alt

সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল, পরের জাতীয় নির্বাচন থেকে কার্যকর

সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট : বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়কে অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। এতে সংবিধানে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে এলেও আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যকর হবে চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে।

বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত বিচারকের পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের বাকি ছয় বিচারক হলেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।

১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু হয়েছিল। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এ সংশোধনী বাতিল করে রায় দিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা উঠে যায়।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ২০১১ সালের সেই রায়ের পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হলে সর্বোচ্চ আদালত নতুন করে আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত নেয়। বৃহস্পতিবার সেই আপিল ও রিভিউ মঞ্জুর করে সর্বসম্মত রায় ঘোষণা করল আপিল বিভাগ।

রায়ে আদালত বলেছেন, ১৪ বছর আগে দেওয়া আপিল বিভাগের রায় ‘একাধিক ত্রুটিতে ত্রুটিপূর্ণ’ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ফলে পূর্বের রায় সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হলো। এ রায়ের মাধ্যমে সংবিধানের চতুর্থ ভাগের পরিচ্ছদ ২ (ক)-এ সংযোজিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার–সম্পর্কিত বিধান পুনরুজ্জীবিত হলো। তবে সর্বোচ্চ আদালত স্পষ্ট করেছে, এসব বিধান কেবল ভবিষ্যৎ প্রয়োগযোগ্যতার ভিত্তিতে কার্যকর হবে।

রায়ের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নাল আবদিন বলেন, “এই রায়ের ফলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল হল। জনগণ এখন নির্দ্বিধায় ভোট দিতে পারবে।”

এ মামলায় রিটকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া; বিএনপির পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল; জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ছিলেন মোহাম্মদ শিশির মনির। এছাড়া ইন্টারভেনর হিসেবে ব্যারিস্টার এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, অ্যাডভোকেট মহসীন রশিদ ও ব্যারিস্টার শাহরিয়ার কবির শুনানিতে অংশ নেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হক।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার: পিছনের ইতিহাস

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার সঙ্গে জনসাধারণের পরিচয় ঘটে ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর। সে সময় সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিধান ছিল না। উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করলে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ উপরাষ্ট্রপতি হন। পরে এরশাদ পদত্যাগ করলে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন এবং দশজন উপদেষ্টাকে নিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে বিএনপি ক্ষমতায় আসে।

এরপর আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত করার আন্দোলন শুরু করে। বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্যেই ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের অধীনে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় এলেও তীব্র আন্দোলনের মুখে একই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসহ ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করা হয়।

সে বিধানের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচন হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।

ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুযায়ী দুই পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যেত—সংসদ ভেঙে দিলে ১৫ দিনের মধ্যে কিংবা সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে সংসদ ভেঙে গেলে ১৫ দিনের মধ্যে।

এই ব্যবস্থায় প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতেন সর্বশেষ অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি। তিনি দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানালে ক্রমানুসারে আগের বিচারপতিদের আমন্ত্রণ জানানো হত। কেউ রাজি না হলে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পরামর্শ করে কাউকে প্রধান উপদেষ্টা করতেন। সেক্ষেত্রেও কাউকে পাওয়া না গেলে রাষ্ট্রপতিই দায়িত্ব নিতেন। ১৯৯৬ সালে প্রথম সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় নির্বাচন তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য হলেও ২০০৬ সালে প্রধান উপদেষ্টা নিয়েই জটিলতা তৈরি হয়। আপিল বিভাগের সদ্য বিদায়ী বিচারপতি কে এম হাসানকে মানতে অনীহা দেখা দিলে অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। পরে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার শপথ নেয় এবং প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকে। ওই সরকারের মেয়াদ পরবর্তীতে সংবিধানে বৈধতা দেওয়া হয়।

ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা ও পুনর্বিবেচনা প্রক্রিয়া

১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেন এম সলিম উল্লাহসহ তিন আইনজীবী। বিএনপি আমলে ২০০৪ সালে রিট খারিজ হয়। ২০০৫ সালে আপিল করা হয়। ২০১০ সালে শুনানি শুরু হয়, যেখানে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে শীর্ষস্থানীয় আট আইনজীবী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও এর পক্ষে মত দেন।

২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলোপসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে পাস হয়।

পরবর্তীতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ওই রায়ের বিরুদ্ধে একাধিক রিভিউ আবেদন করা হয়। গত বছরের ২৭ আগস্ট সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ কয়েকজন আবেদন করেন; অক্টোবর মাসে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও পৃথক আবেদন করে। নওগাঁর বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেনও আবেদন করেন।

সব আবেদন একসঙ্গে শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট আপিল বিভাগ নতুন করে আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে গত ১৭ ডিসেম্বর হাই কোর্ট বেঞ্চ পঞ্চদশ সংশোধনীর ২০ ও ২১ ধারা বাতিল করে রায় দেয়, যা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফেরার পথে নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করে।

দশ দিনের টানা শুনানি শেষে ২০ নভেম্বর রায়ের দিন নির্ধারণ করা হয় এবং বৃহস্পতিবারের রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল ঘোষণা করেছে।

ছবি

২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবস

ছবি

ডেঙ্গুতে একদিনে আরও ৬ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৭৮৮ জন

ছবি

রোজ গার্ডেন কিনে রাষ্ট্রের ‘৩৩২ কোটি টাকা ক্ষতি’, অনুসন্ধানে দুদক

ছবি

আমার মায়ের জীবন বাঁচানোয় মোদি সরকারের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ: জয়

ছবি

ওসি সায়েদ ও এএসআই বিশ্বজিৎ ৬টি মরদেহ পুড়িয়েছে: রাজসাক্ষী আফজালুল

মৃত ও ভুয়া ভোটারের সংখ্যা বাড়ছে, খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা, বললেন ডিসি

ছবি

আশুলিয়ায় ছয়জনকে গুলি ও পুড়িয়ে হত্যা: মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় সাবেক এসআই আবজালুলের রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি

ছবি

গণভোট: করণীয় ঠিক করতে অধ্যাদেশের অপেক্ষায় ইসি

ছবি

খেলাপি ঋণ অবলোপনের সময়সীমা তুলে দিলো বাংলাদেশ ব্যাংক

ছবি

একইদিনে ইসির সংলাপে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি, বিভিন্ন প্রস্তাব

ছবি

নির্বাচন শান্তিপূর্ণ করতে সেনা ও পুলিশের সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা

ছবি

।দিল্লিতে অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠকে খলিলুর রহমান, আলোচনায় সিএসসি ও দ্বিপক্ষীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু

ছবি

বিজয় দিবসে এবারও প্যারেড নয়: জানালেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ছবি

সংসদ নির্বাচনের প্রচারণায় ২৫ কোটি টাকা খরচ করবে সরকার

ছবি

পলাতক ও দণ্ডিত আসামিদের বক্তব্য প্রচারে উদ্বেগ, সতর্ক করলো এনসিএসএ

ছবি

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফের বিরুদ্ধে মামলা করবে দুদক

ছবি

নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ পালনে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা

ছবি

জাতীয় নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ছবি

গাড়ি ভাঙচুর-পোড়ানোর মামলায় বিএমইউর চিকিৎসক গ্রেপ্তার, জামিন নামঞ্জুর

ছবি

এনসিপি ও বাসদ মার্কসবাদীকে নিবন্ধন দিয়ে ইসির প্রজ্ঞাপন

ছবি

নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুলের সম্পদ জব্দ ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ

ছবি

হাসিনা-আসাদুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড: বিচারে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলা আবশ্যক: এইচআরডব্লিউ

ছবি

দেশে মোট ভোটার ১২ কোটি ৭৬ লাখের বেশি

ছবি

অ্যাপে প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন শুরু, ব্যালট ডাকযোগে

ছবি

শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের সম্পদ কত

ছবি

নগদের সাবেক এমডিসহ সংশ্লিষ্টদের ৭৬ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ

ছবি

একদিনে ডেঙ্গুতে আরও ৪ জনের মৃত্যু

ছবি

নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ছবি

কৃষি, বাণিজ্য ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্প্রসারণ নিয়ে সিএ এবং ডাচ মন্ত্রীর আলোচনা

ছবি

লিবিয়া থেকে দেশে ফিরলেন ১৭০ বাংলাদেশি

ছবি

লি‌বিয়া থে‌কে দে‌শে ফি‌রলেন ১৭০ বাংলা‌দে‌শি

ছবি

ভারতকে চিঠি দেবে সরকার

ছবি

যা বললো ভারত

ছবি

রাষ্ট্রনিযুক্ত হাসিনার আইনজীবী

ছবি

প্রধান কৌঁসুলি ও অ্যাটর্নি জেনারেল

ছবি

‘ঐতিহাসিক’ রায়: সরকার ও উপদেষ্টাদের প্রতিক্রিয়া

tab

সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল, পরের জাতীয় নির্বাচন থেকে কার্যকর

সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট

বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়কে অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। এতে সংবিধানে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে এলেও আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যকর হবে চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে।

বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত বিচারকের পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের বাকি ছয় বিচারক হলেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।

১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু হয়েছিল। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এ সংশোধনী বাতিল করে রায় দিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা উঠে যায়।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ২০১১ সালের সেই রায়ের পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হলে সর্বোচ্চ আদালত নতুন করে আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত নেয়। বৃহস্পতিবার সেই আপিল ও রিভিউ মঞ্জুর করে সর্বসম্মত রায় ঘোষণা করল আপিল বিভাগ।

রায়ে আদালত বলেছেন, ১৪ বছর আগে দেওয়া আপিল বিভাগের রায় ‘একাধিক ত্রুটিতে ত্রুটিপূর্ণ’ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ফলে পূর্বের রায় সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হলো। এ রায়ের মাধ্যমে সংবিধানের চতুর্থ ভাগের পরিচ্ছদ ২ (ক)-এ সংযোজিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার–সম্পর্কিত বিধান পুনরুজ্জীবিত হলো। তবে সর্বোচ্চ আদালত স্পষ্ট করেছে, এসব বিধান কেবল ভবিষ্যৎ প্রয়োগযোগ্যতার ভিত্তিতে কার্যকর হবে।

রায়ের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নাল আবদিন বলেন, “এই রায়ের ফলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল হল। জনগণ এখন নির্দ্বিধায় ভোট দিতে পারবে।”

এ মামলায় রিটকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া; বিএনপির পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল; জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ছিলেন মোহাম্মদ শিশির মনির। এছাড়া ইন্টারভেনর হিসেবে ব্যারিস্টার এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, অ্যাডভোকেট মহসীন রশিদ ও ব্যারিস্টার শাহরিয়ার কবির শুনানিতে অংশ নেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হক।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার: পিছনের ইতিহাস

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার সঙ্গে জনসাধারণের পরিচয় ঘটে ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর। সে সময় সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিধান ছিল না। উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করলে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ উপরাষ্ট্রপতি হন। পরে এরশাদ পদত্যাগ করলে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন এবং দশজন উপদেষ্টাকে নিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে বিএনপি ক্ষমতায় আসে।

এরপর আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত করার আন্দোলন শুরু করে। বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্যেই ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের অধীনে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় এলেও তীব্র আন্দোলনের মুখে একই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসহ ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করা হয়।

সে বিধানের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচন হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।

ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুযায়ী দুই পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যেত—সংসদ ভেঙে দিলে ১৫ দিনের মধ্যে কিংবা সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে সংসদ ভেঙে গেলে ১৫ দিনের মধ্যে।

এই ব্যবস্থায় প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতেন সর্বশেষ অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি। তিনি দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানালে ক্রমানুসারে আগের বিচারপতিদের আমন্ত্রণ জানানো হত। কেউ রাজি না হলে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পরামর্শ করে কাউকে প্রধান উপদেষ্টা করতেন। সেক্ষেত্রেও কাউকে পাওয়া না গেলে রাষ্ট্রপতিই দায়িত্ব নিতেন। ১৯৯৬ সালে প্রথম সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় নির্বাচন তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য হলেও ২০০৬ সালে প্রধান উপদেষ্টা নিয়েই জটিলতা তৈরি হয়। আপিল বিভাগের সদ্য বিদায়ী বিচারপতি কে এম হাসানকে মানতে অনীহা দেখা দিলে অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। পরে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার শপথ নেয় এবং প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকে। ওই সরকারের মেয়াদ পরবর্তীতে সংবিধানে বৈধতা দেওয়া হয়।

ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা ও পুনর্বিবেচনা প্রক্রিয়া

১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেন এম সলিম উল্লাহসহ তিন আইনজীবী। বিএনপি আমলে ২০০৪ সালে রিট খারিজ হয়। ২০০৫ সালে আপিল করা হয়। ২০১০ সালে শুনানি শুরু হয়, যেখানে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে শীর্ষস্থানীয় আট আইনজীবী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও এর পক্ষে মত দেন।

২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলোপসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে পাস হয়।

পরবর্তীতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ওই রায়ের বিরুদ্ধে একাধিক রিভিউ আবেদন করা হয়। গত বছরের ২৭ আগস্ট সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ কয়েকজন আবেদন করেন; অক্টোবর মাসে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও পৃথক আবেদন করে। নওগাঁর বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেনও আবেদন করেন।

সব আবেদন একসঙ্গে শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট আপিল বিভাগ নতুন করে আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে গত ১৭ ডিসেম্বর হাই কোর্ট বেঞ্চ পঞ্চদশ সংশোধনীর ২০ ও ২১ ধারা বাতিল করে রায় দেয়, যা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফেরার পথে নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করে।

দশ দিনের টানা শুনানি শেষে ২০ নভেম্বর রায়ের দিন নির্ধারণ করা হয় এবং বৃহস্পতিবারের রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল ঘোষণা করেছে।

back to top