একটি পতাকার জন্য এ দেশের নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবণিতা সম্মিলিতভাবে লড়েছিল ১৯৭১ সালে এবং দেশকে মুক্ত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই ছিল জনযুদ্ধ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই যুদ্ধে শামিল হয়েছিল সমানভাবে। নারীরা অত্যাচারিত বা ধর্ষিত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটা যেমন স্থান পেয়েছে তেমনি স্থান পেয়েছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নারীসমাজ লড়াই করেছে, দেশের ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, রক্ষা করেছে। গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে সংবাদ আদান-প্রদান, সাংস্কৃতিক প্রণোদনা, অর্থ-ওষুধ-খাদ্য-বস্ত্র সংগ্রহ, চিকিৎসা, খাদ্য ও আশ্রয়দান ইত্যাদি সব কাজই মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য অর্জনে ভূমিকা রেখেছে নারী। যুদ্ধক্ষেত্রে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন এমন নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি হিসেবে বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন তিন নারী। এরা হলেন- ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, তারামন বিবি ও কাঁকন বিবি। তারামন বিবি ও কাঁকন বিবি ২০১৮ সালে প্রয়াত হয়েছেন। প্রথম বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত সিতারা বেগম দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। তাই তাদের কারও অনুভূতি জানা সম্ভব হচ্ছে না, আমরা এই বীরমুক্তিযোদ্ধাদের অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি।
সিতারা বেগম
১৯৪৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জে জন্ম সিতারা বেগমের। বাবা মোহাম্মদ ইসরাইল এবং মা হাকিমুন নেসা। তবে বৈবাহিক সূত্রে তিনি সিতারা রহমান নামে পরিচিত। স্বাধিকার আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন সিতারা। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের ভেতর তিনি ছিলেন তৃতীয়। তার বাবা ইসরাইল মিয়া পেশায় ছিলেন আইনজীবী। সিতারার বড় ভাই এটিএম হায়দারও সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। তার সঙ্গেই কিশোরগঞ্জে শৈশব কাটান সিতারা বেগম। সেখান থেকে মেট্রিক পাশ করার পর হলিক্রস কলেজে থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ঢাকা মেডিকেল থেকে পাশ করার পর তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনামেডিকেলে লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগ দেন।
১৯৭০ সালের উত্তাল দিনগুলোতে সিতারা বেগম কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়োজিত ছিলেন। সেই সময় তার বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা মেজর এ.টি.এম. হায়দার পাকিস্তান থেকে কুমিল্লায় বদলি হয়ে আসেন। তিনি কুমিল্লার ৩য় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিতারা ও তার ভাই হায়দার ঈদের ছুটি পালন করার জন্য তাদের কিশোরগঞ্জের বাড়িতে যান। কিন্তু সেই সময়ে দেশ জুড়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। হায়দার তার বোনকে ক্যান্টনমেন্টে আর ফিরে না যাবার জন্য বলেন। পরবর্তীতে তিনি তার বোন সিতারা, বাবা-মা ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে ভারতে পাঠান। কিশোরগঞ্জ থেকে মেঘালয়ে পৌঁছাতে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লেগে যায়।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য মেলাঘরে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল নামে ৪৮০ শয্যার একটি হাসপাতাল ছিল। ঢাকা মেডিকেলের শেষ বর্ষের অনেক ছাত্র সেখানে ছিল। ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা সেক্টর-২ এর অধীনে সেখানের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। হাসপাতালে একটি অপারেশন থিয়েটার ছিল। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বাঙালি ছাড়াও সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লোকজন চিকিৎসাসেবা নিত।
মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা ধরে দিনের পর দিন চিকিৎসক হিসেবে এ হাসপাতালে অসাধ্য সাধন করে গেছেন সিতারা। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আসা গুলিবিদ্ধ, স্পিলন্টারের আঘাতে ঝাঁঝরা, গুরুতর জখম মুক্তিযোদ্ধাদের সারিয়ে তুলতে হতো খুব সামান্য সাধারণ ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে। ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব কেমন ছিল তা বোঝা যায় হাসপাতালের কাঠামোগত বর্ণনা থেকেই। সিতারা বেগমকে কেবল ওষুধ সংগ্রহের জন্য নিয়মিত আগরতলা যেতে হতো। তার রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিপুণ পরিচালনার ফলে বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধরত ভারতীয় সেনাকে মৃত্যুর মুখ থেকে সুস্থ করে আনা সম্ভব হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেডিওতে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার সংবাদ শুনে ঢাকা চলে আসেন ড. সিতারা। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে তার ভাই মেজর হায়দার নিহত হলে ডা. সিতারা ও তার পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী ভাবে থাকা শুরু করেন।
তারামন বিবি
স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করে। তারামন বিবি ১৯৫৭ সালে কুড়িগ্রাম জেলার চর রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবদুস সোহবান এবং মায়ের নাম কুলসুম বিবি। তারামন বিবি ১১নং সেক্টরে নিজ গ্রাম কুড়িগ্রাম জেলার শংকর মাধবপুরে ছিলেন। তখন ১১ নং সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের। মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। যিনি তারামনের গ্রামের পাশের একটি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি তারামনকে ক্যাম্পে রান্নাবান্নার জন্য নিয়ে আসেন। তখন তারামনের বয়স ছিল মাত্র ১৩ কিংবা ১৪ বছর। কিন্তু পরবর্তিতে তারামনের সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মুহিব হাবিলদার তাকে অস্ত্র চালনা শেখান। পরবর্তীতে সহকর্মীদের কাছ থেকে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদের সঙ্গে অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তার সাহসীকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯৯৫ সালের ১৯শে ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার তারামন বিবির হাতে বীরত্বের পুরস্কার হাতে তুলে দেয়।
তারামন বিবির স্বামীর নাম আবদুল মজিদ। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তিনি কুড়িগ্রামের রাজিবপুরে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। তারামন বিবি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি নিজ বাড়িতে মারা যান। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে রাজিবপুর উপজেলার কাচারীপাড়া তালতলা কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়।
কাঁকন বিবি
কাঁকন বিবি ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীরযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা ও গুপ্তচর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর বিপক্ষে মুক্তিবাহিনীর হয়ে গুপ্তচরের কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীর প্রতীক খেতাব দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। তার বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারা বাজার উপজেলার লীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে।
কাঁকন বিবির আসল নাম কাঁকাত হেনিনচিতা। আদিবাসী সম্প্রদায় খাসিয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এই বীর নারী। তার মূল বাড়ি ছিল ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে। ১৯৭০ সালে দিরাই উপজেলার শহীদ আলী নামের একজনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তার নতুন নাম হয় নুরজাহান বেগম।
১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ তিনি এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ায় তার স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য হয় এবং এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়। পরে এপ্রিল মাসে কাঁকনের সঙ্গে ইপিআর সৈনিক মজিদ খানের বিয়ে হয়।
মজিদ তখন কর্মসূত্রে সিলেট ইপিআর ক্যাম্পে থাকতেন। বিয়ের দুই মাস পর আগের স্বামীর ঘর থেকে সখিনাকে আনতে যান। মেয়েকে নিয়ে আসার পর তিনি আর স্বামী মজিদকে পান না। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন মজিদ বদলি হয়ে দোয়ারাবাজার সীমান্ত এলাকার কোন এক ক্যাম্পে আছেন।
১৯৭১ সালের জুন মাস। ঠিক করেন দোয়ারাবাজার যাবেন স্বামীকে খুঁজতে। শহীদ আলী নামের একজনের কাছে শিশুকন্যা সখিনাকে রেখে দোয়ারাবাজারের টেংরাটিলা ক্যাম্পে যান। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। দিনের পর দিন অমানুষিক পাশবিক নির্যাতন করে তাকে ছেড়ে দেয় তারা। রাগে-ক্ষোভে-দুঃখে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন মুক্তিযুদ্ধে। স্বামীকে পাবার আশাও ত্যাগ করেন। জুলাই মাসে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর শওকতের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেন। তার ওপর দায়িত্ব পড়ে গুপ্তচর হিসেবে তথ্য জোগাড়ের। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্যসংগ্রহ করেন। তার সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সফল আক্রমণ চালান।
গুপ্তচরের কাজ করতে গিয়েই দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজারে পাক বাহিনীর হাতে আবারও ধরা পড়েন তিনি। এবারে একনাগাড়ে ৭ দিন পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারেরা অমানুষিক নির্যাতন চালায়। লোহার রড গরম করে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছেঁকা দেয়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে মৃত ভেবে অজ্ঞান কাঁকন বিবিকে ফেলে রেখে যায়। জ্ঞান ফিরে আসলে তাকে উদ্ধার করে বালাট সাবসেক্টরে নিয়ে আসা হয়। সুস্থ হয়ে তিনি পুনরায় ফিরে আসেন বাংলাবাজারে।
এবার কাঁকন বিবি আরও বেশি ক্ষিপ্ত আরও বেশি দৃঢ়। এবার অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নেন মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর কাছে। প্রায় ২০টি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে টেংরাটিলায় পাক সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিলে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। মুক্তিবেটি নামে পরিচিত কাঁকন বিবি দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় ২৫ বছর পর বীর মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবিকে ১৯৯৬ সালে ‘বীর প্রতীক’ উপাধি দেয়া হয়। কিন্তু আজও তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়নি। ২০১৮ সালের ২১ মার্চ ১০৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন বীর এই মুক্তিযোদ্ধা।
বুধবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২১
একটি পতাকার জন্য এ দেশের নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবণিতা সম্মিলিতভাবে লড়েছিল ১৯৭১ সালে এবং দেশকে মুক্ত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই ছিল জনযুদ্ধ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই যুদ্ধে শামিল হয়েছিল সমানভাবে। নারীরা অত্যাচারিত বা ধর্ষিত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটা যেমন স্থান পেয়েছে তেমনি স্থান পেয়েছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নারীসমাজ লড়াই করেছে, দেশের ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, রক্ষা করেছে। গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে সংবাদ আদান-প্রদান, সাংস্কৃতিক প্রণোদনা, অর্থ-ওষুধ-খাদ্য-বস্ত্র সংগ্রহ, চিকিৎসা, খাদ্য ও আশ্রয়দান ইত্যাদি সব কাজই মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য অর্জনে ভূমিকা রেখেছে নারী। যুদ্ধক্ষেত্রে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন এমন নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি হিসেবে বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন তিন নারী। এরা হলেন- ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, তারামন বিবি ও কাঁকন বিবি। তারামন বিবি ও কাঁকন বিবি ২০১৮ সালে প্রয়াত হয়েছেন। প্রথম বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত সিতারা বেগম দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। তাই তাদের কারও অনুভূতি জানা সম্ভব হচ্ছে না, আমরা এই বীরমুক্তিযোদ্ধাদের অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি।
সিতারা বেগম
১৯৪৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জে জন্ম সিতারা বেগমের। বাবা মোহাম্মদ ইসরাইল এবং মা হাকিমুন নেসা। তবে বৈবাহিক সূত্রে তিনি সিতারা রহমান নামে পরিচিত। স্বাধিকার আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন সিতারা। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের ভেতর তিনি ছিলেন তৃতীয়। তার বাবা ইসরাইল মিয়া পেশায় ছিলেন আইনজীবী। সিতারার বড় ভাই এটিএম হায়দারও সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। তার সঙ্গেই কিশোরগঞ্জে শৈশব কাটান সিতারা বেগম। সেখান থেকে মেট্রিক পাশ করার পর হলিক্রস কলেজে থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ঢাকা মেডিকেল থেকে পাশ করার পর তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনামেডিকেলে লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগ দেন।
১৯৭০ সালের উত্তাল দিনগুলোতে সিতারা বেগম কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়োজিত ছিলেন। সেই সময় তার বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা মেজর এ.টি.এম. হায়দার পাকিস্তান থেকে কুমিল্লায় বদলি হয়ে আসেন। তিনি কুমিল্লার ৩য় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিতারা ও তার ভাই হায়দার ঈদের ছুটি পালন করার জন্য তাদের কিশোরগঞ্জের বাড়িতে যান। কিন্তু সেই সময়ে দেশ জুড়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। হায়দার তার বোনকে ক্যান্টনমেন্টে আর ফিরে না যাবার জন্য বলেন। পরবর্তীতে তিনি তার বোন সিতারা, বাবা-মা ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে ভারতে পাঠান। কিশোরগঞ্জ থেকে মেঘালয়ে পৌঁছাতে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লেগে যায়।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য মেলাঘরে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল নামে ৪৮০ শয্যার একটি হাসপাতাল ছিল। ঢাকা মেডিকেলের শেষ বর্ষের অনেক ছাত্র সেখানে ছিল। ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা সেক্টর-২ এর অধীনে সেখানের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। হাসপাতালে একটি অপারেশন থিয়েটার ছিল। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বাঙালি ছাড়াও সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লোকজন চিকিৎসাসেবা নিত।
মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা ধরে দিনের পর দিন চিকিৎসক হিসেবে এ হাসপাতালে অসাধ্য সাধন করে গেছেন সিতারা। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আসা গুলিবিদ্ধ, স্পিলন্টারের আঘাতে ঝাঁঝরা, গুরুতর জখম মুক্তিযোদ্ধাদের সারিয়ে তুলতে হতো খুব সামান্য সাধারণ ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে। ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব কেমন ছিল তা বোঝা যায় হাসপাতালের কাঠামোগত বর্ণনা থেকেই। সিতারা বেগমকে কেবল ওষুধ সংগ্রহের জন্য নিয়মিত আগরতলা যেতে হতো। তার রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিপুণ পরিচালনার ফলে বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধরত ভারতীয় সেনাকে মৃত্যুর মুখ থেকে সুস্থ করে আনা সম্ভব হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেডিওতে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার সংবাদ শুনে ঢাকা চলে আসেন ড. সিতারা। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে তার ভাই মেজর হায়দার নিহত হলে ডা. সিতারা ও তার পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী ভাবে থাকা শুরু করেন।
তারামন বিবি
স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করে। তারামন বিবি ১৯৫৭ সালে কুড়িগ্রাম জেলার চর রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবদুস সোহবান এবং মায়ের নাম কুলসুম বিবি। তারামন বিবি ১১নং সেক্টরে নিজ গ্রাম কুড়িগ্রাম জেলার শংকর মাধবপুরে ছিলেন। তখন ১১ নং সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের। মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। যিনি তারামনের গ্রামের পাশের একটি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি তারামনকে ক্যাম্পে রান্নাবান্নার জন্য নিয়ে আসেন। তখন তারামনের বয়স ছিল মাত্র ১৩ কিংবা ১৪ বছর। কিন্তু পরবর্তিতে তারামনের সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মুহিব হাবিলদার তাকে অস্ত্র চালনা শেখান। পরবর্তীতে সহকর্মীদের কাছ থেকে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদের সঙ্গে অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তার সাহসীকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯৯৫ সালের ১৯শে ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার তারামন বিবির হাতে বীরত্বের পুরস্কার হাতে তুলে দেয়।
তারামন বিবির স্বামীর নাম আবদুল মজিদ। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তিনি কুড়িগ্রামের রাজিবপুরে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। তারামন বিবি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি নিজ বাড়িতে মারা যান। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে রাজিবপুর উপজেলার কাচারীপাড়া তালতলা কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়।
কাঁকন বিবি
কাঁকন বিবি ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীরযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা ও গুপ্তচর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর বিপক্ষে মুক্তিবাহিনীর হয়ে গুপ্তচরের কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীর প্রতীক খেতাব দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। তার বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারা বাজার উপজেলার লীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে।
কাঁকন বিবির আসল নাম কাঁকাত হেনিনচিতা। আদিবাসী সম্প্রদায় খাসিয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এই বীর নারী। তার মূল বাড়ি ছিল ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে। ১৯৭০ সালে দিরাই উপজেলার শহীদ আলী নামের একজনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তার নতুন নাম হয় নুরজাহান বেগম।
১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ তিনি এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ায় তার স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য হয় এবং এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়। পরে এপ্রিল মাসে কাঁকনের সঙ্গে ইপিআর সৈনিক মজিদ খানের বিয়ে হয়।
মজিদ তখন কর্মসূত্রে সিলেট ইপিআর ক্যাম্পে থাকতেন। বিয়ের দুই মাস পর আগের স্বামীর ঘর থেকে সখিনাকে আনতে যান। মেয়েকে নিয়ে আসার পর তিনি আর স্বামী মজিদকে পান না। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন মজিদ বদলি হয়ে দোয়ারাবাজার সীমান্ত এলাকার কোন এক ক্যাম্পে আছেন।
১৯৭১ সালের জুন মাস। ঠিক করেন দোয়ারাবাজার যাবেন স্বামীকে খুঁজতে। শহীদ আলী নামের একজনের কাছে শিশুকন্যা সখিনাকে রেখে দোয়ারাবাজারের টেংরাটিলা ক্যাম্পে যান। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। দিনের পর দিন অমানুষিক পাশবিক নির্যাতন করে তাকে ছেড়ে দেয় তারা। রাগে-ক্ষোভে-দুঃখে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন মুক্তিযুদ্ধে। স্বামীকে পাবার আশাও ত্যাগ করেন। জুলাই মাসে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর শওকতের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেন। তার ওপর দায়িত্ব পড়ে গুপ্তচর হিসেবে তথ্য জোগাড়ের। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্যসংগ্রহ করেন। তার সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সফল আক্রমণ চালান।
গুপ্তচরের কাজ করতে গিয়েই দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজারে পাক বাহিনীর হাতে আবারও ধরা পড়েন তিনি। এবারে একনাগাড়ে ৭ দিন পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারেরা অমানুষিক নির্যাতন চালায়। লোহার রড গরম করে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছেঁকা দেয়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে মৃত ভেবে অজ্ঞান কাঁকন বিবিকে ফেলে রেখে যায়। জ্ঞান ফিরে আসলে তাকে উদ্ধার করে বালাট সাবসেক্টরে নিয়ে আসা হয়। সুস্থ হয়ে তিনি পুনরায় ফিরে আসেন বাংলাবাজারে।
এবার কাঁকন বিবি আরও বেশি ক্ষিপ্ত আরও বেশি দৃঢ়। এবার অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নেন মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর কাছে। প্রায় ২০টি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে টেংরাটিলায় পাক সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিলে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। মুক্তিবেটি নামে পরিচিত কাঁকন বিবি দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় ২৫ বছর পর বীর মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবিকে ১৯৯৬ সালে ‘বীর প্রতীক’ উপাধি দেয়া হয়। কিন্তু আজও তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়নি। ২০১৮ সালের ২১ মার্চ ১০৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন বীর এই মুক্তিযোদ্ধা।