নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। তবে এটি কার্যকর হবে চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিল সর্বোচ্চ আদালত
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে
চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন
আসছে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠ্যেয় ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় অবৈধ ঘোষণা করে বৃহস্পতিবার, (২০ নভেম্বর ২০২৫) রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এর মধ্য দিয়ে সংবিধানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে এলো।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারকের পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ এ রায় ঘোষণা করে। বেঞ্চের অপর ৬ বিচারক হলেন- বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের সময় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়।
শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। এই সরকারের আমলে ২০১১ সালের সেই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন হলে নতুন করে আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত নেয় সর্বোচ্চ আদালত।
বৃহস্পতিবার, সেই আপিল ও রিভিউ মঞ্জুর করে সর্বসম্মত রায় ঘোষণা করলো আপিল বিভাগ। রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বলছেন, ১৪ বছর আগে আপিল বিভাগের দেয়া রায়টি ‘একাধিক ত্রুটিতে ত্রুটিপূর্ণ’ বলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। সেই রায় সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হলো।
আপিল বিভাগ বলেছে, সংবিধানের চতুর্থ ভাগের পরিচ্ছদ ২ (ক)-এর নির্দলীয় সরকার-সম্পর্কিত বিধানবলি, যা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইনের ৩ ধারায় সন্নিবেশিত হয়েছিল, এই রায়ের মাধ্যমে তা পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করা হলো। তবে সর্বোচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সম্পর্কিত বিধানবলি কেবল ভবিষ্যৎ প্রয়োগ যোগ্যতার ভিত্তিতে কার্যকর হবে।
*আইনজীবীদের ব্যাখ্যা*
রায় ঘোষণার পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় যে ফিফটি এইট ওয়ান অ্যান্ড ফিফটি এইট টু আবার পুনর্বহাল হলো। এর অর্থ হল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আবার ফিরে এলো।’
বিএনপি এই রায়ে খুশি কিনা, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘অবশ্যই। আমরা মনে করি যে এটা খুশি না, খালি ঈদের দিন আমাদের মনে হচ্ছে। তার কারণ বিএনপিই খালি খুশি না, পুরো জাতি খুশি।’
বিএনপির আরেক আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘আদালত বলেছে, এর কার্যকারিতা প্রস্পেক্টিভলি (ভবিষ্যতে)।’
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম বর্তমানে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যারা ইতোমধ্যে ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর মধ্যে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন এবং সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন। আজকের রায়ের মাধ্যমে এটা স্পষ্টত হয়ে গেল যে এই নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যেটি আজকে থেকেই সংবিধানে ফিরে এলো, তার অধীনে আসন্ন নির্বাচনটি হবে না। এই রায়ের কার্যকারিতা হবে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের পর।’
জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘রায়ে বলা হয়েছে অতীতের যে রায় দেয়া হয়েছে এটি টেইন্টেড, বাংলায় বলে কলঙ্কিত এবং এরর অ্যাপারেন্ট অন দ্য ফেইস অব দ্য রেকর্ড। দেখামাত্রই মনে হয় অতীতের রায়টা ছিল টেইন্টেড। এবং সেইজন্য বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে থার্টিন্থ অ্যামেন্ডমেন্টকে যে আনকনস্টিটিউশনাল ডিক্লেয়ার করা হয়েছিল সেই রায়কে পরিপূর্ণভাবে বাতিল করা হলো ইন ইটস এনটায়ারিটি।’
তিনি বলেন, ‘এই রায় ঘোষণার ভিত্তিতে থার্টিন্থ অ্যামেন্ডমেন্ট বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত হলো। ইংরেজিতে বলেছেন রিভাইভড অ্যান্ড রেস্টোর্ড। এই রিভাইভ এবং রেস্টোর্ডটা কখন কার্যকর হবে, সেটা বলেছেন সাবজেক্ট টু এনফোর্সমেন্ট অব আর্টিকেল ফিফটি এইট বি অ্যান্ড ফিফটি এইট সি। এর অর্থ হলো, সংসদ ভাঙিয়ে যাওয়ার পনেরো দিনের ভেতরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে। এখন যেহেতু সংসদ নাই, ভাঙিয়ে যাওয়ার পনেরো দিনের ভেতরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়ার কোনো বিধানও আপাতত কার্যকর হবে না।’
শিশির মনির বলেন, ‘এই রিভাইভাল এবং এই রেস্টোরেশনের আদেশ কার্যকর হবে মাস্ট অপারেট প্রস্পেক্টিভলি। আগামীতে এটি কার্যকর হবে। বর্তমান সময়ে এটি কার্যকর হবে না। অর্থাৎ ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রে এই যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রিভাইভ হলো, তার কার্যকারিতা থাকবে না। তার কার্যকারিতা থাকবে প্রস্পেক্টিভলি। অর্থাৎ চতুর্দশ সংসদ যে সংসদ নির্বাচন হবে, সেই সময় থেকে।’
পঞ্চদশ সংশোধনী মামলায় আপিল বিচারের অপেক্ষায় আছে; সেখানেও তত্ত্বাবধায়ক ফেরানোর প্রশ্ন আছে। দুই রায় সাংঘর্ষিক হবে কিনা প্রশ্ন করা হলে শিশির মনির বলেন, ‘পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে অ্যামেন্ডমেন্ট আনা হয়। এই অ্যামেন্ডমেন্টটাকে আমাদের হাইকোর্ট ডিভিশন বাতিল ঘোষণা করেছেন। আংশিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সংক্রান্ত পুরোটাকেই বাতিল করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে আপিল দায়ের হয়েছে। লিভ হয়েছে। এই লিভ শুনানির জন্য পেন্ডিং আছে। সাবজেক্ট টু কী ডিসিশন সেখানে হবে, এটার জন্যও অপেক্ষা করার সময় দরকার বলে আমি মনে করি। তা না হলে একটা জিনিস পরিপূর্ণভাবে সেটেল হবে না। একটা বিতর্ক থেকেই যাবে। সেজন্য ইন ইটস এনটায়ারিটি শেষ করতে পারলে ভালো হতো। আশা করি ওইটাও দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে।’
এই রায়ের কোনো সমস্যা হবে কিনা, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে শিশির মনির বলেন, ‘না। ওটার কারণে আজকের রায়ের, আজকের রায় তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার সিস্টেমটাকে বাতিল করে যে রায় দিয়েছিলেন, তার রিভিউ করে বাতিল করা হলো। এর মানে কী? তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটা বহাল করা হলো। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মামলায় তত্ত্বাবধায়কই একমাত্র ইস্যু নয়। তত্ত্বাবধায়কের বাইরেও প্রায় ২৯টা ইস্যু ফিফটিন্থ অ্যামেন্ডমেন্টে রেইজ করা হয়েছিল। যার চারটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল হাইকোর্ট ডিভিশন। বাকিগুলোর ব্যাপার হাইকোর্ট ডিভিশন পার্লামেন্টের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এটাকে এর বিরুদ্ধে আমরাও আপিল করেছি, জনাব বদিউল আলম মজুমদারও আপিল করেছেন, আরও ক্রস আপিল হয়েছে। সব বিবেচনা হবে। শুধু তত্ত্বাবধায়কের ব্যাপারে নয়, ২৯টা ব্যাপারেই বাকি সিদ্ধান্ত হবে ওই মামলায়।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেমন হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে শিশির মনির বলেন, ‘এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ফরমেশন আছে, সেখানে লাস্ট রিটায়ার্ড চিফ জাস্টিসই হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান। কিন্তু এটা বর্তমানে কার্যকর হচ্ছে না। আপনারা ইতোমধ্যে জানেন যে, জুলাই চার্টারে যেটাকে গণভোটে পাঠানো হচ্ছে সেখানে চারটি অপশন দেয়া হয়েছে। এই চারটি অপশন যদি গণভোটে একসেপ্টেড হয় তাহলে নতুন পার্লামেন্টে, সংবিধান সংস্কার সভায় যদি এটা গৃহীত হয় তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফরমেটে আমূল পরিবর্তন আসতে পারে। যদি গ্রহণ করে তাহলে বর্তমান ফরমেট সেখানে চতুর্থ অপশন হিসেবে আছে, প্রথম অপশন হিসেবে নাই।’
বদিউল আলম মজুমদারের আইনজীবী শরীফ ভুঁইয়া বলেন, ‘৫৮(গ) ধারা দেখিয়ে আমি আদালতকে বলেছিলাম যে, উনাদের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরে এলেও এটাকে অবিলম্বে কার্যকর করা সম্ভব নয়। কারণ ৫৮(গ) ধারায় সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে যে, সংসদ ভেঙে দেয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হতে হবে। আমাদের সংসদ এক বছরেরও বেশি আগে ভেঙে দেয়া হয়েছে। কাজেই এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার কোনো সুযোগ নেই। আমরা খুশি যে, আজকের রায়ে আদালত আমরা যে ৫৮(গ) ধারা নজরে এনেছিলাম সেটার উল্লেখ করে বলেছেন যে এই রায় প্রস্পেক্টিভলি অর্থাৎ ভবিষ্যৎ থেকে কার্যকর হবে।’
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রের আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে রায় হয়েছে। উনারা অ্যাপিলেট ডিভিশন আগে যে জাজমেন্ট দিয়েছিলেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল, বাই মেজরিটি, সেই রায়টা উনারা সর্বসম্মতিক্রমে বাতিল করেছেন। উনারা এটাকে প্রস্পেক্টিভ ইফেক্ট দিয়েছেন। অর্থাৎ আগামী সংসদ ডিজলভ হওয়ার পর থেকে এই রায় কার্যকর হবে। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল হলো।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘যদি পরের নির্বাচনে এটা হয় তাহলে তো ওই যে ৫৮(গ) তিন অনুসারে প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়কের প্রধান হবে। মানে জুলাই সনদে কিন্তু আবার ওই রকম আয়োজন করা হয়েছে। পুরো জাজমেন্ট এলে তখন আমরা ডিটেইলসটা পাবো।’
পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ককে বাতিল করা হয়েছিল। এই পঞ্চদশ সংশোধনীর মামলা এখনও আপিল বিভাগে বিচারের অপেক্ষায়। সেক্ষেত্রে এই রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে কিনা প্রশ্ন করা হলে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না।’
আগের রায় লেখার ক্ষেত্রে বিচারপতি খায়রুল হকসহ অন্যরা দ-বিধির ২১৯ ধারায় ‘অপরাধ করেছেন’ বলে মন্তব্য করেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি বলেন, ‘আমাদের আইনে রায়ের ডেফিনেশনে বলা হচ্ছে যখন প্রোনাউন্স করা হয়। আপনি মুখ দিয়ে যখন বলে ফেললেন এইটা রায়, দ্যাট ইজ দ্য রায়। ওইটা পরিবর্তনের পদ্ধতি আছে আইনে।...সেটা না করে প্রোনাউন্সড জাজমেন্টকে উনারা নিজের ইচ্ছামতো পরিবর্তন করে দিলেন।’
*তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে এলো*
প্রায় তিন যুগ আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় হয়েছিল। সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর পঞ্চম জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছিল অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তবে তখন সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সুযোগ ছিল না।
রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের ওই সময়ে প্রথমে উপ-রাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করলে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সাহাবুদ্দীন আহমদ উপ-রাষ্ট্রপতি হন। এরপর রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগ করলে সে পদে বসেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন।
দশজন উপদেষ্টাকে নিয়ে তিনি নতুন মন্ত্রিসভা বা উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। সেই সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে বিএনপি।
এরপর আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্যে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দলীয় সরকারের অধীনে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি আবার ক্ষমতায় বসে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের চাপে ওই বছরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংসদে পাস করে তৎকালীন বিএনপি সরকার। সেই বিধান অনুসারে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম সংসদ নির্বাচন, যাতে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।
এরপর ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচন এবং ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচন হয় তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে।
১৯৯৬ সালের ক্রয়োদশ সংশোধনী আইন অনুযায়ী দুইভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার সুযোগ ছিল। কোনো কারণে সংসদ ভেঙে দেয়া হলে তার ১৫ দিনের মধ্যে এবং সরকারের মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর ১৫ দিনের মধ্যে। ওই আইনে বলা ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১১ সদস্যের বেশি হবে না। এর মধ্যে একজন প্রধান উপদেষ্টা এবং অনধিক ১০ জন উপদেষ্টা থাকবেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্য উপদেষ্টাদের নিয়োগ দেবেন।
একজন উপদেষ্টার সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে; তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো সংগঠনের সদস্য হবেন না; পরের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার লিখিত সম্মতি দেবেন এবং তার বয়স ৭২ বছরের বেশি হবে না। সর্বশেষ অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি হবেন এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।
যদি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে পাওয়া না যায় অথবা তিনি যদি দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান, তাহলে তার ঠিক আগে অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করা হবে। যদি কোনো অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে পাওয়া না যায় অথবা তিনি যদি দায়িত্ব নিতে অসম্মতি জানান তাহলে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের মধ্যে যিনি সর্বশেষে অবসরে গেছেন তাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে।
আপিল বিভাগের কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে না পাওয়া গেলে বা তারা কেউ প্রধান উপদেষ্টা হতে রাজি না হলে রাষ্ট্রপতি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করে কোনো ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব দেবেন। সেভাবেও যদি কাউকে না পাওয়া যায়, তাহলে রাষ্ট্রপতি তার স্বীয় দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বভার নেবেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় নির্বাচন অনেকটা গ্রহণযোগ্য হলেও ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়েই বাধে বিপত্তি। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী সে সময়ের সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে মেনে নিতে আপত্তি জানায় আওয়ামী লীগসহ অন্য বিরোধী দলগুলো। তাদের অভিযোগ ছিল বিএনপি বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়েছে যাতে কে এম হাসান প্রধান উপদেষ্টা হতে পারেন। এ নিয়ে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নেন।
পরে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার শপথ নেয়। তবে এই সরকার ক্ষমতায় থাকে প্রায় দুই বছর। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গঠন করে।
এদিকে আওয়ামী লীগের আগের সরকারের সময়ে ১৯৯৮ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন এম সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী। পরে বিএনপি সরকারের সময়ে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট সেই রিট খারিজ হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বৈধই থাকে। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে আপিল করেন রিট আবেদনকারীরা।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে ২০১০ সালের ১ মার্চ আপিল বিভাগে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে আপিল আবেদনকারী এবং রাষ্ট্রপক্ষ ছাড়াও অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে শীর্ষস্থানীয় ৮ জন আইনজীবী বক্তব্য দেন। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। এমনকি তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও এর পক্ষে মত দেন।
তবে ওই আপিল মঞ্জুর করে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়। তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন এ বি এম খায়রুল হক। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার আগেই ২০১১ সালের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তিসহ ৫৫টি সংশোধনীসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রস্তাব জাতীয় সংসদে পাস হয়। একই বছরের ৩ জুলাই তাতে অনুমোদন দেন রাষ্ট্রপতি।
গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে একাধিক রিভিউ আবেদন জমা পড়ে।
গত বছরের ২৭ আগস্ট একটি আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজউদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান। একই বছরের ১৬ অক্টোবর আরেকটি আবেদন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এরপর ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারও একটি রিভিউ আবেদন করেন। এছাড়া নওগাঁর বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেনও আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে গত বছর একটি আবেদন করেন।
এই চার রিভিউ আবেদনের একসঙ্গে শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট আপিল বিভাগ নতুন করে আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত দেয়। ২১ অক্টোবর আপিলের শুনানি শুরু হয়। টানা ১০ দিন শুনানি শেষে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এ মামলার রায়ের জন্য ২০ নভেম্বর দিন রাখে।
এর আগে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়। ফলে তখনই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ফেরার পথ তৈরি হয়।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় বৃহস্পতিবার, আপিল বিভাগের দেয়া রায়ের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে পুনর্বহাল হলো।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫
নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। তবে এটি কার্যকর হবে চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিল সর্বোচ্চ আদালত
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে
চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন
আসছে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠ্যেয় ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় অবৈধ ঘোষণা করে বৃহস্পতিবার, (২০ নভেম্বর ২০২৫) রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এর মধ্য দিয়ে সংবিধানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে এলো।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারকের পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ এ রায় ঘোষণা করে। বেঞ্চের অপর ৬ বিচারক হলেন- বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের সময় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়।
শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। এই সরকারের আমলে ২০১১ সালের সেই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন হলে নতুন করে আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত নেয় সর্বোচ্চ আদালত।
বৃহস্পতিবার, সেই আপিল ও রিভিউ মঞ্জুর করে সর্বসম্মত রায় ঘোষণা করলো আপিল বিভাগ। রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বলছেন, ১৪ বছর আগে আপিল বিভাগের দেয়া রায়টি ‘একাধিক ত্রুটিতে ত্রুটিপূর্ণ’ বলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। সেই রায় সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হলো।
আপিল বিভাগ বলেছে, সংবিধানের চতুর্থ ভাগের পরিচ্ছদ ২ (ক)-এর নির্দলীয় সরকার-সম্পর্কিত বিধানবলি, যা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইনের ৩ ধারায় সন্নিবেশিত হয়েছিল, এই রায়ের মাধ্যমে তা পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করা হলো। তবে সর্বোচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সম্পর্কিত বিধানবলি কেবল ভবিষ্যৎ প্রয়োগ যোগ্যতার ভিত্তিতে কার্যকর হবে।
*আইনজীবীদের ব্যাখ্যা*
রায় ঘোষণার পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় যে ফিফটি এইট ওয়ান অ্যান্ড ফিফটি এইট টু আবার পুনর্বহাল হলো। এর অর্থ হল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আবার ফিরে এলো।’
বিএনপি এই রায়ে খুশি কিনা, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘অবশ্যই। আমরা মনে করি যে এটা খুশি না, খালি ঈদের দিন আমাদের মনে হচ্ছে। তার কারণ বিএনপিই খালি খুশি না, পুরো জাতি খুশি।’
বিএনপির আরেক আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘আদালত বলেছে, এর কার্যকারিতা প্রস্পেক্টিভলি (ভবিষ্যতে)।’
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম বর্তমানে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যারা ইতোমধ্যে ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর মধ্যে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন এবং সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন। আজকের রায়ের মাধ্যমে এটা স্পষ্টত হয়ে গেল যে এই নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যেটি আজকে থেকেই সংবিধানে ফিরে এলো, তার অধীনে আসন্ন নির্বাচনটি হবে না। এই রায়ের কার্যকারিতা হবে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের পর।’
জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘রায়ে বলা হয়েছে অতীতের যে রায় দেয়া হয়েছে এটি টেইন্টেড, বাংলায় বলে কলঙ্কিত এবং এরর অ্যাপারেন্ট অন দ্য ফেইস অব দ্য রেকর্ড। দেখামাত্রই মনে হয় অতীতের রায়টা ছিল টেইন্টেড। এবং সেইজন্য বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে থার্টিন্থ অ্যামেন্ডমেন্টকে যে আনকনস্টিটিউশনাল ডিক্লেয়ার করা হয়েছিল সেই রায়কে পরিপূর্ণভাবে বাতিল করা হলো ইন ইটস এনটায়ারিটি।’
তিনি বলেন, ‘এই রায় ঘোষণার ভিত্তিতে থার্টিন্থ অ্যামেন্ডমেন্ট বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত হলো। ইংরেজিতে বলেছেন রিভাইভড অ্যান্ড রেস্টোর্ড। এই রিভাইভ এবং রেস্টোর্ডটা কখন কার্যকর হবে, সেটা বলেছেন সাবজেক্ট টু এনফোর্সমেন্ট অব আর্টিকেল ফিফটি এইট বি অ্যান্ড ফিফটি এইট সি। এর অর্থ হলো, সংসদ ভাঙিয়ে যাওয়ার পনেরো দিনের ভেতরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে। এখন যেহেতু সংসদ নাই, ভাঙিয়ে যাওয়ার পনেরো দিনের ভেতরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়ার কোনো বিধানও আপাতত কার্যকর হবে না।’
শিশির মনির বলেন, ‘এই রিভাইভাল এবং এই রেস্টোরেশনের আদেশ কার্যকর হবে মাস্ট অপারেট প্রস্পেক্টিভলি। আগামীতে এটি কার্যকর হবে। বর্তমান সময়ে এটি কার্যকর হবে না। অর্থাৎ ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রে এই যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রিভাইভ হলো, তার কার্যকারিতা থাকবে না। তার কার্যকারিতা থাকবে প্রস্পেক্টিভলি। অর্থাৎ চতুর্দশ সংসদ যে সংসদ নির্বাচন হবে, সেই সময় থেকে।’
পঞ্চদশ সংশোধনী মামলায় আপিল বিচারের অপেক্ষায় আছে; সেখানেও তত্ত্বাবধায়ক ফেরানোর প্রশ্ন আছে। দুই রায় সাংঘর্ষিক হবে কিনা প্রশ্ন করা হলে শিশির মনির বলেন, ‘পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে অ্যামেন্ডমেন্ট আনা হয়। এই অ্যামেন্ডমেন্টটাকে আমাদের হাইকোর্ট ডিভিশন বাতিল ঘোষণা করেছেন। আংশিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সংক্রান্ত পুরোটাকেই বাতিল করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে আপিল দায়ের হয়েছে। লিভ হয়েছে। এই লিভ শুনানির জন্য পেন্ডিং আছে। সাবজেক্ট টু কী ডিসিশন সেখানে হবে, এটার জন্যও অপেক্ষা করার সময় দরকার বলে আমি মনে করি। তা না হলে একটা জিনিস পরিপূর্ণভাবে সেটেল হবে না। একটা বিতর্ক থেকেই যাবে। সেজন্য ইন ইটস এনটায়ারিটি শেষ করতে পারলে ভালো হতো। আশা করি ওইটাও দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে।’
এই রায়ের কোনো সমস্যা হবে কিনা, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে শিশির মনির বলেন, ‘না। ওটার কারণে আজকের রায়ের, আজকের রায় তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার সিস্টেমটাকে বাতিল করে যে রায় দিয়েছিলেন, তার রিভিউ করে বাতিল করা হলো। এর মানে কী? তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটা বহাল করা হলো। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মামলায় তত্ত্বাবধায়কই একমাত্র ইস্যু নয়। তত্ত্বাবধায়কের বাইরেও প্রায় ২৯টা ইস্যু ফিফটিন্থ অ্যামেন্ডমেন্টে রেইজ করা হয়েছিল। যার চারটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল হাইকোর্ট ডিভিশন। বাকিগুলোর ব্যাপার হাইকোর্ট ডিভিশন পার্লামেন্টের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এটাকে এর বিরুদ্ধে আমরাও আপিল করেছি, জনাব বদিউল আলম মজুমদারও আপিল করেছেন, আরও ক্রস আপিল হয়েছে। সব বিবেচনা হবে। শুধু তত্ত্বাবধায়কের ব্যাপারে নয়, ২৯টা ব্যাপারেই বাকি সিদ্ধান্ত হবে ওই মামলায়।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেমন হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে শিশির মনির বলেন, ‘এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ফরমেশন আছে, সেখানে লাস্ট রিটায়ার্ড চিফ জাস্টিসই হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান। কিন্তু এটা বর্তমানে কার্যকর হচ্ছে না। আপনারা ইতোমধ্যে জানেন যে, জুলাই চার্টারে যেটাকে গণভোটে পাঠানো হচ্ছে সেখানে চারটি অপশন দেয়া হয়েছে। এই চারটি অপশন যদি গণভোটে একসেপ্টেড হয় তাহলে নতুন পার্লামেন্টে, সংবিধান সংস্কার সভায় যদি এটা গৃহীত হয় তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফরমেটে আমূল পরিবর্তন আসতে পারে। যদি গ্রহণ করে তাহলে বর্তমান ফরমেট সেখানে চতুর্থ অপশন হিসেবে আছে, প্রথম অপশন হিসেবে নাই।’
বদিউল আলম মজুমদারের আইনজীবী শরীফ ভুঁইয়া বলেন, ‘৫৮(গ) ধারা দেখিয়ে আমি আদালতকে বলেছিলাম যে, উনাদের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরে এলেও এটাকে অবিলম্বে কার্যকর করা সম্ভব নয়। কারণ ৫৮(গ) ধারায় সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে যে, সংসদ ভেঙে দেয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হতে হবে। আমাদের সংসদ এক বছরেরও বেশি আগে ভেঙে দেয়া হয়েছে। কাজেই এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার কোনো সুযোগ নেই। আমরা খুশি যে, আজকের রায়ে আদালত আমরা যে ৫৮(গ) ধারা নজরে এনেছিলাম সেটার উল্লেখ করে বলেছেন যে এই রায় প্রস্পেক্টিভলি অর্থাৎ ভবিষ্যৎ থেকে কার্যকর হবে।’
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রের আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে রায় হয়েছে। উনারা অ্যাপিলেট ডিভিশন আগে যে জাজমেন্ট দিয়েছিলেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল, বাই মেজরিটি, সেই রায়টা উনারা সর্বসম্মতিক্রমে বাতিল করেছেন। উনারা এটাকে প্রস্পেক্টিভ ইফেক্ট দিয়েছেন। অর্থাৎ আগামী সংসদ ডিজলভ হওয়ার পর থেকে এই রায় কার্যকর হবে। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল হলো।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘যদি পরের নির্বাচনে এটা হয় তাহলে তো ওই যে ৫৮(গ) তিন অনুসারে প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়কের প্রধান হবে। মানে জুলাই সনদে কিন্তু আবার ওই রকম আয়োজন করা হয়েছে। পুরো জাজমেন্ট এলে তখন আমরা ডিটেইলসটা পাবো।’
পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ককে বাতিল করা হয়েছিল। এই পঞ্চদশ সংশোধনীর মামলা এখনও আপিল বিভাগে বিচারের অপেক্ষায়। সেক্ষেত্রে এই রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে কিনা প্রশ্ন করা হলে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না।’
আগের রায় লেখার ক্ষেত্রে বিচারপতি খায়রুল হকসহ অন্যরা দ-বিধির ২১৯ ধারায় ‘অপরাধ করেছেন’ বলে মন্তব্য করেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি বলেন, ‘আমাদের আইনে রায়ের ডেফিনেশনে বলা হচ্ছে যখন প্রোনাউন্স করা হয়। আপনি মুখ দিয়ে যখন বলে ফেললেন এইটা রায়, দ্যাট ইজ দ্য রায়। ওইটা পরিবর্তনের পদ্ধতি আছে আইনে।...সেটা না করে প্রোনাউন্সড জাজমেন্টকে উনারা নিজের ইচ্ছামতো পরিবর্তন করে দিলেন।’
*তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে এলো*
প্রায় তিন যুগ আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় হয়েছিল। সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর পঞ্চম জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছিল অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তবে তখন সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সুযোগ ছিল না।
রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের ওই সময়ে প্রথমে উপ-রাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করলে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সাহাবুদ্দীন আহমদ উপ-রাষ্ট্রপতি হন। এরপর রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগ করলে সে পদে বসেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন।
দশজন উপদেষ্টাকে নিয়ে তিনি নতুন মন্ত্রিসভা বা উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। সেই সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে বিএনপি।
এরপর আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্যে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দলীয় সরকারের অধীনে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি আবার ক্ষমতায় বসে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের চাপে ওই বছরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংসদে পাস করে তৎকালীন বিএনপি সরকার। সেই বিধান অনুসারে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম সংসদ নির্বাচন, যাতে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।
এরপর ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচন এবং ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচন হয় তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে।
১৯৯৬ সালের ক্রয়োদশ সংশোধনী আইন অনুযায়ী দুইভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার সুযোগ ছিল। কোনো কারণে সংসদ ভেঙে দেয়া হলে তার ১৫ দিনের মধ্যে এবং সরকারের মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর ১৫ দিনের মধ্যে। ওই আইনে বলা ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১১ সদস্যের বেশি হবে না। এর মধ্যে একজন প্রধান উপদেষ্টা এবং অনধিক ১০ জন উপদেষ্টা থাকবেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্য উপদেষ্টাদের নিয়োগ দেবেন।
একজন উপদেষ্টার সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে; তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো সংগঠনের সদস্য হবেন না; পরের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার লিখিত সম্মতি দেবেন এবং তার বয়স ৭২ বছরের বেশি হবে না। সর্বশেষ অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি হবেন এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।
যদি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে পাওয়া না যায় অথবা তিনি যদি দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান, তাহলে তার ঠিক আগে অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করা হবে। যদি কোনো অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে পাওয়া না যায় অথবা তিনি যদি দায়িত্ব নিতে অসম্মতি জানান তাহলে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের মধ্যে যিনি সর্বশেষে অবসরে গেছেন তাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে।
আপিল বিভাগের কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে না পাওয়া গেলে বা তারা কেউ প্রধান উপদেষ্টা হতে রাজি না হলে রাষ্ট্রপতি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করে কোনো ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব দেবেন। সেভাবেও যদি কাউকে না পাওয়া যায়, তাহলে রাষ্ট্রপতি তার স্বীয় দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বভার নেবেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় নির্বাচন অনেকটা গ্রহণযোগ্য হলেও ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়েই বাধে বিপত্তি। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী সে সময়ের সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে মেনে নিতে আপত্তি জানায় আওয়ামী লীগসহ অন্য বিরোধী দলগুলো। তাদের অভিযোগ ছিল বিএনপি বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়েছে যাতে কে এম হাসান প্রধান উপদেষ্টা হতে পারেন। এ নিয়ে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নেন।
পরে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার শপথ নেয়। তবে এই সরকার ক্ষমতায় থাকে প্রায় দুই বছর। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গঠন করে।
এদিকে আওয়ামী লীগের আগের সরকারের সময়ে ১৯৯৮ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন এম সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী। পরে বিএনপি সরকারের সময়ে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট সেই রিট খারিজ হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বৈধই থাকে। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে আপিল করেন রিট আবেদনকারীরা।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে ২০১০ সালের ১ মার্চ আপিল বিভাগে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে আপিল আবেদনকারী এবং রাষ্ট্রপক্ষ ছাড়াও অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে শীর্ষস্থানীয় ৮ জন আইনজীবী বক্তব্য দেন। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। এমনকি তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও এর পক্ষে মত দেন।
তবে ওই আপিল মঞ্জুর করে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়। তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন এ বি এম খায়রুল হক। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার আগেই ২০১১ সালের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তিসহ ৫৫টি সংশোধনীসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রস্তাব জাতীয় সংসদে পাস হয়। একই বছরের ৩ জুলাই তাতে অনুমোদন দেন রাষ্ট্রপতি।
গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে একাধিক রিভিউ আবেদন জমা পড়ে।
গত বছরের ২৭ আগস্ট একটি আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজউদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান। একই বছরের ১৬ অক্টোবর আরেকটি আবেদন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এরপর ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারও একটি রিভিউ আবেদন করেন। এছাড়া নওগাঁর বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেনও আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে গত বছর একটি আবেদন করেন।
এই চার রিভিউ আবেদনের একসঙ্গে শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট আপিল বিভাগ নতুন করে আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত দেয়। ২১ অক্টোবর আপিলের শুনানি শুরু হয়। টানা ১০ দিন শুনানি শেষে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এ মামলার রায়ের জন্য ২০ নভেম্বর দিন রাখে।
এর আগে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়। ফলে তখনই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ফেরার পথ তৈরি হয়।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় বৃহস্পতিবার, আপিল বিভাগের দেয়া রায়ের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে পুনর্বহাল হলো।