স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে চার দশকেরও বেশি সময় নেতৃত্ব দিয়ে যাওয়া বিএনপি চেয়ারপারসন ও দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মৃত্যু দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও গভীর আলোড়ন তুলেছে। বিশ্বজুড়ে প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলো তার প্রয়াণকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সমাপ্তি হিসেবে তুলে ধরেছে।
রাজনীতিতে প্রায় নবীন অবস্থায় যাত্রা শুরু করে কীভাবে তিনি রাজপথের সংগ্রাম পেরিয়ে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠেন, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনার সঙ্গে দীর্ঘ ও উত্তাল রাজনৈতিক পথচলা এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলায় তার ভূমিকা—এই বিষয়গুলোই গুরুত্ব পেয়েছে আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে।
খালেদা জিয়াকে পারিবারিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, যিনি আরেক নারী রাজনৈতিক নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দীর্ঘদিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে গেছেন। এই দুই নারীর রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তরুণ দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্র বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণে বড় ভূমিকা রেখেছে।
১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাবশালী নেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর কয়েক দশক ধরে শেখ হাসিনার সঙ্গে তীব্র রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে তারা পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই দীর্ঘ দ্বৈরথ বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
প্রতিবেদনগুলোতে তার রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি মামলার মুখোমুখি হওয়া এবং কারাবরণের ঘটনাও উঠে এসেছে। ক্ষমতা ছাড়ার পর বিভিন্ন সময়ে তাকে কারাবন্দি থাকতে হয়েছে, আবার কখনো গৃহবন্দি অবস্থায় সময় কাটাতে হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জীবন ও রাজনৈতিক উত্তরণ আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে আলাদা গুরুত্ব পেয়েছে। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার আগে খালেদা জিয়া ছিলেন মূলত একজন লাজুক গৃহবধূ। স্বামীর হত্যাকাণ্ডের পরই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন এবং দলের নেতৃত্বের ভার গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাকে একদিকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বিতর্কিত চরিত্র হিসেবেও তুলে ধরা হয়েছে। শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তার অবস্থান এবং রাজনৈতিক সংঘাতের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিতে তার প্রভাবের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, টালমাটাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়ার ভূমিকার কথাও উঠে এসেছে। দেশের রাজনৈতিক সংকট ও পরিবর্তনের সময়ে তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় চরিত্র, যার প্রভাব বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও গণতান্ত্রিক কাঠামোতে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
কিছু প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কয়েক বছর ধরে চলা সামরিক শাসনের পর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাংলাদেশের কয়েক দশকের রাজনীতিতে তার সক্রিয় উপস্থিতি ও প্রভাব আন্তর্জাতিক পরিসরেও স্বীকৃতি পেয়েছে।
এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দুর্নীতির অভিযোগে তার কারাবরণের প্রসঙ্গও প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে। একইসঙ্গে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে তৎকালীন সরকারের পতনের পর তার মুক্তির বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেশী দেশগুলোতেও খালেদা জিয়ার মৃত্যু বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শোক ও শ্রদ্ধা জানানো, পাশাপাশি ২০১৫ সালে তার সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের স্মৃতিচারণের কথাও প্রতিবেদনে এসেছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে খালেদা জিয়ার ভূমিকার কথা তুলে ধরে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে।
সব মিলিয়ে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খালেদা জিয়ার প্রয়াণকে কেবল একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু হিসেবে নয়, বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনীতির একটি দীর্ঘ, প্রভাবশালী ও ঘটনাবহুল অধ্যায়ের সমাপ্তি হিসেবেই মূল্যায়ন করা হয়েছে।