ভারতের কাশ্মীরের পেহেলগামে ২৬ পর্যটককে গুলি করে হত্যার ঘটনায় নয়াদিল্লিতে পাকিস্তানি দূতাবাসের সামনে ভারতীয় নাগরিকদের বিক্ষোভ। শুক্রবার এর ছবি
ভারতের কাশ্মীরে পর্যটক হত্যার ঘটনার হামলাকারীদের ধরতে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী একাধিক অভিযান চালাচ্ছে। শুক্রবার, (২৫ এপ্রিল) সন্দেহভাজন দুই জঙ্গির বাড়ি বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়ার খবর দিয়েছে গণমাধ্যম।
এনডিটিভি জানিয়েছে, হামলাকারীদের বাড়িগুলোর মধ্যে বিস্ফোরক রাখা ছিল। তবে আনন্দবাজারসহ বেশ কিছু ভারতীয় গণমাধ্যম বলেছে, ওই বাড়ি দুটি ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন গুঁড়িয়ে দিয়েছে। একটি বাড়ি স্বয়ংক্রিয় বিস্ফোরকের সাহায্যে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে, অন্যটি বুলডোজারের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনী সূত্রে রয়টার্স জানিয়েছে, ভারত-পাকিস্তান কাশ্মীর বিভাজন রেখা বরাবর বিক্ষিপ্ত গুলিবর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে এ কয়দিনে।
গত মঙ্গলবার কাশ্মীরের পেহেলগামের কাছে বৈসরান উপত্যকায় ২৬ জন পর্যটককে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই জঙ্গি হামলা প্রায় দুই দশকের মধ্যে কাশ্মীরে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা। হামলার পর ভারতজুড়ে ক্ষোভ ও শোকের সৃষ্টি হয়েছে।
সহিংসতায় ‘জড়িত’ তিনজনকে চিহ্নিত করে কাশ্মীরী পুলিশ জানিয়েছে, তাদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানি নাগরিক। তবে ভারত এই সংযোগের বিস্তারিত তথ্য বা প্রমাণ শেয়ার করেনি।
হামলার পর থেকেই ভারত দাবি করেছে, এর পেছনে পাকিস্তানি মদদ রয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে ২৬/১১ হামলার মূল পরিকল্পনাকারী পাকিস্তানের হাফিজ সাইদের নিয়ন্ত্রণে থাকা নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা (এলইটি)-এর সঙ্গে যুক্ত একটি গ্রুপ এই হামলা চালিয়েছে। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর মতে, এই বিশেষ জঙ্গিগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীর উপত্যকায় সক্রিয় রয়েছে।
নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বিশ্বাস করে যে, সোনামার্গ, বুটা পাথরি এবং গান্ডারবাল এলাকায় বেশ কিছু হাই-প্রোফাইল হামলার পেছনেও এই গোষ্ঠী রয়েছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে বুটা পাথরিতে সন্ত্রাসী হামলায় দুই ভারতীয় সেনা সদস্যসহ চারজন নিহত হন। একই মাসে, সোনামার্গে সুড়ঙ্গ নির্মাণ শ্রমিকদের ওপর হামলা চালিয়ে ছয় শ্রমিক ও এক ডাক্তারকে গুলি করা হয়।
এদিকে, পাকিস্তান এই হামলায় কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করে আসছে।
এ ঘটনার পর ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী জলবণ্টন চুক্তি স্থগিত রেখেছে, অন্যদিকে পাকিস্তান ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলোর জন্য তার আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে এবং আরও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
এখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বেশ কয়েকজন নেতা।
এর মধ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করতে শুক্রবার কাশ্মীরের শ্রীনগর পরিদর্শন করেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী। শুক্রবার শ্রীনগর সফর করেছেন ভারতের প্রধানবিরোধী নেতা রাহুল গান্ধীও। তিনি আহতদের ও স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
এখনও পরিস্থিতি উত্তপ্ত রয়েছে এবং দুই দেশের সম্পর্ক আরও তলানিতে পৌঁছেছে, যা এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা জন্য গুরুতর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
বিস্ফোরণে উড়ল ২ লস্কর
জঙ্গির বাড়ি
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার দুই সন্দেহভাজন সদস্য আদিল হোসেন ঠোকের ও আসিফ শেখের বাড়ি বিস্ফোরণে উড়ে যায়।
নিরাপত্তা বাহিনীর একাধিক সূত্র আদিলকে গত মঙ্গলবারের
পেহেলগাম হামলার অন্যতম অভিযুক্ত বলছে, তার বাড়ি অনন্তনাগ জেলায়। আর পুলওয়ামার বাসিন্দা আসিফ হামলার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে দাবি করা হচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার অনন্তনাগের পুলিশ পেহেলগামে হামলায় জড়িত সন্দেহে যে তিনজনের স্কেচ প্রকাশ করেছে আদিল তার একজন। বাকি দুজনই পাকিস্তানের নাগরিক, বলছে পুলিশ। এদের ধরতে তথ্য চেয়ে ২০ লাখ রুপি পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে দেয়া নোটিসে পুলিশ হামলাকারী বাকি দুই সন্দেহভাজনের নাম বলেছে- হাশিম মুসা ওরফে সুলেমান এবং আলি ভাই ওরফে তালহা ভাই। এরা দুজনও জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আনন্দবাজার বলছে, গতকাল বৃহস্পতিবার গভীর রাতে আদিলের বাড়িটি বিস্ফোরণের সাহায্যে উড়িয়ে দেয়া হয়। আর শুক্রবার আসিফের বাড়িটি ?বুলডোজারে ভেঙে ফেলা হয়।
তবে হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, আসিফ শেখের বাড়িতে তল্লাশি চালানোর সময় একটি সন্দেহজনক বাক্স পাওয়া যায়। ওই বাক্স থেকে অনেকটা তার বেরিয়েও এসেছিল, ওই তার ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসের অংশ ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
পরে ঘটনাস্থলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং টিম পৌঁছানোর পর বাক্সটি ঘটনাস্থলেই বিস্ফোরিত হয়। এতে কেউ হতাহত না হলেও আসিফের বাড়ির একাংশ উড়ে যায়।
হিন্দু ও এনডিটিভির প্রতিবেদনেই বিস্ফোরণের সাহায্যে আসিফ ও আদিলের বাড়ি উড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিহারে এক জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘দুনিয়ার শেষ প্রান্তে গিয়েও হামলাকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে’ বলার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদিল ও আসিফের বাড়ি ধ্বংস হলো।
পাকিস্তানি নাগরিকদের খুঁজে ফেরত পাঠাতে নির্দেশ অমিত শাহর
ভিসা বাতিলের পর কোনো পাকিস্তানি নাগরিক যাতে ভারতে থাকতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে শুক্রবার, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নির্দেশ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। মুখ্যমন্ত্রীদের ফোন করে তিনি বলেছেন, ভিসা বাতিলের পর পাকিস্তানিদের শনাক্ত করে যেন দ্রুত ফেরত পাঠানো হয়।
কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা পর্যটকদের হত্যার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ভারত। সেসব ব্যবস্থার অন্যতম হচ্ছে পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল করা। সাধারণ নাগরিকদের ভিসা বাতিল কার্যকর হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ৪৮ ঘণ্টা পর শুক্রবার রাত থেকে। মেডিকেল ভিসা নিয়ে যারা চিকিৎসার জন্য ভারতে এসেছেন, তাদের ফিরে যেতে বলা হয়েছে ২৯ এপ্রিলের পর।
এই দুই ক্যাটাগরির ভিসাসংক্রান্ত দুই নির্দেশ যাতে যথাযথভাবে কার্যকর করা হয়, সে জন্য মুখ্যমন্ত্রীদের তৎপর হতে বলেছেন অমিত শাহ। ফোন করে তাদের বলেছেন, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে কার্যকর করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের পর পাকিস্তানি নাগরিকেরা যাতে দেশে থাকতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে।
সর্বদলীয় বৈঠকে পেহেলগামে নিরাপত্তা ত্রুটির কথা স্বীকার বিজেপি সরকারের
ভারতের বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারবিরোধীদের কাছে পেহেলগামে জঙ্গি হামলায় নিরাপত্তা ত্রুটি থাকার কথা স্বীকার করে নিয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
গতকাল বৃহস্পতিবার রুদ্ধদ্বার সর্বদলীয় বৈঠকে কেন্দ্রীয় সরকার নিরাপত্তা ত্রুটির বিষয়টি স্বীকার করে নেয়, সূত্রের বরাত দিয়ে এ খবর দিয়েছে ইন্ডিয়া টুডে।
পরিস্থিতি সম্বন্ধে বিরোধী দলগুলোর নেতাদের অবহিত করতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার গতকাল বৃহস্পতিবার এ সর্বদলীয় বৈঠক ডাকে।
বৈঠকে বিরোধী দলগুলোর একাধিক নেতা নিরাপত্তা ব্যবস্থার দৃশ্যমান ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
বৈঠকের পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজ্জু সাংবাদিকদের জানান, ভারতকে ঐক্যবদ্ধভাবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবেÑ এ ব্যাপারে সব দল একমত হয়েছে।
‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সরকারের সঙ্গে আছে বলে জানিয়েছে সব দল। সরকার যে পদক্ষেপই নিক না কেন, তাতে তারা সমর্থন দেবে বলে সব দল এবং তাদের নেতারা এক সুরে জানিয়েছেন। ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বৈঠকটি শেষ হয়েছে,’ বলেছেন তিনি।
লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধীও একই কথা বলেছেন।
‘সবাই পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে। যে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে বিরোধীরা,’ বলেছেন তিনি।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সভাপতিত্বে এ সর্বদলীয় বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ, সংসদবিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজ্জু, রাজ্যসভার নেতা জেপি নড্ডা, রাজ্যসভার বিরোধীদলীয় নেতা মল্লিকার্জুন খাড়্গ,ে লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা রাহুলসহ আম আদমি, তৃণমূল কংগ্রেস, আরজেডি, এনসিপি, শিবসেনা, এসপিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
ভারতে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সংকট সৃষ্টি হলে সর্বদলীয় বৈঠকের রেওয়াজ আছে। এর আগে ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলা ও পরের বছর ভারত-চীন সীমান্ত উত্তেজনার সময়ও এমন সর্বদলীয় বৈঠক দেখা গেছে।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে হুমকির মুখে কাশ্মীরী শিক্ষার্থীরা
পেহেলগামের ঘটনার পর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কাশ্মীরী শিক্ষার্থীরা হুমকির মধ্যে পড়েছেন। কোনো কোনো জায়গায় তারা আক্রান্ত হয়েছেন। কোথাও দ্রুত তাদের কাশ্মীরে ফিরে যেতে হুকুম জারি করা হয়েছে। কোথাও বাড়িছাড়া করা হচ্ছে।
জম্মু-কাশ্মীর স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক নাসির খুয়েহামি অভিযোগ করেছেন, পেহেলগাম-কাণ্ডের পর বিভিন্ন রাজ্য থেকে কাশ্মীরী ছাত্রদের ওপর হামলা ও হুমকির অন্তত আটটি ঘটনার খবর তার কাছে এসেছে।
এই প্রবণতা রুখতে জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ থেকে শুরু করে সব রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী গভীরভাবে চিন্তিত। পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি গতকাল বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে অনুরোধ করেন এই প্রবণতা কড়া হাতে দমন করতে।
গতকাল বৃহস্পতিবার শ্রীনগরে সর্বদলীয় বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবেও রাজ্যে রাজ্যে এই অরাজকতা বন্ধের দাবি জানানো হয়। দেশবাসীর উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘দয়া করে কাশ্মীরীদের শত্রু ভাববেন না। পেহেলগামের হামলার জন্য কাশ্মীরীরা দায়ী নন। ৩৫ বছর ধরে আমরাও হামলার শিকার। আমরা ভুক্তভোগী।’
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে, উত্তরাখন্ডের হিন্দু রক্ষা দলের নেতা ললিত শর্মার বিরুদ্ধে গতকাল বৃহস্পতিবার পুলিশ এফআইআর দাখিল করেছে। শর্মা এক ভিডিও বার্তায় কাশ্মীরী শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের অবিলম্বে রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। হুমকি দিয়ে বলেন, না হলে তাদের হাল অকল্পনীয় হবে।
ভারতের কাশ্মীরের পেহেলগামে ২৬ পর্যটককে গুলি করে হত্যার ঘটনায় নয়াদিল্লিতে পাকিস্তানি দূতাবাসের সামনে ভারতীয় নাগরিকদের বিক্ষোভ। শুক্রবার এর ছবি
শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫
ভারতের কাশ্মীরে পর্যটক হত্যার ঘটনার হামলাকারীদের ধরতে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী একাধিক অভিযান চালাচ্ছে। শুক্রবার, (২৫ এপ্রিল) সন্দেহভাজন দুই জঙ্গির বাড়ি বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়ার খবর দিয়েছে গণমাধ্যম।
এনডিটিভি জানিয়েছে, হামলাকারীদের বাড়িগুলোর মধ্যে বিস্ফোরক রাখা ছিল। তবে আনন্দবাজারসহ বেশ কিছু ভারতীয় গণমাধ্যম বলেছে, ওই বাড়ি দুটি ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন গুঁড়িয়ে দিয়েছে। একটি বাড়ি স্বয়ংক্রিয় বিস্ফোরকের সাহায্যে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে, অন্যটি বুলডোজারের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনী সূত্রে রয়টার্স জানিয়েছে, ভারত-পাকিস্তান কাশ্মীর বিভাজন রেখা বরাবর বিক্ষিপ্ত গুলিবর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে এ কয়দিনে।
গত মঙ্গলবার কাশ্মীরের পেহেলগামের কাছে বৈসরান উপত্যকায় ২৬ জন পর্যটককে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই জঙ্গি হামলা প্রায় দুই দশকের মধ্যে কাশ্মীরে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা। হামলার পর ভারতজুড়ে ক্ষোভ ও শোকের সৃষ্টি হয়েছে।
সহিংসতায় ‘জড়িত’ তিনজনকে চিহ্নিত করে কাশ্মীরী পুলিশ জানিয়েছে, তাদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানি নাগরিক। তবে ভারত এই সংযোগের বিস্তারিত তথ্য বা প্রমাণ শেয়ার করেনি।
হামলার পর থেকেই ভারত দাবি করেছে, এর পেছনে পাকিস্তানি মদদ রয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে ২৬/১১ হামলার মূল পরিকল্পনাকারী পাকিস্তানের হাফিজ সাইদের নিয়ন্ত্রণে থাকা নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা (এলইটি)-এর সঙ্গে যুক্ত একটি গ্রুপ এই হামলা চালিয়েছে। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর মতে, এই বিশেষ জঙ্গিগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীর উপত্যকায় সক্রিয় রয়েছে।
নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বিশ্বাস করে যে, সোনামার্গ, বুটা পাথরি এবং গান্ডারবাল এলাকায় বেশ কিছু হাই-প্রোফাইল হামলার পেছনেও এই গোষ্ঠী রয়েছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে বুটা পাথরিতে সন্ত্রাসী হামলায় দুই ভারতীয় সেনা সদস্যসহ চারজন নিহত হন। একই মাসে, সোনামার্গে সুড়ঙ্গ নির্মাণ শ্রমিকদের ওপর হামলা চালিয়ে ছয় শ্রমিক ও এক ডাক্তারকে গুলি করা হয়।
এদিকে, পাকিস্তান এই হামলায় কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করে আসছে।
এ ঘটনার পর ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী জলবণ্টন চুক্তি স্থগিত রেখেছে, অন্যদিকে পাকিস্তান ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলোর জন্য তার আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে এবং আরও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
এখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বেশ কয়েকজন নেতা।
এর মধ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করতে শুক্রবার কাশ্মীরের শ্রীনগর পরিদর্শন করেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী। শুক্রবার শ্রীনগর সফর করেছেন ভারতের প্রধানবিরোধী নেতা রাহুল গান্ধীও। তিনি আহতদের ও স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
এখনও পরিস্থিতি উত্তপ্ত রয়েছে এবং দুই দেশের সম্পর্ক আরও তলানিতে পৌঁছেছে, যা এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা জন্য গুরুতর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
বিস্ফোরণে উড়ল ২ লস্কর
জঙ্গির বাড়ি
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার দুই সন্দেহভাজন সদস্য আদিল হোসেন ঠোকের ও আসিফ শেখের বাড়ি বিস্ফোরণে উড়ে যায়।
নিরাপত্তা বাহিনীর একাধিক সূত্র আদিলকে গত মঙ্গলবারের
পেহেলগাম হামলার অন্যতম অভিযুক্ত বলছে, তার বাড়ি অনন্তনাগ জেলায়। আর পুলওয়ামার বাসিন্দা আসিফ হামলার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে দাবি করা হচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার অনন্তনাগের পুলিশ পেহেলগামে হামলায় জড়িত সন্দেহে যে তিনজনের স্কেচ প্রকাশ করেছে আদিল তার একজন। বাকি দুজনই পাকিস্তানের নাগরিক, বলছে পুলিশ। এদের ধরতে তথ্য চেয়ে ২০ লাখ রুপি পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে দেয়া নোটিসে পুলিশ হামলাকারী বাকি দুই সন্দেহভাজনের নাম বলেছে- হাশিম মুসা ওরফে সুলেমান এবং আলি ভাই ওরফে তালহা ভাই। এরা দুজনও জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আনন্দবাজার বলছে, গতকাল বৃহস্পতিবার গভীর রাতে আদিলের বাড়িটি বিস্ফোরণের সাহায্যে উড়িয়ে দেয়া হয়। আর শুক্রবার আসিফের বাড়িটি ?বুলডোজারে ভেঙে ফেলা হয়।
তবে হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, আসিফ শেখের বাড়িতে তল্লাশি চালানোর সময় একটি সন্দেহজনক বাক্স পাওয়া যায়। ওই বাক্স থেকে অনেকটা তার বেরিয়েও এসেছিল, ওই তার ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসের অংশ ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
পরে ঘটনাস্থলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং টিম পৌঁছানোর পর বাক্সটি ঘটনাস্থলেই বিস্ফোরিত হয়। এতে কেউ হতাহত না হলেও আসিফের বাড়ির একাংশ উড়ে যায়।
হিন্দু ও এনডিটিভির প্রতিবেদনেই বিস্ফোরণের সাহায্যে আসিফ ও আদিলের বাড়ি উড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিহারে এক জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘দুনিয়ার শেষ প্রান্তে গিয়েও হামলাকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে’ বলার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদিল ও আসিফের বাড়ি ধ্বংস হলো।
পাকিস্তানি নাগরিকদের খুঁজে ফেরত পাঠাতে নির্দেশ অমিত শাহর
ভিসা বাতিলের পর কোনো পাকিস্তানি নাগরিক যাতে ভারতে থাকতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে শুক্রবার, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নির্দেশ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। মুখ্যমন্ত্রীদের ফোন করে তিনি বলেছেন, ভিসা বাতিলের পর পাকিস্তানিদের শনাক্ত করে যেন দ্রুত ফেরত পাঠানো হয়।
কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা পর্যটকদের হত্যার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ভারত। সেসব ব্যবস্থার অন্যতম হচ্ছে পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল করা। সাধারণ নাগরিকদের ভিসা বাতিল কার্যকর হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ৪৮ ঘণ্টা পর শুক্রবার রাত থেকে। মেডিকেল ভিসা নিয়ে যারা চিকিৎসার জন্য ভারতে এসেছেন, তাদের ফিরে যেতে বলা হয়েছে ২৯ এপ্রিলের পর।
এই দুই ক্যাটাগরির ভিসাসংক্রান্ত দুই নির্দেশ যাতে যথাযথভাবে কার্যকর করা হয়, সে জন্য মুখ্যমন্ত্রীদের তৎপর হতে বলেছেন অমিত শাহ। ফোন করে তাদের বলেছেন, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে কার্যকর করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের পর পাকিস্তানি নাগরিকেরা যাতে দেশে থাকতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে।
সর্বদলীয় বৈঠকে পেহেলগামে নিরাপত্তা ত্রুটির কথা স্বীকার বিজেপি সরকারের
ভারতের বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারবিরোধীদের কাছে পেহেলগামে জঙ্গি হামলায় নিরাপত্তা ত্রুটি থাকার কথা স্বীকার করে নিয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
গতকাল বৃহস্পতিবার রুদ্ধদ্বার সর্বদলীয় বৈঠকে কেন্দ্রীয় সরকার নিরাপত্তা ত্রুটির বিষয়টি স্বীকার করে নেয়, সূত্রের বরাত দিয়ে এ খবর দিয়েছে ইন্ডিয়া টুডে।
পরিস্থিতি সম্বন্ধে বিরোধী দলগুলোর নেতাদের অবহিত করতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার গতকাল বৃহস্পতিবার এ সর্বদলীয় বৈঠক ডাকে।
বৈঠকে বিরোধী দলগুলোর একাধিক নেতা নিরাপত্তা ব্যবস্থার দৃশ্যমান ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
বৈঠকের পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজ্জু সাংবাদিকদের জানান, ভারতকে ঐক্যবদ্ধভাবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবেÑ এ ব্যাপারে সব দল একমত হয়েছে।
‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সরকারের সঙ্গে আছে বলে জানিয়েছে সব দল। সরকার যে পদক্ষেপই নিক না কেন, তাতে তারা সমর্থন দেবে বলে সব দল এবং তাদের নেতারা এক সুরে জানিয়েছেন। ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বৈঠকটি শেষ হয়েছে,’ বলেছেন তিনি।
লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধীও একই কথা বলেছেন।
‘সবাই পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে। যে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে বিরোধীরা,’ বলেছেন তিনি।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সভাপতিত্বে এ সর্বদলীয় বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ, সংসদবিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজ্জু, রাজ্যসভার নেতা জেপি নড্ডা, রাজ্যসভার বিরোধীদলীয় নেতা মল্লিকার্জুন খাড়্গ,ে লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা রাহুলসহ আম আদমি, তৃণমূল কংগ্রেস, আরজেডি, এনসিপি, শিবসেনা, এসপিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
ভারতে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সংকট সৃষ্টি হলে সর্বদলীয় বৈঠকের রেওয়াজ আছে। এর আগে ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলা ও পরের বছর ভারত-চীন সীমান্ত উত্তেজনার সময়ও এমন সর্বদলীয় বৈঠক দেখা গেছে।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে হুমকির মুখে কাশ্মীরী শিক্ষার্থীরা
পেহেলগামের ঘটনার পর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কাশ্মীরী শিক্ষার্থীরা হুমকির মধ্যে পড়েছেন। কোনো কোনো জায়গায় তারা আক্রান্ত হয়েছেন। কোথাও দ্রুত তাদের কাশ্মীরে ফিরে যেতে হুকুম জারি করা হয়েছে। কোথাও বাড়িছাড়া করা হচ্ছে।
জম্মু-কাশ্মীর স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক নাসির খুয়েহামি অভিযোগ করেছেন, পেহেলগাম-কাণ্ডের পর বিভিন্ন রাজ্য থেকে কাশ্মীরী ছাত্রদের ওপর হামলা ও হুমকির অন্তত আটটি ঘটনার খবর তার কাছে এসেছে।
এই প্রবণতা রুখতে জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ থেকে শুরু করে সব রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী গভীরভাবে চিন্তিত। পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি গতকাল বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে অনুরোধ করেন এই প্রবণতা কড়া হাতে দমন করতে।
গতকাল বৃহস্পতিবার শ্রীনগরে সর্বদলীয় বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবেও রাজ্যে রাজ্যে এই অরাজকতা বন্ধের দাবি জানানো হয়। দেশবাসীর উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘দয়া করে কাশ্মীরীদের শত্রু ভাববেন না। পেহেলগামের হামলার জন্য কাশ্মীরীরা দায়ী নন। ৩৫ বছর ধরে আমরাও হামলার শিকার। আমরা ভুক্তভোগী।’
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে, উত্তরাখন্ডের হিন্দু রক্ষা দলের নেতা ললিত শর্মার বিরুদ্ধে গতকাল বৃহস্পতিবার পুলিশ এফআইআর দাখিল করেছে। শর্মা এক ভিডিও বার্তায় কাশ্মীরী শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের অবিলম্বে রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। হুমকি দিয়ে বলেন, না হলে তাদের হাল অকল্পনীয় হবে।