রাজধানীর ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের সামনে রোববার, (২৬ অক্টোবর ২০২৫) মেট্রো রেললাইনের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে নিচে থাকা এক পথচারীর মৃত্যু হয়। দুপুরে এ ঘটনার পর মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় -সংবাদ
রাজধানীর ফার্মগেটে মেট্রোরেল লাইনের বিয়ারিং প্যাড নিচে পড়ে একজন পথচারীর মৃত্যু হয়েছে। রোববার, দুপুর প্রায় সাড়ে ১২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর ট্রেন চলাচল সাময়িক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
স্টেশনগুলোর সব গেইটে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। যাত্রীদের প্রচ- ভিড় ও ক্ষুব্ধ যাত্রীরা গেইট ধরে টানাহেঁচড়ার এক পর্যায়ে দুপুরের দিকে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ গেইটে নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়েছেন।
সেখানে বলা হয়েছে, যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য মেট্রোরেল চলাচল সাময়িক বন্ধ রয়েছে। এজন্য কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করছেন। দুর্ঘটনার পরপর মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলে ছুটে যান।
রোববার, দুপুরে ঘটনাস্থলে তেজগাঁও থানার ওসি সাংবাদিকদের জানান, ফার্মগেট মেট্রো স্টেশনের নিচে এবং কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের সামনে মেট্রোরেল লাইনের নিচ দিয়ে পথচারীরা হেঁটে যাচ্ছিলেন। এ সময় হঠাৎ করে ওপর থেকে একটি বিয়ারিং প্যাড (পিলার-৪৩৩) বা পিলার ব্যালেন্স নিচে হেঁটে যাওয়া একজন পথচারীর ওপর পড়লে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। মৃত পথচারীর নাম আবুল কালাম। তার বাড়ি শরিয়তপুর।
ঘটনার পর মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কোম্পানি ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, মেট্রোরেল লাইনের গার্ডারের জয়েন্টের একটা বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে গেছে। এ কারণে মেট্রোরেল চলাচল আপাতত বন্ধ আছে। ঘটনা শুনে তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেছেন।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ জানান, মেট্রোরেল চলাচলের সময় কম্পন প্রতিরোধের জন্য সেতু কিংবা উড়াল সেতুতে ইলাস্ট্রোমোরিক বিয়ারিং প্যাড বসানো থাকে। এই প্যাড নিওপ্রেন বা প্রাকৃতিক রাবার দিয়ে তৈরি, যা পিয়ার ও ভায়াডাক্টের সংযোগস্থলে বসানো হয়। এর কোনটির ভেতরে স্টিলের কাঠামো আবার ওপরে রাবারও থাকে। এগুলোর ওজন অনেক ভারী।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিয়ারিং প্যাড পড়ে একজন নিহত হওয়ার পাশাপাশি ফুটপাটের আশপাশের চায়ের দোকানসহ অন্যান্য দোকানও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কেউ সামান্য আহত হয়েছে।
বিকট শব্দ: দূর্ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে বিকট শব্দ হয়েছে। ওই শব্দে পাশের কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনসহ পুরো ভবন কেঁপে উঠেছে বলে অনেকেই মন্তব্য করেন। তখন আশপাশের লোকজন গাড়ির চাকা বিস্ফোরণ হয়েছে বলে মনে করেন।
আগেও ঘটেছে দুর্ঘটনা: মেট্রোরেলের পিয়ার থেকে বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ে গত মাসেও একবার ট্রেন চলাচল সাময়িক বন্ধ ছিল। ওই দুর্ঘটনায় কেউ আহত হয়নি।
এবার দুর্ঘটনায় একজন ঘটনাস্থলে (স্পট ডেড) মারা গেছেন। এরপর মেট্রো কর্তৃপক্ষ কিছুটা নড়েচড়ে বসেছেন।
এ নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ও মেট্রোরেলের এমডি ফারুক আহমেদকে। এমডি ফারুক আহমেদ বলেন, পূর্বের ঘটনার যে তদন্ত কমিটি হয়েছিল সেই কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। সবগুলো পিলার ফিজিক্যালি এক্সপোর্ট দিয়ে পরিদর্শন করা হয়েছিল।
তখন উপদেষ্টা ফাওজুর কবির খান আঙুল তুলে প্রশ্ন করেন, ‘তাহলে এটা হলো কীভাবে?’ আগের ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা? সাংবাদিকদের একম প্রশ্নের জবাবে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের এমডি বলেন, ‘ডিফেক্ট লায়াবেলিটি পিরিয়ডের এ ঘটনা ঘটেছে।
তাই ওই বিষয়টি সংশোধনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল তাদেরকে (ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে)। তখন তারা বলেছিল সেটা সংশোধন করেছে।’
এ সময় উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা জাপানি ঠিকাদাররা করেছে। এখানে বলা হচ্ছে এটা ডিফেক্ট লায়াবেলিটি পিরিয়ডের মধ্যে ঘটেছে। তবে এখন যে কমিটি হচ্ছে এই কমিটি আগের কমিটির রিপোর্ট দেখবে।’
তদন্ত কমিটি: মেট্রোরেলের সাবেক এমডি ও বর্তমান সেতু বিভাগের সচিব আব্দুর রউফকে প্রধান করে গঠিত পাঁচ সদস্যের নতুন কমিটিকে দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
যাত্রীদের অভিযোগ: মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে উত্তরা, মিরপুর ও মতিঝিল মেট্রোরেলের হাজার হাজার যাত্রী রোববার, টিকেট কেটে, মেট্রো স্টেশনগুলোতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন।
কোনো ঘটনা ঘটলে স্টেশনগুলোতে তালা দিয়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়। রোববার,ও যাত্রীদের না জানিয়ে হঠাৎ করে স্টেশনে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এরপর যাত্রীরা গণমাধ্যম, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখে ট্রেন চলাচল বন্ধের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন।
পাঁচ সপ্তাহের ব্যবধানে মেট্রোরেল লাইনের বিয়ারিং প্যাড দুইবার খসে পড়ার পর এর কাঠামো ও কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেউ কেউ বলেছেন, এই প্যাড যদি রাবার দিয়ে তৈরি করা হয়, তার আঘাতে কি মৃত্যু হতে পারে? গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। ততে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়েছিল, তবে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি, ঘটেছে এবার।
আসলে এই প্যাডের ওজন অনেক ভারী হয়: বসানো হয় কম্পন প্রতিরোধের জন্য সেতু বা উড়াল সেতুতে। ইলাস্টোমোরিক বিয়ারিং প্যাড নিওপ্রেন বা প্রাকৃতিক রাবার দিয়ে তৈরি, যা পিয়ার ও ভায়াডাক্টের সংযোগস্থলে বসানো হয়। কোনোটির ভেতরে কয়েক পরতে থাকে স্টিলের কাঠামো, আর ওপরে থাকে রাবার।
দুর্ঘটনা সম্পর্কে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলী কামরুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোনো সেতুর পিয়ার ও গার্ডারের মধ্যে স্থিতিস্থাপকতা সৃষ্টির জন্য এ ধরনের রাবার প্যাড ব্যবহার করা হয়। এগুলো বাংলাদেশেও তৈরি হয়, আবার বিদেশ থেকেও আনানো যায়।
‘এক একটি প্যাডের ওজন হতে পারে ৫০-২০০ কেজি পর্যন্ত। বুয়েট এসব রাবার প্যাডের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে ছাড়পত্র দেয়।’
এখন প্রশ্ন উঠেছে সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা হয়েছিল কি না? হয়ে থাকলে আবার কেন এ ঘটনা ঘটলো।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই প্যাড পড়ে একজন মারা যাওয়ার পাশাপাশি ফুটপাতে একটি চায়ের দোকানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আজ কালামকে বিদায় দিতে চাইনি: মেট্রোরেল লাইনের বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ে মারা যাওয়া আবুল কালামের স্বজনরা রোববার, বিকেলে সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে গিয়ে লাশ দেখে কান্নাকাটি করেন। কালামের স্ত্রী আইরিন আক্তার পিয়া রোববার, বিকেলে মর্গের সামনে যান।
এক ছেলেকে কোলে নিয়ে বার বার বলছিলেন, ‘আজকে কালামকে বিদায় দিতে চাইনি। দরজা লাগাতেও যাইনি। আমার বাচ্চাদের এখন কী হবে? কালামের বাড়ি শরিয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঈশ্বরকাঠি এলাকার জলিলের ছেলে।
নিহতের ভাগ্নে শাহাদাত মর্গের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আবুল কালাম ট্রাভেল এজেন্ট এয়ার টিকেট বিক্রির কাজ করতেন। তার তিন ও চার বছর বয়সী দুটি ছেলে রয়েছে। পরিবার নিয়ে নারায়ণগঞ্জে থাকতেন।
ক্ষতিপূরণ: নিহতের পরিবারের দায়িত্ব নিবেন মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। রোববার, ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে উপদেষ্টা ও মেট্রোরেলের এমডি এ তথ্য জানিয়েছেন।
আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করবে: মেট্রোরেল লাইনের বিয়ারিং প্যাড পড়ে যাওয়ায় আপাতত আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু করা যাচ্ছে না। তবে আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল করবে বলে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ জানিয়েছেন।
যন্ত্রপাতি না এলে এটা মেরামত করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় এই অংশে মেট্রোরেল আপাতত চালু করা সম্ভব না। তবে মেট্রোরেল আপাতত আগারগাঁও থেকে দিয়াবাড়ি পর্যন্ত চলাচল করবে।
অবশ্য আগে ডিএমটিসিএল-এর ফেইসবুক পেইজে বলা হয়, ‘কারিগরি/যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মেট্রোরেল চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। সম্মানিত যাত্রীগণের চলাচলে সাময়িক অসুবিধার জন্য মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ আন্তরিকভাবে দুঃখিত। এই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে ধৈর্য্যধারণ ও সহযোগিতার জন্য যাত্রীসাধারণের প্রতি অনুরোধ করা হলো।’ পরে বিকেল ৩টায় উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার কথা জানানো হয় ডিএমটিসিএল-এর পক্ষ থেকে।
দুপুরে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘এটা এখন চালু করা যাবে না। এটা তো এখন ঝুঁকিপূর্ণ, আরেকটা দুর্ঘটনা যদি ঘটে সেটার দায়িত্ব কে নেবে।’
তদন্ত কমিটি গঠন: ফাওজুল কবির খান বলেন, দুর্ঘটনা তদন্তে সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আব্দুর রউফকে প্রধান করে ৫ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। ‘এই কমিটিকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া তারা আগেও এ ধরনের একটি ঘটনায় যে কমিটি হয়েছিল তাদের প্রতিবেদন দেখবে। সেখানে যদি কোনো ল্যাপ্স থাকে সেটাও আইডেন্টিফাই করবে।’ দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়েছে।
আতঙ্ক: মেট্রোরেল লাইনের নিচ দিয়ে যেতে এখন নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকেই দুর্ঘটনার পরে নিচ দিয়ে ভয়ে যেতে চায়নি।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
রাজধানীর ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের সামনে রোববার, (২৬ অক্টোবর ২০২৫) মেট্রো রেললাইনের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে নিচে থাকা এক পথচারীর মৃত্যু হয়। দুপুরে এ ঘটনার পর মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় -সংবাদ
রোববার, ২৬ অক্টোবর ২০২৫
রাজধানীর ফার্মগেটে মেট্রোরেল লাইনের বিয়ারিং প্যাড নিচে পড়ে একজন পথচারীর মৃত্যু হয়েছে। রোববার, দুপুর প্রায় সাড়ে ১২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর ট্রেন চলাচল সাময়িক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
স্টেশনগুলোর সব গেইটে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। যাত্রীদের প্রচ- ভিড় ও ক্ষুব্ধ যাত্রীরা গেইট ধরে টানাহেঁচড়ার এক পর্যায়ে দুপুরের দিকে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ গেইটে নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়েছেন।
সেখানে বলা হয়েছে, যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য মেট্রোরেল চলাচল সাময়িক বন্ধ রয়েছে। এজন্য কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করছেন। দুর্ঘটনার পরপর মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলে ছুটে যান।
রোববার, দুপুরে ঘটনাস্থলে তেজগাঁও থানার ওসি সাংবাদিকদের জানান, ফার্মগেট মেট্রো স্টেশনের নিচে এবং কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের সামনে মেট্রোরেল লাইনের নিচ দিয়ে পথচারীরা হেঁটে যাচ্ছিলেন। এ সময় হঠাৎ করে ওপর থেকে একটি বিয়ারিং প্যাড (পিলার-৪৩৩) বা পিলার ব্যালেন্স নিচে হেঁটে যাওয়া একজন পথচারীর ওপর পড়লে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। মৃত পথচারীর নাম আবুল কালাম। তার বাড়ি শরিয়তপুর।
ঘটনার পর মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কোম্পানি ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, মেট্রোরেল লাইনের গার্ডারের জয়েন্টের একটা বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে গেছে। এ কারণে মেট্রোরেল চলাচল আপাতত বন্ধ আছে। ঘটনা শুনে তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেছেন।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ জানান, মেট্রোরেল চলাচলের সময় কম্পন প্রতিরোধের জন্য সেতু কিংবা উড়াল সেতুতে ইলাস্ট্রোমোরিক বিয়ারিং প্যাড বসানো থাকে। এই প্যাড নিওপ্রেন বা প্রাকৃতিক রাবার দিয়ে তৈরি, যা পিয়ার ও ভায়াডাক্টের সংযোগস্থলে বসানো হয়। এর কোনটির ভেতরে স্টিলের কাঠামো আবার ওপরে রাবারও থাকে। এগুলোর ওজন অনেক ভারী।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিয়ারিং প্যাড পড়ে একজন নিহত হওয়ার পাশাপাশি ফুটপাটের আশপাশের চায়ের দোকানসহ অন্যান্য দোকানও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কেউ সামান্য আহত হয়েছে।
বিকট শব্দ: দূর্ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে বিকট শব্দ হয়েছে। ওই শব্দে পাশের কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনসহ পুরো ভবন কেঁপে উঠেছে বলে অনেকেই মন্তব্য করেন। তখন আশপাশের লোকজন গাড়ির চাকা বিস্ফোরণ হয়েছে বলে মনে করেন।
আগেও ঘটেছে দুর্ঘটনা: মেট্রোরেলের পিয়ার থেকে বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ে গত মাসেও একবার ট্রেন চলাচল সাময়িক বন্ধ ছিল। ওই দুর্ঘটনায় কেউ আহত হয়নি।
এবার দুর্ঘটনায় একজন ঘটনাস্থলে (স্পট ডেড) মারা গেছেন। এরপর মেট্রো কর্তৃপক্ষ কিছুটা নড়েচড়ে বসেছেন।
এ নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ও মেট্রোরেলের এমডি ফারুক আহমেদকে। এমডি ফারুক আহমেদ বলেন, পূর্বের ঘটনার যে তদন্ত কমিটি হয়েছিল সেই কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। সবগুলো পিলার ফিজিক্যালি এক্সপোর্ট দিয়ে পরিদর্শন করা হয়েছিল।
তখন উপদেষ্টা ফাওজুর কবির খান আঙুল তুলে প্রশ্ন করেন, ‘তাহলে এটা হলো কীভাবে?’ আগের ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা? সাংবাদিকদের একম প্রশ্নের জবাবে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের এমডি বলেন, ‘ডিফেক্ট লায়াবেলিটি পিরিয়ডের এ ঘটনা ঘটেছে।
তাই ওই বিষয়টি সংশোধনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল তাদেরকে (ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে)। তখন তারা বলেছিল সেটা সংশোধন করেছে।’
এ সময় উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা জাপানি ঠিকাদাররা করেছে। এখানে বলা হচ্ছে এটা ডিফেক্ট লায়াবেলিটি পিরিয়ডের মধ্যে ঘটেছে। তবে এখন যে কমিটি হচ্ছে এই কমিটি আগের কমিটির রিপোর্ট দেখবে।’
তদন্ত কমিটি: মেট্রোরেলের সাবেক এমডি ও বর্তমান সেতু বিভাগের সচিব আব্দুর রউফকে প্রধান করে গঠিত পাঁচ সদস্যের নতুন কমিটিকে দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
যাত্রীদের অভিযোগ: মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে উত্তরা, মিরপুর ও মতিঝিল মেট্রোরেলের হাজার হাজার যাত্রী রোববার, টিকেট কেটে, মেট্রো স্টেশনগুলোতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন।
কোনো ঘটনা ঘটলে স্টেশনগুলোতে তালা দিয়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়। রোববার,ও যাত্রীদের না জানিয়ে হঠাৎ করে স্টেশনে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এরপর যাত্রীরা গণমাধ্যম, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখে ট্রেন চলাচল বন্ধের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন।
পাঁচ সপ্তাহের ব্যবধানে মেট্রোরেল লাইনের বিয়ারিং প্যাড দুইবার খসে পড়ার পর এর কাঠামো ও কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেউ কেউ বলেছেন, এই প্যাড যদি রাবার দিয়ে তৈরি করা হয়, তার আঘাতে কি মৃত্যু হতে পারে? গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। ততে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়েছিল, তবে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি, ঘটেছে এবার।
আসলে এই প্যাডের ওজন অনেক ভারী হয়: বসানো হয় কম্পন প্রতিরোধের জন্য সেতু বা উড়াল সেতুতে। ইলাস্টোমোরিক বিয়ারিং প্যাড নিওপ্রেন বা প্রাকৃতিক রাবার দিয়ে তৈরি, যা পিয়ার ও ভায়াডাক্টের সংযোগস্থলে বসানো হয়। কোনোটির ভেতরে কয়েক পরতে থাকে স্টিলের কাঠামো, আর ওপরে থাকে রাবার।
দুর্ঘটনা সম্পর্কে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলী কামরুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোনো সেতুর পিয়ার ও গার্ডারের মধ্যে স্থিতিস্থাপকতা সৃষ্টির জন্য এ ধরনের রাবার প্যাড ব্যবহার করা হয়। এগুলো বাংলাদেশেও তৈরি হয়, আবার বিদেশ থেকেও আনানো যায়।
‘এক একটি প্যাডের ওজন হতে পারে ৫০-২০০ কেজি পর্যন্ত। বুয়েট এসব রাবার প্যাডের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে ছাড়পত্র দেয়।’
এখন প্রশ্ন উঠেছে সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা হয়েছিল কি না? হয়ে থাকলে আবার কেন এ ঘটনা ঘটলো।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই প্যাড পড়ে একজন মারা যাওয়ার পাশাপাশি ফুটপাতে একটি চায়ের দোকানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আজ কালামকে বিদায় দিতে চাইনি: মেট্রোরেল লাইনের বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ে মারা যাওয়া আবুল কালামের স্বজনরা রোববার, বিকেলে সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে গিয়ে লাশ দেখে কান্নাকাটি করেন। কালামের স্ত্রী আইরিন আক্তার পিয়া রোববার, বিকেলে মর্গের সামনে যান।
এক ছেলেকে কোলে নিয়ে বার বার বলছিলেন, ‘আজকে কালামকে বিদায় দিতে চাইনি। দরজা লাগাতেও যাইনি। আমার বাচ্চাদের এখন কী হবে? কালামের বাড়ি শরিয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঈশ্বরকাঠি এলাকার জলিলের ছেলে।
নিহতের ভাগ্নে শাহাদাত মর্গের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আবুল কালাম ট্রাভেল এজেন্ট এয়ার টিকেট বিক্রির কাজ করতেন। তার তিন ও চার বছর বয়সী দুটি ছেলে রয়েছে। পরিবার নিয়ে নারায়ণগঞ্জে থাকতেন।
ক্ষতিপূরণ: নিহতের পরিবারের দায়িত্ব নিবেন মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। রোববার, ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে উপদেষ্টা ও মেট্রোরেলের এমডি এ তথ্য জানিয়েছেন।
আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করবে: মেট্রোরেল লাইনের বিয়ারিং প্যাড পড়ে যাওয়ায় আপাতত আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু করা যাচ্ছে না। তবে আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল করবে বলে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ জানিয়েছেন।
যন্ত্রপাতি না এলে এটা মেরামত করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় এই অংশে মেট্রোরেল আপাতত চালু করা সম্ভব না। তবে মেট্রোরেল আপাতত আগারগাঁও থেকে দিয়াবাড়ি পর্যন্ত চলাচল করবে।
অবশ্য আগে ডিএমটিসিএল-এর ফেইসবুক পেইজে বলা হয়, ‘কারিগরি/যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মেট্রোরেল চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। সম্মানিত যাত্রীগণের চলাচলে সাময়িক অসুবিধার জন্য মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ আন্তরিকভাবে দুঃখিত। এই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে ধৈর্য্যধারণ ও সহযোগিতার জন্য যাত্রীসাধারণের প্রতি অনুরোধ করা হলো।’ পরে বিকেল ৩টায় উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার কথা জানানো হয় ডিএমটিসিএল-এর পক্ষ থেকে।
দুপুরে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘এটা এখন চালু করা যাবে না। এটা তো এখন ঝুঁকিপূর্ণ, আরেকটা দুর্ঘটনা যদি ঘটে সেটার দায়িত্ব কে নেবে।’
তদন্ত কমিটি গঠন: ফাওজুল কবির খান বলেন, দুর্ঘটনা তদন্তে সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আব্দুর রউফকে প্রধান করে ৫ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। ‘এই কমিটিকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া তারা আগেও এ ধরনের একটি ঘটনায় যে কমিটি হয়েছিল তাদের প্রতিবেদন দেখবে। সেখানে যদি কোনো ল্যাপ্স থাকে সেটাও আইডেন্টিফাই করবে।’ দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়েছে।
আতঙ্ক: মেট্রোরেল লাইনের নিচ দিয়ে যেতে এখন নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকেই দুর্ঘটনার পরে নিচ দিয়ে ভয়ে যেতে চায়নি।