দেশে গত একবছরে সাংবাদিকদের ‘নির্বিচার গ্রেপ্তারের ধরন কমেছে’। তবে এখনও সাংবাদিকরা ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইনে’ আটক হচ্ছেন। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারাই আসেন, তারা সাংবাদিক ‘নিবর্তনের মানসিকতা পোষণ করেন’। অবাধ তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে সমস্যা শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) বা সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) নয়। সমস্যা হলো বৃহত্তর মতপ্রকাশের স্বাধীনতায়।
সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫ ঢাকায় এক সম্মেলনে আলোচকদের বক্তব্যে এসব কথা উঠে এসেছে।
আকাশের যত তারা, ‘সাংবাদিক নিবর্তনে’ আইনেরও তত ধারা: অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান
এখনও সাংবাদিকরা সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আটক হচ্ছেন: আইনজীবী সারা হোসেন
প্রেস কাউন্সিল ‘যথাযথভাবে কাজ করছে না
আলোচনায় এটাও উঠে এসেছে যে, দেশে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতাবিষয়ক যে আইনগুলো আছে সেগুলো ‘সাংবাদিকবান্ধব নয়’। সাংবাদিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে প্রেস কাউন্সিল ‘যথাযথভাবে কাজ করছে না’।
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) ঢাকার একটি হোটেলে ‘বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন ২০২৫’ শীর্ষক এ সম্মেলনের আয়োজন করে। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলনের শেষ দিন আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশ: ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা’। এতে বক্তব্য দেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) মো. আসাদুজ্জামান, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সাজ্জাদ সিদ্দিকী প্রমুখ।
*প্রতিবেদন প্রকাশ*
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে এবং এর থেকে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কী ধরনের শিক্ষা নিতে পারে, তা নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সিজিএস ও ক্লুনি ফাউন্ডেশন ফর জাস্টিস।
প্রতিবেদনটিতে ৩৯৬ জন সাংবাদিক সংশ্লিষ্ট ২২২টি মামলা বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে যে, ডিএসএ কীভাবে সাংবাদিকতা ও সমালোচনাকে শাস্তিযোগ্য করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া, ডিএসএর প্রয়োগ ও এর প্রভাব সম্পর্কে সরাসরি জানতে ৩০ জন সাংবাদিকের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে।
*আকাশে যত তারা*
সম্মেলনে আলোচনায় অংশ নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘সাংবাদিক নিবর্তনের জন্য রাষ্ট্র অনেক রকম পথ খোলা রেখেছে। যেটা বলা হয় আকাশের যত তারা, আইনের তত ধারা। সাংবাদিকদের নিবর্তনের জন্য, নিয়ন্ত্রণের জন্য আকাশের সব রকম তারার মতো আইনের ধারা প্রয়োগ করা হয়।’
ব্রিটিশ আমল থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইনের ধারা ও তার প্রয়োগের কথা উল্লেখ করে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘যে-ই সরকারি ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা সাংবাদিক নিবর্তনের মানসিকতা মনে পোষণ করে।’ তিনি বলেন, ‘আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল করে সবার সঙ্গে আলোচনা করে যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আওয়ামী লীগ সরকার করেছিল, সেটা ছিল সবার সঙ্গে প্রতারণা।’
বিগত সরকারের সময়ে এসব আইনের অপপ্রয়োগের বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরে এই আইনজীবী বলেন, ‘এই সমস্ত নিবর্তন এবং নির্যাতনমূলক আইন, যে আইন কণ্ঠরোধ করে, যে আইন সাংবাদিকের কলম থামিয়ে দেয়, আমরা এই আইনের অবসান চাই। এটা যাতে ঘুরেফিরে না আসে, সেই বিষয়ে রাজনৈতিক যারা নেতৃত্ব থাকবেন, আগামী দিনে তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে এই বিষয়গুলো রিথিংক করার।’
শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে না বলে মনে করেন আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘এই ট্রেন্ডটাকে পরিবর্তন করতে হলে রাষ্ট্রের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে।’ বিগত সময়ে দিনাজপুরের এক কিশোরীর মামলায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির আদালতের উদাহরণ টেনে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘শুধু আইন করে বা আইন সংশোধন করে এই অবস্থার পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না।’
বাংলাদেশে ভয়হীন সংস্কৃতির প্রত্যাশা রেখে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বর্তমান সরকার আসার পর গুমের ঘটনা ঘটেনি এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও অনেক কমেছে। গত ১৭ মাসে পুলিশ নিজে বাদী হয়ে একটিও ‘গায়েবি’ মামলা করেনি। আসাদুজ্জামান আশা প্রকাশ করেন, ‘পরবর্তী নির্বাচিত সরকার সব ধরনের নিবর্তনমূলক আইনের পথ থেকে ফিরে আসবে। তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নীতিতে ফিরে যাবে না।’
*নির্বিচার গেপ্তার*
আলোচনায় অংশ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, গত একবছরে সাংবাদিকদের নির্বিচার গ্রেপ্তারের ধরন কমেছে। একে ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কিন্তু আদালতের ভূমিকা আরও বিশ্লেষণ করা দরকার।’ গবেষণায় বিচারিক আদেশগুলো বিশ্লেষণের পরামর্শ দেন এই আইনজীবী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পুলিশ জবাবদিহিহীন ছিল। একইভাবে বিচারব্যবস্থাও কতটা স্বাধীন ছিল, তা দেখা দরকার।’
এখনও সাংবাদিকরা সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আটক হচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন সারা হোসেন। তিনি বলেন,‘ অর্থাৎ সমস্যা শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ), সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) নয়। সমস্যা হলো বৃহত্তর মতপ্রকাশের স্বাধীনতায়।’
সারা হোসেন বলেন, ‘শুধু সাইবার আইন না, এখন যে অবস্থা তাতে দেখা যাচ্ছে আবার নতুন করে অনেকে বিশেষ আমলের দণ্ডবিধিকে আবিষ্কার করছে। সাইবার সুরক্ষা আইনের বাইরে গিয়ে নানা দিকে যাচ্ছে। একই সঙ্গে মব চলছে। মব দিয়ে মামলাটা যাতে ঠিকমতো না চলতে পারে, আইন নিজের মতো যাতে না চলতে পারে, জোরজবরদস্তির কারণে অন্যদিকে যাতে চলে যায়, সেই অবস্থা সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে।’
এই আইনজীবী বলেন, ‘পুরনো আইনগুলো কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটি দেখা দরকার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারের অনুমোদন ছাড়া এখন ম্যাজিস্ট্রেট মামলা নিয়ে নিচ্ছে। পুলিশও ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
*প্রেস কাউন্সিল*
প্রেস কাউন্সিল যথাযথভাবে কাজ করছে না বলে মন্তব্য করেন সারা হোসেন। তিনি বলেন, ‘তাই গণমাধ্যম কমিশনের যে সুপারিশ এসেছে, তা ভালো। পাশাপাশি এই মুহূর্তে মানবাধিকার ও তথ্য কমিশনকে সক্রিয় করা প্রয়োজন, যাতে সবকিছু আদালতে না গিয়ে এসব কমিশনে সমাধান আসে।’
সারা হোসেন বলেন, ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছিল, তা কখনোই বিচার শেষ করার জন্য ছিল না; বরং কথা বলা বন্ধ করার জন্য, লেখা বন্ধ করার জন্য করা হয়েছিল।’ এখন আইনি কাঠামোতে পরিবর্তন এসেছে উল্লেখ করে সারা হোসেন বলেন, ‘ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইন এখন সিআরপিসি সংশোধনীতে যুক্ত হয়েছে। এটা বড় অগ্রগতি; কিন্তু বাস্তবায়ন এখনও দুর্বল।’
সিজিএসের গবেষণা সহযোগী রোমান উদ্দিনের সঞ্চালনায় সম্মেলনের এই পর্বে আরও বক্তব্য দেন ট্রায়াল ওয়াচের জ্যেষ্ঠ প্রোগ্রাম ম্যানেজার মানেকা খান্না।
*হয়রানি, ভয় দেখানো*
সিজিএসর প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ক্ষমতাসীনরা ডিএসএকে সাংবাদিকদের হয়রানি ও ভয় দেখানোর হাতিয়ারে পরিণত করেছিল। বিশেষত রাজনীতিবিদরা (২২২টির মধ্যে ৭৩টি মামলা) ও অন্য প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত প্রতিশোধ বা ক্ষমতার অপব্যবহারের উদ্দেশে আইনটি ব্যবহার করেছেন। অনেক সাংবাদিককে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অভিযোগকারী ঘটনার প্রকৃত ভুক্তভোগী হোক বা না হোক, এ আইনটি যে কাউকে অভিযোগ করার সুযোগ দিয়েছিল। ফলে একই ব্যক্তিকে একই ঘটনার জন্য একাধিক মামলারও শিকার হতে হয়েছিল।
প্রতিবেদনে প্রকাশিত একটি মামলার উদাহরণে দেখা যায়, পুলিশের দুর্নীতির বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মামলা না করলেও শাসক দলের একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সেই গণমাধ্যম কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই সাংবাদিক জানান, জিজ্ঞাসাবাদের সময় ৫-৬ জন কর্মকর্তা তাকে আক্রমণাত্মকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং বৈদ্যুতিক শক দেয়ার অভিযোগও তিনি করেন। জিজ্ঞাসাবাদের প্রধান বিষয় ছিল তিনি ‘সরকারবিরোধী’ মনোভাব পোষণ করেন কিনা।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫
দেশে গত একবছরে সাংবাদিকদের ‘নির্বিচার গ্রেপ্তারের ধরন কমেছে’। তবে এখনও সাংবাদিকরা ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইনে’ আটক হচ্ছেন। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারাই আসেন, তারা সাংবাদিক ‘নিবর্তনের মানসিকতা পোষণ করেন’। অবাধ তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে সমস্যা শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) বা সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) নয়। সমস্যা হলো বৃহত্তর মতপ্রকাশের স্বাধীনতায়।
সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫ ঢাকায় এক সম্মেলনে আলোচকদের বক্তব্যে এসব কথা উঠে এসেছে।
আকাশের যত তারা, ‘সাংবাদিক নিবর্তনে’ আইনেরও তত ধারা: অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান
এখনও সাংবাদিকরা সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আটক হচ্ছেন: আইনজীবী সারা হোসেন
প্রেস কাউন্সিল ‘যথাযথভাবে কাজ করছে না
আলোচনায় এটাও উঠে এসেছে যে, দেশে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতাবিষয়ক যে আইনগুলো আছে সেগুলো ‘সাংবাদিকবান্ধব নয়’। সাংবাদিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে প্রেস কাউন্সিল ‘যথাযথভাবে কাজ করছে না’।
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) ঢাকার একটি হোটেলে ‘বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন ২০২৫’ শীর্ষক এ সম্মেলনের আয়োজন করে। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলনের শেষ দিন আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশ: ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা’। এতে বক্তব্য দেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) মো. আসাদুজ্জামান, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সাজ্জাদ সিদ্দিকী প্রমুখ।
*প্রতিবেদন প্রকাশ*
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে এবং এর থেকে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কী ধরনের শিক্ষা নিতে পারে, তা নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সিজিএস ও ক্লুনি ফাউন্ডেশন ফর জাস্টিস।
প্রতিবেদনটিতে ৩৯৬ জন সাংবাদিক সংশ্লিষ্ট ২২২টি মামলা বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে যে, ডিএসএ কীভাবে সাংবাদিকতা ও সমালোচনাকে শাস্তিযোগ্য করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া, ডিএসএর প্রয়োগ ও এর প্রভাব সম্পর্কে সরাসরি জানতে ৩০ জন সাংবাদিকের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে।
*আকাশে যত তারা*
সম্মেলনে আলোচনায় অংশ নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘সাংবাদিক নিবর্তনের জন্য রাষ্ট্র অনেক রকম পথ খোলা রেখেছে। যেটা বলা হয় আকাশের যত তারা, আইনের তত ধারা। সাংবাদিকদের নিবর্তনের জন্য, নিয়ন্ত্রণের জন্য আকাশের সব রকম তারার মতো আইনের ধারা প্রয়োগ করা হয়।’
ব্রিটিশ আমল থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইনের ধারা ও তার প্রয়োগের কথা উল্লেখ করে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘যে-ই সরকারি ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা সাংবাদিক নিবর্তনের মানসিকতা মনে পোষণ করে।’ তিনি বলেন, ‘আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল করে সবার সঙ্গে আলোচনা করে যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আওয়ামী লীগ সরকার করেছিল, সেটা ছিল সবার সঙ্গে প্রতারণা।’
বিগত সরকারের সময়ে এসব আইনের অপপ্রয়োগের বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরে এই আইনজীবী বলেন, ‘এই সমস্ত নিবর্তন এবং নির্যাতনমূলক আইন, যে আইন কণ্ঠরোধ করে, যে আইন সাংবাদিকের কলম থামিয়ে দেয়, আমরা এই আইনের অবসান চাই। এটা যাতে ঘুরেফিরে না আসে, সেই বিষয়ে রাজনৈতিক যারা নেতৃত্ব থাকবেন, আগামী দিনে তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে এই বিষয়গুলো রিথিংক করার।’
শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে না বলে মনে করেন আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘এই ট্রেন্ডটাকে পরিবর্তন করতে হলে রাষ্ট্রের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে।’ বিগত সময়ে দিনাজপুরের এক কিশোরীর মামলায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির আদালতের উদাহরণ টেনে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘শুধু আইন করে বা আইন সংশোধন করে এই অবস্থার পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না।’
বাংলাদেশে ভয়হীন সংস্কৃতির প্রত্যাশা রেখে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বর্তমান সরকার আসার পর গুমের ঘটনা ঘটেনি এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও অনেক কমেছে। গত ১৭ মাসে পুলিশ নিজে বাদী হয়ে একটিও ‘গায়েবি’ মামলা করেনি। আসাদুজ্জামান আশা প্রকাশ করেন, ‘পরবর্তী নির্বাচিত সরকার সব ধরনের নিবর্তনমূলক আইনের পথ থেকে ফিরে আসবে। তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নীতিতে ফিরে যাবে না।’
*নির্বিচার গেপ্তার*
আলোচনায় অংশ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, গত একবছরে সাংবাদিকদের নির্বিচার গ্রেপ্তারের ধরন কমেছে। একে ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কিন্তু আদালতের ভূমিকা আরও বিশ্লেষণ করা দরকার।’ গবেষণায় বিচারিক আদেশগুলো বিশ্লেষণের পরামর্শ দেন এই আইনজীবী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পুলিশ জবাবদিহিহীন ছিল। একইভাবে বিচারব্যবস্থাও কতটা স্বাধীন ছিল, তা দেখা দরকার।’
এখনও সাংবাদিকরা সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আটক হচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন সারা হোসেন। তিনি বলেন,‘ অর্থাৎ সমস্যা শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ), সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) নয়। সমস্যা হলো বৃহত্তর মতপ্রকাশের স্বাধীনতায়।’
সারা হোসেন বলেন, ‘শুধু সাইবার আইন না, এখন যে অবস্থা তাতে দেখা যাচ্ছে আবার নতুন করে অনেকে বিশেষ আমলের দণ্ডবিধিকে আবিষ্কার করছে। সাইবার সুরক্ষা আইনের বাইরে গিয়ে নানা দিকে যাচ্ছে। একই সঙ্গে মব চলছে। মব দিয়ে মামলাটা যাতে ঠিকমতো না চলতে পারে, আইন নিজের মতো যাতে না চলতে পারে, জোরজবরদস্তির কারণে অন্যদিকে যাতে চলে যায়, সেই অবস্থা সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে।’
এই আইনজীবী বলেন, ‘পুরনো আইনগুলো কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটি দেখা দরকার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারের অনুমোদন ছাড়া এখন ম্যাজিস্ট্রেট মামলা নিয়ে নিচ্ছে। পুলিশও ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
*প্রেস কাউন্সিল*
প্রেস কাউন্সিল যথাযথভাবে কাজ করছে না বলে মন্তব্য করেন সারা হোসেন। তিনি বলেন, ‘তাই গণমাধ্যম কমিশনের যে সুপারিশ এসেছে, তা ভালো। পাশাপাশি এই মুহূর্তে মানবাধিকার ও তথ্য কমিশনকে সক্রিয় করা প্রয়োজন, যাতে সবকিছু আদালতে না গিয়ে এসব কমিশনে সমাধান আসে।’
সারা হোসেন বলেন, ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছিল, তা কখনোই বিচার শেষ করার জন্য ছিল না; বরং কথা বলা বন্ধ করার জন্য, লেখা বন্ধ করার জন্য করা হয়েছিল।’ এখন আইনি কাঠামোতে পরিবর্তন এসেছে উল্লেখ করে সারা হোসেন বলেন, ‘ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইন এখন সিআরপিসি সংশোধনীতে যুক্ত হয়েছে। এটা বড় অগ্রগতি; কিন্তু বাস্তবায়ন এখনও দুর্বল।’
সিজিএসের গবেষণা সহযোগী রোমান উদ্দিনের সঞ্চালনায় সম্মেলনের এই পর্বে আরও বক্তব্য দেন ট্রায়াল ওয়াচের জ্যেষ্ঠ প্রোগ্রাম ম্যানেজার মানেকা খান্না।
*হয়রানি, ভয় দেখানো*
সিজিএসর প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ক্ষমতাসীনরা ডিএসএকে সাংবাদিকদের হয়রানি ও ভয় দেখানোর হাতিয়ারে পরিণত করেছিল। বিশেষত রাজনীতিবিদরা (২২২টির মধ্যে ৭৩টি মামলা) ও অন্য প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত প্রতিশোধ বা ক্ষমতার অপব্যবহারের উদ্দেশে আইনটি ব্যবহার করেছেন। অনেক সাংবাদিককে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অভিযোগকারী ঘটনার প্রকৃত ভুক্তভোগী হোক বা না হোক, এ আইনটি যে কাউকে অভিযোগ করার সুযোগ দিয়েছিল। ফলে একই ব্যক্তিকে একই ঘটনার জন্য একাধিক মামলারও শিকার হতে হয়েছিল।
প্রতিবেদনে প্রকাশিত একটি মামলার উদাহরণে দেখা যায়, পুলিশের দুর্নীতির বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মামলা না করলেও শাসক দলের একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সেই গণমাধ্যম কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই সাংবাদিক জানান, জিজ্ঞাসাবাদের সময় ৫-৬ জন কর্মকর্তা তাকে আক্রমণাত্মকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং বৈদ্যুতিক শক দেয়ার অভিযোগও তিনি করেন। জিজ্ঞাসাবাদের প্রধান বিষয় ছিল তিনি ‘সরকারবিরোধী’ মনোভাব পোষণ করেন কিনা।