alt

ব্রাহ্মণবাড়িয়া: বিভক্ত বিএনপি, আধিপত্য তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারীর ভাইয়ের

মোহাম্মদ সাব্বির, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফিরে : মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপি এখন স্পষ্টতই দুই ভাগে বিভক্ত। দলীয় কর্মসূচি থেকে শুরু করে সাংগঠনিক কার্যক্রম সবকিছুই আলাদাভাবে চলছে। এই বিভাজন শুধু জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মাঝেও। ফলে প্রায়শই সংঘর্ষ ও উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।

একটি পক্ষের নেতৃত্বে আছেন কেন্দ্রীয় বিএনপির অর্থনীতিবিষয়ক সম্পাদক এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের একাধিকবারের প্রার্থী খালেদ হোসেন মাহবুব (শ্যামল)। তার সঙ্গে আছেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি,সাধারণ সম্পাদকসহ সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের একটি অংশ। আর অন্য পক্ষের নেতৃত্বে তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী আবদুর রহমান সানির বড় ভাই সদ্য ঘোষিত জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য কবির আহমেদ ও বর্তমান কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবসহ ২৬ জন।

জেলা বিএনপির অভ্যন্তরীণ এই দ্বন্দ্বের কারণে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। গত ১৮ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা বিএনপির সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। পরে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। এর আগে ২০২৩ সালের আগস্টে জেলা বিএনপির ৫ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষর ঘটনা ঘটে। একই বছরের জুনে ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি গঠন নিয়ে সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ, এবং গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে, মামলাও হয়েছে কয়েকটি।

গত ৪ নভেম্বর জেলা বিএনপির ৩২ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর প্রতিবাদে ৬ নভেম্বর দুপুরে জেলা শহরের কান্দিপাড়ায় এক সংবাদ সম্মেলনে এই কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি গঠন করার দাবি জানিয়েছেন জেলা বিএনপির একাংশের নেতা- কর্মীরা।

কেন এই বিভক্তি,দ্বন্দ্ব ?

এক সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিএনপির ঘাটি হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৯১, ১৯৯৬, ১৯৯৬, ২০০১ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির প্রার্থী হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসন (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর-বিজয়নগর) থেকে হারুন আল রশিদ টানা চারবার নির্বাচিত হয়েছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন (সরাইল-আশুগঞ্জ) থেকে ১৯৯১,১৯৯৬, ১৯৯৬,২০১৮ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হয়ে আবদুস সাত্তার ভূইঞা নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এই আসনটি তাদের জোট সঙ্গী ইসলামী ঐক্যজোটের ফজলুল হক আমিনী জন্য ছেড়ে দেন। তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ থেকে আওয়ামী লীগের লুৎফুল হাই সাচ্চু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর ২০১১ উপ-নির্বাচনের আওয়ামী লীগের র. আ. ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর সাথে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন খালেদ হোসেন মাহবুব (শ্যামল)। তখন থেকেই শ্যামলের উত্থান । শ্যামল,জেলা বিএনপির সভাপতি হাফিজুর রহমান মোল্লা (কচি) ও সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম খোকন এই ত্রয়ী নেতৃত্বে মোটামুটি একাট্টা ছিল জেলা বিএনপি।

তাহলে বিভক্তির শুরু কবে থেকে ?

২০২০ সালে ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৩১ সদস্য বিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কমিটি অনুমোদন দেন। কমিটিতে বিলুপ্ত হওয়া জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি জিল্লুর রহমান জিল্লুকে আহবায়ক করা হয়। তখন থেকেই শুরু হয় বিভক্তি, তখন আলোচনা শুরু হয় জিল্লুর রহমান জিল্লু আহবায়ক হওয়ার পেছনে কেউ একজন আছেন, তিনি কে? তারপর বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনের কমিটি নিয়ে বিরোধ বাড়তে থাকে নেতাকর্মীদের মাঝে। আলোচনা শুরু হয় কমিটি হচ্ছে একজনের ইশারায়, কে তিনি? তখন সামনে আসে একটি নাম কবির আহমেদ, কে এই কবির আহমেদ? কবির আহমেদ তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী আবদুর রহমান সানির বড় ভাই। পদের আশায় নেতাকর্মীদের ভিড় জমতে থাকে কবির আহমেদের কাছে।

২০২৩ সালের ১০ আগস্ট জেলা বিএনপির পাঁচ সদস্যের আংশিক আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। ওই পাঁচ সদস্যের কমিটি এরপর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর ২০২৩ সালের ১১ আগস্ট বিকেলে শহরের নিউ মৌড়াইল এলাকায় সভা করে জেলা বিএনপির ঘোষিত পাঁচ সদস্যের আংশিক আহ্বায়ক কমিটিকে ‘বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য’ উল্লেখ করে সাত দিনের মধ্যে বিলুপ্ত ঘোষণার দাবি জানান বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।

এক পক্ষে সাবেক সভাপতি মোল্লা কচি ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক জহিরুল। অন্য পক্ষে কবির আহমদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত আবদুল মান্নান, সিরাজুল ইসলাম ও নূরে আলম সিদ্দিকীর নেতৃত্বে বিএনপির আরেক অংশ। কমিটি ঘোষণার পর দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এরপর থেকে দুই পক্ষই পৃথকভাবে দলীয় সব কর্মসূচি পালন করে আসছে।

কবির আহমেদের প্রভাব এবং বিতর্ক:

কবির আহমেদ আখাউড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন ১৯৯৭ সালে। বিএনপির রাজনীতিতে তার সরাসরি সম্পৃক্ততার অতীত নেই বলে নেতাকর্মীদের অভিযোগ। তবে ভাইয়ের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে তিনি জেলা বিএনপির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। নতুন কমিটির সদস্য হলেও নেতৃত্বের নাটাই তার হাতেই বলছেন জেলা বিএনপির সবাই। শোনা যাচ্ছে, তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসন (আখাউড়া-কসবা) থেকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হতে চান।

সদ্য ঘোষিত ৩২ সদস্যের জেলা আহ্বায়ক কমিটিতে কবিরপন্থী ২৬ জনের জায়গা হয়েছে, সেখানে শ্যামলপন্থী মাত্র ৬ জন। এমনকি বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বিজয়নগরের কোনো নেতা কমিটিতে স্থান পাননি।

তাছাড়া, জেলা ছাত্রদল, সেচ্ছাসেবকদল, সরাইল উপজেলা বিএনপি এবং নাসিরনগন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি এবং সবশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা বিএনপির কমিটিতেও কবির অনুসারী হিসেবে পরিচিতরাই পদ-পদবি পেয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘কবির যা বলেন, সেটাই হচ্ছে। যারা তার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তারা কোনো পদ পাননি। ত্যাগী নেতাদের উপেক্ষা করা হচ্ছে, যা দলের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।’

কে কোন দিকে ছুটবেন দোটানায় এখন অনেক নেতা। নতুন করে যত কমিটিই হচ্ছে সব গুলোতেই পদ-পদবির বেশী অংশ পাচ্ছেন কবির অনুসারীরাই। তাই এখন অনেক নেতাই নিরব, কিছুদিন আগেও যারা কবিরের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। এখন সংবাদ মাধ্যমের সাথে নাম প্রকাশ করে এই বিষয়ে কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না।

কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরও অস্বস্তি:

কেন্দ্রীয় বিএনপির আর্ন্তজাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক রুমিন ফারহানার ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন (সরাইল-আশুগঞ্জ) থেকে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু আপত্তি সরাইল উপজেলা বিএনপির এক অংশের ।

কবিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত সরাইল উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান লস্কর বলেন, ‘উপজেলা বিএনপি পরিবার বহিরাগত কাউকে গ্রহণ করবে না। আমি নিজেও একজন প্রার্থী। আমরা চাই, এলাকার কাউকে প্রার্থী করা হোক। আমি শতভাগ নিশ্চিত, দল এখানে কোনো নারী প্রার্থী দেবে না।’

তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদে রুমিন ফারহানা এক কর্মীসভায় বলেন,‘আমি এক বাপের বাচ্চা হলে সরাইল থেকেই নির্বাচন করবো।’ নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আমার হাতকে শক্তিশালী করুন তাহলে বেগম খালেদা জিয়ার হাত শক্তিশালি হবে, তারেক রহমানের হাত শক্তিশালী হবে।’

নেতা-কর্মীদের বিরোধ দূর না করেই প্রায় ১৫ মাস পর গত ৪ নভেম্বর জেলা বিএনপির ৩২ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। আগের পাঁচ সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবকে নতুন আহ্বায়ক কমিটিতে অপরিবর্তিত রাখায় ক্ষোভ বঞ্চিতদের। ২৮ ডিসেম্বর এই আহ্বায়ক কমিটি সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করছেন, দলের অভ্যন্তরীণ বিভক্তি নিরসনে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এটি আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির জন্য বড় সংকট হয়ে উঠতে পারে।

ছবি

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোট প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলো

ছবি

রাজশাহীতে এনসিপি নেত্রীর আকস্মিক পদত্যাগ

ছবি

জামায়াতসহ কয়েক দলের যুগপৎ আন্দোলনের জবাব রাজপথেই দেবে বিএনপি: সালাহউদ্দিন

ছবি

খালেদা জিয়ার ভাগ্নে শাহরিনকে আহ্বায়ক করে এইবির নতুন কমিটি

ছবি

নাশকতার দুই মামলা থেকে ফখরুল ও আব্বাসসহ ১০৬ জনকে অব্যাহতি

ছবি

এখন কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়তে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে: মির্জা ফখরুল

ছবি

অভিন্ন দাবিতে তিন ইসলামী দলের যুগপৎ কর্মসূচি ঘোষণা

ছবি

যুগপতে পাঁচ দাবিতে জামায়াতের তিন দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা

ছবি

চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৫ সনাতন যোগ দিলেন জামায়াতে

ছবি

তারেকের নিরাপত্তা নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বাবরের আলোচনা

ছবি

যুগপতে কারা থাকছে ঠিক হয়নি, তবে খেলাফতের কর্মসূচি ঘোষণা

জামায়াতের আযাদ: মুক্তিযুদ্ধ না মানলে ‘বাংলাদেশ অস্বীকার করা হবে’

ছবি

জুলাই সনদের গেরো: এবার আদালতের মত নিতে বলল বিএনপি

ছবি

‘জুলাই সনদ’ স্বাক্ষরে রাজি বিএনপি, তবে আইনি ভিত্তি নিয়ে মতভেদ

ছবি

ডাকসু-জাকসু নির্বাচনে ‘মাস্টার প্ল্যান’ প্রশ্ন তুললেন রিজভী

ছবি

মৌলবাদীরা ‘বেহেশতের টিকেট’ বিক্রি করছে: বিএনপির গয়েশ্বর

ছবি

সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের দাবি

ছবি

জুলাই সনদ বাস্তবায়নসহ ৫ দফা দাবিতে খেলাফত মজলিসের তিন দিনের কর্মসূচি

ছবি

সাবেক প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান এবার তুহিন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার

ছবি

রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে বাস্তুতন্ত্রও নিরাপদ থাকবে: তারেক রহমান

ছবি

সরকার ও উপদেষ্টারা মাহফুজদের যথেচ্ছ ব্যবহার করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে: নাহিদ ইসলাম

ছবি

দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে পশু-পাখি ও বাস্তুতন্ত্রের অধিকার নিশ্চিত হবে: তারেক রহমান

ছবি

বসুন্ধরায় গোপন বৈঠক: ময়মনসিংহ জেলা আ.লীগ নেতার দোষ স্বীকার

ছবি

ঢাকার আগারগাঁওয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ‘নিষিদ্ধ’ আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ মিছিল

ছবি

আওয়ামী লীগ লুটপাট করে দেশকে দেউলিয়া করে দিয়েছে: মঈন খান

ছবি

ইসরায়েলের ওপর চাপ বাড়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি তারেকের আহ্বান

ছবি

বাংলাদেশের সংবিধানে শ্রমিক, জনতার অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি: এনসিপি

ছবি

নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলেই দেশে ফিরবেন তারেক রহমান: মিন্টু

ছবি

জাতীয় নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র চলছে: বিএনপি

ছবি

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে গাজীপুরে সমাবেশ ও গণমিছিল করেছে ইসলামিক আন্দোলন

ছবি

নির্বাচনের আগে পরিবেশ সৃষ্টি জরুরি: আনিসুল ইসলাম মাহমুদ

ছবি

সংবিধান সংশোধন: মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়ন পদ্ধতিতে ভিন্নমত রাজনৈতিক দলগুলোর

ছবি

বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচন হলে দেশের সংকট আরও বাড়বে: আনিসুল ইসলাম

ছবি

‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নে কোনো কিছু চাপিয়ে দেবে না কমিশন: আলী রীয়াজ

ছবি

ডাকসু জয়ে ছাত্র শিবিরকে অভিনন্দন পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর

ছবি

এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ পদত্যাগ ঘোষণা

tab

ব্রাহ্মণবাড়িয়া: বিভক্ত বিএনপি, আধিপত্য তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারীর ভাইয়ের

মোহাম্মদ সাব্বির, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফিরে

মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপি এখন স্পষ্টতই দুই ভাগে বিভক্ত। দলীয় কর্মসূচি থেকে শুরু করে সাংগঠনিক কার্যক্রম সবকিছুই আলাদাভাবে চলছে। এই বিভাজন শুধু জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মাঝেও। ফলে প্রায়শই সংঘর্ষ ও উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।

একটি পক্ষের নেতৃত্বে আছেন কেন্দ্রীয় বিএনপির অর্থনীতিবিষয়ক সম্পাদক এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের একাধিকবারের প্রার্থী খালেদ হোসেন মাহবুব (শ্যামল)। তার সঙ্গে আছেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি,সাধারণ সম্পাদকসহ সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের একটি অংশ। আর অন্য পক্ষের নেতৃত্বে তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী আবদুর রহমান সানির বড় ভাই সদ্য ঘোষিত জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য কবির আহমেদ ও বর্তমান কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবসহ ২৬ জন।

জেলা বিএনপির অভ্যন্তরীণ এই দ্বন্দ্বের কারণে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। গত ১৮ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা বিএনপির সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। পরে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। এর আগে ২০২৩ সালের আগস্টে জেলা বিএনপির ৫ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষর ঘটনা ঘটে। একই বছরের জুনে ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি গঠন নিয়ে সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ, এবং গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে, মামলাও হয়েছে কয়েকটি।

গত ৪ নভেম্বর জেলা বিএনপির ৩২ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর প্রতিবাদে ৬ নভেম্বর দুপুরে জেলা শহরের কান্দিপাড়ায় এক সংবাদ সম্মেলনে এই কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি গঠন করার দাবি জানিয়েছেন জেলা বিএনপির একাংশের নেতা- কর্মীরা।

কেন এই বিভক্তি,দ্বন্দ্ব ?

এক সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিএনপির ঘাটি হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৯১, ১৯৯৬, ১৯৯৬, ২০০১ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির প্রার্থী হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসন (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর-বিজয়নগর) থেকে হারুন আল রশিদ টানা চারবার নির্বাচিত হয়েছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন (সরাইল-আশুগঞ্জ) থেকে ১৯৯১,১৯৯৬, ১৯৯৬,২০১৮ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হয়ে আবদুস সাত্তার ভূইঞা নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এই আসনটি তাদের জোট সঙ্গী ইসলামী ঐক্যজোটের ফজলুল হক আমিনী জন্য ছেড়ে দেন। তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ থেকে আওয়ামী লীগের লুৎফুল হাই সাচ্চু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর ২০১১ উপ-নির্বাচনের আওয়ামী লীগের র. আ. ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর সাথে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন খালেদ হোসেন মাহবুব (শ্যামল)। তখন থেকেই শ্যামলের উত্থান । শ্যামল,জেলা বিএনপির সভাপতি হাফিজুর রহমান মোল্লা (কচি) ও সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম খোকন এই ত্রয়ী নেতৃত্বে মোটামুটি একাট্টা ছিল জেলা বিএনপি।

তাহলে বিভক্তির শুরু কবে থেকে ?

২০২০ সালে ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৩১ সদস্য বিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কমিটি অনুমোদন দেন। কমিটিতে বিলুপ্ত হওয়া জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি জিল্লুর রহমান জিল্লুকে আহবায়ক করা হয়। তখন থেকেই শুরু হয় বিভক্তি, তখন আলোচনা শুরু হয় জিল্লুর রহমান জিল্লু আহবায়ক হওয়ার পেছনে কেউ একজন আছেন, তিনি কে? তারপর বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনের কমিটি নিয়ে বিরোধ বাড়তে থাকে নেতাকর্মীদের মাঝে। আলোচনা শুরু হয় কমিটি হচ্ছে একজনের ইশারায়, কে তিনি? তখন সামনে আসে একটি নাম কবির আহমেদ, কে এই কবির আহমেদ? কবির আহমেদ তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী আবদুর রহমান সানির বড় ভাই। পদের আশায় নেতাকর্মীদের ভিড় জমতে থাকে কবির আহমেদের কাছে।

২০২৩ সালের ১০ আগস্ট জেলা বিএনপির পাঁচ সদস্যের আংশিক আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। ওই পাঁচ সদস্যের কমিটি এরপর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর ২০২৩ সালের ১১ আগস্ট বিকেলে শহরের নিউ মৌড়াইল এলাকায় সভা করে জেলা বিএনপির ঘোষিত পাঁচ সদস্যের আংশিক আহ্বায়ক কমিটিকে ‘বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য’ উল্লেখ করে সাত দিনের মধ্যে বিলুপ্ত ঘোষণার দাবি জানান বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।

এক পক্ষে সাবেক সভাপতি মোল্লা কচি ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক জহিরুল। অন্য পক্ষে কবির আহমদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত আবদুল মান্নান, সিরাজুল ইসলাম ও নূরে আলম সিদ্দিকীর নেতৃত্বে বিএনপির আরেক অংশ। কমিটি ঘোষণার পর দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এরপর থেকে দুই পক্ষই পৃথকভাবে দলীয় সব কর্মসূচি পালন করে আসছে।

কবির আহমেদের প্রভাব এবং বিতর্ক:

কবির আহমেদ আখাউড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন ১৯৯৭ সালে। বিএনপির রাজনীতিতে তার সরাসরি সম্পৃক্ততার অতীত নেই বলে নেতাকর্মীদের অভিযোগ। তবে ভাইয়ের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে তিনি জেলা বিএনপির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। নতুন কমিটির সদস্য হলেও নেতৃত্বের নাটাই তার হাতেই বলছেন জেলা বিএনপির সবাই। শোনা যাচ্ছে, তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসন (আখাউড়া-কসবা) থেকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হতে চান।

সদ্য ঘোষিত ৩২ সদস্যের জেলা আহ্বায়ক কমিটিতে কবিরপন্থী ২৬ জনের জায়গা হয়েছে, সেখানে শ্যামলপন্থী মাত্র ৬ জন। এমনকি বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বিজয়নগরের কোনো নেতা কমিটিতে স্থান পাননি।

তাছাড়া, জেলা ছাত্রদল, সেচ্ছাসেবকদল, সরাইল উপজেলা বিএনপি এবং নাসিরনগন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি এবং সবশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা বিএনপির কমিটিতেও কবির অনুসারী হিসেবে পরিচিতরাই পদ-পদবি পেয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘কবির যা বলেন, সেটাই হচ্ছে। যারা তার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তারা কোনো পদ পাননি। ত্যাগী নেতাদের উপেক্ষা করা হচ্ছে, যা দলের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।’

কে কোন দিকে ছুটবেন দোটানায় এখন অনেক নেতা। নতুন করে যত কমিটিই হচ্ছে সব গুলোতেই পদ-পদবির বেশী অংশ পাচ্ছেন কবির অনুসারীরাই। তাই এখন অনেক নেতাই নিরব, কিছুদিন আগেও যারা কবিরের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। এখন সংবাদ মাধ্যমের সাথে নাম প্রকাশ করে এই বিষয়ে কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না।

কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরও অস্বস্তি:

কেন্দ্রীয় বিএনপির আর্ন্তজাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক রুমিন ফারহানার ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন (সরাইল-আশুগঞ্জ) থেকে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু আপত্তি সরাইল উপজেলা বিএনপির এক অংশের ।

কবিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত সরাইল উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান লস্কর বলেন, ‘উপজেলা বিএনপি পরিবার বহিরাগত কাউকে গ্রহণ করবে না। আমি নিজেও একজন প্রার্থী। আমরা চাই, এলাকার কাউকে প্রার্থী করা হোক। আমি শতভাগ নিশ্চিত, দল এখানে কোনো নারী প্রার্থী দেবে না।’

তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদে রুমিন ফারহানা এক কর্মীসভায় বলেন,‘আমি এক বাপের বাচ্চা হলে সরাইল থেকেই নির্বাচন করবো।’ নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আমার হাতকে শক্তিশালী করুন তাহলে বেগম খালেদা জিয়ার হাত শক্তিশালি হবে, তারেক রহমানের হাত শক্তিশালী হবে।’

নেতা-কর্মীদের বিরোধ দূর না করেই প্রায় ১৫ মাস পর গত ৪ নভেম্বর জেলা বিএনপির ৩২ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। আগের পাঁচ সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবকে নতুন আহ্বায়ক কমিটিতে অপরিবর্তিত রাখায় ক্ষোভ বঞ্চিতদের। ২৮ ডিসেম্বর এই আহ্বায়ক কমিটি সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করছেন, দলের অভ্যন্তরীণ বিভক্তি নিরসনে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এটি আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির জন্য বড় সংকট হয়ে উঠতে পারে।

back to top