘ জমছিলই। আরও বলা হচ্ছিল যে পশ্চিমবঙ্গের ভোটদাতারা এখন ধর্মের ভিত্তিতে সংখ্যাগুরু হিন্দু ও সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছেন।

কিন্তু নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর বোঝা গেল ভোট ধর্মীয় মেরুকরণের ভিত্তিতে হয়নি, হয়েছে ‘বিজেপি হঠাও, দেশ বাঁচাও’ জাতীয় স্লোগানের ভিত্তিতে। তাই বিজেপিকে ঠেকাতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমুল কংগ্রেসকে ঢেলে ভোট দিয়েছেন। তাই তৃতীয় শক্তি বাম-কংগ্রেস-আব্বাস সিদ্দিকি জোটকে ভোট দিয়ে বি জে পি বিরোধী ভোট ভাগাভাগি করার ঝুঁকি নেন নি।

আরও দুটি কথা উল্লেখযোগ্য, এবারের ভোটে রাজ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ যারা মুসলমান পরিচয় বহন করেন, তারা নিজেদের ভোট ভাগ করতে দেননি। তাই দীর্ঘদিন ধরে মালদহ, উত্তর দিনাজপুর ও মুর্শিদাবাদ জেলায় কংগ্রেসের কট্টর সমর্থক হিসাবে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও এবার তারা একযোগে কংগ্রেস ছেড়ে মমতার তৃণমুল কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছেন। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের সময় উত্তর মালদহ কেন্দ্রে এই দু দলের মধ্যে ভোট কাটাকাটির জেরেই বি জে পি প্রার্থী জিতে যান। এবার মুসলমানরা হিসাব কষেই সবাই এক জায়গায় ভোট দিয়েছেন, কারণ এবারের ভোটের লড়াইটা ছিল তাদের কাছে ধর-প্রাণ বাঁচানোর লড়াই। এনআরসি এবং সিএএ জাতীয় সরকারি ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের নাগরিকত্ব হারানোর বিরুদ্ধে লড়াই।

এবারের ভোটের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল মহিলা ভোটদাতাদের ভুমিকা। মহিলারা কত শতাংশ মমতার দিকে তা সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা না গেলেও বোঝাই যাচ্ছে যে মমতার জনসভায় তাঁদের বিপুল সংখ্যায় উপস্থিতি, ভোটদাতাদের লাইনে বিপুল সংখ্যায় উপস্থিতির মধ্যে একটা গভীর যোগসুত্র রয়েছে। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মমতা মেয়েদের জন্য একগুচ্ছ প্রকল্প শুরু করেন। কন্যাশ্রী, সবুজসাথী ইত্যাদির মাধ্যমে মেয়েদের স্কুল কলেজে পড়াশোনার কাল বাড়িয়ে দেওয়া ও নাবালিকা অবস্থায় বিয়ে ঠেকাতে উৎসাহ দেওয়া তার অন্যতম। এবার ভোটের মুখে স্বাস্থ্যসাথীর মতো প্রকল্প সাধারণ মানুষের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগায়। উল্লেখ্য, এই প্রকল্পে পরিবারের মহিলা সদস্যকেই গৃহকত্রীর সম্মান দিয়ে কেবল তার নামেই কার্ড করা যায়। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা শুধু তার পরিবারের সদস্য হিসাবে সুবিধা পান। এ ভাবে মহিলাদের সম্মান দেওয়ার সুফল মমতা হাতেনাতে পেলেন।

‘বাংলা তার নিজের মেয়েকেই চায়’ জাতীয় স্লোগানের বিপরীতে প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির কণ্ঠে একের পর এক জনসভা থেকে মমতাকে ব্যঙ্গ করে ‘দিদি, ও দিদি’ বলে ক্রমাগত ডাক সাধারণ মানুষের কাছে যে কুরুচিকর মনে হয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই। ভাঙ্গা পায়ে প্লাস্টার করে হুইল চেয়ারে বসেই গোটা রাজ্য ঘুরে মমতার সাহসী প্রচার যে রাজ্যের নারী ভোটারদের মন জয় করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই।

এবারের ভোটে রাজ্যে মোট ভোটদাতাদের সংখ্যা ছিল কমবেশি সাত কোটি ২০ লক্ষ, তার মধ্যে তিন কোটি ৪৮ লক্ষ নারী ভোটার। বি জে পিকে ঠেকাতে এরাও মুসলমানদের মতোই গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা নেন।

ভোট শেষ। ফল ঘোষণাও হয়ে গেছে। মমতা বিপুলভাবে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের বিজেপিকে পরাস্ত করেছেন। এবার কী হতে চলেছে? সংক্ষেপে বলা যায়, ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে আমরা এখন বেশ কয়েকটি গুরুত্বপুর্ণ পরিবর্তন দেখতে পাব বলেই মনে করি। যেমন, মমতাকে এবার জাতীয় রাজনীতিতে সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলকে জোটবদ্ধ করে বি জে পির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে দেখতে পারি। রাহুল গান্ধী অনেক সুযোগ পেয়েও নিজেকে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিতে পারার মতো বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। শরদ পওয়ার বৃদ্ধ, এবং নিজের রাজ্য মহারাষ্ট্রে অবিসংবাদিতভাবে ক্ষমতার অধিকারী নন। তামিলনাড়ুর সদ্য নির্বাচনে জয়ী এম কে স্ট্যালিন প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হবেন। তা ছাড়া এদের কাউকেই মমতার মতো বি জে পির তৈরি চক্রব্যুহে পড়তে হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী, তাঁর মন্ত্রিসভার প্রায় সব হেভিওয়েট নেতা দিনের পর দিন পশ্চিমবঙ্গে প্রচারে এসে মমতাকে ক্রমাগত ব্যক্তিগত আক্রমণ করে গেছেন। তার দলের বেশ কয়েকজন নেতা ও কর্মীকে বেছে বেছে ঠিক ভোটের মুখেই কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো ( সিবিআই), এনফোর্সমেন্ট বিভাগ (ইডি), আয়কর বিভাগ, জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) তদন্তের নামে হয়রানি করতে শুরু করে। তা ছাড়া নির্বাচন কমিশনের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত অনেকেরই দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে। অনেকে তো প্রকাশ্যেই নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রতি পক্ষপাতিত্বমুলক আচরণের অভিযোগ এনেছেন। এত সব বাধা অতিক্রম করে বি জে পির বিরুদ্ধে মমতা যে বিশাল জয় অর্জন করেছেন, তা এক কথায় নজীরবিহীন। তাই মমতাকে এখন সর্বভারতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করতে দেখলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

মনে রাখতে হবে, দেশে করোনা মহামারীর প্রকোপ ঠেকাতে মোদি সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। অক্সিজেন, জীবনদায়ী ওষুধ, হাসপাতালের বেডের জন্য চারদিকে হাহাকার চলছে। প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা, সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ক্ষোভ। এই সঙ্গেই উত্তর ভারতের বিজেপি বিরোধী কৃষক আন্দোলন এখন নতুন উদ্যমে আবার শুরু হচ্ছে। গত ৩০ মার্চ মমতা দেশের ১৫ জন বিরোধী নেতা ও নেত্রীকে একটি চিঠি পাঠিয়ে বলেছেন বিজেপির বিরুদ্ধে সর্বভারতীয় স্তরে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করা দরকার। এই জয়ের পরে জাতীয় স্তরে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশ্নে মমতাকে কেউই চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবেন না। মমতা জাতীয় স্তরেই আসছেন মনে হয়।

লেখকঃ ভারতের সাংবাদিক

ছবি

সৌদি-পাকিস্তান যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি, একজনের ওপর হামলা হবে ‘উভয়ের ওপর আক্রমণ’

ছবি

গাজায় দুই বছরের যুদ্ধে মৃত্যু ছাড়াল ৬৫ হাজার

ছবি

ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন করে ‘মুক্ত’ হতে চান নেপালের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী

ছবি

তেল বিক্রি বন্ধে ইরানের ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল যুক্তরাষ্ট্র

ছবি

মায়ানমারে ১২১টি আসনে হবে না ভোটগ্রহণ, ঘোষণা নির্বাচন কমিশনের

ছবি

দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রীয় সফরে যুক্তরাজ্য গেলেন ট্রাম্প

ছবি

গাজায় এবার স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল, হত্যাযজ্ঞ চলছে

ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন রাশিয়া-বেলারুশ সামরিক মহড়ায় কেন

ছবি

দক্ষিণ এশিয়াই কি জেন জি বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে?

ছবি

গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ বাড়ছে: জাতিসংঘ

ছবি

ওএবার ইউরোপকে তাড়িয়ে বেড়ানোর হুমকি রাশিয়ার

ছবি

গাজায় গণহত্যা চালিয়েছে ইসরায়েল : জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন

ছবি

মুসলিম বিশ্ব নেটোর আদলে সামরিক বাহিনী গঠনে একমত

ছবি

গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছে ইসরায়েল: জাতিসংঘ তদন্ত কমিশন

ছবি

ভেনেজুয়েলার মাদকবাহী জলযানে মার্কিন হামলা, নিহত ৩

ছবি

ইসরায়েলি আগ্রাসন ঠেকাতে মুসলিম দেশগুলোকে যৌথ সামরিক জোটের আহ্বান ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর

ছবি

ইউরোপকে সতর্ক করল রাশিয়া

ছবি

ওয়াকফ সংশোধনী আইন স্থগিত করল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট

ছবি

তালেবান সরকারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করছে জার্মানি

ছবি

১০ হাজার ইসরায়লি সেনাকে মানসিক রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে

ছবি

দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানে বিপুল সমর্থন, নারাজ যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল

ছবি

নেপালে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবিতে আবারও রাস্তায় জেন জি

ছবি

নেপালে বিক্ষোভে সহিংসতা: নিহত ৭২, আহত দুই হাজারের বেশি

ছবি

তেল কেনা বন্ধ করলেই রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা

ছবি

যুক্তরাষ্ট্রে চার্লি কার্কের সমালোচনাকারীদের ওপর ক্ষুব্ধ আইনপ্রণেতারা

ছবি

যুক্তরাষ্ট্র-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার মহড়া ‘খারাপ পরিণতি’ ডেকে আনবে

ছবি

লন্ডনে অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভে এক লাখের বেশি মানুষ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ

ছবি

গাজা ছেড়েছে আরও আড়াই লাখ মানুষ

ছবি

বিপর্যস্ত নেপালের পর্যটন খাত, ২ দিনে ক্ষতি ২৫০০ কোটি রুপি

ছবি

নেপাল: দায়িত্ব নিয়েই নির্বাচনের তারিখ জানিয়ে দিলেন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান

ছবি

আফগানিস্তানে বন্দি থাকা মার্কিন নাগরিকদের বিষয় নিয়ে কাবুলে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা

ছবি

রাশিয়ার ড্রোন হামলা কোনো ভুল ছিল না: পোল্যান্ড

ছবি

উত্তর কোরিয়ায় বিদেশি চলচ্চিত্র দেখলেও মৃত্যুদণ্ড

ছবি

ইসরায়েলি হামলার পর ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী

ছবি

নেপালের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলেন সুশীলা কারকি

ছবি

হামাসমুক্ত স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ভোট

tab

পশ্চিমবঙ্গ ভোটের ফল এবং মমতার ভবিষ্যৎ

রজত রায়, কলকাতা

সোমবার, ০৩ মে ২০২১

পাঁচ রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন হলেও কোনও সন্দেহ নেই যে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের দিকেই গোটা ভারত তো বটেই, উপমহাদেশের অন্য দেশগুলিও অধীর আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়ে ছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশ। কারণটাও অজানা নয়। একদা বামদূর্গ বলে সুবিদিত এবং পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক জননেত্রীর শাসনাধীন পশ্চিমবঙ্গ ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সুবাদে বি জে পির উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আঁতুরঘর বলে চিহ্নিত হয়েও বিজেপির নাগালের বাইরে ছিল।

২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের সময় তারা প্রথম বার বিরাটভাবে আত্মপ্রকাশ করে। তারপরেই তারা এবারের নির্বাচনে রাজ্যের ক্ষমতা দখলের জন্য ঝাঁপায়। যে ভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ এবং অন্য হেভিওয়েট নেতারা পশ্চিমবঙ্গে প্রচারে ঘন ঘন এসেছেন, ঘাঁটি গেড়ে বসেন, তাতে বোঝাই যাচ্ছিল যে এই রাজ্যের গুরুত্ব তাঁদের কাছে অপরিসীম।

তামিলনাড়ু, কেরালায় হার অনিবার্য্য, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বিজয় করা গেলে শুধু মুখ রক্ষাই হবে না, দেশ জুড়ে করোনা মোকাবিলায় মোদি সরকারের ব্যর্থতার দায় অনেকটাই ঝেড়ে ফেলা যাবে। সেই সঙ্গে ক্ষমতায় এলে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী, তার কিছু নমুনা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নির্বাচনী প্রচারে এসে জানিয়ে গেছেন। ফলে, আশঙ্কার কালো মেঘ জমছিলই। আরও বলা হচ্ছিল যে পশ্চিমবঙ্গের ভোটদাতারা এখন ধর্মের ভিত্তিতে সংখ্যাগুরু হিন্দু ও সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছেন।

কিন্তু নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর বোঝা গেল ভোট ধর্মীয় মেরুকরণের ভিত্তিতে হয়নি, হয়েছে ‘বিজেপি হঠাও, দেশ বাঁচাও’ জাতীয় স্লোগানের ভিত্তিতে। তাই বিজেপিকে ঠেকাতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমুল কংগ্রেসকে ঢেলে ভোট দিয়েছেন। তাই তৃতীয় শক্তি বাম-কংগ্রেস-আব্বাস সিদ্দিকি জোটকে ভোট দিয়ে বি জে পি বিরোধী ভোট ভাগাভাগি করার ঝুঁকি নেন নি।

আরও দুটি কথা উল্লেখযোগ্য, এবারের ভোটে রাজ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ যারা মুসলমান পরিচয় বহন করেন, তারা নিজেদের ভোট ভাগ করতে দেননি। তাই দীর্ঘদিন ধরে মালদহ, উত্তর দিনাজপুর ও মুর্শিদাবাদ জেলায় কংগ্রেসের কট্টর সমর্থক হিসাবে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও এবার তারা একযোগে কংগ্রেস ছেড়ে মমতার তৃণমুল কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছেন। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের সময় উত্তর মালদহ কেন্দ্রে এই দু দলের মধ্যে ভোট কাটাকাটির জেরেই বি জে পি প্রার্থী জিতে যান। এবার মুসলমানরা হিসাব কষেই সবাই এক জায়গায় ভোট দিয়েছেন, কারণ এবারের ভোটের লড়াইটা ছিল তাদের কাছে ধর-প্রাণ বাঁচানোর লড়াই। এনআরসি এবং সিএএ জাতীয় সরকারি ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের নাগরিকত্ব হারানোর বিরুদ্ধে লড়াই।

এবারের ভোটের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল মহিলা ভোটদাতাদের ভুমিকা। মহিলারা কত শতাংশ মমতার দিকে তা সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা না গেলেও বোঝাই যাচ্ছে যে মমতার জনসভায় তাঁদের বিপুল সংখ্যায় উপস্থিতি, ভোটদাতাদের লাইনে বিপুল সংখ্যায় উপস্থিতির মধ্যে একটা গভীর যোগসুত্র রয়েছে। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মমতা মেয়েদের জন্য একগুচ্ছ প্রকল্প শুরু করেন। কন্যাশ্রী, সবুজসাথী ইত্যাদির মাধ্যমে মেয়েদের স্কুল কলেজে পড়াশোনার কাল বাড়িয়ে দেওয়া ও নাবালিকা অবস্থায় বিয়ে ঠেকাতে উৎসাহ দেওয়া তার অন্যতম। এবার ভোটের মুখে স্বাস্থ্যসাথীর মতো প্রকল্প সাধারণ মানুষের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগায়। উল্লেখ্য, এই প্রকল্পে পরিবারের মহিলা সদস্যকেই গৃহকত্রীর সম্মান দিয়ে কেবল তার নামেই কার্ড করা যায়। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা শুধু তার পরিবারের সদস্য হিসাবে সুবিধা পান। এ ভাবে মহিলাদের সম্মান দেওয়ার সুফল মমতা হাতেনাতে পেলেন।

‘বাংলা তার নিজের মেয়েকেই চায়’ জাতীয় স্লোগানের বিপরীতে প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির কণ্ঠে একের পর এক জনসভা থেকে মমতাকে ব্যঙ্গ করে ‘দিদি, ও দিদি’ বলে ক্রমাগত ডাক সাধারণ মানুষের কাছে যে কুরুচিকর মনে হয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই। ভাঙ্গা পায়ে প্লাস্টার করে হুইল চেয়ারে বসেই গোটা রাজ্য ঘুরে মমতার সাহসী প্রচার যে রাজ্যের নারী ভোটারদের মন জয় করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই।

এবারের ভোটে রাজ্যে মোট ভোটদাতাদের সংখ্যা ছিল কমবেশি সাত কোটি ২০ লক্ষ, তার মধ্যে তিন কোটি ৪৮ লক্ষ নারী ভোটার। বি জে পিকে ঠেকাতে এরাও মুসলমানদের মতোই গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা নেন।

ভোট শেষ। ফল ঘোষণাও হয়ে গেছে। মমতা বিপুলভাবে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের বিজেপিকে পরাস্ত করেছেন। এবার কী হতে চলেছে? সংক্ষেপে বলা যায়, ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে আমরা এখন বেশ কয়েকটি গুরুত্বপুর্ণ পরিবর্তন দেখতে পাব বলেই মনে করি। যেমন, মমতাকে এবার জাতীয় রাজনীতিতে সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলকে জোটবদ্ধ করে বি জে পির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে দেখতে পারি। রাহুল গান্ধী অনেক সুযোগ পেয়েও নিজেকে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিতে পারার মতো বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। শরদ পওয়ার বৃদ্ধ, এবং নিজের রাজ্য মহারাষ্ট্রে অবিসংবাদিতভাবে ক্ষমতার অধিকারী নন। তামিলনাড়ুর সদ্য নির্বাচনে জয়ী এম কে স্ট্যালিন প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হবেন। তা ছাড়া এদের কাউকেই মমতার মতো বি জে পির তৈরি চক্রব্যুহে পড়তে হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী, তাঁর মন্ত্রিসভার প্রায় সব হেভিওয়েট নেতা দিনের পর দিন পশ্চিমবঙ্গে প্রচারে এসে মমতাকে ক্রমাগত ব্যক্তিগত আক্রমণ করে গেছেন। তার দলের বেশ কয়েকজন নেতা ও কর্মীকে বেছে বেছে ঠিক ভোটের মুখেই কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো ( সিবিআই), এনফোর্সমেন্ট বিভাগ (ইডি), আয়কর বিভাগ, জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) তদন্তের নামে হয়রানি করতে শুরু করে। তা ছাড়া নির্বাচন কমিশনের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত অনেকেরই দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে। অনেকে তো প্রকাশ্যেই নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রতি পক্ষপাতিত্বমুলক আচরণের অভিযোগ এনেছেন। এত সব বাধা অতিক্রম করে বি জে পির বিরুদ্ধে মমতা যে বিশাল জয় অর্জন করেছেন, তা এক কথায় নজীরবিহীন। তাই মমতাকে এখন সর্বভারতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করতে দেখলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

মনে রাখতে হবে, দেশে করোনা মহামারীর প্রকোপ ঠেকাতে মোদি সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। অক্সিজেন, জীবনদায়ী ওষুধ, হাসপাতালের বেডের জন্য চারদিকে হাহাকার চলছে। প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা, সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ক্ষোভ। এই সঙ্গেই উত্তর ভারতের বিজেপি বিরোধী কৃষক আন্দোলন এখন নতুন উদ্যমে আবার শুরু হচ্ছে। গত ৩০ মার্চ মমতা দেশের ১৫ জন বিরোধী নেতা ও নেত্রীকে একটি চিঠি পাঠিয়ে বলেছেন বিজেপির বিরুদ্ধে সর্বভারতীয় স্তরে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করা দরকার। এই জয়ের পরে জাতীয় স্তরে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশ্নে মমতাকে কেউই চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবেন না। মমতা জাতীয় স্তরেই আসছেন মনে হয়।

লেখকঃ ভারতের সাংবাদিক

back to top