গত বছর জুলাইয়ে শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলন চলাকালে ঢাকার চাঁনখারপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

তদন্ত সংস্থার নথি

হাবিবুর রহমানসহ ৮ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নিয়ে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল রোববার,(২৫ মে ২০২৫) এ আদেশ দেয়। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম রোববার, ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে এই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করেন। বিস্তারিত শোনার পর ট্রাইব্যুনাল বলে, আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয়ার কারণ রয়েছে। তাই তা আমলে নেয়া হলো।

পরে তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে আজ (রোববার,) প্রথম জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলার আনুষ্ঠানিক বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলো। ফরমাল চার্জ আজ (গতকাল) দাখিল করা হয়। ফরমাল চার্জের ভিত্তিতে আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বিচারের জন্য আমলে নিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। ফরমাল চার্জ আমলে নেয়ার মাধ্যমে একটি বিচারপ্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। সেটি আজ (রোববার,) বাংলাদেশে শুরু হয়ে গেল।’

এই প্রথম

শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলন দমনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো নিপীড়নকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ বিবেচনা করে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের উদ্যোগ নেয়ার পর এই প্রথম কোনো মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয়া হলো। এখন ট্রাইব্যুনাল আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম কোনো মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হবে।

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা গত ১১ এপ্রিল এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে জমা দেয়। নথিপত্র পর্যালোচনা করে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম রোববার, ফরমাল চার্জ আকারে তা দাখিল করেন। পরে এ বিষয়ে শুনানি হয়।

আসামি যারা

হাবিবুর রহমান ছাড়াও ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী, রমনা জোনের সাবেক এডিসি শাহ আলম মো. আকতারুল ইসলাম ও এসি মো. ইমরুল, শাহবাগ থানার সাবেক পুলিশ পরিদর্শক আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল সুজন, ইমাজ হোসেন ও নাসিরুল ইসলাম এ মামলার আসামি।

তাদের মধ্যে আরশাদ হোসেন, সুজন, ইমাজ হোসেন ও নাসিরুল ইসলাম কারাগারে আছেন। বাকিরা পলাতক। সুদীপ, শাহ আলম ও ইমরুলের বিরুদ্ধে আগেই পরোয়ানা জারি হয়েছিল, এবার হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধেও পরোয়ানা জারি হলো।

কারাগারে থাকা চার আসামিকে রোববার, ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের দিন ৫ আগস্ট চাঁনখারপুল এলাকায় শিক্ষার্থী আনাসসহ ৬ জনকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়।

তদন্তে কী পাওয়া গেছে, সেই তথ্য তুলে ধরে চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম গত ১১ এপ্রিল বলেন, ‘ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের নির্দেশে মাঠপর্যায়ে থেকে ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে ৬ জনকে হত্যা করেন আসামিরা।’

শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততা

চাঁনখারপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালেরও ‘সম্পৃক্ততা’ রয়েছে মন্তব্য করে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু তাদের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির তদন্ত চলছে, সেজন্য তাদের এই মামলায় আসামি করা হয়নি। তবে নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনার যে ভূমিকা রয়েছে তাদের, সেটার বর্ণনা এই চার্জশিটে রয়েছে। কারণ শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে তার অধীনস্তরা মাঠপর্যায়ে থেকে ওই নির্দেশনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতাকর্মীরা বাস্তবায়ন করেছেন।’

মানবতাবিরোধী আরও অপরাধ

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘চাঁনখারপুল এলাকায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আরও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। সেসব ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা জড়িত রয়েছেন। সেসব অপরাধের তদন্ত চলছে। তদন্ত সম্পন্ন হলেই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে তদন্ত সংস্থা।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু ৬

জনকে হত্যার ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রথমেই সম্পন্ন হয়েছে, সেজন্য এটাই প্রথমে দাখিল করা হয়েছে।’

৯০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন ছাড়াও দালিলিক তথ্য-প্রমাণ জমা দিয়েছিল তদন্ত সংস্থা। ৭৯ জন সাক্ষীর জবানবন্দী, ১৯টি ভিডিও ক্লিপ, ১১টি পত্রিকার রিপোর্ট, ২টি অডিও কল রয়েছে সেখানে।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘এর মধ্যে একটি অডিও কল রয়েছে হাবিবুর রহমানের, যিনি পুলিশ কমান্ড সেন্টার থেকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমাতে চায়নিজ রাইফেল দিয়ে সরাসরি গুলি চালানোর নির্দেশ দেন পুলিশ সদস্যদের। উনার এই নির্দেশের পরই প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছেন পুলিশ সদস্যরা।’