আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে একটানা চুয়াল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে রয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে থেকে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।
দলীয় নেতৃত্বে তার অনুপস্থিতিতে কে বা কারা কীভাবে দলের হাল ধরবেন, সেই উত্তরাধিকারের পরিকল্পনা নিয়ে কোনোদিন তিনি প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। ঠিক কী ভাবছেন, তারও কোনো আভাস দেননি।
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, গত বছরের পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের মতো এত বড় একটা দল যে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল, সেটারও একটা বড় কারণ ছিল এই দুর্বলতা। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দলটির কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করে রেখেছে।
বস্তুত শেখ হাসিনা অনুপস্থিতিতে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা কার কাছ থেকে নির্দেশনা পাবেন, তা নিয়েও ছিল চূড়ান্ত অস্পষ্টতা। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারত সরকারের ‘অতিথি’ হিসেবে সেখানেই অবস্থান করছেন শেখ হাসিনা। যদিও ভারতে তার গতিবিধি, দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মেলামেশা- সব ব্যাপারেই কড়াকড়ি আছে।
ফলে খানিকটা পরিস্থিতির চাপেই তাকে এখন উত্তরাধিকারের এই অমীমাংসিত বিষয়টির দিকে নজর দিতে হচ্ছে। তাছাড়া চলতি মাসেই তিনি ৭৮ বছর পূর্ণ করবেন, ফলে বয়সেরও কিছুটা তাগিদ রয়েছে।
এখন পরিকল্পনা কী?
বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে, শেখ হাসিনা তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকেই নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে আনার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছেন। পাশাপাশি শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিরও একটা ভূমিকা থাকবে।
এক্ষেত্রে ভারতের প্রধানবিরোধী দল কংগ্রেস তাদের দলীয় নেতৃত্বে রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে নিয়ে যে ‘মডেল’টা অনুসরণ করছে, আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ঠিক সেটাই করতে চাইছেন শেখ হাসিনা।
মাত্র মাস দুয়েক আগেও দিল্লিতে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ‘আঞ্চলিক পরিচালক’ পদে ছিলেন সায়মা ওয়াজেদ। হু-র কর্তৃপক্ষ তাকে অনির্দিষ্টকালীন ছুটিতে পাঠানোর পর শেখ হাসিনার কন্যা এখন পুরাদস্তুর রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন।
শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ মার্কিন নাগরিক ও আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা। মায়ের পর দলের প্রধান মুখ ও মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনিই। দেশ-বিদেশের মিডিয়াকে সাক্ষাৎকারও দিচ্ছেন ঘন ঘন।
আর সায়মা ওয়াজেদ যেহেতু মায়ের সঙ্গে একই শহরে ও একই টাইম জোনে রয়েছেন, শেখ হাসিনাকে তিনি সরাসরি সাহায্য করতে পারছেন অনেক বেশি। অনলাইনে মায়ের দেয়া ভাষণের খসড়া তৈরিতে, কর্মসূচির ক্যালেন্ডার স্থির করতে সাহায্য করছেন। এমনকি বাইরের দর্শনার্থীদের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরাসরি দেখা করার ক্ষেত্রে যেহেতু অনেক বিধিনিষেধ আছে- তাই সে কাজটাও অনেকাংশেই সায়মার ওপর বর্তেছে। গত দু’মাসে তিনি বেশ কয়েকবার এরকম বৈঠকও করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। ফলে বলা যেতেই পারে, শেখ হাসিনা এখন ধীরে ধীরে অনেক দায়িত্বই ছেলে-মেয়ের ওপরে ছেড়ে দিয়েছেন বা দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
কী বলছে আওয়ামী লীগ?
শেখ হাসিনার এই তথাকথিত ‘সাকসেসন প্ল্যান’ নিয়ে বিবিসি বাংলা ভারতে ও ভারতের বাইরে অবস্থানরত বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা বলেছে।
তারা অনেকেই দলীয় নেতৃত্বে এই ‘রাহুল-প্রিয়াঙ্কা’ মডেল অনুসরণ করার বিষয়টি নিয়ে অবহিত বলে বিবিসির কাছে নিশ্চিত করেছেন।
তবে এই বিষয়টি আওয়ামী লীগের ভেতরে এতটাই স্পর্শকাতর একটি ইস্যু যে, তারা কেউই এটি নিয়ে ‘অন রেকর্ড’ মুখ খুলতে চাননি।
দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আরাফাত দাবি করছেন, এই বিষয়টি নিয়ে দলের ভেতরে এখনও কোনো আলোচনাই হয়নি। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, আপনি যে সাকসেসন প্ল্যানের কথা বলছেন সেটা এখন আমাদের অগ্রাধিকারের মধ্যেই পড়ে না। কে কী পদ-পদবি পেলেন, সেটা এখন ভাবারই সময় নয়।’
‘দলের মধ্যেও আমরা এটা নিয়ে এখন কথাবার্তা বলছি না। আপনারা জানেন, আমাদের এখন প্রধান লক্ষ্য হলো- বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা, সেই লক্ষ্যেই সব চেষ্টা নিয়োজিত করা হচ্ছে।’
তিনি যোগ করেন, ‘তবে এটুকু বলতে পারি- সভানেত্রীর পরিবারের সব সদস্য যেমন, তেমনি দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী যে যেখানে আছেন সবাই এই একটা লক্ষ্যেই কাজ করছেন।’
কেন এখন রাজনীতিতে পুতুল?
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা তাকে ছুটিতে পাঠানোর পর, শেখ হাসিনার কন্যার কাছে এছাড়া আর কোনো অপশন ছিল না। গত ১১ জুলাই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালকের পদ থেকে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে অনির্দিষ্টকালীন ছুটিতে পাঠানো হয়।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রস এ গেব্রেয়িসুস যে ‘ইন্টারনাল ইমেইলে’ তার কর্মীদের এই সিদ্ধান্তের কথা জানান, সেটির একটি প্রতিলিপি এই প্রতিবেদকও দেখেছেন। সেই ইমেইলের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার যে, পুতুল ওই পদে থাকলে সংস্থার সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার অনাগ্রহ প্রকাশ করেছিল এবং ওই পদে তার নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, সেটা বিবেচনায় নিয়েই তাকে ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তাছাড়া বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন আয়বহির্ভূত সম্পত্তি বানানো, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের যেসব অভিযোগ তার বিরুদ্ধে এনেছে- সেটাও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ওই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশ সরকারের মনোভাবের ‘অপ্রত্যাশিত কোনো পরিবর্তন’ না হলে এই ছুটি থেকে অচিরেই তাকে ফেরানোর কোনো সম্ভাবনা নেই- সংস্থার একাধিক সূত্র বিবিসির কাছে তাও নিশ্চিত করেছেন।
আর এটা জানেন বলেই সায়মা ওয়াজেদও এখন ‘ফুলটাইম’ মায়ের সঙ্গে দলীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। অথচ বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর গত
বছরের ৮ আগস্ট একটি টুইটে সায়মা জানিয়েছিলেন, তিনি সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাবেন।
দিল্লিতে তিনি ওই পদে যান ২০২৪ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি, যার মেয়াদ ছিল পুরো পাঁচ বছরের। কিন্তু সংস্থার ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্তই তাকে কার্যত বাধ্য করেছে এখনই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চলে আসতে।
বস্তুত গত মাসেই তিনি নিজের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে আবার ‘রাজনৈতিক পোস্ট’ করা শুরু করেছেন। যেগুলো ছিল তার নিজস্ব কিছু মন্তব্যসহ একটি খালাতো বোন টিউলিপ সিদ্দিকের ও অন্যটি বড় ভাই সজীব ওয়াজেদের করা পোস্টের রিটুইট।
গত কিছুদিনে তার এই সব পোস্ট থেকেই অনেকে ধারণা করছেন যে, সায়মা হয়তো নিজেও জানেন তার বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থায় ফেরার রাস্তা কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।
কোণঠাসা ওবায়দুল কাদের, গুরুত্ব পাচ্ছেন তিন নেতা
নিজের ছেলেমেয়েকে অঘোষিতভাবে দলের নেতৃত্বে একেবারে সামনের সারিতে নিয়ে আসার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ পরিচালনার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছেন সভাপতি শেখ হাসিনা।
তিনি নিজে এই মুহূর্তে ভারতের মাটিতে, দলের শীর্ষ নেতাদেরও অনেকেই সেখানে। ফলে আওয়ামী লীগের ‘নিউক্লিয়াস’ এখন কার্যত প্রতিবেশী দেশের মাটিতেই। শেখ হাসিনা, সায়মা ওয়াজেদ দিল্লিতে (বা দিল্লির উপকণ্ঠে), সজীব ওয়াজেদ আমেরিকার ভার্জিনিয়ায় এবং দলের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ নেতা কলকাতায়- এভাবেই একটি ত্রিভুজাকার যৌথ নেতৃত্বর মধ্যে দিয়ে এই মুহূর্তে দলটির দৈনন্দিন কাজকর্ম চলছে।
কিন্তু কাগজে-কলমে এখনও যিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে আছেন, সেই ওবায়দুল কাদের দলের এই নতুন কাঠামোতে একেবারেই উপেক্ষিত।
প্রায় দশ মাস আগে ভারতে চলে এলেও তিনি এখনও দলীয় সভাপতির দেখাই পাননি বলে বিবিসি নিশ্চিত হতে পেরেছে।
শেখ হাসিনা বরং বেশি ভরসা রাখছেন দলের তিন জন নেতার ওপর, যারা প্রত্যেকেই আপাতত কলকাতায়। তারা হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ঢাকা-৮ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও একদা প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী আ.ফ.ম. বাহাউদ্দিন নাসিম এবং আওয়ামী লীগ সভাপতিম-লীর সদস্য ও সাবেক এমপি জাহাঙ্গীর কবির নানক।
দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানাচ্ছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতে তাদের সশরীরে সাক্ষাৎ হয়েছে। তবে আপাতত তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা ও অ্যাকশন প্ল্যান তৈরির কাজটি করছেন সায়মা।
অন্যদিকে সজীব ওয়াজেদের নেতৃত্বে আমেরিকায় আর একটি টিম কাজ করছেন দলের অনুকূলে ‘ন্যারেটিভ নির্মাণ’ (বয়ান তৈরি) এবং বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বক্তব্য তুলে ধরতে।
৭৬ বছরেরও বেশি পুরনো এই রাজনৈতিক দলটি ইতিহাসে সম্ভবত তাদের সবচেয়ে সংকটময় সময় পার করে ঘুরে দাঁড়ানোর কঠিন লড়াই? করছে। তবে নেতৃত্বের রাশ থাকছে যথারীতি দলটির ‘ফার্স্ট ফ্যামিলি’র হাতেই। (সংক্ষেপিত)
সোমবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে একটানা চুয়াল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে রয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে থেকে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।
দলীয় নেতৃত্বে তার অনুপস্থিতিতে কে বা কারা কীভাবে দলের হাল ধরবেন, সেই উত্তরাধিকারের পরিকল্পনা নিয়ে কোনোদিন তিনি প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। ঠিক কী ভাবছেন, তারও কোনো আভাস দেননি।
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, গত বছরের পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের মতো এত বড় একটা দল যে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল, সেটারও একটা বড় কারণ ছিল এই দুর্বলতা। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দলটির কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করে রেখেছে।
বস্তুত শেখ হাসিনা অনুপস্থিতিতে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা কার কাছ থেকে নির্দেশনা পাবেন, তা নিয়েও ছিল চূড়ান্ত অস্পষ্টতা। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারত সরকারের ‘অতিথি’ হিসেবে সেখানেই অবস্থান করছেন শেখ হাসিনা। যদিও ভারতে তার গতিবিধি, দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মেলামেশা- সব ব্যাপারেই কড়াকড়ি আছে।
ফলে খানিকটা পরিস্থিতির চাপেই তাকে এখন উত্তরাধিকারের এই অমীমাংসিত বিষয়টির দিকে নজর দিতে হচ্ছে। তাছাড়া চলতি মাসেই তিনি ৭৮ বছর পূর্ণ করবেন, ফলে বয়সেরও কিছুটা তাগিদ রয়েছে।
এখন পরিকল্পনা কী?
বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে, শেখ হাসিনা তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকেই নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে আনার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছেন। পাশাপাশি শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিরও একটা ভূমিকা থাকবে।
এক্ষেত্রে ভারতের প্রধানবিরোধী দল কংগ্রেস তাদের দলীয় নেতৃত্বে রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে নিয়ে যে ‘মডেল’টা অনুসরণ করছে, আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ঠিক সেটাই করতে চাইছেন শেখ হাসিনা।
মাত্র মাস দুয়েক আগেও দিল্লিতে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ‘আঞ্চলিক পরিচালক’ পদে ছিলেন সায়মা ওয়াজেদ। হু-র কর্তৃপক্ষ তাকে অনির্দিষ্টকালীন ছুটিতে পাঠানোর পর শেখ হাসিনার কন্যা এখন পুরাদস্তুর রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন।
শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ মার্কিন নাগরিক ও আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা। মায়ের পর দলের প্রধান মুখ ও মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনিই। দেশ-বিদেশের মিডিয়াকে সাক্ষাৎকারও দিচ্ছেন ঘন ঘন।
আর সায়মা ওয়াজেদ যেহেতু মায়ের সঙ্গে একই শহরে ও একই টাইম জোনে রয়েছেন, শেখ হাসিনাকে তিনি সরাসরি সাহায্য করতে পারছেন অনেক বেশি। অনলাইনে মায়ের দেয়া ভাষণের খসড়া তৈরিতে, কর্মসূচির ক্যালেন্ডার স্থির করতে সাহায্য করছেন। এমনকি বাইরের দর্শনার্থীদের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরাসরি দেখা করার ক্ষেত্রে যেহেতু অনেক বিধিনিষেধ আছে- তাই সে কাজটাও অনেকাংশেই সায়মার ওপর বর্তেছে। গত দু’মাসে তিনি বেশ কয়েকবার এরকম বৈঠকও করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। ফলে বলা যেতেই পারে, শেখ হাসিনা এখন ধীরে ধীরে অনেক দায়িত্বই ছেলে-মেয়ের ওপরে ছেড়ে দিয়েছেন বা দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
কী বলছে আওয়ামী লীগ?
শেখ হাসিনার এই তথাকথিত ‘সাকসেসন প্ল্যান’ নিয়ে বিবিসি বাংলা ভারতে ও ভারতের বাইরে অবস্থানরত বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা বলেছে।
তারা অনেকেই দলীয় নেতৃত্বে এই ‘রাহুল-প্রিয়াঙ্কা’ মডেল অনুসরণ করার বিষয়টি নিয়ে অবহিত বলে বিবিসির কাছে নিশ্চিত করেছেন।
তবে এই বিষয়টি আওয়ামী লীগের ভেতরে এতটাই স্পর্শকাতর একটি ইস্যু যে, তারা কেউই এটি নিয়ে ‘অন রেকর্ড’ মুখ খুলতে চাননি।
দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আরাফাত দাবি করছেন, এই বিষয়টি নিয়ে দলের ভেতরে এখনও কোনো আলোচনাই হয়নি। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, আপনি যে সাকসেসন প্ল্যানের কথা বলছেন সেটা এখন আমাদের অগ্রাধিকারের মধ্যেই পড়ে না। কে কী পদ-পদবি পেলেন, সেটা এখন ভাবারই সময় নয়।’
‘দলের মধ্যেও আমরা এটা নিয়ে এখন কথাবার্তা বলছি না। আপনারা জানেন, আমাদের এখন প্রধান লক্ষ্য হলো- বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা, সেই লক্ষ্যেই সব চেষ্টা নিয়োজিত করা হচ্ছে।’
তিনি যোগ করেন, ‘তবে এটুকু বলতে পারি- সভানেত্রীর পরিবারের সব সদস্য যেমন, তেমনি দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী যে যেখানে আছেন সবাই এই একটা লক্ষ্যেই কাজ করছেন।’
কেন এখন রাজনীতিতে পুতুল?
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা তাকে ছুটিতে পাঠানোর পর, শেখ হাসিনার কন্যার কাছে এছাড়া আর কোনো অপশন ছিল না। গত ১১ জুলাই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালকের পদ থেকে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে অনির্দিষ্টকালীন ছুটিতে পাঠানো হয়।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রস এ গেব্রেয়িসুস যে ‘ইন্টারনাল ইমেইলে’ তার কর্মীদের এই সিদ্ধান্তের কথা জানান, সেটির একটি প্রতিলিপি এই প্রতিবেদকও দেখেছেন। সেই ইমেইলের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার যে, পুতুল ওই পদে থাকলে সংস্থার সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার অনাগ্রহ প্রকাশ করেছিল এবং ওই পদে তার নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, সেটা বিবেচনায় নিয়েই তাকে ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তাছাড়া বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন আয়বহির্ভূত সম্পত্তি বানানো, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের যেসব অভিযোগ তার বিরুদ্ধে এনেছে- সেটাও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ওই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশ সরকারের মনোভাবের ‘অপ্রত্যাশিত কোনো পরিবর্তন’ না হলে এই ছুটি থেকে অচিরেই তাকে ফেরানোর কোনো সম্ভাবনা নেই- সংস্থার একাধিক সূত্র বিবিসির কাছে তাও নিশ্চিত করেছেন।
আর এটা জানেন বলেই সায়মা ওয়াজেদও এখন ‘ফুলটাইম’ মায়ের সঙ্গে দলীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। অথচ বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর গত
বছরের ৮ আগস্ট একটি টুইটে সায়মা জানিয়েছিলেন, তিনি সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাবেন।
দিল্লিতে তিনি ওই পদে যান ২০২৪ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি, যার মেয়াদ ছিল পুরো পাঁচ বছরের। কিন্তু সংস্থার ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্তই তাকে কার্যত বাধ্য করেছে এখনই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চলে আসতে।
বস্তুত গত মাসেই তিনি নিজের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে আবার ‘রাজনৈতিক পোস্ট’ করা শুরু করেছেন। যেগুলো ছিল তার নিজস্ব কিছু মন্তব্যসহ একটি খালাতো বোন টিউলিপ সিদ্দিকের ও অন্যটি বড় ভাই সজীব ওয়াজেদের করা পোস্টের রিটুইট।
গত কিছুদিনে তার এই সব পোস্ট থেকেই অনেকে ধারণা করছেন যে, সায়মা হয়তো নিজেও জানেন তার বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থায় ফেরার রাস্তা কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।
কোণঠাসা ওবায়দুল কাদের, গুরুত্ব পাচ্ছেন তিন নেতা
নিজের ছেলেমেয়েকে অঘোষিতভাবে দলের নেতৃত্বে একেবারে সামনের সারিতে নিয়ে আসার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ পরিচালনার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছেন সভাপতি শেখ হাসিনা।
তিনি নিজে এই মুহূর্তে ভারতের মাটিতে, দলের শীর্ষ নেতাদেরও অনেকেই সেখানে। ফলে আওয়ামী লীগের ‘নিউক্লিয়াস’ এখন কার্যত প্রতিবেশী দেশের মাটিতেই। শেখ হাসিনা, সায়মা ওয়াজেদ দিল্লিতে (বা দিল্লির উপকণ্ঠে), সজীব ওয়াজেদ আমেরিকার ভার্জিনিয়ায় এবং দলের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ নেতা কলকাতায়- এভাবেই একটি ত্রিভুজাকার যৌথ নেতৃত্বর মধ্যে দিয়ে এই মুহূর্তে দলটির দৈনন্দিন কাজকর্ম চলছে।
কিন্তু কাগজে-কলমে এখনও যিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে আছেন, সেই ওবায়দুল কাদের দলের এই নতুন কাঠামোতে একেবারেই উপেক্ষিত।
প্রায় দশ মাস আগে ভারতে চলে এলেও তিনি এখনও দলীয় সভাপতির দেখাই পাননি বলে বিবিসি নিশ্চিত হতে পেরেছে।
শেখ হাসিনা বরং বেশি ভরসা রাখছেন দলের তিন জন নেতার ওপর, যারা প্রত্যেকেই আপাতত কলকাতায়। তারা হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ঢাকা-৮ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও একদা প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী আ.ফ.ম. বাহাউদ্দিন নাসিম এবং আওয়ামী লীগ সভাপতিম-লীর সদস্য ও সাবেক এমপি জাহাঙ্গীর কবির নানক।
দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানাচ্ছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতে তাদের সশরীরে সাক্ষাৎ হয়েছে। তবে আপাতত তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা ও অ্যাকশন প্ল্যান তৈরির কাজটি করছেন সায়মা।
অন্যদিকে সজীব ওয়াজেদের নেতৃত্বে আমেরিকায় আর একটি টিম কাজ করছেন দলের অনুকূলে ‘ন্যারেটিভ নির্মাণ’ (বয়ান তৈরি) এবং বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বক্তব্য তুলে ধরতে।
৭৬ বছরেরও বেশি পুরনো এই রাজনৈতিক দলটি ইতিহাসে সম্ভবত তাদের সবচেয়ে সংকটময় সময় পার করে ঘুরে দাঁড়ানোর কঠিন লড়াই? করছে। তবে নেতৃত্বের রাশ থাকছে যথারীতি দলটির ‘ফার্স্ট ফ্যামিলি’র হাতেই। (সংক্ষেপিত)