alt

উপ-সম্পাদকীয়

শুভ-অশুভ বলে কিছু কি আছে

বাবুল রবিদাস

: বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫

মানুষের মধ্যে শুভ ও অশুভের দ্বৈত সত্তা চিরকালই এক জটিল ও রহস্যময় বিষয়। ১৮৮৬ সালে স্কটিশ লেখক রবার্ট লুইস স্টিভেনসন তার বিখ্যাত উপন্যাস ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড-এ এই দ্বৈততার চিত্র তুলে ধরেছেন। উপন্যাসে দেখা যায়, একই মানুষের মধ্যে দুটি বিপরীত সত্তা বাস করেÑ একটি উদার, সজ্জন ও প্রজ্ঞাবান ডক্টর জেকিল, অন্যটি নিষ্ঠুর, স্বার্থপর ও হিংস্র মিস্টার হাইড। এই দ্বন্দ্ব মানুষের দেবত্ব ও দানবত্বের প্রতিচ্ছবি।

পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মানুষের শুভ-অশুভের এই দ্বন্দ্বই সংস্কার ও কুসংস্কারের গতিপথ নির্ধারণ করে। প্রাচীন দার্শনিক প্লেটো বলেছিলেন, মানুষের আত্মা দুটি ঘোড়ার রথের মতোÑ একটি শুভ, অন্যটি অশুভ। একটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে অপরটি বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। সমাজে আমরা ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভের এই দ্বৈততা দেখি। বিজ্ঞানের ভাষায় এটি সংস্কার ও কুসংস্কার। কেউ যুদ্ধের বিরোধিতা করে, আবার কেউ যুদ্ধের পক্ষে দাঁড়ায়। ইতিহাসে ডক্টর জেকিলরা সভ্যতা গড়ে তুলেছে, আর মিস্টার হাইডরা অন্ধ ধ্বংসযজ্ঞে তা ভেঙে ফেলেছে।

সমাজে শুভ-অশুভের সংজ্ঞা প্রায়ই ক্ষমতার হাতে নির্ধারিত হয়। সম্পদশালী ও প্রভাবশালীরা যা করে, তাই শুভ বা কল্যাণকর বলে প্রচারিত হয়। এটিই ‘ক্ষমতাই সত্য’র দর্শন। পরাজিতরা সমাজে দানব, রাক্ষস বা অসুর হিসেবে চিহ্নিত হয়। অথচ সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষ দলিত, বঞ্চিত, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত হয়, যখন মাত্র ১৫ শতাংশ সবল শ্রেণী তাদের শাসন ও শোষণ করে। এই বিভেদ কি প্রকৃত শুভ-অশুভের সংজ্ঞা দিতে পারে?

শুভ ও অশুভের ধারণা সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত। পঞ্জিকা, পুস্তক বা লোকবিশ্বাসে এই শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়। মানুষ শুভ দিন বেছে বিবাহ, গৃহপ্রবেশ বা নামকরণের আয়োজন করে। কিন্তু শুভ-অশুভ কি সত্যিই বাস্তব? দুটি কাহিনী এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সাহায্য করে।

প্রথম কাহিনী : নাবিকের ভাগ্য

এক নাবিক সমুদ্রে জাহাজডুবির পর জনমানবহীন দ্বীপে আশ্রয় নেয়। সেখানে গাছের পাতা দিয়ে তৈরি তার কুঁড়েঘর রোদে পুড়ে যায়। নাবিক এটিকে অকল্যাণ মনে করে আফসোস করে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর একটি লাইফবোট তার উদ্ধারে আসে, কারণ তারা পোড়া ঘরের ধোঁয়া দেখে দ্বীপে মানুষের উপস্থিতি টের পায়। নাবিক তখন বুঝতে পারে, যা তাকে অশুভ মনে হয়েছিল, তাই তার কল্যাণ এনেছে।

দ্বিতীয় কাহিনী : কৃষকের কপাল

চীনের এক গ্রামে এক বৃদ্ধ কৃষকের ঘোড়া পালিয়ে যায়। প্রতিবেশীরা এটিকে মন্দ কপাল বলে। কৃষক বলেন, ‘কপাল ভালো না মন্দ, কে জানে?’ কিছুদিন পর ঘোড়াটি বুনো ঘোড়ার পাল নিয়ে ফিরে আসে। প্রতিবেশীরা তখন ভালো কপালের প্রশংসা করে। কৃষক আবার বলেন, ‘কপাল ভালো না মন্দ, কে জানে?’ পরে তার ছেলে বুনো ঘোড়া বশ করতে গিয়ে পা ভাঙে। প্রতিবেশীরা এটিকে অশুভ বলে। কিন্তু কিছুদিন পর সেনাবাহিনী গ্রামের যুবকদের যুদ্ধে নিয়ে যায়, কেবল কৃষকের পা-ভাঙা ছেলেকে ছেড়ে দেয়। যা মন্দ মনে হয়েছিল, তাই তার জীবন রক্ষা করল।

এই কাহিনীগুলো থেকে বোঝা যায়, শুভ বা অশুভ বলে কিছু নেই। জীবনের ঘটনাগুলো আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। সংস্কার ও কুসংস্কারের বেড়াজালে আটকে না থেকে সতর্কতা ও কর্মের ওপর ভরসা করা উচিত। জন্ম, বিবাহ, বা গৃহপ্রবেশের জন্য শুভ দিনের অপেক্ষা না করে যে কোনো দিনই কাজ শুরু করা যায়। পত্রিকায় দেখা যায়, তথাকথিত শুভ দিনেও দুর্ঘটনা ঘটে। তাই কুসংস্কার ত্যাগ করে সচেতন ও যুক্তিবাদী জীবনযাপনই আমাদের শিক্ষা হওয়া উচিত। ‘ভাগ্যে নয়, কর্মে বিশ্বাসী হও’Ñ এই মন্ত্রই আমাদের পথ দেখাবে।

[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

tab

উপ-সম্পাদকীয়

শুভ-অশুভ বলে কিছু কি আছে

বাবুল রবিদাস

বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫

মানুষের মধ্যে শুভ ও অশুভের দ্বৈত সত্তা চিরকালই এক জটিল ও রহস্যময় বিষয়। ১৮৮৬ সালে স্কটিশ লেখক রবার্ট লুইস স্টিভেনসন তার বিখ্যাত উপন্যাস ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড-এ এই দ্বৈততার চিত্র তুলে ধরেছেন। উপন্যাসে দেখা যায়, একই মানুষের মধ্যে দুটি বিপরীত সত্তা বাস করেÑ একটি উদার, সজ্জন ও প্রজ্ঞাবান ডক্টর জেকিল, অন্যটি নিষ্ঠুর, স্বার্থপর ও হিংস্র মিস্টার হাইড। এই দ্বন্দ্ব মানুষের দেবত্ব ও দানবত্বের প্রতিচ্ছবি।

পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মানুষের শুভ-অশুভের এই দ্বন্দ্বই সংস্কার ও কুসংস্কারের গতিপথ নির্ধারণ করে। প্রাচীন দার্শনিক প্লেটো বলেছিলেন, মানুষের আত্মা দুটি ঘোড়ার রথের মতোÑ একটি শুভ, অন্যটি অশুভ। একটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে অপরটি বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। সমাজে আমরা ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভের এই দ্বৈততা দেখি। বিজ্ঞানের ভাষায় এটি সংস্কার ও কুসংস্কার। কেউ যুদ্ধের বিরোধিতা করে, আবার কেউ যুদ্ধের পক্ষে দাঁড়ায়। ইতিহাসে ডক্টর জেকিলরা সভ্যতা গড়ে তুলেছে, আর মিস্টার হাইডরা অন্ধ ধ্বংসযজ্ঞে তা ভেঙে ফেলেছে।

সমাজে শুভ-অশুভের সংজ্ঞা প্রায়ই ক্ষমতার হাতে নির্ধারিত হয়। সম্পদশালী ও প্রভাবশালীরা যা করে, তাই শুভ বা কল্যাণকর বলে প্রচারিত হয়। এটিই ‘ক্ষমতাই সত্য’র দর্শন। পরাজিতরা সমাজে দানব, রাক্ষস বা অসুর হিসেবে চিহ্নিত হয়। অথচ সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষ দলিত, বঞ্চিত, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত হয়, যখন মাত্র ১৫ শতাংশ সবল শ্রেণী তাদের শাসন ও শোষণ করে। এই বিভেদ কি প্রকৃত শুভ-অশুভের সংজ্ঞা দিতে পারে?

শুভ ও অশুভের ধারণা সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত। পঞ্জিকা, পুস্তক বা লোকবিশ্বাসে এই শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়। মানুষ শুভ দিন বেছে বিবাহ, গৃহপ্রবেশ বা নামকরণের আয়োজন করে। কিন্তু শুভ-অশুভ কি সত্যিই বাস্তব? দুটি কাহিনী এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সাহায্য করে।

প্রথম কাহিনী : নাবিকের ভাগ্য

এক নাবিক সমুদ্রে জাহাজডুবির পর জনমানবহীন দ্বীপে আশ্রয় নেয়। সেখানে গাছের পাতা দিয়ে তৈরি তার কুঁড়েঘর রোদে পুড়ে যায়। নাবিক এটিকে অকল্যাণ মনে করে আফসোস করে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর একটি লাইফবোট তার উদ্ধারে আসে, কারণ তারা পোড়া ঘরের ধোঁয়া দেখে দ্বীপে মানুষের উপস্থিতি টের পায়। নাবিক তখন বুঝতে পারে, যা তাকে অশুভ মনে হয়েছিল, তাই তার কল্যাণ এনেছে।

দ্বিতীয় কাহিনী : কৃষকের কপাল

চীনের এক গ্রামে এক বৃদ্ধ কৃষকের ঘোড়া পালিয়ে যায়। প্রতিবেশীরা এটিকে মন্দ কপাল বলে। কৃষক বলেন, ‘কপাল ভালো না মন্দ, কে জানে?’ কিছুদিন পর ঘোড়াটি বুনো ঘোড়ার পাল নিয়ে ফিরে আসে। প্রতিবেশীরা তখন ভালো কপালের প্রশংসা করে। কৃষক আবার বলেন, ‘কপাল ভালো না মন্দ, কে জানে?’ পরে তার ছেলে বুনো ঘোড়া বশ করতে গিয়ে পা ভাঙে। প্রতিবেশীরা এটিকে অশুভ বলে। কিন্তু কিছুদিন পর সেনাবাহিনী গ্রামের যুবকদের যুদ্ধে নিয়ে যায়, কেবল কৃষকের পা-ভাঙা ছেলেকে ছেড়ে দেয়। যা মন্দ মনে হয়েছিল, তাই তার জীবন রক্ষা করল।

এই কাহিনীগুলো থেকে বোঝা যায়, শুভ বা অশুভ বলে কিছু নেই। জীবনের ঘটনাগুলো আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। সংস্কার ও কুসংস্কারের বেড়াজালে আটকে না থেকে সতর্কতা ও কর্মের ওপর ভরসা করা উচিত। জন্ম, বিবাহ, বা গৃহপ্রবেশের জন্য শুভ দিনের অপেক্ষা না করে যে কোনো দিনই কাজ শুরু করা যায়। পত্রিকায় দেখা যায়, তথাকথিত শুভ দিনেও দুর্ঘটনা ঘটে। তাই কুসংস্কার ত্যাগ করে সচেতন ও যুক্তিবাদী জীবনযাপনই আমাদের শিক্ষা হওয়া উচিত। ‘ভাগ্যে নয়, কর্মে বিশ্বাসী হও’Ñ এই মন্ত্রই আমাদের পথ দেখাবে।

[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]

back to top