ফেরারি আসামি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না, এমন বিধান আইনে যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এছাড়া, অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সুযোগ বাতিল, জামানত আড়াইগুণ বৃদ্ধি, ভোটারপ্রতি ১০ টাকা হারে নির্বাচনী ব্যয় নির্ধারণসহ একগুচ্ছ সংস্কার প্রস্তাব রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করতে গত মঙ্গলবার আইন, বিচারও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় পাঠিয়েছে ইসি।
আরপিও সংশোধনে ইসির প্রস্তাব
অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া বন্ধ
একক প্রার্থী হলে ‘না’ ভোট
জামানত আড়াইগুণ বৃদ্ধি
দিতে হবে বিদেশে সম্পদের তথ্য
আসনপ্রতি নয়, ভোটারপ্রতি নির্বাচনী ব্যয়
সোশ্যাল মিডিয়া ও এআই ব্যবহারে সতর্কতা
বুধবার,(০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫) দুপুরে ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ব্রিফিংয়ে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনী আইন সংস্কার নিয়ে মাসখানেক ধরে দফায় দফায় পর্যালোচনা বৈঠক করেছে ইসি। এরপর জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালানসংক্রান্ত আইন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ’ সংশোধনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়। বেশকিছু প্রস্তাবে প্রথমে ইসির ‘সায় না থাকলেও’ পরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় ‘সন্তুষ্ট হয়ে’ সেগুলো আরপিও সংশোধনী প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি।
বিদ্যমান আইনে, যদি কোনো ব্যক্তির ফৌজদারি অপরাধে কোনো আদালতে অন্যূন দুই বছরের কারাদ- হয়, সাজা শেষে মুক্তি পাওয়ার পাঁচ বছর পার না হলে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না।
ইসি এখন যে প্রস্তাব করেছে, তাতে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলে, তিনি যদি ফেরারি আসামি হন, তাহলে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
ফেরারি আসামি
যে কোনো ফৌজদারি মামলায় কোনো আসামি পলাতক হলে বা আত্মগোপনে থাকলে, আদালত ওই আসামিকে একটা নির্দিষ্ট তারিখ বা সময়ের মধ্যে আদলতে হাজির হওয়ার জন্য হুলিয়া জারি করে। যার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয় তাকে ফেরারি আসামি বলে।
ইসির প্রস্তাবে, বিচারের আগেই একজনকে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যাওয়া দলটির অসংখ্য নেতাকর্মী বিভিন্ন ফৌজদারি মামলার আসামি হয়েছেন। দলটির শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অনেক নেতার নামে হুলিয়া জারি হয়েছে অর্থাৎ, তারা ফেরারি আসামি।
অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ আছে। ইসিও দলটির নিবন্ধন স্থগিত করেছে।
আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে ‘অংশ নিতে পারলে’ এক হিসাব; না পারলেও দলটির অনেক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন বলে আলোচনা আছে। ইসির এ প্রস্তাব অনুমোদন পেলে, ফেরারি
হওয়ার কারণে তাদের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থীও হতে পারবেন না।
কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকলে সে দলের নেতারা কি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘সেই রাজনৈতিক দল কোনো কার্যক্রম চালাতে পারছে না। সুতরাং ওই রাজনৈতিক দলের নাম নিয়ে কেউ নির্বাচন করতে পারছেন না। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কীভাবে অংশ নেবেন সেটা সময়ই বলে দেবে।’
* ইসির বক্তব্য *
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশ্রে- ফেরারি আসামিদের নির্বাচনে অযোগ্য করার বিধান সংযোজনের প্রস্তাব করেছিল। তবে এ প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়েছিল ইসি। ইসি বলেছিল, এমন বিধান অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে।
আগে দ্বিমত জানিয়ে এখন কেন এ প্রস্তাব ইসি গ্রহণ করলো, ব্রিফিং শেষে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘যে কোনো ফৌজদারি মামলায় ফেরারি আসামি হলে অযোগ্য হবেন। অপব্যবহারের আশঙ্কা থেকে এটা করতে চাইনি। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে এটা করা হয়েছে। সামনে যদি অপব্যবহার হয়, তবে আবার এটা পর্যালোচনা করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন আলোচনা করেছে। আলোচনায় নির্বাচন কমিশন সন্তুষ্ট হয়েছে এবং মনে করেছে এমন বিধানটি রাখা ভালো হবে। সামনে যদি এটির অপব্যবহার হয় তখন প্রয়োজনে আবার সংশোধন করা যাবে।’
ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কেউ অভিযুক্ত হলে তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার বিধান করার প্রস্তাব ছিল সংস্কার কমিশনের, তবে এটি ইসির প্রস্তাবে রাখা হয়নি।
* একক প্রার্থী হলে ‘না’ ভোট *
কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে ‘না’ ভোট যুক্ত করে প্রথমে ভোট হবে বলে জানান আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। তিনি বলেন, ‘একক প্রার্থী ও ‘না’ ভোটের মধ্যে যদি কোনো কারণে ‘না’ বেশি ভোট পায় তাহলে পুনঃতফসিল হবে। পরে সেই তফসিলে আবারও একক প্রার্থী হলে প্রার্থী জিতে যাবে।’
* অনলাইনে মনোনয়ন বাদ *
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের কেউ কেউ বিগত সময় অনলাইনে নির্বাচনের মনোনয়ন ফরম জমা দেয়ার বিধান করার বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। তাদের ভাষ্য ছিল, স্বশরীরে মনোয়নপত্র জমা দিতে গেলে অনেকে বাধার শিকার হন।
দেশের নির্বাচনী বিশ্লেষকদের সুপারিশেই বিগত ইসি অনলাইনে মনোনয়ন দাখিলের বিধান করেছিল। বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অসংখ্য প্রার্থী অনলাইনে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অনলাইনে মনোনয়ন জমা প্রদানের নির্দেশিকাও ইসি প্রকাশ করেছিল।
আগামী সংসদ নির্বাচনে অনলাইনে মনোনয়ন দাখিল করার সুযোগ আছে কিনা, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘শুধু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অনলাইনে মনোনয়ন জমা দেয়ার ব্যবস্থা ছিল, জাতীয় নির্বাচনে ছিল না। এটা আমরা নতুন করে যোগ করব বলেছিলাম, কিন্তু এখন আমরা এটা যোগ করছি না।’
* ভোটারপ্রতি খরচ ১০ টাকা *
এ নির্বাচন কমিশনার জানান, এবার প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময় জামানত ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করেছে ইসি। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ থাকলেও অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার বিধান রাখা হয়নি। ভোটারপ্রতি ১০ টাকা হারে আসনের ভোটার সংখ্যার সমান ব্যয় এর সুযোগ রাখা হয়েছে।
বিদ্যমান আইনে ২৫ লাখ টাকা নির্বাচনী ব্যয়ের সুযোগ ছিল প্রত্যেক প্রার্থীর। সে বিধান বাদ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। আসনভিত্তিক ভোটার তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সব থেকে বেশি ভোটার রয়েছে গাজীপুর-২ আসনে। এ আসনের ভোটার ৭ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৬ জন। অন্যদিকে, সবচেয়ে কম ভোটারের আসন হচ্ছে ঝালকাঠি-১ আসনে। এ আসনে ভোটার ২ লাখ ১২ হাজার ১২ জন।
* নির্বাচনী ব্যয় *
এবার ভোটাপ্রতি ১০ টাকা হারে ব্যয়ের সুযোগ রেখে প্রস্তাব দেয়ায় গাজীপুরের এই আসনটিতে ভোটারের জন্য সর্বোচ্চ প্রায় ৭৮ লাখ টাকা ব্যয়ের সুযোগ থাকছে। এছাড়া ঢাকা ১৯ আসনে সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ লাখ ভোটারের জন্য ৭৫ লাখ টাকা ব্যয় করতে পারবেন প্রার্থীরা।
আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানান, অনিয়ম হলে রিটার্নিং অফিসার একটি বা একাধিক কেন্দ্র বা পুরো আসনের নির্বাচন বাতিল করতে পারবেন। ভোটকেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন কখন ভোট শুরু করবেন, আর কখন বন্ধ করবেন।
তিনি বলেন, ‘আগে প্রিজাইডিং অফিসার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ছিল। মাঝখানে এটা সংশোধন করে বিধান করা হয়েছিল যে ভোট শুরুর পূর্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি দেখবেন, তারা রিপোর্ট দিলে প্রিজাইডিং অফিসার ভোট শুরু করতেন। আমরা এটাকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে গেছি। এতে কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার হবেন সর্বেসর্বা।’
তিনি বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমের কর্মীসহ কে কতক্ষণ ভোটকক্ষের ভেতরে থাকবেন তা নির্ধারণের ক্ষমতা প্রিজাইডিং অফিসারকে দেয়া হয়েছে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন। সরকারপ্রধানের নির্দেশ পেয়ে ইসিও সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ওই নির্বাচন সামনে রেখেই আরপিওর অন্তত ৪৬টি অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে ইসি। তবে প্রস্তাবের কোনটা থাকবে, কোনটা থাকবে না, তা নির্ভর করবে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদনের ওপর। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের সায় পেলে রাষ্ট্রপতি সংশোধন অধ্যাদেশ জারি করবেন।
ইসির প্রস্তাবনার মধ্যে আরও আছে- জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীরা নিজ সংসদীয় আসনের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সদস্য হতে পারবেন না। পাশাপাশি কোনো প্রার্থী হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে নির্বাচন কমিশন স্বতপ্রণোদিতভাবে ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
* বিদেশে সম্পদের তথ্য *
আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ আরও জানান, ‘আগে আরপিওতে লেখা ছিল সোর্স অফ ইনকাম। এখানে আমরা আরেকটু অ্যাড করেছি, বোথ অ্যাট হোম অ্যান্ড অ্যাব্রড। অর্থাৎ দেশে ও দেশের বাইরের সম্পদের বিবরণী দিতে হবে। একইভাবে স্টেটমেন্ট অব প্রপার্টি এবং ডেট অর্থাৎ সম্পদ ও দেনার বর্ণনাতেও দেশে ও বিদেশের কথা যোগ করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘যদি কোনো প্রার্থী তার হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেন, প্রমাণ হলে নির্বাচন কমিশন স্বতপ্রণোদিতভাবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারবে এবং এমনকি তার প্রার্থিতাও বাতিল হবে এবং তিনি সংসদ সদস্য পদ হারাবেন।’
এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করতে গেলেও দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে।’
বুধবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ফেরারি আসামি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না, এমন বিধান আইনে যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এছাড়া, অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সুযোগ বাতিল, জামানত আড়াইগুণ বৃদ্ধি, ভোটারপ্রতি ১০ টাকা হারে নির্বাচনী ব্যয় নির্ধারণসহ একগুচ্ছ সংস্কার প্রস্তাব রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করতে গত মঙ্গলবার আইন, বিচারও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় পাঠিয়েছে ইসি।
আরপিও সংশোধনে ইসির প্রস্তাব
অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া বন্ধ
একক প্রার্থী হলে ‘না’ ভোট
জামানত আড়াইগুণ বৃদ্ধি
দিতে হবে বিদেশে সম্পদের তথ্য
আসনপ্রতি নয়, ভোটারপ্রতি নির্বাচনী ব্যয়
সোশ্যাল মিডিয়া ও এআই ব্যবহারে সতর্কতা
বুধবার,(০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫) দুপুরে ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ব্রিফিংয়ে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনী আইন সংস্কার নিয়ে মাসখানেক ধরে দফায় দফায় পর্যালোচনা বৈঠক করেছে ইসি। এরপর জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালানসংক্রান্ত আইন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ’ সংশোধনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়। বেশকিছু প্রস্তাবে প্রথমে ইসির ‘সায় না থাকলেও’ পরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় ‘সন্তুষ্ট হয়ে’ সেগুলো আরপিও সংশোধনী প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি।
বিদ্যমান আইনে, যদি কোনো ব্যক্তির ফৌজদারি অপরাধে কোনো আদালতে অন্যূন দুই বছরের কারাদ- হয়, সাজা শেষে মুক্তি পাওয়ার পাঁচ বছর পার না হলে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না।
ইসি এখন যে প্রস্তাব করেছে, তাতে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলে, তিনি যদি ফেরারি আসামি হন, তাহলে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
ফেরারি আসামি
যে কোনো ফৌজদারি মামলায় কোনো আসামি পলাতক হলে বা আত্মগোপনে থাকলে, আদালত ওই আসামিকে একটা নির্দিষ্ট তারিখ বা সময়ের মধ্যে আদলতে হাজির হওয়ার জন্য হুলিয়া জারি করে। যার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয় তাকে ফেরারি আসামি বলে।
ইসির প্রস্তাবে, বিচারের আগেই একজনকে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যাওয়া দলটির অসংখ্য নেতাকর্মী বিভিন্ন ফৌজদারি মামলার আসামি হয়েছেন। দলটির শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অনেক নেতার নামে হুলিয়া জারি হয়েছে অর্থাৎ, তারা ফেরারি আসামি।
অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ আছে। ইসিও দলটির নিবন্ধন স্থগিত করেছে।
আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে ‘অংশ নিতে পারলে’ এক হিসাব; না পারলেও দলটির অনেক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন বলে আলোচনা আছে। ইসির এ প্রস্তাব অনুমোদন পেলে, ফেরারি
হওয়ার কারণে তাদের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থীও হতে পারবেন না।
কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকলে সে দলের নেতারা কি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘সেই রাজনৈতিক দল কোনো কার্যক্রম চালাতে পারছে না। সুতরাং ওই রাজনৈতিক দলের নাম নিয়ে কেউ নির্বাচন করতে পারছেন না। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কীভাবে অংশ নেবেন সেটা সময়ই বলে দেবে।’
* ইসির বক্তব্য *
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশ্রে- ফেরারি আসামিদের নির্বাচনে অযোগ্য করার বিধান সংযোজনের প্রস্তাব করেছিল। তবে এ প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়েছিল ইসি। ইসি বলেছিল, এমন বিধান অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে।
আগে দ্বিমত জানিয়ে এখন কেন এ প্রস্তাব ইসি গ্রহণ করলো, ব্রিফিং শেষে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘যে কোনো ফৌজদারি মামলায় ফেরারি আসামি হলে অযোগ্য হবেন। অপব্যবহারের আশঙ্কা থেকে এটা করতে চাইনি। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে এটা করা হয়েছে। সামনে যদি অপব্যবহার হয়, তবে আবার এটা পর্যালোচনা করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন আলোচনা করেছে। আলোচনায় নির্বাচন কমিশন সন্তুষ্ট হয়েছে এবং মনে করেছে এমন বিধানটি রাখা ভালো হবে। সামনে যদি এটির অপব্যবহার হয় তখন প্রয়োজনে আবার সংশোধন করা যাবে।’
ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কেউ অভিযুক্ত হলে তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার বিধান করার প্রস্তাব ছিল সংস্কার কমিশনের, তবে এটি ইসির প্রস্তাবে রাখা হয়নি।
* একক প্রার্থী হলে ‘না’ ভোট *
কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে ‘না’ ভোট যুক্ত করে প্রথমে ভোট হবে বলে জানান আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। তিনি বলেন, ‘একক প্রার্থী ও ‘না’ ভোটের মধ্যে যদি কোনো কারণে ‘না’ বেশি ভোট পায় তাহলে পুনঃতফসিল হবে। পরে সেই তফসিলে আবারও একক প্রার্থী হলে প্রার্থী জিতে যাবে।’
* অনলাইনে মনোনয়ন বাদ *
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের কেউ কেউ বিগত সময় অনলাইনে নির্বাচনের মনোনয়ন ফরম জমা দেয়ার বিধান করার বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। তাদের ভাষ্য ছিল, স্বশরীরে মনোয়নপত্র জমা দিতে গেলে অনেকে বাধার শিকার হন।
দেশের নির্বাচনী বিশ্লেষকদের সুপারিশেই বিগত ইসি অনলাইনে মনোনয়ন দাখিলের বিধান করেছিল। বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অসংখ্য প্রার্থী অনলাইনে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অনলাইনে মনোনয়ন জমা প্রদানের নির্দেশিকাও ইসি প্রকাশ করেছিল।
আগামী সংসদ নির্বাচনে অনলাইনে মনোনয়ন দাখিল করার সুযোগ আছে কিনা, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘শুধু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অনলাইনে মনোনয়ন জমা দেয়ার ব্যবস্থা ছিল, জাতীয় নির্বাচনে ছিল না। এটা আমরা নতুন করে যোগ করব বলেছিলাম, কিন্তু এখন আমরা এটা যোগ করছি না।’
* ভোটারপ্রতি খরচ ১০ টাকা *
এ নির্বাচন কমিশনার জানান, এবার প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময় জামানত ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করেছে ইসি। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ থাকলেও অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার বিধান রাখা হয়নি। ভোটারপ্রতি ১০ টাকা হারে আসনের ভোটার সংখ্যার সমান ব্যয় এর সুযোগ রাখা হয়েছে।
বিদ্যমান আইনে ২৫ লাখ টাকা নির্বাচনী ব্যয়ের সুযোগ ছিল প্রত্যেক প্রার্থীর। সে বিধান বাদ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। আসনভিত্তিক ভোটার তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সব থেকে বেশি ভোটার রয়েছে গাজীপুর-২ আসনে। এ আসনের ভোটার ৭ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৬ জন। অন্যদিকে, সবচেয়ে কম ভোটারের আসন হচ্ছে ঝালকাঠি-১ আসনে। এ আসনে ভোটার ২ লাখ ১২ হাজার ১২ জন।
* নির্বাচনী ব্যয় *
এবার ভোটাপ্রতি ১০ টাকা হারে ব্যয়ের সুযোগ রেখে প্রস্তাব দেয়ায় গাজীপুরের এই আসনটিতে ভোটারের জন্য সর্বোচ্চ প্রায় ৭৮ লাখ টাকা ব্যয়ের সুযোগ থাকছে। এছাড়া ঢাকা ১৯ আসনে সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ লাখ ভোটারের জন্য ৭৫ লাখ টাকা ব্যয় করতে পারবেন প্রার্থীরা।
আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানান, অনিয়ম হলে রিটার্নিং অফিসার একটি বা একাধিক কেন্দ্র বা পুরো আসনের নির্বাচন বাতিল করতে পারবেন। ভোটকেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন কখন ভোট শুরু করবেন, আর কখন বন্ধ করবেন।
তিনি বলেন, ‘আগে প্রিজাইডিং অফিসার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ছিল। মাঝখানে এটা সংশোধন করে বিধান করা হয়েছিল যে ভোট শুরুর পূর্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি দেখবেন, তারা রিপোর্ট দিলে প্রিজাইডিং অফিসার ভোট শুরু করতেন। আমরা এটাকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে গেছি। এতে কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার হবেন সর্বেসর্বা।’
তিনি বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমের কর্মীসহ কে কতক্ষণ ভোটকক্ষের ভেতরে থাকবেন তা নির্ধারণের ক্ষমতা প্রিজাইডিং অফিসারকে দেয়া হয়েছে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন। সরকারপ্রধানের নির্দেশ পেয়ে ইসিও সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ওই নির্বাচন সামনে রেখেই আরপিওর অন্তত ৪৬টি অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে ইসি। তবে প্রস্তাবের কোনটা থাকবে, কোনটা থাকবে না, তা নির্ভর করবে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদনের ওপর। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের সায় পেলে রাষ্ট্রপতি সংশোধন অধ্যাদেশ জারি করবেন।
ইসির প্রস্তাবনার মধ্যে আরও আছে- জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীরা নিজ সংসদীয় আসনের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সদস্য হতে পারবেন না। পাশাপাশি কোনো প্রার্থী হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে নির্বাচন কমিশন স্বতপ্রণোদিতভাবে ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
* বিদেশে সম্পদের তথ্য *
আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ আরও জানান, ‘আগে আরপিওতে লেখা ছিল সোর্স অফ ইনকাম। এখানে আমরা আরেকটু অ্যাড করেছি, বোথ অ্যাট হোম অ্যান্ড অ্যাব্রড। অর্থাৎ দেশে ও দেশের বাইরের সম্পদের বিবরণী দিতে হবে। একইভাবে স্টেটমেন্ট অব প্রপার্টি এবং ডেট অর্থাৎ সম্পদ ও দেনার বর্ণনাতেও দেশে ও বিদেশের কথা যোগ করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘যদি কোনো প্রার্থী তার হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেন, প্রমাণ হলে নির্বাচন কমিশন স্বতপ্রণোদিতভাবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারবে এবং এমনকি তার প্রার্থিতাও বাতিল হবে এবং তিনি সংসদ সদস্য পদ হারাবেন।’
এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করতে গেলেও দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে।’