সম্প্রতি শিল্প ও ক্যাপটিভ বিদ্যুতে গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তে শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে সমালোচনা চলছে। গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে যাবে এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে পণ্যের দামও বেড়ে যাবে। এতে ভোক্তাকে গুনতে হবে বাড়তি অর্থ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘সরকারকে রাজস্ব বাড়াতে হবে এটা যেমন সত্য, এর চেয়ে বড় সত্য হলো, গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সরকার নিজের ব্যর্থতার দায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দিলো।’
সরকারের সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের সমালোচনা
অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস সংগ্রহের উদ্যোগ না নিয়ে দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি
দাম বাড়ানো তো নয়ই, কমানোর দাবি ব্যবসায়ীদের
দাম বাড়লে উৎপাদন খরচ বাড়বে, খরচ বাড়লে পণ্যের দাম বাড়বে এবং ভোক্তা চাপে পড়বে
সম্প্রতি গ্যাসের দাম ঘনমিটারপ্রতি ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা এবং ক্যাপটিভে ৩১ দশমিক ৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪২ টাকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। নতুন শিল্পের পাশাপাশি এখন যারা অনুমোদিত লোডের বেশি গ্যাস ব্যবহার করছেন সেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানকেও ৩০ টাকার পরিবর্তে ৪০ টাকা দরে বিল দিতে হবে। নতুন দাম চলতি এপ্রিল মাসের বিল থেকেই কার্যকর হবে।
তবে এভাবে দাম বৃদ্ধিতে সরকারের ব্যর্থতা দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, সরকার যদি এলএনজি থেকে সরে আসতে পারতো এবং আগেই যদি গ্যাসের কূপ খনন করে অভ্যন্তরীণ গ্যাস সরবরাহ করতো তাহলে আজ দাম বাড়াতে হতো না। অর্থাৎ সরকার কূপ খনন করে অভ্যন্তরীণ গ্যাস সংগ্রহের চেষ্টা না করে সেই দায় জনগণের ওপর চাপিয়েছে।
মঙ্গলবার (১৫এপ্রিল) কথা হয় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ডিরেক্টর খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের সঙ্গে। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘প্রথমত, সরকার এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে অব্যাহত ভর্তুকি কমানোর জন্য। ভর্তুকিজনিত চাপ সরকারের ওপরে আছে। এখন ভর্তুকি কমাতে হবে সেটা আইএমএফের শর্তেও আছে। অব্যাহতভাবে পেট্রোবাংলা লোকসানও দিচ্ছে। পেট্রোবাংলার কাছে বিভিন্ন কোম্পানির প্রায় চৌদ্দ হাজার কোটি টাকার মতো পাওনা আছে। এই পাওনা পরিশোধের জন্যেও সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে সরকার সেটার দায় জনগণের ওপর না চাপালেও পারতো। সরকার যদি এলএনজির ওপর নির্ভর না করে নিজেরদের কূপ খনন করে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস সংগ্রহ করতো তাহলে এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না।’
ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ
গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারাও বলছেন, ‘বাংলাদেশে পর্যাপ্ত গ্যাস মজুত রয়েছে কিন্তু কর্তৃপক্ষ কখনও নতুন কূপ খননের উদ্যোগ নেয়নি। এখন দাম বাড়িয়ে আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হলো।’
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী টেক্সটাইল খাতের উদ্যোক্তারা। এই বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল সংবাদকে বলেন, ‘সরকার এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যা মূলত একটি অলিগার্ক শ্রেণিকে লাভবান করেছে। এটি ছিল পূর্ববর্তী সরকারের অনুসৃত পথ। দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমান সরকারও একই পথে হাঁটছে। এখন তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি দেশের শিল্প খাতকে ধ্বংস হতে দেবে, নাকি এগিয়ে নিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে?’
আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি করেছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘পূর্ববর্তী সরকার অনেক খাতে বিশেষ করে জ্বালানির ক্ষেত্রে ভারতের ওপর উচ্চমাত্রার নির্ভরশীলতা তৈরি করেছে। আমরা সেই নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে চাই। কারণ ভারত কখনও উভয়পক্ষের জন্য লাভজনক দ্বিপক্ষীয় বা কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর বিশ্বাস করে না। যে কোনো পরিস্থিতিতেই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এখন দাম কমিয়ে ২০ টাকার কাছাকাছি আনা উচিত। বিপিসি, তিতাস এবং এ ধরনের সংস্থাগুলো মুনাফাকেন্দ্রিক মানসিকতা নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে, কিন্তু তাদের কার্যক্রমে উপকার পাচ্ছে
না সাধারণ ভোক্তা বা শিল্প খাত।’
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের ভিত্তি হলো জ্বালানির নিশ্চয়তা। কিন্তু বারবার গ্যাসের দাম বাড়ালে আমরা কীভাবে বিনিয়োগকারী প্রত্যাশা করব? এই ধরনের মূল্যবৃদ্ধি নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।’
এই বিষয়ে বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল সংবাদকে বলেন, ‘গ্যাসের দাম বৃদ্ধি সরকারি সিদ্ধান্ত। ওনারা হয়তো ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি শিল্পের প্রতিনিধি হিসেবে বলতে পারি, খরচ বাড়লে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতা করার ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে পড়ি। কারণ বায়াররা এতকিছু বোঝেন না। যেখান থেকে কম দামে পণ্য পাবেন সেখান থেকেই কিনবেন। কিন্তু আমাদের তো আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে কম্পিট করতে হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে দাম না বাড়িয়ে, অন্য কোনো উপায়ে এটার সমাধান করা যেত কিনা, সেটা দেখা দরকার ছিল।’
অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস সংগ্রহের জোর উদ্যোগ নেই সরকারের
আগের সরকারও যেমন এ কাজটি করেনি ঠিক তেমনি নতুন সরকারও করছে না জানিয়ে গোলাম মোয়াজ্জেম সংবাদকে বলেন, ‘আগের সরকারও করেনি। বর্তমান সরকারও অভ্যন্তরীণ গ্যাস কূপ খননের ক্ষেত্রে যথেষ্ট আন্তরিক না। সীমিতভাবে কিছু গ্যাস কূপ খননের জন্য অভ্যন্তরীণ অর্থবরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু সরকারের টার্গেট রয়েছে ২০২৬ সালের মধ্যে সম্ভবত ২৬টি গ্যাস কূপ খনন করার। এখন পর্যন্ত ৭টির মতো গ্যাস কূপ খননের উদ্যোগ চলছে। সুতরাং সেই জায়গাগুলোতে আরও বেশি অর্থবরাদ্দ দরকার।’
গ্যাস ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে আরও অর্থবরাদ্দ করা প্রয়োজন ছিল জানিয়ে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘গ্যাস ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে অর্থবরাদ্দের জন্য সরকারের উদ্যোগ নেয়া দরকার ছিল। নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকেও যদি ধীরে ধীরে সরকার গুরুত্ব বাড়াতো, তাহলে সেখান থেকেও আমরা যদি বিদ্যুতের জন্য যে জ্বালানির প্রয়োজন সেটা পেতাম। এতে এলএনজির ওপর নির্ভরতা কমানো যেত।’
সরকার নিজের কাজ না করে জনগণের ওপর দায় চাপিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গ্যাস কোম্পানির অব্যাহত লোকসান এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেহেতু সীমিত সে কারণে সরকার ভোক্তার ওপর এটা চাপিয়ে দিয়েছে। আমরা মনে করি, এটা ভোক্তার দায় নয়। ভোক্তার ওপর দায়টা না চাপিয়ে এটা বরং অভ্যন্তরীণ গ্যাস সংগ্রহ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবস্থা করে এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসা যেত।’
এর আগে পেট্রোবাংলা একটি প্রস্তাব দিয়েছিল যাতে নতুন এবং প্রতিশ্রুত (ইতোমধ্যে অনুমোদিত কিন্তু কার্যকর না হওয়া) গ্রাহকদের গ্যাসের দাম ৭৫ দশমিক ৭২ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল। এমনকি প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের অর্ধেক বিল বর্তমান দরে এবং বাকি অর্ধেক ৭৫ দশমিক ৭২ টাকা হার অনুযায়ী নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়।
বিইআরসি গত ২৬ ফেব্রুয়ারি পেট্রোবাংলার প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি আয়োজন করে। সেখানে ব্যবসায়ী এবং শিল্প সংগঠনের প্রতিনিধিরা পেট্রোবাংলার প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। বিশেষ করে একই খাতে দুই ধরনের গ্যাস মূল্য নির্ধারণকে ‘বৈষম্যমূলক’ এবং ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে উল্লেখ করেন উদ্যোক্তারা।
শুনানিতে পেট্রোবাংলা দাবি করেছিল, বর্তমান গ্যাস বিক্রয়মূল্য অপর্যাপ্ত হওয়ায় বছরে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হচ্ছে। সেই ঘাটতি পূরণেই তারা মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। তবে শিল্প মালিকরা এ যুক্তিকে অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেন। তাদের দাবি, এর ফলে দেশীয় শিল্প উৎপাদন এবং বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৫
সম্প্রতি শিল্প ও ক্যাপটিভ বিদ্যুতে গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তে শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে সমালোচনা চলছে। গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে যাবে এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে পণ্যের দামও বেড়ে যাবে। এতে ভোক্তাকে গুনতে হবে বাড়তি অর্থ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘সরকারকে রাজস্ব বাড়াতে হবে এটা যেমন সত্য, এর চেয়ে বড় সত্য হলো, গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সরকার নিজের ব্যর্থতার দায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দিলো।’
সরকারের সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের সমালোচনা
অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস সংগ্রহের উদ্যোগ না নিয়ে দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি
দাম বাড়ানো তো নয়ই, কমানোর দাবি ব্যবসায়ীদের
দাম বাড়লে উৎপাদন খরচ বাড়বে, খরচ বাড়লে পণ্যের দাম বাড়বে এবং ভোক্তা চাপে পড়বে
সম্প্রতি গ্যাসের দাম ঘনমিটারপ্রতি ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা এবং ক্যাপটিভে ৩১ দশমিক ৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪২ টাকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। নতুন শিল্পের পাশাপাশি এখন যারা অনুমোদিত লোডের বেশি গ্যাস ব্যবহার করছেন সেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানকেও ৩০ টাকার পরিবর্তে ৪০ টাকা দরে বিল দিতে হবে। নতুন দাম চলতি এপ্রিল মাসের বিল থেকেই কার্যকর হবে।
তবে এভাবে দাম বৃদ্ধিতে সরকারের ব্যর্থতা দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, সরকার যদি এলএনজি থেকে সরে আসতে পারতো এবং আগেই যদি গ্যাসের কূপ খনন করে অভ্যন্তরীণ গ্যাস সরবরাহ করতো তাহলে আজ দাম বাড়াতে হতো না। অর্থাৎ সরকার কূপ খনন করে অভ্যন্তরীণ গ্যাস সংগ্রহের চেষ্টা না করে সেই দায় জনগণের ওপর চাপিয়েছে।
মঙ্গলবার (১৫এপ্রিল) কথা হয় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ডিরেক্টর খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের সঙ্গে। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘প্রথমত, সরকার এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে অব্যাহত ভর্তুকি কমানোর জন্য। ভর্তুকিজনিত চাপ সরকারের ওপরে আছে। এখন ভর্তুকি কমাতে হবে সেটা আইএমএফের শর্তেও আছে। অব্যাহতভাবে পেট্রোবাংলা লোকসানও দিচ্ছে। পেট্রোবাংলার কাছে বিভিন্ন কোম্পানির প্রায় চৌদ্দ হাজার কোটি টাকার মতো পাওনা আছে। এই পাওনা পরিশোধের জন্যেও সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে সরকার সেটার দায় জনগণের ওপর না চাপালেও পারতো। সরকার যদি এলএনজির ওপর নির্ভর না করে নিজেরদের কূপ খনন করে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস সংগ্রহ করতো তাহলে এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না।’
ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ
গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারাও বলছেন, ‘বাংলাদেশে পর্যাপ্ত গ্যাস মজুত রয়েছে কিন্তু কর্তৃপক্ষ কখনও নতুন কূপ খননের উদ্যোগ নেয়নি। এখন দাম বাড়িয়ে আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হলো।’
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী টেক্সটাইল খাতের উদ্যোক্তারা। এই বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল সংবাদকে বলেন, ‘সরকার এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যা মূলত একটি অলিগার্ক শ্রেণিকে লাভবান করেছে। এটি ছিল পূর্ববর্তী সরকারের অনুসৃত পথ। দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমান সরকারও একই পথে হাঁটছে। এখন তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি দেশের শিল্প খাতকে ধ্বংস হতে দেবে, নাকি এগিয়ে নিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে?’
আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি করেছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘পূর্ববর্তী সরকার অনেক খাতে বিশেষ করে জ্বালানির ক্ষেত্রে ভারতের ওপর উচ্চমাত্রার নির্ভরশীলতা তৈরি করেছে। আমরা সেই নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে চাই। কারণ ভারত কখনও উভয়পক্ষের জন্য লাভজনক দ্বিপক্ষীয় বা কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর বিশ্বাস করে না। যে কোনো পরিস্থিতিতেই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এখন দাম কমিয়ে ২০ টাকার কাছাকাছি আনা উচিত। বিপিসি, তিতাস এবং এ ধরনের সংস্থাগুলো মুনাফাকেন্দ্রিক মানসিকতা নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে, কিন্তু তাদের কার্যক্রমে উপকার পাচ্ছে
না সাধারণ ভোক্তা বা শিল্প খাত।’
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের ভিত্তি হলো জ্বালানির নিশ্চয়তা। কিন্তু বারবার গ্যাসের দাম বাড়ালে আমরা কীভাবে বিনিয়োগকারী প্রত্যাশা করব? এই ধরনের মূল্যবৃদ্ধি নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।’
এই বিষয়ে বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল সংবাদকে বলেন, ‘গ্যাসের দাম বৃদ্ধি সরকারি সিদ্ধান্ত। ওনারা হয়তো ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি শিল্পের প্রতিনিধি হিসেবে বলতে পারি, খরচ বাড়লে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতা করার ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে পড়ি। কারণ বায়াররা এতকিছু বোঝেন না। যেখান থেকে কম দামে পণ্য পাবেন সেখান থেকেই কিনবেন। কিন্তু আমাদের তো আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে কম্পিট করতে হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে দাম না বাড়িয়ে, অন্য কোনো উপায়ে এটার সমাধান করা যেত কিনা, সেটা দেখা দরকার ছিল।’
অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস সংগ্রহের জোর উদ্যোগ নেই সরকারের
আগের সরকারও যেমন এ কাজটি করেনি ঠিক তেমনি নতুন সরকারও করছে না জানিয়ে গোলাম মোয়াজ্জেম সংবাদকে বলেন, ‘আগের সরকারও করেনি। বর্তমান সরকারও অভ্যন্তরীণ গ্যাস কূপ খননের ক্ষেত্রে যথেষ্ট আন্তরিক না। সীমিতভাবে কিছু গ্যাস কূপ খননের জন্য অভ্যন্তরীণ অর্থবরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু সরকারের টার্গেট রয়েছে ২০২৬ সালের মধ্যে সম্ভবত ২৬টি গ্যাস কূপ খনন করার। এখন পর্যন্ত ৭টির মতো গ্যাস কূপ খননের উদ্যোগ চলছে। সুতরাং সেই জায়গাগুলোতে আরও বেশি অর্থবরাদ্দ দরকার।’
গ্যাস ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে আরও অর্থবরাদ্দ করা প্রয়োজন ছিল জানিয়ে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘গ্যাস ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে অর্থবরাদ্দের জন্য সরকারের উদ্যোগ নেয়া দরকার ছিল। নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকেও যদি ধীরে ধীরে সরকার গুরুত্ব বাড়াতো, তাহলে সেখান থেকেও আমরা যদি বিদ্যুতের জন্য যে জ্বালানির প্রয়োজন সেটা পেতাম। এতে এলএনজির ওপর নির্ভরতা কমানো যেত।’
সরকার নিজের কাজ না করে জনগণের ওপর দায় চাপিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গ্যাস কোম্পানির অব্যাহত লোকসান এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেহেতু সীমিত সে কারণে সরকার ভোক্তার ওপর এটা চাপিয়ে দিয়েছে। আমরা মনে করি, এটা ভোক্তার দায় নয়। ভোক্তার ওপর দায়টা না চাপিয়ে এটা বরং অভ্যন্তরীণ গ্যাস সংগ্রহ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবস্থা করে এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসা যেত।’
এর আগে পেট্রোবাংলা একটি প্রস্তাব দিয়েছিল যাতে নতুন এবং প্রতিশ্রুত (ইতোমধ্যে অনুমোদিত কিন্তু কার্যকর না হওয়া) গ্রাহকদের গ্যাসের দাম ৭৫ দশমিক ৭২ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল। এমনকি প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের অর্ধেক বিল বর্তমান দরে এবং বাকি অর্ধেক ৭৫ দশমিক ৭২ টাকা হার অনুযায়ী নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়।
বিইআরসি গত ২৬ ফেব্রুয়ারি পেট্রোবাংলার প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি আয়োজন করে। সেখানে ব্যবসায়ী এবং শিল্প সংগঠনের প্রতিনিধিরা পেট্রোবাংলার প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। বিশেষ করে একই খাতে দুই ধরনের গ্যাস মূল্য নির্ধারণকে ‘বৈষম্যমূলক’ এবং ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে উল্লেখ করেন উদ্যোক্তারা।
শুনানিতে পেট্রোবাংলা দাবি করেছিল, বর্তমান গ্যাস বিক্রয়মূল্য অপর্যাপ্ত হওয়ায় বছরে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হচ্ছে। সেই ঘাটতি পূরণেই তারা মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। তবে শিল্প মালিকরা এ যুক্তিকে অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেন। তাদের দাবি, এর ফলে দেশীয় শিল্প উৎপাদন এবং বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।