বশিরুল ইসলাম
কৃষিতে যেমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে তেমনি কালের পরিক্রমনে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতায় এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। যে লাঙল-জোয়াল আর হালের বলদ ছিল কৃষকের চাষাবাদের প্রধান উপকরণ সে জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে পাওয়ার টিলার। জমি চাষ থেকে শুরু করে ধানের চারা রোপণ, ধানগাছ কাটা এবং মাড়াইÑ সবই যন্ত্রের সাহায্যে হচ্ছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নববর্ষ এবং কৃষি উভয়ের মধ্যেই এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে খাজনা আদায়ের পর যে উৎসব থেকে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছিল তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ লাভ করেছে।
যেভাবেই পালিত হোক না কেন, বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব এখন পহেলা বৈশাখ। এদিন সরকারি ছুটি থাকে। সরকারি চাকরিজীবীদের দেয়া হয় ‘বৈশাখী ভাতা’। ঋতুভিত্তিক এই অসাম্প্রদায়িক উৎসবে অংশ নেন দেশের ধর্ম, বর্ণ, গোত্র সব শ্রেণীপেশার মানুষ। এ দিনে বিশ্বের সব প্রান্তের বাঙালিরা অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। বাংলা বর্ষবরণের মাধ্যমে বাঙালি যেন এদিন তার শিকড়ে ফেরে। প্রাণের আবেগ আর ভালোবাসায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এই দিন। আর কালের বিবর্তনে বাংলা নববর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক পুরনো উৎসবের বিলুপ্তি ঘটেছে। আবার সংযোগ ঘটেছে অনেক নতুন উৎসবের। বাঙালি এই প্রাণের উৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে আবহমান বাংলার কৃষি।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, কৃষিকাজের সুবিধার্থেই মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন এবং তা কার্যকর হয় তার সিংহাসন আরোহণের সময় থেকে, অর্থাৎ ১৫৫৬ সালের পাঁচ নভেম্বর থেকে। মূলত বাংলা সন প্রবর্তন হয় কৃষকের ফসল রোপণ, ফসলের সময়ভিত্তিক পরিচর্যা, ফসল কাটাসহ অন্য কৃষিকাজের ওপর নির্ভর করে। এ কারণে এই সনের আরেক নাম ‘ফসলি সন’। পরে তা বঙ্গাব্দ আর বাংলা সন করা হয়। তখন চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা, শুল্ক দিতে হতো কৃষকদের। তাই তখন থেকেই সম্রাট আকবর কৃষকদের জন্য মিষ্টি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। হালখাতার প্রচলনও সম্রাট আকবরের সময় থেকেই ব্যবসায়ীরা করেছে। বাংলা সনের উদ্ভব নিয়ে অনেক বির্তক থাকলেও সবথেকে জনপ্রিয় ধারণায় যুক্ত সম্রাট আকবরের নাম। প্রখ্যাত বহু প-িত এ মতের পক্ষে রায় দেন।
পহেলা বৈশাখের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ হলো হালখাতা তথা নতুন খাতা প্রস্তুতকরণ। এখন পর্যন্তও ব্যবসায়িক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হালখাতার প্রচলন রয়েছে। এই দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে। মেলায় দেশীয় কুটিরশিল্পের বিভিন্ন পণ্য ও পিঠাপুলির আয়োজন করা হয়। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকা-ের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদের অংশ হিসেবে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’ ১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে প্রথম নববর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠান করে। সে থেকে তথা ১৯৬৭ সাল থেকে রমনার বটমূলে প্রতি বছরÑ ‘এসো হে বৈশাখ, এসো হে...’ গান দিয়ে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেয় এ দেশের হাজার হাজার সংস্কৃতি প্রিয় মানুষ।
বাংলা নববর্ষের এই লগ্নে একবারও কি ভাবা যায় না, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষকরা কেমন আছেন? উৎপাদন ব্যয় কতটুকু বেড়েছে? তবে এটা ঠিক বাংলা নববর্ষের ভেতর দিয়ে মূলত দেশের আপামর জনসাধারণ নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে লালন করে চলেছে। পহেলা বৈশাখের উৎসবের মধ্যদিয়ে এ দেশের নর-নারী এ ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নতুবা আমাদের নতুন প্রজন্ম বাংলার ঐতিহ্য লোক-সংস্কৃতির কিংবা বাংলা ঋতু কথা ভুলেই যেত!
তবু নববর্ষ আসলে কৃষকের জন্য। নতুন বছরে কৃষকের মুখের হাসি ফুটুক। যে হাসিতে থাকবে না কোনো কৃত্রিমতা। সবুজ ফসলের খেত দেখে যে আশায় তারা বুক বাঁধে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রতিকূল আবহাওয়ায় যেন সে হাসিতে ভাটা না পড়ে। সোনার ফসল ঘরে তুলে, ফসলের ন্যায্য মূল্য পেয়ে, সে হাসি অটুট থাকুক। শুভ হোক সবার নতুন বছর।
[লেখক : উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়]
বশিরুল ইসলাম
বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫
কৃষিতে যেমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে তেমনি কালের পরিক্রমনে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতায় এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। যে লাঙল-জোয়াল আর হালের বলদ ছিল কৃষকের চাষাবাদের প্রধান উপকরণ সে জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে পাওয়ার টিলার। জমি চাষ থেকে শুরু করে ধানের চারা রোপণ, ধানগাছ কাটা এবং মাড়াইÑ সবই যন্ত্রের সাহায্যে হচ্ছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নববর্ষ এবং কৃষি উভয়ের মধ্যেই এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে খাজনা আদায়ের পর যে উৎসব থেকে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছিল তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ লাভ করেছে।
যেভাবেই পালিত হোক না কেন, বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব এখন পহেলা বৈশাখ। এদিন সরকারি ছুটি থাকে। সরকারি চাকরিজীবীদের দেয়া হয় ‘বৈশাখী ভাতা’। ঋতুভিত্তিক এই অসাম্প্রদায়িক উৎসবে অংশ নেন দেশের ধর্ম, বর্ণ, গোত্র সব শ্রেণীপেশার মানুষ। এ দিনে বিশ্বের সব প্রান্তের বাঙালিরা অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। বাংলা বর্ষবরণের মাধ্যমে বাঙালি যেন এদিন তার শিকড়ে ফেরে। প্রাণের আবেগ আর ভালোবাসায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এই দিন। আর কালের বিবর্তনে বাংলা নববর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক পুরনো উৎসবের বিলুপ্তি ঘটেছে। আবার সংযোগ ঘটেছে অনেক নতুন উৎসবের। বাঙালি এই প্রাণের উৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে আবহমান বাংলার কৃষি।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, কৃষিকাজের সুবিধার্থেই মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন এবং তা কার্যকর হয় তার সিংহাসন আরোহণের সময় থেকে, অর্থাৎ ১৫৫৬ সালের পাঁচ নভেম্বর থেকে। মূলত বাংলা সন প্রবর্তন হয় কৃষকের ফসল রোপণ, ফসলের সময়ভিত্তিক পরিচর্যা, ফসল কাটাসহ অন্য কৃষিকাজের ওপর নির্ভর করে। এ কারণে এই সনের আরেক নাম ‘ফসলি সন’। পরে তা বঙ্গাব্দ আর বাংলা সন করা হয়। তখন চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা, শুল্ক দিতে হতো কৃষকদের। তাই তখন থেকেই সম্রাট আকবর কৃষকদের জন্য মিষ্টি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। হালখাতার প্রচলনও সম্রাট আকবরের সময় থেকেই ব্যবসায়ীরা করেছে। বাংলা সনের উদ্ভব নিয়ে অনেক বির্তক থাকলেও সবথেকে জনপ্রিয় ধারণায় যুক্ত সম্রাট আকবরের নাম। প্রখ্যাত বহু প-িত এ মতের পক্ষে রায় দেন।
পহেলা বৈশাখের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ হলো হালখাতা তথা নতুন খাতা প্রস্তুতকরণ। এখন পর্যন্তও ব্যবসায়িক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হালখাতার প্রচলন রয়েছে। এই দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে। মেলায় দেশীয় কুটিরশিল্পের বিভিন্ন পণ্য ও পিঠাপুলির আয়োজন করা হয়। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকা-ের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদের অংশ হিসেবে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’ ১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে প্রথম নববর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠান করে। সে থেকে তথা ১৯৬৭ সাল থেকে রমনার বটমূলে প্রতি বছরÑ ‘এসো হে বৈশাখ, এসো হে...’ গান দিয়ে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেয় এ দেশের হাজার হাজার সংস্কৃতি প্রিয় মানুষ।
বাংলা নববর্ষের এই লগ্নে একবারও কি ভাবা যায় না, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষকরা কেমন আছেন? উৎপাদন ব্যয় কতটুকু বেড়েছে? তবে এটা ঠিক বাংলা নববর্ষের ভেতর দিয়ে মূলত দেশের আপামর জনসাধারণ নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে লালন করে চলেছে। পহেলা বৈশাখের উৎসবের মধ্যদিয়ে এ দেশের নর-নারী এ ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নতুবা আমাদের নতুন প্রজন্ম বাংলার ঐতিহ্য লোক-সংস্কৃতির কিংবা বাংলা ঋতু কথা ভুলেই যেত!
তবু নববর্ষ আসলে কৃষকের জন্য। নতুন বছরে কৃষকের মুখের হাসি ফুটুক। যে হাসিতে থাকবে না কোনো কৃত্রিমতা। সবুজ ফসলের খেত দেখে যে আশায় তারা বুক বাঁধে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রতিকূল আবহাওয়ায় যেন সে হাসিতে ভাটা না পড়ে। সোনার ফসল ঘরে তুলে, ফসলের ন্যায্য মূল্য পেয়ে, সে হাসি অটুট থাকুক। শুভ হোক সবার নতুন বছর।
[লেখক : উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়]