*শৈত্যপ্রবাহ ও অধিক তাপমাত্রা ক্ষতি করেছে আমের
*উচ্চ তাপমাত্রা ও উচ্চ আর্দ্রতায় অ্যানথ্র্যাকনোস রোগে আক্রান্ত হয়ে আম নষ্ট হয়
*আমের উৎপাদন ৪০ শতাংশ কমার আশঙ্কা
*ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অনিশ্চয়তার পরিমাণ আরও বাড়বে :এ এস মনিরুজ্জামান খান
চলতি মৌসুমে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা অঞ্চলের আম বাগানগুলোতে পর্যাপ্ত মুকুল আসেনি। কেন?
ওই যে তাপমাত্রা যা থাকা উচিত ছিল তার চেয়ে অনেক কম। পরে তাপমাত্রা অনেক বেড়েছে। সেটা আবার আরেক বিপদ তৈরি করেছে। অত্যধিক তাপপ্রবাহের কারণে এখন গুটি থেকে আম ঝরে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছে, এই দুই সমস্যাই এবার আমের উৎপাদন কম হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) বলছে, আমের ‘অফ ইয়ার’ মৌসুম ও শীতের আধিক্যই গাছের মুকুল আসাতে বাধা দেয়ায় ৪০ শতাংশ উৎপাদন কমবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও আবহাওয়া অনুকূলে না থাকার কারণে বিপাকে পাড়ছে আম চাষিরা।
সরেজমিনে রংপুর অঞ্চলের কয়েকটি উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, হাঁড়িভাঙ্গাসহ বিভিন্ন জাতের আমের বাগানে গতবছরের চেয়ে মুকুল কম আসায় গাছগুলোতে নতুন পাতা দেখা গেছে।
রংপুরের চতরা ইউনিয়নের আম চাষি রুহুল আমিন বলেন, ‘এখানকার আশপাশের এলাকার আম বাগানের গাছগুলোতে তেমন মুকুল আসে নেই। দু-একটি গাছে মুকুল থাকলেও একেবারেই কম। আম বাগানিরা স্প্রে ও সেচ দেয়ার কোনো কমতি রাখিনি। তবে, অনেকেই বলছে অতিরিক্ত শীতের কারণে নাকি এমনটা হয়েছে।’
রাজশাহীর জিনাত আরা আফরোজ ৪টি বাগানের মালিক। তিনি আক্ষেপ করে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘রাজশাহীতে এবার আম নেই। আমার বাগানেও কোনো আম নেই। যে আমি গতবছর দেড় লাখ টাকার আম বিক্রি করেছি এবার আমাকেই আম কিনে খেতে হবে।’
কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, ‘আমার আম বাগানে মেইনটেন্স পুরাটাই করা হয়েছে। গাছ ভরে মুকুল আসলো কিন্তু প্রচ- কুয়াশা ও খরার কারণে আমার বাগানের গাছের সব মুকুল পড়ে গেল। তারপর গাছ ভরে পাতা চলে আসলো আর মুকুল হয় নাই। এই হলো অবস্থা!’
রংপুরের আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘প্রান্তিক পর্যায়ে আমের দাম না থাকায় ও বাগান পরিচর্যা, সার, কীটনাশক শ্রমিকের মজুরিসহ বিভিন্ন উপকরণের দাম বৃদ্ধির ফলে লোকশানে পড়েছি। এর মধ্যে এবার বেশিরভাগ গাছের মুকুল আসেনি। যে গাছগুলোতে আমের গুটি ছিল গত মাসের গরমে সেগুলো বেশিরভাগ পড়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এবার দীর্ঘমেয়াদি শৈত্যপ্রবাহ, অতিরিক্ত শীত ও ঠা-া, অসময়ে বৃষ্টি হওয়ায় আমের গাছে মুকুল আসে নাই।’
আমের উৎপাদন
ডিএই এর তথ্য মতে, গত বছর আম উৎপাদন হয় প্রায় ২৫ লাখ টন। চাষিরা বলছেন, চলতি বছর আমের ফলন ‘নেই’ বললেই চলে। কারণ হিসেবে শীত মৌসুমে ঘন কুয়াশা ও শৈত্যপ্রবাহ এবং স্বাভাবিকের তুলনায় বায়ুর আর্দ্রতার কারণে সিংহভাগ মুকুল ঝরে যাওয়ার কথা জানান তারা।
চাষিদের সঙ্গে একমত ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির প্রধান এ এস মনিরুজ্জামান খান। তিনি মনে করেন, এবার আমের আশানুরূপ ফলন হবে না। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘জনজীবনের তাপমাত্রার প্রভাবটা অনুভব করা যায় কিন্তু প্রকৃতি এক্ষেত্রে অনেকটাই নীরব। যেমন আমের ক্ষেত্রেই ধরুণ। বিচিত্র সব প্রজাতির আম আমাদের ফলের জায়গা অনেকটাই দখল করে রেখেছে। কিন্তু অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছরে আমের ফলন পাওয়া যাবে না।’
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘দেশের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে চলে এসেছে। আমের মুকুল ও গুটি আমে এই তাপমাত্রা মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।’
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মুহম্মদ আবদুর রহমান, সেন্টার ফর পিপল অ্যান্ড এনভায়রোনমেন্টের (সিপিই) পরিচালক। তিনি সংবাদকে বলছেন, ‘মুকুল থাকাকালীন ঘন কুয়াশা এবং উচ্চ আর্দ্রতায় আমের ম্যাংগো হপার রোগ দেখা দেয় যা মুকুল ঝরে পড়তে সহায়তা করে। অন্যদিকে আম পাকার সময়ে উচ্চ তাপমাত্রা ও উচ্চ আর্দ্রতা বিরাজ করলে অহঃযৎধপহড়ংব (অ্যানথ্র্যাকনোস) রোগে আক্রান্ত হয়ে আম নষ্ট করে। এবার আমের মৌসুম এই পরিস্থির ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, যা আমের ফলনে বড় প্রভাব ফেলছে।’
চলতি মৌসুমে আমের উৎপাদন কম হওয়ার কথা স্বীকার করেন ডিএই-এর হর্টিকালচার উইংয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কে জে এম আবদুল আউয়াল। কারণ হিসেবে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘আবহাওয়ার কারণে এবার আমের উৎপাদন গত বছরের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম হবে।’
‘প্রতিবছর মুকুল যেসময় মুকুল আসে এ মৌসুমে তা ১৫ দিন পরে আসা শুরু হয়েছে,’ বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘মুকুল আসতে সর্বনি¤œ ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন পড়ে। কিন্ত এবার শীতের দৈর্ঘ্য বেশি হওয়ায় এবার সেসময় ওই লেবেলের তাপমাত্রা হঠাৎ করে পড়ে যায়। শীতের দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ার কারণে এবার আমের মুকুলই কম এসছে।
শৈত্যপ্রবাহ ও অধিক তাপমাত্রা ক্ষতি করেছে
বাংলাদেশে আমে মুকুল আসার সময়ে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ১৮ থেকে ২০ ডিগ্রির মধ্যে থাকাই শ্রেয়। এর বেশি বা কম হলে আমের মুকুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চলতি বছর শীত মৌসুমে তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রিরও নিচে নেমে আমারে মুকুলকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেসময় ঘনঘন শৈত্যপ্রবাহ যেমন আমের মুকুল তৈরি ও গুটিতে বাধাগ্রস্ত করেছে তেমনি বর্তমানে অধিক তাপমাত্রার কারণে আমের গুটি থেকে ছোট আম ঝরে গেছে।
মুহম্মদ আবদুর রহমান বলেন, ‘অত্যধিক শৈত্যপ্রবাহ প্রয়োজনীয় সূর্যরশ্মি আগমনে বাধা সৃষ্টি করা এবং বায়ুম-লের বায়ুদূষণ শীত মৌসুমে পরাগায়ণে বাধা সৃষ্টি করে। তাও অল্প যা আম গুটিতে পরিণত হয়েছে তা গ্রীষ্মের শুরুতে দাবদাহের কারণে ঝরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় বৃষ্টি না হওয়ায় বৃষ্টির অভাবে মাটি শুষ্ক থাকায় প্রয়োজনীয় পানি ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আমগাছ। তাতে করে আম ঝরে যাচ্ছে। অন্যদিকে অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে বোটায় একটি বিশেষ স্তর তৈরি হয়, যা বোটাকে দুর্বল করে ফেলে এবং অল্প বাতাসেই আম ঝরে যায়। তাই ইতোমধ্যে অধিকাংশ আমই নষ্ট হয়ে গেছে।’
আম গাছগুলোতে ফুল আসা ও মুকুল আসা থেকে ফল হওয়া পর্যন্ত যে তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা প্রয়োজন সেটা সঠিকভাবে পেলে আমের উৎপাদন ভালো হয় বলে জানান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্টিকালচার বিভাগের অধ্যাপক তামান্না হক। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘আমের মুকুল সাধারণত জানুয়ারির শেষ দিক বা ফেব্রুয়ারির শুরু দিকে আসা শুরু করে। ওই সময় আমাদের দেশে তাপমাত্রা কমতে থাকে। এবারের ঘটনা যেটা হয়েছে, আমাদের দেরিতে শীত গেছে। যেহেতু সেসময় কম তাপমাত্রা ছিল তাই সেসময় মুকুল আসাটা ডিলে হতে পারে অথবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুকুল কম আসার সম্ভাবনা থাকে।’
‘আমের ক্ষেত্রে মুকুল আসার সময় যদি তাপমাত্রা কম থাকে তাহলে আমের যে পেনিক্রাল থাকে সেটাতে তিন রকমের ফুল থাকে। একটা পুরুষ ফুল, স্ত্রী ফুল ও কম্পিলিট ফুল থাকে। তাপমাত্রা কম থাকলে পুরুষ ফুলের সংখ্যাটা বেড়ে যায়, এ পুরুষ ফুলের সংখ্যা বেড়ে গেলে আম ধরার প্রবণতা কমে যাবে।’
এপ্রিল থেকে ঝড়বৃষ্টি শুরু হয় দেশে, ওই বৃষ্টিও আমের জীবন প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করেন তামান্না হক। তিনি বলেন, ‘এখনকার তো মাটি খুবই শুকনো। এখন যেটা সমস্যা হবে যেহেতু আম বড় হয়ে গেছে; কিছুদিন পরেই পাকা শুরু হওয়ার কথা এই সময়টাতে যদি সেচ দেয়া না যায় ম্যাক্সিমাম আম গাছ থেকে ঝরে পড়ে যাবে।’
এ এস মনিরুজ্জামান খান বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর আমের উৎপাদন অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম হবে। নাসার তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল থেকে জুন এল নিনো থেকে লা নিনোর পরিবর্তনকাল। যখন সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে। এক্ষেত্রে হয়তো আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু প্রকৃতির ওপরও যে এর বিরূপ পড়লো সেক্ষেত্রে কি আমাদের করণীয় কিছুই নেই? মনুষ্যসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনে আমরা আমাদের দায়ভার কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারবো না। ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অনিশ্চয়তার পরিমাণ আরও বাড়বে।’
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এ বছর বাজারে আমের সংকট থাকবে, আমের দাম হবে ‘আকাশচুম্বী’। জলবায়ু এরকম বৈরী আচরণ দীর্ঘমেয়াদি হলে হয়ত সামনের দিনগুলো আমের ফলন হারাবে বাংলাদেশ।
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
*শৈত্যপ্রবাহ ও অধিক তাপমাত্রা ক্ষতি করেছে আমের
*উচ্চ তাপমাত্রা ও উচ্চ আর্দ্রতায় অ্যানথ্র্যাকনোস রোগে আক্রান্ত হয়ে আম নষ্ট হয়
*আমের উৎপাদন ৪০ শতাংশ কমার আশঙ্কা
*ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অনিশ্চয়তার পরিমাণ আরও বাড়বে :এ এস মনিরুজ্জামান খান
চলতি মৌসুমে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা অঞ্চলের আম বাগানগুলোতে পর্যাপ্ত মুকুল আসেনি। কেন?
ওই যে তাপমাত্রা যা থাকা উচিত ছিল তার চেয়ে অনেক কম। পরে তাপমাত্রা অনেক বেড়েছে। সেটা আবার আরেক বিপদ তৈরি করেছে। অত্যধিক তাপপ্রবাহের কারণে এখন গুটি থেকে আম ঝরে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছে, এই দুই সমস্যাই এবার আমের উৎপাদন কম হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) বলছে, আমের ‘অফ ইয়ার’ মৌসুম ও শীতের আধিক্যই গাছের মুকুল আসাতে বাধা দেয়ায় ৪০ শতাংশ উৎপাদন কমবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও আবহাওয়া অনুকূলে না থাকার কারণে বিপাকে পাড়ছে আম চাষিরা।
সরেজমিনে রংপুর অঞ্চলের কয়েকটি উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, হাঁড়িভাঙ্গাসহ বিভিন্ন জাতের আমের বাগানে গতবছরের চেয়ে মুকুল কম আসায় গাছগুলোতে নতুন পাতা দেখা গেছে।
রংপুরের চতরা ইউনিয়নের আম চাষি রুহুল আমিন বলেন, ‘এখানকার আশপাশের এলাকার আম বাগানের গাছগুলোতে তেমন মুকুল আসে নেই। দু-একটি গাছে মুকুল থাকলেও একেবারেই কম। আম বাগানিরা স্প্রে ও সেচ দেয়ার কোনো কমতি রাখিনি। তবে, অনেকেই বলছে অতিরিক্ত শীতের কারণে নাকি এমনটা হয়েছে।’
রাজশাহীর জিনাত আরা আফরোজ ৪টি বাগানের মালিক। তিনি আক্ষেপ করে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘রাজশাহীতে এবার আম নেই। আমার বাগানেও কোনো আম নেই। যে আমি গতবছর দেড় লাখ টাকার আম বিক্রি করেছি এবার আমাকেই আম কিনে খেতে হবে।’
কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, ‘আমার আম বাগানে মেইনটেন্স পুরাটাই করা হয়েছে। গাছ ভরে মুকুল আসলো কিন্তু প্রচ- কুয়াশা ও খরার কারণে আমার বাগানের গাছের সব মুকুল পড়ে গেল। তারপর গাছ ভরে পাতা চলে আসলো আর মুকুল হয় নাই। এই হলো অবস্থা!’
রংপুরের আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘প্রান্তিক পর্যায়ে আমের দাম না থাকায় ও বাগান পরিচর্যা, সার, কীটনাশক শ্রমিকের মজুরিসহ বিভিন্ন উপকরণের দাম বৃদ্ধির ফলে লোকশানে পড়েছি। এর মধ্যে এবার বেশিরভাগ গাছের মুকুল আসেনি। যে গাছগুলোতে আমের গুটি ছিল গত মাসের গরমে সেগুলো বেশিরভাগ পড়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এবার দীর্ঘমেয়াদি শৈত্যপ্রবাহ, অতিরিক্ত শীত ও ঠা-া, অসময়ে বৃষ্টি হওয়ায় আমের গাছে মুকুল আসে নাই।’
আমের উৎপাদন
ডিএই এর তথ্য মতে, গত বছর আম উৎপাদন হয় প্রায় ২৫ লাখ টন। চাষিরা বলছেন, চলতি বছর আমের ফলন ‘নেই’ বললেই চলে। কারণ হিসেবে শীত মৌসুমে ঘন কুয়াশা ও শৈত্যপ্রবাহ এবং স্বাভাবিকের তুলনায় বায়ুর আর্দ্রতার কারণে সিংহভাগ মুকুল ঝরে যাওয়ার কথা জানান তারা।
চাষিদের সঙ্গে একমত ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির প্রধান এ এস মনিরুজ্জামান খান। তিনি মনে করেন, এবার আমের আশানুরূপ ফলন হবে না। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘জনজীবনের তাপমাত্রার প্রভাবটা অনুভব করা যায় কিন্তু প্রকৃতি এক্ষেত্রে অনেকটাই নীরব। যেমন আমের ক্ষেত্রেই ধরুণ। বিচিত্র সব প্রজাতির আম আমাদের ফলের জায়গা অনেকটাই দখল করে রেখেছে। কিন্তু অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছরে আমের ফলন পাওয়া যাবে না।’
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘দেশের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে চলে এসেছে। আমের মুকুল ও গুটি আমে এই তাপমাত্রা মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।’
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মুহম্মদ আবদুর রহমান, সেন্টার ফর পিপল অ্যান্ড এনভায়রোনমেন্টের (সিপিই) পরিচালক। তিনি সংবাদকে বলছেন, ‘মুকুল থাকাকালীন ঘন কুয়াশা এবং উচ্চ আর্দ্রতায় আমের ম্যাংগো হপার রোগ দেখা দেয় যা মুকুল ঝরে পড়তে সহায়তা করে। অন্যদিকে আম পাকার সময়ে উচ্চ তাপমাত্রা ও উচ্চ আর্দ্রতা বিরাজ করলে অহঃযৎধপহড়ংব (অ্যানথ্র্যাকনোস) রোগে আক্রান্ত হয়ে আম নষ্ট করে। এবার আমের মৌসুম এই পরিস্থির ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, যা আমের ফলনে বড় প্রভাব ফেলছে।’
চলতি মৌসুমে আমের উৎপাদন কম হওয়ার কথা স্বীকার করেন ডিএই-এর হর্টিকালচার উইংয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কে জে এম আবদুল আউয়াল। কারণ হিসেবে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘আবহাওয়ার কারণে এবার আমের উৎপাদন গত বছরের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম হবে।’
‘প্রতিবছর মুকুল যেসময় মুকুল আসে এ মৌসুমে তা ১৫ দিন পরে আসা শুরু হয়েছে,’ বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘মুকুল আসতে সর্বনি¤œ ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন পড়ে। কিন্ত এবার শীতের দৈর্ঘ্য বেশি হওয়ায় এবার সেসময় ওই লেবেলের তাপমাত্রা হঠাৎ করে পড়ে যায়। শীতের দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ার কারণে এবার আমের মুকুলই কম এসছে।
শৈত্যপ্রবাহ ও অধিক তাপমাত্রা ক্ষতি করেছে
বাংলাদেশে আমে মুকুল আসার সময়ে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ১৮ থেকে ২০ ডিগ্রির মধ্যে থাকাই শ্রেয়। এর বেশি বা কম হলে আমের মুকুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চলতি বছর শীত মৌসুমে তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রিরও নিচে নেমে আমারে মুকুলকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেসময় ঘনঘন শৈত্যপ্রবাহ যেমন আমের মুকুল তৈরি ও গুটিতে বাধাগ্রস্ত করেছে তেমনি বর্তমানে অধিক তাপমাত্রার কারণে আমের গুটি থেকে ছোট আম ঝরে গেছে।
মুহম্মদ আবদুর রহমান বলেন, ‘অত্যধিক শৈত্যপ্রবাহ প্রয়োজনীয় সূর্যরশ্মি আগমনে বাধা সৃষ্টি করা এবং বায়ুম-লের বায়ুদূষণ শীত মৌসুমে পরাগায়ণে বাধা সৃষ্টি করে। তাও অল্প যা আম গুটিতে পরিণত হয়েছে তা গ্রীষ্মের শুরুতে দাবদাহের কারণে ঝরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় বৃষ্টি না হওয়ায় বৃষ্টির অভাবে মাটি শুষ্ক থাকায় প্রয়োজনীয় পানি ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আমগাছ। তাতে করে আম ঝরে যাচ্ছে। অন্যদিকে অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে বোটায় একটি বিশেষ স্তর তৈরি হয়, যা বোটাকে দুর্বল করে ফেলে এবং অল্প বাতাসেই আম ঝরে যায়। তাই ইতোমধ্যে অধিকাংশ আমই নষ্ট হয়ে গেছে।’
আম গাছগুলোতে ফুল আসা ও মুকুল আসা থেকে ফল হওয়া পর্যন্ত যে তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা প্রয়োজন সেটা সঠিকভাবে পেলে আমের উৎপাদন ভালো হয় বলে জানান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্টিকালচার বিভাগের অধ্যাপক তামান্না হক। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘আমের মুকুল সাধারণত জানুয়ারির শেষ দিক বা ফেব্রুয়ারির শুরু দিকে আসা শুরু করে। ওই সময় আমাদের দেশে তাপমাত্রা কমতে থাকে। এবারের ঘটনা যেটা হয়েছে, আমাদের দেরিতে শীত গেছে। যেহেতু সেসময় কম তাপমাত্রা ছিল তাই সেসময় মুকুল আসাটা ডিলে হতে পারে অথবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুকুল কম আসার সম্ভাবনা থাকে।’
‘আমের ক্ষেত্রে মুকুল আসার সময় যদি তাপমাত্রা কম থাকে তাহলে আমের যে পেনিক্রাল থাকে সেটাতে তিন রকমের ফুল থাকে। একটা পুরুষ ফুল, স্ত্রী ফুল ও কম্পিলিট ফুল থাকে। তাপমাত্রা কম থাকলে পুরুষ ফুলের সংখ্যাটা বেড়ে যায়, এ পুরুষ ফুলের সংখ্যা বেড়ে গেলে আম ধরার প্রবণতা কমে যাবে।’
এপ্রিল থেকে ঝড়বৃষ্টি শুরু হয় দেশে, ওই বৃষ্টিও আমের জীবন প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করেন তামান্না হক। তিনি বলেন, ‘এখনকার তো মাটি খুবই শুকনো। এখন যেটা সমস্যা হবে যেহেতু আম বড় হয়ে গেছে; কিছুদিন পরেই পাকা শুরু হওয়ার কথা এই সময়টাতে যদি সেচ দেয়া না যায় ম্যাক্সিমাম আম গাছ থেকে ঝরে পড়ে যাবে।’
এ এস মনিরুজ্জামান খান বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর আমের উৎপাদন অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম হবে। নাসার তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল থেকে জুন এল নিনো থেকে লা নিনোর পরিবর্তনকাল। যখন সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে। এক্ষেত্রে হয়তো আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু প্রকৃতির ওপরও যে এর বিরূপ পড়লো সেক্ষেত্রে কি আমাদের করণীয় কিছুই নেই? মনুষ্যসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনে আমরা আমাদের দায়ভার কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারবো না। ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অনিশ্চয়তার পরিমাণ আরও বাড়বে।’
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এ বছর বাজারে আমের সংকট থাকবে, আমের দাম হবে ‘আকাশচুম্বী’। জলবায়ু এরকম বৈরী আচরণ দীর্ঘমেয়াদি হলে হয়ত সামনের দিনগুলো আমের ফলন হারাবে বাংলাদেশ।