‘কোথায় পালালো সত্য?/দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো.../ টেলিভিশনে বা সিনেমা বেতারে,/ নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো।’ মুখর মানুষ, তুখোড় আড্ডাবাজ কবি আসাদ চৌধুরী আজকের দিনের সত্য হারানোর মতো নিজেও হারিয়ে গেলেন, অবয়বে। তবে তিনি বেঁচে থাকবেন তার কবিতা ও সৃষ্টিতে আরও দীর্ঘ সময়। ‘তবক দেওয়া পান’ থেকে ‘সত্য ফেরারী’র মতো অসংখ্য কবিতা লিখে অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি হিসেবে খ্যাতি পান পাঠক সমাজে।
১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বাকেরগঞ্জে জন্ম নেয়া এই কবি আজ ৫ অক্টোবর কানাডার টরন্টোতে একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। এর আগে প্রায় দুই বছর যাবত তিনি প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। এর মধ্যে তিনি কানাডা-বাংলাদেশ ঘন ঘন দুই জায়গাতেই আসা যাওয়া করতেন। আসাদ চৌধুরীর জামাতা তার ফেইসবুক পোস্টে লেখেন, ‘মৃত্যু হায়নাদের মতো তার পিছু লেগেছিল অনেকদিন ধরেই। কিন্তু তিনি ছিলেন সিংহরাজ। সহজে হার মানেননি, তার নামের অর্থও তাই। সবার টান টান উত্তেজনা আর শুভ প্রত্যাশার অগণিত তারগুলো ছিঁড়ে গেছে। ঐব ষরাবফ ধ মৎবধঃ ষরভব!’
তিরিশীয় আধুনিকতার পর বাংলাদেশের ষাটের দশকের কবিতা আন্দোলন ছিল চোখে পড়ার মতো। বলা হয়, বোদলেয়ারীয় জীবনধারায় এই সময়ের কবিরা তাদের জীবনাচরণে বোহেমিয়ানিজমকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। যেমন কবি রফিক আজাদ, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, মোহাম্মদ রফিক, হেলাল হাফিজসহ আরও অনেকে। অন্যদিকে ব্যতিক্রম কবি আসাদ চৌধুরী, সিকদার আমিনুল হক ও মহাদেব সাহা। আসাদ চৌধুরী ছিলেন অত্যন্ত সদালাপী, মানুষকে মুহূর্তে কাছে টেনে নেবার মতো প্রাণবান।
কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি টেলিভিশন উপস্থাপনা ও অনুবাদ করতে পছন্দ করতেন। বিটিভিসহ বেশ কিছু বেসরকারি টেলিভিশনে তিনি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে জনপ্রিয়তা পান। উপমহাদেশের উর্দু কবিতার অসাধারণ সব অনুবাদ আমরা তার কাছ থেকেই অধিক পরিমাণে পেয়েছি। তিনি অনুবাদ করেছেন প্যালেস্টাইনের নির্বাচিত কবিতা। আসাদ চৌধুরীর কবিতা ছিল ষাটের দশকের অন্য কবিদের থেকে কিছুটা অন্য রকম। অবশ্য ঐ সময়ের প্রত্যেক কবিই তাদের স্বতন্ত্র কাব্যভাষা তৈরিতে উজ্জ্বল ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতার ঠিক আগের দশকের কবিরা পাকিস্তানি অত্যাচার-নির্যাতনের যে নির্মমতা দেখেছেন, তা দেখে কবিহৃদয় স্থির থাকতে পারেনি। রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিকের মতো কবিরা সরাসরি সম্মুখ সমরে যেমন অংশ নেন, পাশাপাশি অন্য কবিরা তাদের লেখনীর মাধ্যমে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন আসাদ চৌধুরী, যা বিশেষভাবে আলোচিত হয়।
পেশাগত জীবনে তিনি অধ্যাপনা, সাংবাদিকতা ও বাংলা একাডেমিতে চাকরি করেন।
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তবক দেয়া পান’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। অনেকটা পরিণত সময়েই। তিনি কবিতার মান ও শিল্পের নন্দনতত্ত্বের প্রশ্নে ছিলেন আপোসহীন। তাই ষাটের দশকের একজন কবির প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ-বিত্ত নাই বেসাত নাই, জলের মধ্যে লেখাজোখা, নদীও বিবস্ত্র হয়, ঘরে ফেরা সহজ নয় প্রভৃতি। প্রায় দুই ডজন শিশুসাহিত্যের বই রচনা করেন কবি আসাদ চৌধুরী। রাজার নতুন জামা (রূপান্তর), রাজা বাদশার গল্প, কেশবতী রাজকন্যা, সোনার খড়ম তার জনপ্রিয় শিশুকিশোর সাহিত্যের গ্রন্থ।
সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু, রজনীকান্ত সেননামে জীবনীগ্রন্থ রয়েছে তার। তিনি যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন-যাদের রক্তে মুক্ত এদেশ গ্রন্থটি।
গুণী ও সমৃদ্ধ এই কবি তার লেখালেখির জন্য ১৯৮৭ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১৩ সালে একুশে পদকসহ আরও অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা।
কবি আসাদ চৌধুরীর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৩
‘কোথায় পালালো সত্য?/দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো.../ টেলিভিশনে বা সিনেমা বেতারে,/ নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো।’ মুখর মানুষ, তুখোড় আড্ডাবাজ কবি আসাদ চৌধুরী আজকের দিনের সত্য হারানোর মতো নিজেও হারিয়ে গেলেন, অবয়বে। তবে তিনি বেঁচে থাকবেন তার কবিতা ও সৃষ্টিতে আরও দীর্ঘ সময়। ‘তবক দেওয়া পান’ থেকে ‘সত্য ফেরারী’র মতো অসংখ্য কবিতা লিখে অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি হিসেবে খ্যাতি পান পাঠক সমাজে।
১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বাকেরগঞ্জে জন্ম নেয়া এই কবি আজ ৫ অক্টোবর কানাডার টরন্টোতে একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। এর আগে প্রায় দুই বছর যাবত তিনি প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। এর মধ্যে তিনি কানাডা-বাংলাদেশ ঘন ঘন দুই জায়গাতেই আসা যাওয়া করতেন। আসাদ চৌধুরীর জামাতা তার ফেইসবুক পোস্টে লেখেন, ‘মৃত্যু হায়নাদের মতো তার পিছু লেগেছিল অনেকদিন ধরেই। কিন্তু তিনি ছিলেন সিংহরাজ। সহজে হার মানেননি, তার নামের অর্থও তাই। সবার টান টান উত্তেজনা আর শুভ প্রত্যাশার অগণিত তারগুলো ছিঁড়ে গেছে। ঐব ষরাবফ ধ মৎবধঃ ষরভব!’
তিরিশীয় আধুনিকতার পর বাংলাদেশের ষাটের দশকের কবিতা আন্দোলন ছিল চোখে পড়ার মতো। বলা হয়, বোদলেয়ারীয় জীবনধারায় এই সময়ের কবিরা তাদের জীবনাচরণে বোহেমিয়ানিজমকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। যেমন কবি রফিক আজাদ, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, মোহাম্মদ রফিক, হেলাল হাফিজসহ আরও অনেকে। অন্যদিকে ব্যতিক্রম কবি আসাদ চৌধুরী, সিকদার আমিনুল হক ও মহাদেব সাহা। আসাদ চৌধুরী ছিলেন অত্যন্ত সদালাপী, মানুষকে মুহূর্তে কাছে টেনে নেবার মতো প্রাণবান।
কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি টেলিভিশন উপস্থাপনা ও অনুবাদ করতে পছন্দ করতেন। বিটিভিসহ বেশ কিছু বেসরকারি টেলিভিশনে তিনি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে জনপ্রিয়তা পান। উপমহাদেশের উর্দু কবিতার অসাধারণ সব অনুবাদ আমরা তার কাছ থেকেই অধিক পরিমাণে পেয়েছি। তিনি অনুবাদ করেছেন প্যালেস্টাইনের নির্বাচিত কবিতা। আসাদ চৌধুরীর কবিতা ছিল ষাটের দশকের অন্য কবিদের থেকে কিছুটা অন্য রকম। অবশ্য ঐ সময়ের প্রত্যেক কবিই তাদের স্বতন্ত্র কাব্যভাষা তৈরিতে উজ্জ্বল ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতার ঠিক আগের দশকের কবিরা পাকিস্তানি অত্যাচার-নির্যাতনের যে নির্মমতা দেখেছেন, তা দেখে কবিহৃদয় স্থির থাকতে পারেনি। রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিকের মতো কবিরা সরাসরি সম্মুখ সমরে যেমন অংশ নেন, পাশাপাশি অন্য কবিরা তাদের লেখনীর মাধ্যমে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন আসাদ চৌধুরী, যা বিশেষভাবে আলোচিত হয়।
পেশাগত জীবনে তিনি অধ্যাপনা, সাংবাদিকতা ও বাংলা একাডেমিতে চাকরি করেন।
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তবক দেয়া পান’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। অনেকটা পরিণত সময়েই। তিনি কবিতার মান ও শিল্পের নন্দনতত্ত্বের প্রশ্নে ছিলেন আপোসহীন। তাই ষাটের দশকের একজন কবির প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ-বিত্ত নাই বেসাত নাই, জলের মধ্যে লেখাজোখা, নদীও বিবস্ত্র হয়, ঘরে ফেরা সহজ নয় প্রভৃতি। প্রায় দুই ডজন শিশুসাহিত্যের বই রচনা করেন কবি আসাদ চৌধুরী। রাজার নতুন জামা (রূপান্তর), রাজা বাদশার গল্প, কেশবতী রাজকন্যা, সোনার খড়ম তার জনপ্রিয় শিশুকিশোর সাহিত্যের গ্রন্থ।
সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু, রজনীকান্ত সেননামে জীবনীগ্রন্থ রয়েছে তার। তিনি যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন-যাদের রক্তে মুক্ত এদেশ গ্রন্থটি।
গুণী ও সমৃদ্ধ এই কবি তার লেখালেখির জন্য ১৯৮৭ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১৩ সালে একুশে পদকসহ আরও অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা।
কবি আসাদ চৌধুরীর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন।