ফেইসবুক পোস্টে জানালেন সমন্বয়ক আবদুল কাদের
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিবির নেতার পরামর্শে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ৯ দফা দাবি উত্থাপন করেছিল। ইন্টারনেটবিহীন ওই সময়টায় গোলাগুলি-কারফিউয়ের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সশরীরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ওই দাবি পৌঁছে দেয়া, বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থাও শিবিরকর্মীরাই করেছেন। এই ৯ দফা দাবির পথ ধরেই আসে সরকার পতনের একদফা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল কাদের নিজের ফেইসবুকে পোস্টে এ তথ্য প্রকাশ করেছেন।
শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতেই সীমাবদ্ধ ছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। তবে ১৬ জুলাই বিক্ষোভে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু সাঈদসহ ৬ জন নিহত হওয়ার রাতে আন্দোলনের সমন্বয়করা অনলাইন বৈঠক করে আন্দোলনটি কেবল কোটা সংস্কারের দাবিতে সীমিত না রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
কাদের তার পোস্টে লেখেন, এরপর যে ৯ দফা দাবি সামনে আনা হয়, সেটি ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখার সাধারণ সম্পাদকের পরামর্শে করা হয়।
পোস্টে তিনি শিবির সেক্রেটারির নাম বলেন ‘ফরহাদ’। ঢাবি সূত্রে জানা যায়, শিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল (মহাসচিব) পদে যিনি আছেন তার নাম এস এম ফরহাদ। তিনি ঢাবির সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন।
শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদিক কায়েম নিজের পরিচয় প্রকাশের পরদিন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদের পরিচয় প্রকাশ করলেন কাদের।
শনিবার ঢাবি প্রশাসনের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় যোগ দিয়ে সাদিক কায়েম নিজেকে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাবি শাখার সভাপতি হিসেবে পরিচয় দিয়ে বক্তব্য রাখেন।
রোববার একটি গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটিতে কারা আছেন দ্রুতই তা প্রকাশ কর হবে। গত দেড় দশক আওয়ামী লীগ সরকারের নিপীড়নে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা গোপনে রাজনীতি করতে বাধ্য হয়েছেন বলেও জানান তিনি।
শিবিরের সঙ্গে যোগাযোগ যেভাবে
শিবিরের সঙ্গে যোগাযোগ কীভাবে হলো, ফেইসবুক পোস্টে সেটিও তুলে ধরেন সমন্বয়ক আবদুল কাদের। তিনি জানান, বর্তমান তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম তাকে ডেকে নিয়ে একজনের সঙ্গে পরিচয় করান এবং পরে আন্দোলনের জন্য একাধিকবার তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়।
আবদুল কাদের পোস্টে লেখেন, ‘পরবর্তীতে জানতে পারি তিনি ঢাবি শিবিরের ছাত্র আন্দোলনবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু তখনও শিবিরের সভাপতি এবং সেক্রেটারির সঙ্গে ওইভাবে যোগাযোগ হয় নাই।’
৯ দফার নেপথ্যে
‘৯ দফা’ তৈরির নেপথ্যের কাহিনী তুলে ধরে সমন্বয়ক আবদুল কাদের ফেইসবুক পোস্টে লিখেন, ‘৯ দফা প্রচার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল শিবির। যেহেতু নেট নাই, গোলাগুলি-কারফিউয়ের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সশরীরে হাউজে হাউজে পৌঁছে দিয়েছে, বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা তারাই করেছে।’
কেবল কোটার দাবিতে না
১৬ জুলাই বিক্ষোভে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু সাঈদসহ ৬ জন নিহত হওয়ার রাতে সমন্বয়করা একটা অনলাইন বৈঠক করে আন্দোলনটি কেবল কোটা সংস্কারের দাবিতে সীমিত না রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
আবদুল কাদের পোস্টে লেখেন, ‘তখন সবাই হই হই করে বলে উঠে, ছয়টা লাশের বিনিময়ে শুধু কোটা সংস্কার হতে পারে না। পরবর্তীতে দীর্ঘক্ষণ আলাপ আলোচনা করা হয়। এই আলোচনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিসহ আরও কিছু দাবি দাওয়া উঠে আসে।’
১ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘বাংলা ব্লকেড’ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেয়াসহ নানা কর্মসূচি দিলেও সরকারের পক্ষ থেকে একেবারে ‘নির্বিকার-নির্লিপ্ত’ মনোভাব দেখার কথাও তুলে ধরেন কাদের।
তিনি লেখেন, ‘আলাপ-আলোচনার ধার ধারে নাই সরকার। কেবল হাইকোর্টের কাঁধে বন্দুক রেখে চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি যখন বেগতিক হয়ে যায়, ৬ জন শহীদ হয়, ওই দিনই সরকার আলোচনার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দেয়, আমাদেরকে বিভিন্ন মাধ্যমে চাপ দিতে থাকে আলোচনায় বসার জন্য। কিন্তু আমরা আলোচনার আহ্বানকে বরাবরের মতোই প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করি। যদিও ভেতর-বাইর থেকে আলোচনায় বসার নানারকম চাপ আসছিল।’
১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়েবানা জানাজায় পুলিশ গুলি চালালে কাদেরসহ কয়েকজন আহত হন। গুলিবিদ্ধ হন হান্নান মাসউদ। কাদের লেখেন, ‘তখন থেকেই আমরা আন্দোলন পরিচালনা করে যাওয়ার স্বার্থে কৌশলী অবস্থান নিয়ে গ্রেপ্তার এড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই।’
১৮ জুলাই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির দিন কাদের ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এক বাসা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্যে চলে যান। সেই রাতেই ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। তখন কর্মসূচি চালিয়ে যেতে, গ্রেপ্তার এড়াতে বার বার জায়গা পরিবর্তন করতে থাকেন কাদেররা। কারও সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগ করতে পারছিলেন না।
কাদেরে পোস্টে লেখেন, ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ী এলাকায় আন্দোলন করার সময় শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সেক্রেটারি ফরহাদ তাকে ফোন দিয়ে বলেন, ‘আন্দোলনরত কয়েকজন সমন্বয়ক সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে যাচ্ছে। ফরহাদ বলেন, এত এত শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করতেছে তারা, আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে। কিছু দাবি-দাওয়া দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, মানুষের সাথে বেইমানি করা যাবে না।’
ফরহাদের বক্তব্যে সম্মতি দেন কাদের। পোস্টে তিনি লেখেন, ‘আমাদের তো আগেই অবস্থান ছিল আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার। তাছাড়া মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) রাতের মিটিংয়ে ঠিক করা কিছু দাবি দাওয়া আমার মাথায় আছে।’
সে আন্দোলন চালিয়ে নেয়ার মতো নেতারা মাঠে ছিলেন না। আসিফ-নাহিদকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না তারা।
কাদের লেখেন, ‘আমি সাত-পাঁচ না ভেবে রিস্ক নেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ওইদিন জুমার নামাজের পর পরই যাত্রাবাড়ীতে কয়েকজন শহীদ হয়, সবগুলা আমার চোখের সামনেই ঘটতেছে। মানুষকে ‘পাখির মতো’ গুলি করে মেরে ফেলতেছে, এটা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারতেছিলাম না।’
কিছুক্ষণ পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সেক্রেটারি তাকে আবারও ফোন দিয়ে বলেন, ‘কিছু দাবি দাওয়া খসড়া আকারে করছি, তোমার সাথে আলোচনা করি’।
কাদের লেখেন, ‘আমাদেরও যেহেতু আগেই আলোচনা হয়েছিল অনেকগুলো দাবির ব্যাপারে। সেগুলো তখন উনার সাথে আলোচনা করে সমন্বিতভাবে তৈরি হয় ৯ দফা।’
শিবির নেতা ফরহাদ সেদিন একে একে কিছু দাবি বলেন
কাদেরের ভাষ্য, ‘যেগুলা খুব কমন দাবি-দাওয়া, যেমন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ, ছাত্র হত্যার সঙ্গে জড়িত পুলিশ প্রশাসনকে বরখাস্ত, সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় আনা, ভিসির পদত্যাগ। যেগুলা ৬ জন শহীদ হওয়ার পরে মঙ্গলবার রাতের বৈঠকের আলোচনাতেই আমরা ভেবেছিলাম। এছাড়া মানুষজনও সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন কিছু দাবি-দাওয়া জানিয়ে আসছিল।’
পোস্টে কাদের লেখেন, ‘শেষের দিকে গিয়ে শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেক্রেটারি একটা দাবি যোগ করেন- ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।’ তবে কাদের এর বিরাধিতা করেন। দীর্ঘক্ষণ এটা নিয়ে আলোচনা হয়। পরে কাদের বলেন, ঢালাওভাবে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা যাবে না, এক্ষেত্রে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলা যেতে পারে। পরে ঠিক হয়, ‘লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।’
শিবিরের পরামর্শে নতুন ফোন ও সিম
সমন্বয়ক আবদুল কাদের জানান, এরপর শিবির তাকে নতুন একটা সিম এবং মোবাইল ফোন সংগ্রহ করার পরামর্শ দেয়।
তিনি লেখেন, ‘আমি স্টুডেন্টের বাসা থেকে সিম নিয়ে ওই নম্বরটা ৯ দফা সংবলিত প্রেস বিজ্ঞপ্তির সাথে দিয়ে দিলাম। ওইদিন সন্ধ্যায় বাসা থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরে হেঁটে গিয়ে পরিচিত সাংবাদিকদেরকে ফোন দিয়ে ৯ দফার বিষয়টা জানাইলাম।’
‘টুকটাক ছাত্র রাজনীতি করার সুবাদে’ ক্যাম্পাসের সেই সাংবাদিকদের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। হাতের বাটন ফোন দিয়ে মেসেজ করে একটা একটা করে দফা লিখে সেই সংবাদকর্মীকে পাঠান কাদের। কাউকে আবার মুখে বলেছেন। বিদেশি সংবাদ মাধ্যমগুলোর সঙ্গেও সেই রাতে কথা বলেন তিনি। এরপর থেকে প্রতিদিন রাতের বেলায় বাসা থেকে দূরে চলে যেতেন। ফোন অন করে সাংবাদিকদের সঙ্গে ২-৩ ঘণ্টা কথা বলে আবার ফোন বন্ধ করে বাসায় ফিরতেন।
এই সমন্বয়ক লেখেন, ‘আমার বাসা ছিল যাত্রাবাড়ী থানার পাশেই। গ্রেপ্তারের আতঙ্ক, তারপরও বাসায় থাকতে হতো। শুরুতেই যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। কোনো রাত মসজিদে কাটাইছি, কোনো রাত অর্ধেকটা বাইরে কিংবা বাসার ছাদে কাটিয়ে শেষ রাতে বাসায় ফিরেছি।’
৩ আগস্ট একদফা দাবিতে অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণার তৃতীয় দিনেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করেন শেখ হাসিনা।
কাদের তার পোস্টে লেখেন, এই তো ঐতিহাসিক ৯ দফা, আমাদের ৯ দফা, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা’ থেকে মুক্তি লাভের সনদ।
ফেইসবুক পোস্টে জানালেন সমন্বয়ক আবদুল কাদের
মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিবির নেতার পরামর্শে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ৯ দফা দাবি উত্থাপন করেছিল। ইন্টারনেটবিহীন ওই সময়টায় গোলাগুলি-কারফিউয়ের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সশরীরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ওই দাবি পৌঁছে দেয়া, বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থাও শিবিরকর্মীরাই করেছেন। এই ৯ দফা দাবির পথ ধরেই আসে সরকার পতনের একদফা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল কাদের নিজের ফেইসবুকে পোস্টে এ তথ্য প্রকাশ করেছেন।
শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতেই সীমাবদ্ধ ছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। তবে ১৬ জুলাই বিক্ষোভে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু সাঈদসহ ৬ জন নিহত হওয়ার রাতে আন্দোলনের সমন্বয়করা অনলাইন বৈঠক করে আন্দোলনটি কেবল কোটা সংস্কারের দাবিতে সীমিত না রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
কাদের তার পোস্টে লেখেন, এরপর যে ৯ দফা দাবি সামনে আনা হয়, সেটি ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখার সাধারণ সম্পাদকের পরামর্শে করা হয়।
পোস্টে তিনি শিবির সেক্রেটারির নাম বলেন ‘ফরহাদ’। ঢাবি সূত্রে জানা যায়, শিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল (মহাসচিব) পদে যিনি আছেন তার নাম এস এম ফরহাদ। তিনি ঢাবির সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন।
শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদিক কায়েম নিজের পরিচয় প্রকাশের পরদিন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদের পরিচয় প্রকাশ করলেন কাদের।
শনিবার ঢাবি প্রশাসনের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় যোগ দিয়ে সাদিক কায়েম নিজেকে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাবি শাখার সভাপতি হিসেবে পরিচয় দিয়ে বক্তব্য রাখেন।
রোববার একটি গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটিতে কারা আছেন দ্রুতই তা প্রকাশ কর হবে। গত দেড় দশক আওয়ামী লীগ সরকারের নিপীড়নে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা গোপনে রাজনীতি করতে বাধ্য হয়েছেন বলেও জানান তিনি।
শিবিরের সঙ্গে যোগাযোগ যেভাবে
শিবিরের সঙ্গে যোগাযোগ কীভাবে হলো, ফেইসবুক পোস্টে সেটিও তুলে ধরেন সমন্বয়ক আবদুল কাদের। তিনি জানান, বর্তমান তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম তাকে ডেকে নিয়ে একজনের সঙ্গে পরিচয় করান এবং পরে আন্দোলনের জন্য একাধিকবার তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়।
আবদুল কাদের পোস্টে লেখেন, ‘পরবর্তীতে জানতে পারি তিনি ঢাবি শিবিরের ছাত্র আন্দোলনবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু তখনও শিবিরের সভাপতি এবং সেক্রেটারির সঙ্গে ওইভাবে যোগাযোগ হয় নাই।’
৯ দফার নেপথ্যে
‘৯ দফা’ তৈরির নেপথ্যের কাহিনী তুলে ধরে সমন্বয়ক আবদুল কাদের ফেইসবুক পোস্টে লিখেন, ‘৯ দফা প্রচার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল শিবির। যেহেতু নেট নাই, গোলাগুলি-কারফিউয়ের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সশরীরে হাউজে হাউজে পৌঁছে দিয়েছে, বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা তারাই করেছে।’
কেবল কোটার দাবিতে না
১৬ জুলাই বিক্ষোভে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু সাঈদসহ ৬ জন নিহত হওয়ার রাতে সমন্বয়করা একটা অনলাইন বৈঠক করে আন্দোলনটি কেবল কোটা সংস্কারের দাবিতে সীমিত না রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
আবদুল কাদের পোস্টে লেখেন, ‘তখন সবাই হই হই করে বলে উঠে, ছয়টা লাশের বিনিময়ে শুধু কোটা সংস্কার হতে পারে না। পরবর্তীতে দীর্ঘক্ষণ আলাপ আলোচনা করা হয়। এই আলোচনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিসহ আরও কিছু দাবি দাওয়া উঠে আসে।’
১ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘বাংলা ব্লকেড’ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেয়াসহ নানা কর্মসূচি দিলেও সরকারের পক্ষ থেকে একেবারে ‘নির্বিকার-নির্লিপ্ত’ মনোভাব দেখার কথাও তুলে ধরেন কাদের।
তিনি লেখেন, ‘আলাপ-আলোচনার ধার ধারে নাই সরকার। কেবল হাইকোর্টের কাঁধে বন্দুক রেখে চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি যখন বেগতিক হয়ে যায়, ৬ জন শহীদ হয়, ওই দিনই সরকার আলোচনার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দেয়, আমাদেরকে বিভিন্ন মাধ্যমে চাপ দিতে থাকে আলোচনায় বসার জন্য। কিন্তু আমরা আলোচনার আহ্বানকে বরাবরের মতোই প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করি। যদিও ভেতর-বাইর থেকে আলোচনায় বসার নানারকম চাপ আসছিল।’
১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়েবানা জানাজায় পুলিশ গুলি চালালে কাদেরসহ কয়েকজন আহত হন। গুলিবিদ্ধ হন হান্নান মাসউদ। কাদের লেখেন, ‘তখন থেকেই আমরা আন্দোলন পরিচালনা করে যাওয়ার স্বার্থে কৌশলী অবস্থান নিয়ে গ্রেপ্তার এড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই।’
১৮ জুলাই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির দিন কাদের ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এক বাসা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্যে চলে যান। সেই রাতেই ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। তখন কর্মসূচি চালিয়ে যেতে, গ্রেপ্তার এড়াতে বার বার জায়গা পরিবর্তন করতে থাকেন কাদেররা। কারও সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগ করতে পারছিলেন না।
কাদেরে পোস্টে লেখেন, ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ী এলাকায় আন্দোলন করার সময় শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সেক্রেটারি ফরহাদ তাকে ফোন দিয়ে বলেন, ‘আন্দোলনরত কয়েকজন সমন্বয়ক সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে যাচ্ছে। ফরহাদ বলেন, এত এত শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করতেছে তারা, আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে। কিছু দাবি-দাওয়া দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, মানুষের সাথে বেইমানি করা যাবে না।’
ফরহাদের বক্তব্যে সম্মতি দেন কাদের। পোস্টে তিনি লেখেন, ‘আমাদের তো আগেই অবস্থান ছিল আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার। তাছাড়া মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) রাতের মিটিংয়ে ঠিক করা কিছু দাবি দাওয়া আমার মাথায় আছে।’
সে আন্দোলন চালিয়ে নেয়ার মতো নেতারা মাঠে ছিলেন না। আসিফ-নাহিদকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না তারা।
কাদের লেখেন, ‘আমি সাত-পাঁচ না ভেবে রিস্ক নেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ওইদিন জুমার নামাজের পর পরই যাত্রাবাড়ীতে কয়েকজন শহীদ হয়, সবগুলা আমার চোখের সামনেই ঘটতেছে। মানুষকে ‘পাখির মতো’ গুলি করে মেরে ফেলতেছে, এটা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারতেছিলাম না।’
কিছুক্ষণ পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সেক্রেটারি তাকে আবারও ফোন দিয়ে বলেন, ‘কিছু দাবি দাওয়া খসড়া আকারে করছি, তোমার সাথে আলোচনা করি’।
কাদের লেখেন, ‘আমাদেরও যেহেতু আগেই আলোচনা হয়েছিল অনেকগুলো দাবির ব্যাপারে। সেগুলো তখন উনার সাথে আলোচনা করে সমন্বিতভাবে তৈরি হয় ৯ দফা।’
শিবির নেতা ফরহাদ সেদিন একে একে কিছু দাবি বলেন
কাদেরের ভাষ্য, ‘যেগুলা খুব কমন দাবি-দাওয়া, যেমন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ, ছাত্র হত্যার সঙ্গে জড়িত পুলিশ প্রশাসনকে বরখাস্ত, সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় আনা, ভিসির পদত্যাগ। যেগুলা ৬ জন শহীদ হওয়ার পরে মঙ্গলবার রাতের বৈঠকের আলোচনাতেই আমরা ভেবেছিলাম। এছাড়া মানুষজনও সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন কিছু দাবি-দাওয়া জানিয়ে আসছিল।’
পোস্টে কাদের লেখেন, ‘শেষের দিকে গিয়ে শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেক্রেটারি একটা দাবি যোগ করেন- ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।’ তবে কাদের এর বিরাধিতা করেন। দীর্ঘক্ষণ এটা নিয়ে আলোচনা হয়। পরে কাদের বলেন, ঢালাওভাবে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা যাবে না, এক্ষেত্রে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলা যেতে পারে। পরে ঠিক হয়, ‘লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।’
শিবিরের পরামর্শে নতুন ফোন ও সিম
সমন্বয়ক আবদুল কাদের জানান, এরপর শিবির তাকে নতুন একটা সিম এবং মোবাইল ফোন সংগ্রহ করার পরামর্শ দেয়।
তিনি লেখেন, ‘আমি স্টুডেন্টের বাসা থেকে সিম নিয়ে ওই নম্বরটা ৯ দফা সংবলিত প্রেস বিজ্ঞপ্তির সাথে দিয়ে দিলাম। ওইদিন সন্ধ্যায় বাসা থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরে হেঁটে গিয়ে পরিচিত সাংবাদিকদেরকে ফোন দিয়ে ৯ দফার বিষয়টা জানাইলাম।’
‘টুকটাক ছাত্র রাজনীতি করার সুবাদে’ ক্যাম্পাসের সেই সাংবাদিকদের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। হাতের বাটন ফোন দিয়ে মেসেজ করে একটা একটা করে দফা লিখে সেই সংবাদকর্মীকে পাঠান কাদের। কাউকে আবার মুখে বলেছেন। বিদেশি সংবাদ মাধ্যমগুলোর সঙ্গেও সেই রাতে কথা বলেন তিনি। এরপর থেকে প্রতিদিন রাতের বেলায় বাসা থেকে দূরে চলে যেতেন। ফোন অন করে সাংবাদিকদের সঙ্গে ২-৩ ঘণ্টা কথা বলে আবার ফোন বন্ধ করে বাসায় ফিরতেন।
এই সমন্বয়ক লেখেন, ‘আমার বাসা ছিল যাত্রাবাড়ী থানার পাশেই। গ্রেপ্তারের আতঙ্ক, তারপরও বাসায় থাকতে হতো। শুরুতেই যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। কোনো রাত মসজিদে কাটাইছি, কোনো রাত অর্ধেকটা বাইরে কিংবা বাসার ছাদে কাটিয়ে শেষ রাতে বাসায় ফিরেছি।’
৩ আগস্ট একদফা দাবিতে অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণার তৃতীয় দিনেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করেন শেখ হাসিনা।
কাদের তার পোস্টে লেখেন, এই তো ঐতিহাসিক ৯ দফা, আমাদের ৯ দফা, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা’ থেকে মুক্তি লাভের সনদ।