‘সমন্বয়হীনভাবে’ বাস্তবায়নের কারণে সাতটি প্রকল্পের মাধ্যমিক শিক্ষায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের কার্যক্রম আপাতত স্থগিত। ওইসব প্রকল্পে শিক্ষা উপকরণ ক্রয় ও ক্রয় প্রক্রিয়া, ক্রয় মূল্য, উপকরণ নির্বাচন বা স্পেসিফিকেশনের কোনো মিল বা সমন্বয় না থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সেজন্য ওইসব প্রকল্পে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রেখে প্রকল্পগুলোর ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফাইল) সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) হুমায়ুন কবীরের সভাপতিত্বে গত ১৭ মার্চ অনুষ্ঠিত এক সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
ক্লাসরুম স্থাপনের ‘স্টক রেজিস্টার’ না থাকা
ক্রয় প্রক্রিয়ায় ‘গরমিল’
ওই সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, ‘প্রকল্পসমূহের কার্যক্রমগুলো সুনির্দিষ্ট করে ওয়ার্কপ্ল্যান প্রস্তুত করতে হবে। সে অনুসারে স্বল্প ব্যয়ে টেকসই উন্নয়ন করতে হবে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের বাজেট প্রকল্পভেদে ভিন্ন হওয়ায় তা পরিহার করে সমজাতীয় বিষয়ে ব্যয়ের পরিমাণ অভিন্ন রেখে ডিপিপি সংশোধন করতে হবে।’
প্রকল্পগুলোর মধ্যে সমন্বয়তা বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘যাতে সমন্বিত কর্মসূচির মাধ্যমে ডুপ্লিকেশন পরিহার করে সর্বোচ্চ সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। একই সঙ্গে আইসিটির (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) উন্নয়নে মাউশির আওতাধীন প্রকল্পগুলো হতে যেসব কম্পিউটার ও সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হয়েছে সেক্ষেত্রে গ্রহীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একটি স্টক রেজিস্টার সংরক্ষণ করবে।’
প্রকল্পভেদে অর্থাৎ কোনো ‘ইকুইপমেন্ট’ কোন প্রকল্প হতে গ্রহণ করা হয়েছে তা প্রকল্পের ‘নামান্বিত সিলযুক্ত’ করতে হবে উল্লেখ করে সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ‘মাউশিসহ যারা পরিদর্শনে যাবেন তারা বিষয়টি যথাযথভাবে নিশ্চিত করবেন।’
প্রকল্পের আওতায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনে ‘স্মার্ট টিভির’ পরিবর্তে ইন্টারঅ্যাক্টিভ প্যানেল অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের (পরিকল্পনা) সভাপতিত্বে ছয় সদস্যের একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়।
এই কমিটি কারিগরি উপযোগিতা, তুলনামূলক সুবিধা এবং আর্থিক সংশ্লিষ্টতাসহ সার্বিক বিষয়ে স্বল্প সময়ে একটি প্রতিবেদন প্রদান করবে। এই প্রতিবেদনের সুপারিশ যথাযথভাবে প্রতিপালন নিশ্চিত করতে হবে বলে কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে জানা গেছে, সারা দেশের মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ২৭ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসিটি শিক্ষা উপকরণ বা মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম রয়েছে। আরও প্রায় পাঁচ হাজার প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের শ্রেণীকক্ষ নেই।
কেনাকাটায় গরমিল:
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নওগাঁ জেলার সান্দা উপজেলার ‘গোবিন্দপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে’ আইসিটি উপকরণ কেনার জন্য গত বছরের জুনে দুই লাখ ৪৫ লাখ টাকা দেয়া হয় মাউশির একটি প্রকল্প থেকে। কিন্তু ওই টাকা খরচ দেখানো হলেও স্কুলটিতে কোনো মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন হয়নি।
গোবিন্দপুর বহুমুখী বিদ্যালয়টির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সাবেক অধ্যাপক আব্দুল মালেক সংবাদকে বলেন, ‘স্কুলটিতে যখন দুই লাখ ৪৫ হাজার টাকা দেয়া হয়, তখন কোনো ম্যানেজিং কমিটি ছিল না। কিন্তু টাকা ব্যাংক থেকে তুলে খেয়ে ফেলেছে কয়েকজন শিক্ষক। কোনো মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম হয়নি।’
২০১৬ সাল থেকে চার বছরে ‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন প্রকল্প-
২’ প্রকল্পের আওতায় তিন হাজার ৩৪০টি হাইস্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করার কথা ছিল। নানা কারণে এই প্রকল্প মাঠে গড়ায়নি।
এরপর সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ও মহিবুল হাসান চৌধুরীর তৎপরতায় ক্লাসরুম স্থাপনের জন্য স্কুলগুলোতে টাকা বিতরণের উদ্যোগ নেয় শিক্ষা প্রশাসন। সেই আলোকে গত বছর স্কুল পর্যায়ে টাকা বিতরণ করা হয়; এর পরই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন প্রকল্প-২’ বাস্তবায়নে সরকারের মোট এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। এই প্রকল্পের আওতায় তিন হাজার ৩৪০টি হাইস্কুলে একটি করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে মহানগর ও জেলা সদরের স্কুলে প্রতিটিতে ৬ থেকে ৮টি মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে মোট ৩৬ হাজার ৮৪টি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়।
গড়ে একটি স্কুলে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ স্থাপনে ব্যয় ধরা হয় এক লাখ ৬০ হাজার টাকা। এই টাকায় মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, সাউন্ডবক্স ও মডেম-ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ দেয়ার কথা ছিল।
পরবর্তীতে ডিপিপি সংশোধন করে প্রতিটি শ্রেণীকক্ষে একটি ৬৫ ইঞ্চি স্মার্ট টিভি, একটি ডেস্কটপ কম্পিউটার, একটি ইউপিএস, একটি ওয়াই-ফাই রাউটার ও একটি পেনড্রাইভ কেনার সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনে স্মার্ট টিভির পরিবর্তে ইন্টারঅ্যাক্টিভ প্যানেল অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাউশির একটি প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) সংবাদকে বলেন, সবকটি প্রকল্পেই স্মার্ট টিভির পরিবর্তে ইন্টারঅ্যাক্টিভ প্যানেল কেনার সিদ্ধান্ত দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে সবকটি প্রকল্পের ডিপিপি আবারও সংশোধন করতে হবে। এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ব্যয়ও কম-বেশি হতে পারে।
আরেকটি প্রকল্পের পিডি নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, আইসিটি উপকরণ সরবরাহ নিয়ে তারা ‘ঝামেলায়’ আছেন। ‘পছন্দের প্রতিষ্ঠানের’ মাধ্যমে এসব উপকরণ ক্রয় করতে ‘মন্ত্রণালয়কেন্দ্রিক’ এক শ্রেণীর কর্মকর্তা প্রায়ই প্রকল্পের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আসছিলেন। আবার শিক্ষা উপকরণ কেনা না হলেও বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ের ওপর সারা দেশের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হচ্ছে। এতে সরকারের ‘বিপুল’ অংকের টাকা ‘অপচয়’ হচ্ছে।
‘৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত বিদ্যালয়গুলোর পাঠদান সহায়ক আইসিটি সরঞ্জাম, বিজ্ঞানাগার সংস্থানসহ প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের কথা রয়েছে।
‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর (৩২৩টি) উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি বিদ্যালয়ে কম্পিউটার সামগ্রী, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, স্মার্ট ক্লাসরুম, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও ফটোকপিয়ার সরবরাহের কথা রয়েছে।
‘সরকারি কলেজসমূহে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে ১৭৬টি নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এসব ভবনে মোট এক হাজার ৯১৪টি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৯১টি কলেজে দশ হাজার ৫২০টি কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হয়েছে।
‘তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজগুলোর উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে এক হাজার ৬১০টি নির্বাচিত কলেজে একাডেমিক ভবন নির্মাণ হচ্ছে। এসব ভবনের প্রতিটিতে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটিসহ একটি করে আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব ও প্রতিটি শ্রেণীকক্ষে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হচ্ছে।
‘ঢাকা শহর সন্নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি স্কুলে ৩০টি করে মোট ৩০০টি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হবে।
মাউশির পরিকল্পনা শাখার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে তড়িঘড়ি করে ‘লার্নিং অ্যাক্সিলারেশন ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন’ (লেইস) শীর্ষক প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় তিন হাজার ৩০৪ কোটি টাকা ধরা হয়েছে।
এই প্রকল্পের আওতায় মোট দশ হাজার ৩৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিটিতে দুটি করে মোট ২০ হাজার ৬৮০টি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হবে। ওই সময় আইসিটি উপকরণ সরবরাহের জন্য ছয়টি প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলমান থাকলেও সেগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করা হয়নি বলে মাউশির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ওই সাতটি প্রকল্প নিয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিশেষ সভায় মাউশির মহাপরিচালক বলেন, ‘সাতটি প্রকল্পের যারা বেনিফিশিয়ারি আছে তাদের মধ্যে আন্তঃসমন্বয় হচ্ছে কিনা, তা খেয়াল রাখা প্রয়োজন। সব প্রকল্পের সমন্বিত কর্মসূচির মাধ্যমে ডুপ্লিকেশন পরিহার করে সর্বোচ্চ সুযোগ সৃষ্টির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ইতিবাচকভাবে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
অতিরিক্ত সচিব হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হচ্ছে এবং মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের সংখ্যা প্রকল্প ভিত্তিতে তালিকা করা প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের বাজেট প্রকল্পভেদে ভিন্ন, স্পেসিফিকেশনও ভিন্ন হচ্ছে; এর সমন্বয় করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে ডিপিপি সংশোধন করে ভিন্নতা পরিহার করতে হবে। সমজাতীয় সুযোগ-সুবিধা সমন্বিতভাবে স্পেসিফিকেশন এবং ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করা প্রয়োজন।’
মঙ্গলবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৫
‘সমন্বয়হীনভাবে’ বাস্তবায়নের কারণে সাতটি প্রকল্পের মাধ্যমিক শিক্ষায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের কার্যক্রম আপাতত স্থগিত। ওইসব প্রকল্পে শিক্ষা উপকরণ ক্রয় ও ক্রয় প্রক্রিয়া, ক্রয় মূল্য, উপকরণ নির্বাচন বা স্পেসিফিকেশনের কোনো মিল বা সমন্বয় না থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সেজন্য ওইসব প্রকল্পে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রেখে প্রকল্পগুলোর ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফাইল) সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) হুমায়ুন কবীরের সভাপতিত্বে গত ১৭ মার্চ অনুষ্ঠিত এক সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
ক্লাসরুম স্থাপনের ‘স্টক রেজিস্টার’ না থাকা
ক্রয় প্রক্রিয়ায় ‘গরমিল’
ওই সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, ‘প্রকল্পসমূহের কার্যক্রমগুলো সুনির্দিষ্ট করে ওয়ার্কপ্ল্যান প্রস্তুত করতে হবে। সে অনুসারে স্বল্প ব্যয়ে টেকসই উন্নয়ন করতে হবে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের বাজেট প্রকল্পভেদে ভিন্ন হওয়ায় তা পরিহার করে সমজাতীয় বিষয়ে ব্যয়ের পরিমাণ অভিন্ন রেখে ডিপিপি সংশোধন করতে হবে।’
প্রকল্পগুলোর মধ্যে সমন্বয়তা বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘যাতে সমন্বিত কর্মসূচির মাধ্যমে ডুপ্লিকেশন পরিহার করে সর্বোচ্চ সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। একই সঙ্গে আইসিটির (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) উন্নয়নে মাউশির আওতাধীন প্রকল্পগুলো হতে যেসব কম্পিউটার ও সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হয়েছে সেক্ষেত্রে গ্রহীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একটি স্টক রেজিস্টার সংরক্ষণ করবে।’
প্রকল্পভেদে অর্থাৎ কোনো ‘ইকুইপমেন্ট’ কোন প্রকল্প হতে গ্রহণ করা হয়েছে তা প্রকল্পের ‘নামান্বিত সিলযুক্ত’ করতে হবে উল্লেখ করে সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ‘মাউশিসহ যারা পরিদর্শনে যাবেন তারা বিষয়টি যথাযথভাবে নিশ্চিত করবেন।’
প্রকল্পের আওতায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনে ‘স্মার্ট টিভির’ পরিবর্তে ইন্টারঅ্যাক্টিভ প্যানেল অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের (পরিকল্পনা) সভাপতিত্বে ছয় সদস্যের একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়।
এই কমিটি কারিগরি উপযোগিতা, তুলনামূলক সুবিধা এবং আর্থিক সংশ্লিষ্টতাসহ সার্বিক বিষয়ে স্বল্প সময়ে একটি প্রতিবেদন প্রদান করবে। এই প্রতিবেদনের সুপারিশ যথাযথভাবে প্রতিপালন নিশ্চিত করতে হবে বলে কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে জানা গেছে, সারা দেশের মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ২৭ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসিটি শিক্ষা উপকরণ বা মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম রয়েছে। আরও প্রায় পাঁচ হাজার প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের শ্রেণীকক্ষ নেই।
কেনাকাটায় গরমিল:
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নওগাঁ জেলার সান্দা উপজেলার ‘গোবিন্দপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে’ আইসিটি উপকরণ কেনার জন্য গত বছরের জুনে দুই লাখ ৪৫ লাখ টাকা দেয়া হয় মাউশির একটি প্রকল্প থেকে। কিন্তু ওই টাকা খরচ দেখানো হলেও স্কুলটিতে কোনো মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন হয়নি।
গোবিন্দপুর বহুমুখী বিদ্যালয়টির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সাবেক অধ্যাপক আব্দুল মালেক সংবাদকে বলেন, ‘স্কুলটিতে যখন দুই লাখ ৪৫ হাজার টাকা দেয়া হয়, তখন কোনো ম্যানেজিং কমিটি ছিল না। কিন্তু টাকা ব্যাংক থেকে তুলে খেয়ে ফেলেছে কয়েকজন শিক্ষক। কোনো মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম হয়নি।’
২০১৬ সাল থেকে চার বছরে ‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন প্রকল্প-
২’ প্রকল্পের আওতায় তিন হাজার ৩৪০টি হাইস্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করার কথা ছিল। নানা কারণে এই প্রকল্প মাঠে গড়ায়নি।
এরপর সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ও মহিবুল হাসান চৌধুরীর তৎপরতায় ক্লাসরুম স্থাপনের জন্য স্কুলগুলোতে টাকা বিতরণের উদ্যোগ নেয় শিক্ষা প্রশাসন। সেই আলোকে গত বছর স্কুল পর্যায়ে টাকা বিতরণ করা হয়; এর পরই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন প্রকল্প-২’ বাস্তবায়নে সরকারের মোট এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। এই প্রকল্পের আওতায় তিন হাজার ৩৪০টি হাইস্কুলে একটি করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে মহানগর ও জেলা সদরের স্কুলে প্রতিটিতে ৬ থেকে ৮টি মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে মোট ৩৬ হাজার ৮৪টি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়।
গড়ে একটি স্কুলে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ স্থাপনে ব্যয় ধরা হয় এক লাখ ৬০ হাজার টাকা। এই টাকায় মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, সাউন্ডবক্স ও মডেম-ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ দেয়ার কথা ছিল।
পরবর্তীতে ডিপিপি সংশোধন করে প্রতিটি শ্রেণীকক্ষে একটি ৬৫ ইঞ্চি স্মার্ট টিভি, একটি ডেস্কটপ কম্পিউটার, একটি ইউপিএস, একটি ওয়াই-ফাই রাউটার ও একটি পেনড্রাইভ কেনার সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনে স্মার্ট টিভির পরিবর্তে ইন্টারঅ্যাক্টিভ প্যানেল অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাউশির একটি প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) সংবাদকে বলেন, সবকটি প্রকল্পেই স্মার্ট টিভির পরিবর্তে ইন্টারঅ্যাক্টিভ প্যানেল কেনার সিদ্ধান্ত দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে সবকটি প্রকল্পের ডিপিপি আবারও সংশোধন করতে হবে। এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ব্যয়ও কম-বেশি হতে পারে।
আরেকটি প্রকল্পের পিডি নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, আইসিটি উপকরণ সরবরাহ নিয়ে তারা ‘ঝামেলায়’ আছেন। ‘পছন্দের প্রতিষ্ঠানের’ মাধ্যমে এসব উপকরণ ক্রয় করতে ‘মন্ত্রণালয়কেন্দ্রিক’ এক শ্রেণীর কর্মকর্তা প্রায়ই প্রকল্পের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আসছিলেন। আবার শিক্ষা উপকরণ কেনা না হলেও বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ের ওপর সারা দেশের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হচ্ছে। এতে সরকারের ‘বিপুল’ অংকের টাকা ‘অপচয়’ হচ্ছে।
‘৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত বিদ্যালয়গুলোর পাঠদান সহায়ক আইসিটি সরঞ্জাম, বিজ্ঞানাগার সংস্থানসহ প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের কথা রয়েছে।
‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর (৩২৩টি) উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি বিদ্যালয়ে কম্পিউটার সামগ্রী, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, স্মার্ট ক্লাসরুম, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও ফটোকপিয়ার সরবরাহের কথা রয়েছে।
‘সরকারি কলেজসমূহে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে ১৭৬টি নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এসব ভবনে মোট এক হাজার ৯১৪টি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৯১টি কলেজে দশ হাজার ৫২০টি কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হয়েছে।
‘তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজগুলোর উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে এক হাজার ৬১০টি নির্বাচিত কলেজে একাডেমিক ভবন নির্মাণ হচ্ছে। এসব ভবনের প্রতিটিতে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটিসহ একটি করে আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব ও প্রতিটি শ্রেণীকক্ষে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হচ্ছে।
‘ঢাকা শহর সন্নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি স্কুলে ৩০টি করে মোট ৩০০টি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হবে।
মাউশির পরিকল্পনা শাখার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে তড়িঘড়ি করে ‘লার্নিং অ্যাক্সিলারেশন ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন’ (লেইস) শীর্ষক প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় তিন হাজার ৩০৪ কোটি টাকা ধরা হয়েছে।
এই প্রকল্পের আওতায় মোট দশ হাজার ৩৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিটিতে দুটি করে মোট ২০ হাজার ৬৮০টি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হবে। ওই সময় আইসিটি উপকরণ সরবরাহের জন্য ছয়টি প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলমান থাকলেও সেগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করা হয়নি বলে মাউশির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ওই সাতটি প্রকল্প নিয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিশেষ সভায় মাউশির মহাপরিচালক বলেন, ‘সাতটি প্রকল্পের যারা বেনিফিশিয়ারি আছে তাদের মধ্যে আন্তঃসমন্বয় হচ্ছে কিনা, তা খেয়াল রাখা প্রয়োজন। সব প্রকল্পের সমন্বিত কর্মসূচির মাধ্যমে ডুপ্লিকেশন পরিহার করে সর্বোচ্চ সুযোগ সৃষ্টির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ইতিবাচকভাবে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
অতিরিক্ত সচিব হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হচ্ছে এবং মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের সংখ্যা প্রকল্প ভিত্তিতে তালিকা করা প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের বাজেট প্রকল্পভেদে ভিন্ন, স্পেসিফিকেশনও ভিন্ন হচ্ছে; এর সমন্বয় করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে ডিপিপি সংশোধন করে ভিন্নতা পরিহার করতে হবে। সমজাতীয় সুযোগ-সুবিধা সমন্বিতভাবে স্পেসিফিকেশন এবং ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করা প্রয়োজন।’