বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেসব কর্মকর্তা গুমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের অনেকে এখনও ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে’ অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছেন গুমসংক্রান্ত অনুসন্ধান কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী।
যাদের আমরা আইডেন্টিফাই করেছি তাদের নামগুলো আমরা প্রকাশ করছি না। কারণ আমরা ভিকটিম এবং ঘটনার শিকার পরিবারগুলোর জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে চাই না: কমিশন চেয়ারম্যান
তিনি বলেন, ওই কর্মকর্তারা গুমের ঘটনার শিকার ও সাক্ষীদের ‘ভয়ভীতি’ দেখিয়ে চলেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের নাম প্রকাশ করা হলে ভিকটিমদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে। তাই তাদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।
বৃহস্পতিবার,(১৯ জুন ২০২৫) ঢাকার গুলশানে নিজস্ব কার্যালয়ে গুমসংক্রান্ত অনুসন্ধান কমিশনের এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থা চেয়ারম্যান এ কথা বলেন।
কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন গত ৪ জুন প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিবেদনে আমরা তুলে ধরেছি যে, বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত দমননীতির অংশ হিসেবে গুমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরেও বহু অপরাধী ও তাদের শুভাকাক্সক্ষীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে তাদের অবস্থানে থাকায় অনেক জোরালো প্রমাণ ও নিদর্শন ধ্বংস, অনেক ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতা, সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানারকম ভীতিকর ও আতঙ্কজনক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।’
এসব কর্মকর্তা কারা, তাদের নাম-পরিচয় জানাবেন কি এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, ‘যাদের আমরা আইডেন্টিফাই করেছি তাদের নামগুলো আমরা প্রকাশ করছি না। কী জন্য করছি না, মেইনলি একটা কারণ ফর দ্য সেইফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অব দ্য ভিকটিমস।’
মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘এখনও গুমের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা (পারপিট্রেটর) ভিকটিমদের থ্রেট করতেছে। একজন ভিকটিমকে থ্রেট করা হচ্ছে এমন অডিও রেকর্ডও আছে আমাদের কাছে।’
প্রশ্নকারী সাংবাদিকের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনি চান ওদের জীবন ঝুঁকিতে পড়–ক? এমনিতেই তারা ট্রমার মধ্যে আছে। আমরা ভিকটিম এবং ঘটনার শিকার পরিবারগুলোর জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলতে চাই না। ভিকটিমদের ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে (আইসিটি)। দায়িত্বটা এখন তাদের, আমাদের কাছে তো কোনো মেকানিজম নাই। এখন এটা ট্রাইব্যুনালের কর্তব্য।’
একই প্রশ্নের জবাবে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, ‘ভিকটিমদের নিরাপত্তা এবং সন্দেহভাজন আসামি যাতে পালিয়ে না যায়, এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে সম্পূর্ণ বিষয়টা চলমান অবস্থায় আমাদের পক্ষে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
সেনাবাহিনী
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা এবং র্যাবে দায়িত্বরত সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গুমে জড়িত থাকার অভিযোগ এলেও সেনাবাহিনী ‘প্রাতিষ্ঠানিকভাবে’ এ অপরাধে জড়িত ছিল না বলেই মনে করেন সরকারের গুমসংক্রান্ত কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী।
তবে সেনাবাহিনীর একজন সাবেক প্রধানের বক্তব্য তুলে ধরে কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, সেনাবাহিনী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জড়িত না থাকলেও গুমের বিষয়টি তারা ‘জানত’।
সম্ভাব্য চার ধরনের পরিণতি
কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, ‘কমিশনে জমা অভিযোগগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের সম্ভাব্য চার ধরনের পরিণতি হয়েছিল। সেগুলো হলো ভুক্তভোগীকে হত্যা, বিচারের আগেই ভুক্তভোগীকে গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করে সাধারণত জঙ্গি তকমা দিয়ে বাংলাদেশে বিচারাধীন বা নতুন ফৌজদারি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো, ভুক্তভোগীকে সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করা ও আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে মামলা না দিয়ে ভুক্তভোগীকে ছেড়ে দেয়া।’
গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের জন্য সারা দেশে মোট ১৬টি গোপন বন্দীশালা পরিদর্শন করা হয়েছে বলে কমিশন জানায়। কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ ছাড়া বিভিন্ন সময় তথ্যপ্রাপ্তির পরপরই তাৎক্ষণিকভাবে অভিযান চালানো করা হয়েছে।
শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে ‘গুম ও আয়নাঘরের’ বিষয়টি আবার সামনে আসে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে এসে এসব ঘটনা তদন্তে গত ২৭ আগস্ট অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ
সদস্যের গুম তদন্ত কমিশন গঠন করে।
কমিশন গত ১৪ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী একটি প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়। পরদিন ওই প্রতিবেদনের কিছু অংশ প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ‘গুমের নির্দেশদাতা’ হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার দাবি করা হয়।
কার কী ভূমিকা
এরপর ৪ জুন দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে ‘গুমের’ শিকার ব্যক্তি এবং প্রত্যক্ষদর্শী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বরাতে নির্যাতন ও স্বীকারোক্তি আদায়ের সচিত্র বর্ণনা দেয়া হয়।
‘গুমের’ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর মধ্যে কার কী ভূমিকা ছিল, ওই প্রতিবেদনে তা তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, গুমের বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটেছে পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। গুমের শিকার ব্যক্তি, তার পরিবারের সদস্য ও প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশ, র্যাব এবং পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটকে ‘মূল অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
এর বাইরে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) অধিদপ্তর ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার ‘সত্যতা’ পাওয়ার কথা বলেছে কমিশন।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনামল কমিশনের বিবেচনায় আনা হচ্ছে। কমিশন এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ পেয়ে ১ হাজার ৩৫০টি অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে দ্বিতীয় প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
গুমের শিকার হওয়ার পর নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজ পেতে কমিশন কী করছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধিতে দুটো বিষয় আছে। একটা হচ্ছে অনুসন্ধান (এনকোয়্যারি), আরেকটা হচ্ছে তদন্ত (ইনভেস্টিগেশন)। আমরা কিন্তু তদন্ত করছি না, আমরা অনুসন্ধান করছি। তদন্তের দায়িত্ব হচ্ছে আমাদের যে আইসিটি আছে তাদের। তদন্ত করা পুলিশের দায়িত্ব। সার্চ হচ্ছে পার্ট অব ইনভেস্টিগেশন, নট পার্ট অব এনকোয়্যারি। আপনাদের মনে রাখতে হবে, সার্চ হচ্ছে অনেক গভীর তদন্ত।’
কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন এ সময় বলেন, ‘আমরা যে একেবারেই সার্চ করছি না তা নয়, কমিশন সার্চের প্রক্রিয়ায় চারটি কাজ করছে। এক নম্বর হচ্ছে পুলিশের কাছে আমরা ১৩১টি কেইস পাঠিয়েছি। যাদের বিষয়ে তদন্ত করা ও তাদের খুঁজে বের করতে বলেছি আমরা। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, আমরা নিজেরা বিভিন্ন জায়গায় তথ্যের ভিত্তিতে গোপন বন্দীশালাগুলোতে ইন্সপেকশনে যাচ্ছি। তৃতীয়ত: ভারতের কারাগারে কতজন বাংলাদেশি আছে, সেটার তালিকা আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে চেয়েছি এবং এটা আংশিক পেয়েছি। আমরা সেই নামগুলো আমাদের লিস্টের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছি। চতুর্থত, বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে যে বাংলাদেশিদের পুশ ইন করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে গুম হওয়া কেউ আছে কিনা সেটা মিলিয়ে দেখছি। এমন না যে আমরা সার্চ করছি না। তবে যেটা ইন ডেপথ, সেটা পুলিশ করবে, আইসিটি করবে।’
এখনও তালিকা মিলিয়ে গুম হওয়া কাউকে শনাক্ত করা যায়নি বলে জানান সাজ্জাদ হোসেন।
বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেসব কর্মকর্তা গুমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের অনেকে এখনও ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে’ অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছেন গুমসংক্রান্ত অনুসন্ধান কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী।
যাদের আমরা আইডেন্টিফাই করেছি তাদের নামগুলো আমরা প্রকাশ করছি না। কারণ আমরা ভিকটিম এবং ঘটনার শিকার পরিবারগুলোর জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে চাই না: কমিশন চেয়ারম্যান
তিনি বলেন, ওই কর্মকর্তারা গুমের ঘটনার শিকার ও সাক্ষীদের ‘ভয়ভীতি’ দেখিয়ে চলেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের নাম প্রকাশ করা হলে ভিকটিমদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে। তাই তাদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।
বৃহস্পতিবার,(১৯ জুন ২০২৫) ঢাকার গুলশানে নিজস্ব কার্যালয়ে গুমসংক্রান্ত অনুসন্ধান কমিশনের এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থা চেয়ারম্যান এ কথা বলেন।
কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন গত ৪ জুন প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিবেদনে আমরা তুলে ধরেছি যে, বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত দমননীতির অংশ হিসেবে গুমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরেও বহু অপরাধী ও তাদের শুভাকাক্সক্ষীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে তাদের অবস্থানে থাকায় অনেক জোরালো প্রমাণ ও নিদর্শন ধ্বংস, অনেক ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতা, সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানারকম ভীতিকর ও আতঙ্কজনক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।’
এসব কর্মকর্তা কারা, তাদের নাম-পরিচয় জানাবেন কি এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, ‘যাদের আমরা আইডেন্টিফাই করেছি তাদের নামগুলো আমরা প্রকাশ করছি না। কী জন্য করছি না, মেইনলি একটা কারণ ফর দ্য সেইফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অব দ্য ভিকটিমস।’
মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘এখনও গুমের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা (পারপিট্রেটর) ভিকটিমদের থ্রেট করতেছে। একজন ভিকটিমকে থ্রেট করা হচ্ছে এমন অডিও রেকর্ডও আছে আমাদের কাছে।’
প্রশ্নকারী সাংবাদিকের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনি চান ওদের জীবন ঝুঁকিতে পড়–ক? এমনিতেই তারা ট্রমার মধ্যে আছে। আমরা ভিকটিম এবং ঘটনার শিকার পরিবারগুলোর জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলতে চাই না। ভিকটিমদের ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে (আইসিটি)। দায়িত্বটা এখন তাদের, আমাদের কাছে তো কোনো মেকানিজম নাই। এখন এটা ট্রাইব্যুনালের কর্তব্য।’
একই প্রশ্নের জবাবে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, ‘ভিকটিমদের নিরাপত্তা এবং সন্দেহভাজন আসামি যাতে পালিয়ে না যায়, এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে সম্পূর্ণ বিষয়টা চলমান অবস্থায় আমাদের পক্ষে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
সেনাবাহিনী
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা এবং র্যাবে দায়িত্বরত সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গুমে জড়িত থাকার অভিযোগ এলেও সেনাবাহিনী ‘প্রাতিষ্ঠানিকভাবে’ এ অপরাধে জড়িত ছিল না বলেই মনে করেন সরকারের গুমসংক্রান্ত কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী।
তবে সেনাবাহিনীর একজন সাবেক প্রধানের বক্তব্য তুলে ধরে কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, সেনাবাহিনী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জড়িত না থাকলেও গুমের বিষয়টি তারা ‘জানত’।
সম্ভাব্য চার ধরনের পরিণতি
কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, ‘কমিশনে জমা অভিযোগগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের সম্ভাব্য চার ধরনের পরিণতি হয়েছিল। সেগুলো হলো ভুক্তভোগীকে হত্যা, বিচারের আগেই ভুক্তভোগীকে গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করে সাধারণত জঙ্গি তকমা দিয়ে বাংলাদেশে বিচারাধীন বা নতুন ফৌজদারি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো, ভুক্তভোগীকে সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করা ও আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে মামলা না দিয়ে ভুক্তভোগীকে ছেড়ে দেয়া।’
গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের জন্য সারা দেশে মোট ১৬টি গোপন বন্দীশালা পরিদর্শন করা হয়েছে বলে কমিশন জানায়। কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ ছাড়া বিভিন্ন সময় তথ্যপ্রাপ্তির পরপরই তাৎক্ষণিকভাবে অভিযান চালানো করা হয়েছে।
শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে ‘গুম ও আয়নাঘরের’ বিষয়টি আবার সামনে আসে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে এসে এসব ঘটনা তদন্তে গত ২৭ আগস্ট অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ
সদস্যের গুম তদন্ত কমিশন গঠন করে।
কমিশন গত ১৪ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী একটি প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়। পরদিন ওই প্রতিবেদনের কিছু অংশ প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ‘গুমের নির্দেশদাতা’ হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার দাবি করা হয়।
কার কী ভূমিকা
এরপর ৪ জুন দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে ‘গুমের’ শিকার ব্যক্তি এবং প্রত্যক্ষদর্শী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বরাতে নির্যাতন ও স্বীকারোক্তি আদায়ের সচিত্র বর্ণনা দেয়া হয়।
‘গুমের’ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর মধ্যে কার কী ভূমিকা ছিল, ওই প্রতিবেদনে তা তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, গুমের বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটেছে পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। গুমের শিকার ব্যক্তি, তার পরিবারের সদস্য ও প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশ, র্যাব এবং পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটকে ‘মূল অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
এর বাইরে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) অধিদপ্তর ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার ‘সত্যতা’ পাওয়ার কথা বলেছে কমিশন।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনামল কমিশনের বিবেচনায় আনা হচ্ছে। কমিশন এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ পেয়ে ১ হাজার ৩৫০টি অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে দ্বিতীয় প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
গুমের শিকার হওয়ার পর নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজ পেতে কমিশন কী করছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধিতে দুটো বিষয় আছে। একটা হচ্ছে অনুসন্ধান (এনকোয়্যারি), আরেকটা হচ্ছে তদন্ত (ইনভেস্টিগেশন)। আমরা কিন্তু তদন্ত করছি না, আমরা অনুসন্ধান করছি। তদন্তের দায়িত্ব হচ্ছে আমাদের যে আইসিটি আছে তাদের। তদন্ত করা পুলিশের দায়িত্ব। সার্চ হচ্ছে পার্ট অব ইনভেস্টিগেশন, নট পার্ট অব এনকোয়্যারি। আপনাদের মনে রাখতে হবে, সার্চ হচ্ছে অনেক গভীর তদন্ত।’
কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন এ সময় বলেন, ‘আমরা যে একেবারেই সার্চ করছি না তা নয়, কমিশন সার্চের প্রক্রিয়ায় চারটি কাজ করছে। এক নম্বর হচ্ছে পুলিশের কাছে আমরা ১৩১টি কেইস পাঠিয়েছি। যাদের বিষয়ে তদন্ত করা ও তাদের খুঁজে বের করতে বলেছি আমরা। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, আমরা নিজেরা বিভিন্ন জায়গায় তথ্যের ভিত্তিতে গোপন বন্দীশালাগুলোতে ইন্সপেকশনে যাচ্ছি। তৃতীয়ত: ভারতের কারাগারে কতজন বাংলাদেশি আছে, সেটার তালিকা আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে চেয়েছি এবং এটা আংশিক পেয়েছি। আমরা সেই নামগুলো আমাদের লিস্টের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছি। চতুর্থত, বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে যে বাংলাদেশিদের পুশ ইন করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে গুম হওয়া কেউ আছে কিনা সেটা মিলিয়ে দেখছি। এমন না যে আমরা সার্চ করছি না। তবে যেটা ইন ডেপথ, সেটা পুলিশ করবে, আইসিটি করবে।’
এখনও তালিকা মিলিয়ে গুম হওয়া কাউকে শনাক্ত করা যায়নি বলে জানান সাজ্জাদ হোসেন।