বৃহস্পতিবার, এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর সাফল্যে উৎফুল্ল রাজধানীর ভিকারুন্নেসা কলেজের শিক্ষার্থীরা -সোহরাব আলম
দুই দশকের মধ্যে উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় এবার সবচেয়ে খারাপ ফল হয়েছে। নম্বর বেশি দিতে কোনো নির্দেশনা না থাকার কারণে পাসের হার কমেছে বলে শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের দাবি।
৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ
অকৃতকার্য ৫ লাখের
বেশি পরীক্ষার্থী
এক বছরে জিপিএ-৫
কমেছে প্রায় ৭৭ হাজার
২০২টি প্রতিষ্ঠানে
কেউ পাস করেনি
ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন
বৃহস্পতিবার, (১৬ অক্টোবর ২০২৫) এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। নয়টি সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে এবার গড় পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। গত বছরের চেয়ে যা ১৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ কম। এই পরীক্ষায় গত বছর পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
ফল প্রকাশের অনুষ্ঠানে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডেও চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বলেছেন, ‘এ বছর নম্বও বেশি দিতে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি শিক্ষকদের’। তিনি পরীক্ষার্থীদের দায়ী করে বলেন, শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার ব্যাপারে অনেকটাই ‘বিমুখ’।
এর আগে ২০০৪ সালে এইচএসসিতে পাস করেছিল ৪৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। ২০০৫ সালে পাসের হার ছিল ৫৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। এরপর এইচএসসি ও সমমানে পাসের হার আর কখনো এর চেয়ে নিচে নামেনি। সেই হিসাবে ২০ বছরের মধ্যে এবারই পাসের হার সবচেয়ে কম।
শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন, মূলত তিনটি কারণে এবার পাশের হার ও জিপিএ-৫ কমেছে। প্রথমত, এবার পরীক্ষার্থীরা রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে কলেজে ক্লাস কম পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, ইংরেজী, হিসাববিজ্ঞান ও আইসিটিতে পাসের হার ছিল তুলনামূলক কম। তৃতীয়ত, উত্তরপত্র মূল্যায়নে ‘কড়াকড়ি’ ও গ্রাম-শহরের ফলাফলেও ব্যাপক তারতম্য।
বৃহস্পতিবার, (১৬ অক্টোবর ২০২৫) দুপুরে রাজধানীর ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সংবাদ সম্মেলন করে ফলাফলের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান খন্দোকার এহসানুল কবির।
পাঁচ লাখ পরীক্ষার্থীই ফেল:
এবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ফেল বা অকৃতকার্য হয়েছে পাঁচ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছেলেদের সংখ্যা বেশি। মোট ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৬১ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ জন, ফেল করেছে ৫ লাখ ৮ হাজার ৭০১ জন।
এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে এবার মোট ছাত্র ছিল ৬ লাখ ১১ হাজার ৪৪৬ জন। উত্তীর্ণ হয়েছে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮৬৪ জন। এছাড়া ৬ লাখ ২৪ হাজার ২১৫ জন ছাত্রীর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৯৬ জন।
শিক্ষা উপদেষ্টা ও বোর্ডের মূল্যায়ন:
ফল খারাপের কারণ জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, ইংরেজিতে শিক্ষার্থীরা বরাবরই খারাপ করে। হিসাব বিজ্ঞানও কঠিন বিষয়। এসব বিষয়ে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভলো শিক্ষক নেই।
এছাড়া আরও অনেকগুলো সংকট রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার ব্যাপারে অনেকটাই বিমুখ। তারা অনেকটাই পড়ার টেবিল থেকে দূরে ছিল বলে আমাদের ধারণা। এই ফল নিয়ে আমাদের চর্চা করতে হবে। শিক্ষার্থীদেরও বসতে হবে। আমরাও শিক্ষক ছিলাম দেখেছি। প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এটা নিয়ে বসতে হবে, শিক্ষা বোর্ডগুলোকে বসতে হবে। আমাদের যতটুকু এখতিয়ার আছে দেখব। শতভাগ ফেল করেছে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদেও মোটিভেট করবো।’
এবারের ফলাফলই প্রকৃত চিত্র বলে মনে করেন শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার (সিআর আবরার।
তিনি বৃহস্পতিবার, সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আরও বলেন, ‘আমরা এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি যেখানে সংখ্যাই সত্য হয়ে ওঠেছিল-পাসের হারই সাফল্যের প্রতীক; জিপিএ-৫ এর সংখ্যা ছিল তৃপ্তির মানদণ্ড। ফলাফল ‘ভালো’ দেখাতে গিয়ে আমরা অজান্তেই শেখার প্রকৃত সংকট আড়াল করেছি। আজ আমি সেই সংস্কৃতির পরিবর্তন চাই।’
এ বিষয়ে সিলেট বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, ইংরেজিসহ কয়েকটি বিষয়ে খারাপ ফলের কারণে সামগ্রিক ফলাফল খারাপ হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত না হওয়া, দুর্গম হাওরাঞ্চল ও গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ও বিজ্ঞান বিভাগের বিভিন্ন বিষয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষক না থাকায় সার্বিক ফলাফলে প্রভাব পড়েছে বলে তিনি মনে করেন।
২১ বছর পর ফলে ধস:
দুই দশকের মধ্যে এবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় সবচেয়ে কম পাসের হার হয়েছে। ২০০৫ সালে এই পরীক্ষায় গড় পাসের হার ছিল ৫৯ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপর থেকে প্রায় প্রতিবছরই পাসের হার বেড়েছে বা সামান্য কমবেশি হয়েছে। ২১ বছর পর শিক্ষার্থীদের ফলাফলে এক প্রকার ধস নেমেছে।
এবার ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় গড় পাসের হার হয়েছে ৫৮ দশমিক ৮৩, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ কম। একইসঙ্গে সর্বোচ্চ স্কোর গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজ (জিপিএ-৫) পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমেছে।
এ বছর জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬৯ হাজার ৯৭ জন। গত বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ৩৭ হাজার ৪৪ এবং ছাত্র ৩২ হাজার ৫৩ জন। সেই হিসেবে এবার জিপিএ-৫ কম পেয়েছে ৭৬ হাজার ৮১৪ জন।
বাণিজ্য ও মানবিকে ধরাশায়ী:
বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা বরাবরের মতো এবারও ভালো করলেও মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের ফল সেই তুলনায় খুব একটা ভালো হয়নি।
ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, এবার বিজ্ঞান বিভাগে গড় পাসের হার ৭৮ দশমিক ৭২ শতাংশ। কিন্তু বাণিজ্য বিভাগে পাসের হার ৫৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং মানবিকে পাসের হার মাত্র ৪৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে বেশি খারাপ করেছে বলে শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ফলাফলে এগিয়ে মেয়েরা
বিগত কয়েক বছরের মতো এবারও এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার এবং জিপিএ-৫ পাওয়ার দিক থেকে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা এগিয়ে। এবার মেয়েদের পাসের হার ৬২ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং ছেলেদের ৫৪ দশমিক ৬০ শতাংশ।
জিপিএ-৫ পাওয়াদের মধ্যেও এগিয়ে মেয়েরা। এই পরীক্ষা জিপিএ-৫ পাওয়া মোট ৬৯ হাজার ৯৭ জনের মধ্যে ছাত্রী ৩৭ হাজার ৪৪ এবং ছাত্র ৩২ হাজার ৫৩ জন।
২০২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সবাই ফেল
এ বছর দেশের ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৬৫টি।
আর কমেছে শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও। এবার মোট ৩৪৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থী পাস করেছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৮৮টি।
বোর্ডভিত্তিক পাসের হার:
১১টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে পাসের হারে শীর্ষে রয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। এ বোর্ডে ৭৫ দশমিক ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। আর সবচেয়ে কম পাস করেছে কুমিল্লা বোর্ডে, ৪৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আর নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে পাশের হারে এগিয়ে ঢাকা এবং পিছিয়ে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বোর্ডে গড় পাসের হার ৬৪ দশমিক ৬২ শতাংশ, রাজশাহী বোর্ডে ৫৯ দশমিক ৪০ শতাংশ, যশোর বোর্ডে ৫০ দশমিক ২০ শতাংশ, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৫২ দশমিক ৫৭ শতাংশ, বরিশাল বোর্ডে ৬২ দশমিক ৫৭ শতাংশ, সিলেটে ৫১ দশমিক ৮৬ শতাংশ, দিনাজপুর বোর্ডে ৫৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ময়মনসিংহ বোর্ডে ৫১ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং কারিগরি বোর্ডে ৬২ দশমিক ৬৭ শতাংশ পাশ করছে।
ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন:
এইচএসসি ও সমমানের ফলে অসন্তুষ্ট পরীক্ষার্থীরা আজ থেকেই পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করতে পারবে। এই আবেদন আজ (১৭ অক্টোবর) থেকে আগামী ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত করা যাবে। প্রতিটি পত্রের জন্য ১৫০ টাকা হারে ফি প্রযোজ্য হবে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড জানিয়েছে, যঃঃঢ়ং://ৎবংপৎঁঃরহু.বফঁনড়ধৎফৎবংঁষঃং.মড়া.নফ-এ গিয়ে নির্ধারিত স্থানে রোল, রেজিস্ট্রেশন নম্বর পূরণ করতে হবে এবং বোর্ড ড্রপ ডাউন থেকে বোর্ড নির্বাচন করতে হবে। অতঃপর সাবমিট বাটনে ক্লিক করতে হবে।
এরপর মোবাইল নম্বর দিতে হবে। পুনঃনিরীক্ষণের ফল প্রকাশিত হলে এই নম্বরে এসএমএস পাঠানো হবে। পরবর্তী স্ক্রিনে শিক্ষার্থীর বিষয়ভিত্তিক ফল দেখা যাবে। এক বা একাধিক বিষয়ে ফল পুনঃনিরীক্ষণের জন্য বিষয়গুলো নির্বাচন করে ‘ফি প্রদান করুন’ বাটনে ক্লিক করতে হবে।
প্রতিটি পত্রের জন্য ১৫০ টাকা হারে ফি প্রযোজ্য হবে। দ্বিপত্র বিশিষ্ট বিষয়ের ক্ষেত্রে উভয়পত্রের আবেদন করতে হবে। পরবর্তী স্ক্রিনে প্রদেয় ফি-এর পরিমাণ দেখা যাবে। বিকাশ, নগদ, সোনালি সেবা, ডিবিবিএল রকেট এবং টেলিটক মোবাইল সিমের মাধ্যমে ফি পরিশোধ করা যাবে। ফি পরিশোধের বিস্তারিত ধাপসমূহ ওপরে উল্লেখিত পোর্টালের ‘হেল্প’ বাটনে ক্লিক কওে দেখে নেয়া যাবে। ফি পরিশোধ করে আবেদনের পোর্টালে এসে ‘জমা দিন’ বাটনে ক্লিক করতে হবে।
ফি দিয়ে একবার আবেদন জমা দেয়ার পরে আরও বিষয় যুক্ত করতে চাইলে একইভাবে তা করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে নতুনভাবে মোবাইল নম্বও দেয়ার প্রয়োজন হবে না।
বৃহস্পতিবার, এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর সাফল্যে উৎফুল্ল রাজধানীর ভিকারুন্নেসা কলেজের শিক্ষার্থীরা -সোহরাব আলম
বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫
দুই দশকের মধ্যে উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় এবার সবচেয়ে খারাপ ফল হয়েছে। নম্বর বেশি দিতে কোনো নির্দেশনা না থাকার কারণে পাসের হার কমেছে বলে শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের দাবি।
৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ
অকৃতকার্য ৫ লাখের
বেশি পরীক্ষার্থী
এক বছরে জিপিএ-৫
কমেছে প্রায় ৭৭ হাজার
২০২টি প্রতিষ্ঠানে
কেউ পাস করেনি
ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন
বৃহস্পতিবার, (১৬ অক্টোবর ২০২৫) এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। নয়টি সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে এবার গড় পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। গত বছরের চেয়ে যা ১৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ কম। এই পরীক্ষায় গত বছর পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
ফল প্রকাশের অনুষ্ঠানে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডেও চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বলেছেন, ‘এ বছর নম্বও বেশি দিতে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি শিক্ষকদের’। তিনি পরীক্ষার্থীদের দায়ী করে বলেন, শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার ব্যাপারে অনেকটাই ‘বিমুখ’।
এর আগে ২০০৪ সালে এইচএসসিতে পাস করেছিল ৪৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। ২০০৫ সালে পাসের হার ছিল ৫৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। এরপর এইচএসসি ও সমমানে পাসের হার আর কখনো এর চেয়ে নিচে নামেনি। সেই হিসাবে ২০ বছরের মধ্যে এবারই পাসের হার সবচেয়ে কম।
শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন, মূলত তিনটি কারণে এবার পাশের হার ও জিপিএ-৫ কমেছে। প্রথমত, এবার পরীক্ষার্থীরা রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে কলেজে ক্লাস কম পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, ইংরেজী, হিসাববিজ্ঞান ও আইসিটিতে পাসের হার ছিল তুলনামূলক কম। তৃতীয়ত, উত্তরপত্র মূল্যায়নে ‘কড়াকড়ি’ ও গ্রাম-শহরের ফলাফলেও ব্যাপক তারতম্য।
বৃহস্পতিবার, (১৬ অক্টোবর ২০২৫) দুপুরে রাজধানীর ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সংবাদ সম্মেলন করে ফলাফলের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান খন্দোকার এহসানুল কবির।
পাঁচ লাখ পরীক্ষার্থীই ফেল:
এবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ফেল বা অকৃতকার্য হয়েছে পাঁচ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছেলেদের সংখ্যা বেশি। মোট ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৬১ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ জন, ফেল করেছে ৫ লাখ ৮ হাজার ৭০১ জন।
এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে এবার মোট ছাত্র ছিল ৬ লাখ ১১ হাজার ৪৪৬ জন। উত্তীর্ণ হয়েছে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮৬৪ জন। এছাড়া ৬ লাখ ২৪ হাজার ২১৫ জন ছাত্রীর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৯৬ জন।
শিক্ষা উপদেষ্টা ও বোর্ডের মূল্যায়ন:
ফল খারাপের কারণ জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, ইংরেজিতে শিক্ষার্থীরা বরাবরই খারাপ করে। হিসাব বিজ্ঞানও কঠিন বিষয়। এসব বিষয়ে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভলো শিক্ষক নেই।
এছাড়া আরও অনেকগুলো সংকট রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার ব্যাপারে অনেকটাই বিমুখ। তারা অনেকটাই পড়ার টেবিল থেকে দূরে ছিল বলে আমাদের ধারণা। এই ফল নিয়ে আমাদের চর্চা করতে হবে। শিক্ষার্থীদেরও বসতে হবে। আমরাও শিক্ষক ছিলাম দেখেছি। প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এটা নিয়ে বসতে হবে, শিক্ষা বোর্ডগুলোকে বসতে হবে। আমাদের যতটুকু এখতিয়ার আছে দেখব। শতভাগ ফেল করেছে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদেও মোটিভেট করবো।’
এবারের ফলাফলই প্রকৃত চিত্র বলে মনে করেন শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার (সিআর আবরার।
তিনি বৃহস্পতিবার, সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আরও বলেন, ‘আমরা এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি যেখানে সংখ্যাই সত্য হয়ে ওঠেছিল-পাসের হারই সাফল্যের প্রতীক; জিপিএ-৫ এর সংখ্যা ছিল তৃপ্তির মানদণ্ড। ফলাফল ‘ভালো’ দেখাতে গিয়ে আমরা অজান্তেই শেখার প্রকৃত সংকট আড়াল করেছি। আজ আমি সেই সংস্কৃতির পরিবর্তন চাই।’
এ বিষয়ে সিলেট বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, ইংরেজিসহ কয়েকটি বিষয়ে খারাপ ফলের কারণে সামগ্রিক ফলাফল খারাপ হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত না হওয়া, দুর্গম হাওরাঞ্চল ও গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ও বিজ্ঞান বিভাগের বিভিন্ন বিষয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষক না থাকায় সার্বিক ফলাফলে প্রভাব পড়েছে বলে তিনি মনে করেন।
২১ বছর পর ফলে ধস:
দুই দশকের মধ্যে এবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় সবচেয়ে কম পাসের হার হয়েছে। ২০০৫ সালে এই পরীক্ষায় গড় পাসের হার ছিল ৫৯ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপর থেকে প্রায় প্রতিবছরই পাসের হার বেড়েছে বা সামান্য কমবেশি হয়েছে। ২১ বছর পর শিক্ষার্থীদের ফলাফলে এক প্রকার ধস নেমেছে।
এবার ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় গড় পাসের হার হয়েছে ৫৮ দশমিক ৮৩, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ কম। একইসঙ্গে সর্বোচ্চ স্কোর গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজ (জিপিএ-৫) পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমেছে।
এ বছর জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬৯ হাজার ৯৭ জন। গত বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ৩৭ হাজার ৪৪ এবং ছাত্র ৩২ হাজার ৫৩ জন। সেই হিসেবে এবার জিপিএ-৫ কম পেয়েছে ৭৬ হাজার ৮১৪ জন।
বাণিজ্য ও মানবিকে ধরাশায়ী:
বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা বরাবরের মতো এবারও ভালো করলেও মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের ফল সেই তুলনায় খুব একটা ভালো হয়নি।
ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, এবার বিজ্ঞান বিভাগে গড় পাসের হার ৭৮ দশমিক ৭২ শতাংশ। কিন্তু বাণিজ্য বিভাগে পাসের হার ৫৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং মানবিকে পাসের হার মাত্র ৪৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে বেশি খারাপ করেছে বলে শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ফলাফলে এগিয়ে মেয়েরা
বিগত কয়েক বছরের মতো এবারও এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার এবং জিপিএ-৫ পাওয়ার দিক থেকে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা এগিয়ে। এবার মেয়েদের পাসের হার ৬২ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং ছেলেদের ৫৪ দশমিক ৬০ শতাংশ।
জিপিএ-৫ পাওয়াদের মধ্যেও এগিয়ে মেয়েরা। এই পরীক্ষা জিপিএ-৫ পাওয়া মোট ৬৯ হাজার ৯৭ জনের মধ্যে ছাত্রী ৩৭ হাজার ৪৪ এবং ছাত্র ৩২ হাজার ৫৩ জন।
২০২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সবাই ফেল
এ বছর দেশের ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৬৫টি।
আর কমেছে শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও। এবার মোট ৩৪৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থী পাস করেছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৮৮টি।
বোর্ডভিত্তিক পাসের হার:
১১টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে পাসের হারে শীর্ষে রয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। এ বোর্ডে ৭৫ দশমিক ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। আর সবচেয়ে কম পাস করেছে কুমিল্লা বোর্ডে, ৪৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আর নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে পাশের হারে এগিয়ে ঢাকা এবং পিছিয়ে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বোর্ডে গড় পাসের হার ৬৪ দশমিক ৬২ শতাংশ, রাজশাহী বোর্ডে ৫৯ দশমিক ৪০ শতাংশ, যশোর বোর্ডে ৫০ দশমিক ২০ শতাংশ, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৫২ দশমিক ৫৭ শতাংশ, বরিশাল বোর্ডে ৬২ দশমিক ৫৭ শতাংশ, সিলেটে ৫১ দশমিক ৮৬ শতাংশ, দিনাজপুর বোর্ডে ৫৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ময়মনসিংহ বোর্ডে ৫১ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং কারিগরি বোর্ডে ৬২ দশমিক ৬৭ শতাংশ পাশ করছে।
ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন:
এইচএসসি ও সমমানের ফলে অসন্তুষ্ট পরীক্ষার্থীরা আজ থেকেই পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করতে পারবে। এই আবেদন আজ (১৭ অক্টোবর) থেকে আগামী ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত করা যাবে। প্রতিটি পত্রের জন্য ১৫০ টাকা হারে ফি প্রযোজ্য হবে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ড জানিয়েছে, যঃঃঢ়ং://ৎবংপৎঁঃরহু.বফঁনড়ধৎফৎবংঁষঃং.মড়া.নফ-এ গিয়ে নির্ধারিত স্থানে রোল, রেজিস্ট্রেশন নম্বর পূরণ করতে হবে এবং বোর্ড ড্রপ ডাউন থেকে বোর্ড নির্বাচন করতে হবে। অতঃপর সাবমিট বাটনে ক্লিক করতে হবে।
এরপর মোবাইল নম্বর দিতে হবে। পুনঃনিরীক্ষণের ফল প্রকাশিত হলে এই নম্বরে এসএমএস পাঠানো হবে। পরবর্তী স্ক্রিনে শিক্ষার্থীর বিষয়ভিত্তিক ফল দেখা যাবে। এক বা একাধিক বিষয়ে ফল পুনঃনিরীক্ষণের জন্য বিষয়গুলো নির্বাচন করে ‘ফি প্রদান করুন’ বাটনে ক্লিক করতে হবে।
প্রতিটি পত্রের জন্য ১৫০ টাকা হারে ফি প্রযোজ্য হবে। দ্বিপত্র বিশিষ্ট বিষয়ের ক্ষেত্রে উভয়পত্রের আবেদন করতে হবে। পরবর্তী স্ক্রিনে প্রদেয় ফি-এর পরিমাণ দেখা যাবে। বিকাশ, নগদ, সোনালি সেবা, ডিবিবিএল রকেট এবং টেলিটক মোবাইল সিমের মাধ্যমে ফি পরিশোধ করা যাবে। ফি পরিশোধের বিস্তারিত ধাপসমূহ ওপরে উল্লেখিত পোর্টালের ‘হেল্প’ বাটনে ক্লিক কওে দেখে নেয়া যাবে। ফি পরিশোধ করে আবেদনের পোর্টালে এসে ‘জমা দিন’ বাটনে ক্লিক করতে হবে।
ফি দিয়ে একবার আবেদন জমা দেয়ার পরে আরও বিষয় যুক্ত করতে চাইলে একইভাবে তা করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে নতুনভাবে মোবাইল নম্বও দেয়ার প্রয়োজন হবে না।