জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য আগের মতোই ‘অস্থায়ী সাংবিধানিক আদেশ’ অথবা গণভোটের কথা বলেছে জামায়াতে ইসলামী; আর জাতীয় নাগরিক পার্টি বলেছে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন করা। অধ্যাদেশ দিয়ে সংবিধান সংশোধনের বিরোধিতা করে আসা বিএনপির সুর সামান্য নরম হয়েছে। দলটি এখন বলছে, অতিরিক্ত বা বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন করা যায় কি না, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের মতামত নেওয়া যেতে পারে।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের পথ খুঁজতে রোববার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানেই নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন দলগুলোর নেতারা। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও এদিন বৈঠকের একটি অংশে উপস্থিত ছিলেন।
এতদিনের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো মোট ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে (নোট অব ডিসেন্টসহ) একমত হলেও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে স্পষ্ট মতবিরোধ রয়েছে এনসিপি, জামায়াত এবং বিএনপির মধ্যে। এনসিপি ও জামায়াত নির্বাচনের আগে সংবিধান সংশোধন করে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে। অন্যদিকে বিএনপি বলে আসছে, নির্বাচিত সংসদ ছাড়া কেউ সংবিধানে হাত দিতে পারবে না।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, “এনসিপি মনে করে একটি গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে দিয়ে নতুন সংবিধান ও নতুনভাবে লিখিত ধারা-উপধারা ও অনুচ্ছেদের মধ্য দিয়ে যে সংশোধনী ও সংস্কার প্রস্তাবে একমত হয়েছি, সেগুলো টেকসইভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে একটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।
“জাতীয় ঐকম্যত কমিশনে আমরা দীর্ঘদিন আলোচনা করছি। আমরা দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। তার একটি হল, যেগুলো সংবিধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, সেগুলো অডিন্যান্স অথবা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। কিন্তু রাষ্ট্র কাঠামো অনেক বিষয় নিয়ে, যেগুলো সংবিধানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যাতে সংবিধানের মৌলিক কতগুলো বিষয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে, এত বড় পরিবর্তন যে সেগুলোকে শুধু মাত্র সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে টেকসই করা সম্ভব কিনা, তার আশঙ্কার জায়গাটি আমাদের মাঝে বিদ্যমান রয়েছে।”
তিনি বলেন, “যেহেতু বাংলাদেশে ইতোমধ্যে হাই কোর্টে সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং সেইগুলো বাতিল হয়েছে। সেই ক্ষেত্রে আমরা সংবিধানে যে মৌলিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে আসছি, তা কীভাবে টেকসই করা ও কার্যকর করা যায়—সে ব্যাপারে আমরা রাজনৈতিক দলগুলো প্রতি আহ্বান রেখেছি পদ্ধতি ঠিক করার ক্ষেত্রে।”
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একটা ইতিবাচক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে বলেও আশা প্রকাশ করেন আখতার। তিনি বলেন, “তার জন্য কমিশনের সভাপতি মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে আবেদন, কমিশনের মেয়াদ বৃদ্ধি করে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সবার কাছে প্রশ্নাতীত করে কমিশনের কার্যক্রম সফলভাবে শেষ করতে পারি।”
জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী নির্বাচন হলেই তা ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য’ হবে বলে মনে করেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ। বৈঠকে দলের পক্ষ থেকে সনদ বাস্তবায়নের দুটি সম্ভাব্য উপায়ের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “একটি হলো প্রভিশনাল কন্সটিটিউশনাল অর্ডার। অতীতে এটার নজির আছে। আরেকটি হলো গণভোট। এটার ইতিহাসও দেশে আছে। দলগুলো একমত হতে না পারলে গণভোটের মাধ্যমে মানুষ রায় দেবে।
“সরকারের প্রতিশ্রুতি যেটা ছিল, এক নম্বরে সংস্কার করা। বিগত দিনে রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে যে ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি, ধ্বংসস্তূপ, আবর্জনা তৈরি হয়েছিল, এটা দূর করে বাংলাদেশকে একটি নতুন পথে নিয়ে যাবে, এটা ছিল সরকারের প্রথম অঙ্গীকার। সেকেন্ডলি সরকারের প্রতিশ্রুতি গণহত্যার বিচার, তৃতীয়ত একটি উৎসবমুখর পরিবেশে ইতিহাস সেরা নির্বাচন সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল।”
সংবিধান সংশোধনের বিষয়গুলো পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে বলে আসা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এদিন নতুন একটি প্রস্তাব সামনে আনেন। তিনি বলেন, “আমরা ৮২৬টি ছোট-বড় সংস্কার প্রস্তাব পেয়েছি। এগুলো দলে আলোচনা করে লিখিত মতামত দিয়েছি। মাত্র ৫১টি প্রস্তাবে আমরা দ্বিমত করেছি, ১১৫টি প্রস্তাবে আমাদের মতামতসহ ভিন্নমত দিয়ে গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছি। এ বিষয়ে চূড়ান্ত ঐকমত্য হয়েছে প্রায়। মৌলিকগুলো নিয়ে ৮৪৫টি সংস্কার প্রস্তাব হয়।
“দুই দিন পরে টিকবে না, চ্যালেঞ্জ হয়ে যেতে পারে, এমন কোনো বিষয় আমরা রেখে দিতে চাই না। আমরা যেসব বিষয়ে একমত হয়েছি, তা বাস্তবায়ন হচ্ছে এবং হয়ে যাবে। প্রসিডিউরের জন্য বাস্তবায়নে একটু সময় লাগে।”
যে ১৯টি সাংবিধানিক বিষয় বাকি থেকে, সেগুলোর বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “এর মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে নোট অব ডিসেন্টসহ আমরা একমত হয়েছি। আমাদের বিবেচনায় ৭০ অনুচ্ছেদের চারটি বিষয়ে এমপিদের স্বাধীনতা না থাকলে ভালো হয়। সর্বনিম্ন দুটি বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। নোট অব ডিসেন্টের ভাষা উল্লেখ করে সনদ তৈরি হচ্ছে এবং সেভাবে আমরা স্বাক্ষর করব। যারা জনগণের ম্যান্ডেট পাবে, তারা তাদের নোট অব ডিসেন্ট রক্ষা করে বাস্তবায়ন করবে। এটি কোনো জটিল বিষয় নয়।
“এগুলো বাস্তবায়ন খুব সহজ। কিন্তু ফোরাম কোনটা? সাংবিধানিক বিষয়গুলো পরবর্তী সংসদ ছাড়া অন্য কোনো ফোরাম করতে পারে কিনা—এ বিষয়ে আইনি পরামর্শ দিতে পারে সুপ্রিম কোর্ট। আমরা সেখানে যেতে পারি এবং সহায়তা নিতে পারি। এর বাইরে কিছু থাকলে জানান, আমরা একমত। আমরা সনদে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত আছি, তা আগেও বলেছি।”
কেন সুপ্রিম কোর্টের মতামত নিতে বলা হচ্ছে, তার ব্যাখ্যায় এ বিএনপি নেতা বলেন, “আইনি ভিত্তি নিয়ে আলোচনা হলে তাতে আমরা অংশ নেব। সেই আলোচনা শুরু হয়েছে। তার আগে কমিশন বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে। সেখান থেকে অঙ্গীকারনামার যে ড্রাফট দেওয়া হয়েছে, তাতে আমরা লিখিত মতামত দিয়েছি। যেসব বিষয় পরে টিকবে না, সেগুলো এতে উত্থাপন করা ঠিক হবে না।
“কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না, তেমন কোনো দলিল হতে পারে না, সংবিধানের ওপর সনদকে স্থান দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। এর বাইরেও অনেক পন্থা থাকতে পারে যাতে আমরা এটার বৈধতা দিতে, আইনি ভিত্তি দিতে পারি। আপিল বিভাগের পরামর্শ নিতে পারি আমরা—এটা (সংবিধান সংশোধন) এক্সট্রা কন্সটিটিউশনাল অর্ডার বা স্পেশাল কন্সটিটিউশনাল অর্ডার করা যায় কি না। তাহলে ভবিষ্যতে জুডিশিয়ারিতে এটা চ্যালেঞ্জ করলেও বলতে পারবে যে আমরা মতামত নিয়েছিলাম। এখন সেই পরামর্শ দিতে পারে, নাও পারে।”
প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্যে করে সালাহউদ্দিন বলেন, “স্পেশাল কন্সটিটিউশনাল অর্ডারে আপনি (প্রধান উপদেষ্টা) করলেন। আমরা কেউ কিছু বললাম না। ঐকমত্য কমিশন থেকে আমরা আপনাকে দায়িত্ব দিলাম, সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে আপনি সিদ্ধান্ত দেন। তারপর আপনি করলেন। কিন্তু যে কোনো একজন নাগরিক যদি এটা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে কোথাও যায়, সেটা আপনার গ্লোবাল রেপুটেশন নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। আমরা অনেক আলোচনা করেছি, সেখান থেকে আপনি কোনো মতামত নিতে পারে। সেই স্বাধীনতা আপনার আছে।”
তিন ঘণ্টার এই বৈঠকের মধ্যে এক ঘণ্টা আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিন দলের বক্তব্যের পর তিনি সবাইকে একমত হয়ে জুলাই সনদে সই করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “এই একমাত্র সুযোগ। আমাদেরকে এটা গ্রহণ করতেই হবে। এটা থেকে বিচ্যুত হবার উপায় নেই। সমঝোতা বলেন, ঐক্য বলেন, যাই বলেন, যখন নির্বাচনে যাব, একমত হয়ে সবাই যাব। এর মধ্যে কোনো দ্বিমত আর আমরা রাখব না।”
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সামনে রেখে ইউনূস বলেন, “আমার একান্ত আবেদন, যখনই আপনারা এই সনদ করবেন, কোলাকুলি করে, যে হ্যাঁ, ‘আমরা একমত হয়ে গেছি’। তাহলে নির্বাচন ইত্যাদি সব সার্থক হবে।”
সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন একে অপরের ওপর কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয় মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “সংস্কার সংস্কারের মত চলবে, এটা কন্টিনিউয়াস প্রসেস। বিচারেও টাইম লিমিট করা যায় না, তাতে অবিচার হবে। সেটা চলবে, যে সরকারই আসুক।”
তিনি বলেন, “বিচার চলবে, এটা আমাদের কমিটমেন্ট, জাতির কমিটমেন্ট। কিন্তু নির্বাচনকে এটার কন্ডিশনাল করা যাবে না। আর যদি ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে কোনো রকম একটি অনিশ্চিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়, সেটা ফ্যাসিবাদ চেষ্টা করছে। আমরা যদি এমন কোনো কর্মকাণ্ড করি, যে ফ্যাসিবাদী শক্তি সুযোগ পাবে, আসকারা পাবে, সেটা আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য... অনেকে বলছেন, এটা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে। আমি বলছি, এটা রিজিওনাল সিকিউরিটির জন্য থ্রেট হতে পারে। এখানে দুইটা রিজিওনাল শক্তি, একটা গ্লোবাল শক্তি ইনভলভ হয়ে যেতে পারে। আমরা বাংলাদেশকে সেখানে নিতে চাই না। নির্ধারিত টাইম লাইনে নির্বাচন হতেই হবে।”
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) মনির হায়দারের সঞ্চালনায় আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও বক্তব্য দেন। বৈঠক শেষে বেরিয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, “আগামী বুধবার আবার বসব, সেদিন বিস্তারিত আরো কিছু জানতে পারবেন, কী হয়।”
তবে দলগুলো জুলাই সনদ সই করবে কবে, সে বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে নতুন কিছু জানানো হয়নি।
রোববার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য আগের মতোই ‘অস্থায়ী সাংবিধানিক আদেশ’ অথবা গণভোটের কথা বলেছে জামায়াতে ইসলামী; আর জাতীয় নাগরিক পার্টি বলেছে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন করা। অধ্যাদেশ দিয়ে সংবিধান সংশোধনের বিরোধিতা করে আসা বিএনপির সুর সামান্য নরম হয়েছে। দলটি এখন বলছে, অতিরিক্ত বা বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন করা যায় কি না, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের মতামত নেওয়া যেতে পারে।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের পথ খুঁজতে রোববার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানেই নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন দলগুলোর নেতারা। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও এদিন বৈঠকের একটি অংশে উপস্থিত ছিলেন।
এতদিনের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো মোট ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে (নোট অব ডিসেন্টসহ) একমত হলেও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে স্পষ্ট মতবিরোধ রয়েছে এনসিপি, জামায়াত এবং বিএনপির মধ্যে। এনসিপি ও জামায়াত নির্বাচনের আগে সংবিধান সংশোধন করে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে। অন্যদিকে বিএনপি বলে আসছে, নির্বাচিত সংসদ ছাড়া কেউ সংবিধানে হাত দিতে পারবে না।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, “এনসিপি মনে করে একটি গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে দিয়ে নতুন সংবিধান ও নতুনভাবে লিখিত ধারা-উপধারা ও অনুচ্ছেদের মধ্য দিয়ে যে সংশোধনী ও সংস্কার প্রস্তাবে একমত হয়েছি, সেগুলো টেকসইভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে একটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।
“জাতীয় ঐকম্যত কমিশনে আমরা দীর্ঘদিন আলোচনা করছি। আমরা দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। তার একটি হল, যেগুলো সংবিধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, সেগুলো অডিন্যান্স অথবা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। কিন্তু রাষ্ট্র কাঠামো অনেক বিষয় নিয়ে, যেগুলো সংবিধানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যাতে সংবিধানের মৌলিক কতগুলো বিষয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে, এত বড় পরিবর্তন যে সেগুলোকে শুধু মাত্র সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে টেকসই করা সম্ভব কিনা, তার আশঙ্কার জায়গাটি আমাদের মাঝে বিদ্যমান রয়েছে।”
তিনি বলেন, “যেহেতু বাংলাদেশে ইতোমধ্যে হাই কোর্টে সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং সেইগুলো বাতিল হয়েছে। সেই ক্ষেত্রে আমরা সংবিধানে যে মৌলিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে আসছি, তা কীভাবে টেকসই করা ও কার্যকর করা যায়—সে ব্যাপারে আমরা রাজনৈতিক দলগুলো প্রতি আহ্বান রেখেছি পদ্ধতি ঠিক করার ক্ষেত্রে।”
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একটা ইতিবাচক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে বলেও আশা প্রকাশ করেন আখতার। তিনি বলেন, “তার জন্য কমিশনের সভাপতি মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে আবেদন, কমিশনের মেয়াদ বৃদ্ধি করে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সবার কাছে প্রশ্নাতীত করে কমিশনের কার্যক্রম সফলভাবে শেষ করতে পারি।”
জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী নির্বাচন হলেই তা ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য’ হবে বলে মনে করেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ। বৈঠকে দলের পক্ষ থেকে সনদ বাস্তবায়নের দুটি সম্ভাব্য উপায়ের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “একটি হলো প্রভিশনাল কন্সটিটিউশনাল অর্ডার। অতীতে এটার নজির আছে। আরেকটি হলো গণভোট। এটার ইতিহাসও দেশে আছে। দলগুলো একমত হতে না পারলে গণভোটের মাধ্যমে মানুষ রায় দেবে।
“সরকারের প্রতিশ্রুতি যেটা ছিল, এক নম্বরে সংস্কার করা। বিগত দিনে রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে যে ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি, ধ্বংসস্তূপ, আবর্জনা তৈরি হয়েছিল, এটা দূর করে বাংলাদেশকে একটি নতুন পথে নিয়ে যাবে, এটা ছিল সরকারের প্রথম অঙ্গীকার। সেকেন্ডলি সরকারের প্রতিশ্রুতি গণহত্যার বিচার, তৃতীয়ত একটি উৎসবমুখর পরিবেশে ইতিহাস সেরা নির্বাচন সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল।”
সংবিধান সংশোধনের বিষয়গুলো পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে বলে আসা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এদিন নতুন একটি প্রস্তাব সামনে আনেন। তিনি বলেন, “আমরা ৮২৬টি ছোট-বড় সংস্কার প্রস্তাব পেয়েছি। এগুলো দলে আলোচনা করে লিখিত মতামত দিয়েছি। মাত্র ৫১টি প্রস্তাবে আমরা দ্বিমত করেছি, ১১৫টি প্রস্তাবে আমাদের মতামতসহ ভিন্নমত দিয়ে গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছি। এ বিষয়ে চূড়ান্ত ঐকমত্য হয়েছে প্রায়। মৌলিকগুলো নিয়ে ৮৪৫টি সংস্কার প্রস্তাব হয়।
“দুই দিন পরে টিকবে না, চ্যালেঞ্জ হয়ে যেতে পারে, এমন কোনো বিষয় আমরা রেখে দিতে চাই না। আমরা যেসব বিষয়ে একমত হয়েছি, তা বাস্তবায়ন হচ্ছে এবং হয়ে যাবে। প্রসিডিউরের জন্য বাস্তবায়নে একটু সময় লাগে।”
যে ১৯টি সাংবিধানিক বিষয় বাকি থেকে, সেগুলোর বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “এর মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে নোট অব ডিসেন্টসহ আমরা একমত হয়েছি। আমাদের বিবেচনায় ৭০ অনুচ্ছেদের চারটি বিষয়ে এমপিদের স্বাধীনতা না থাকলে ভালো হয়। সর্বনিম্ন দুটি বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। নোট অব ডিসেন্টের ভাষা উল্লেখ করে সনদ তৈরি হচ্ছে এবং সেভাবে আমরা স্বাক্ষর করব। যারা জনগণের ম্যান্ডেট পাবে, তারা তাদের নোট অব ডিসেন্ট রক্ষা করে বাস্তবায়ন করবে। এটি কোনো জটিল বিষয় নয়।
“এগুলো বাস্তবায়ন খুব সহজ। কিন্তু ফোরাম কোনটা? সাংবিধানিক বিষয়গুলো পরবর্তী সংসদ ছাড়া অন্য কোনো ফোরাম করতে পারে কিনা—এ বিষয়ে আইনি পরামর্শ দিতে পারে সুপ্রিম কোর্ট। আমরা সেখানে যেতে পারি এবং সহায়তা নিতে পারি। এর বাইরে কিছু থাকলে জানান, আমরা একমত। আমরা সনদে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত আছি, তা আগেও বলেছি।”
কেন সুপ্রিম কোর্টের মতামত নিতে বলা হচ্ছে, তার ব্যাখ্যায় এ বিএনপি নেতা বলেন, “আইনি ভিত্তি নিয়ে আলোচনা হলে তাতে আমরা অংশ নেব। সেই আলোচনা শুরু হয়েছে। তার আগে কমিশন বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে। সেখান থেকে অঙ্গীকারনামার যে ড্রাফট দেওয়া হয়েছে, তাতে আমরা লিখিত মতামত দিয়েছি। যেসব বিষয় পরে টিকবে না, সেগুলো এতে উত্থাপন করা ঠিক হবে না।
“কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না, তেমন কোনো দলিল হতে পারে না, সংবিধানের ওপর সনদকে স্থান দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। এর বাইরেও অনেক পন্থা থাকতে পারে যাতে আমরা এটার বৈধতা দিতে, আইনি ভিত্তি দিতে পারি। আপিল বিভাগের পরামর্শ নিতে পারি আমরা—এটা (সংবিধান সংশোধন) এক্সট্রা কন্সটিটিউশনাল অর্ডার বা স্পেশাল কন্সটিটিউশনাল অর্ডার করা যায় কি না। তাহলে ভবিষ্যতে জুডিশিয়ারিতে এটা চ্যালেঞ্জ করলেও বলতে পারবে যে আমরা মতামত নিয়েছিলাম। এখন সেই পরামর্শ দিতে পারে, নাও পারে।”
প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্যে করে সালাহউদ্দিন বলেন, “স্পেশাল কন্সটিটিউশনাল অর্ডারে আপনি (প্রধান উপদেষ্টা) করলেন। আমরা কেউ কিছু বললাম না। ঐকমত্য কমিশন থেকে আমরা আপনাকে দায়িত্ব দিলাম, সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে আপনি সিদ্ধান্ত দেন। তারপর আপনি করলেন। কিন্তু যে কোনো একজন নাগরিক যদি এটা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে কোথাও যায়, সেটা আপনার গ্লোবাল রেপুটেশন নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। আমরা অনেক আলোচনা করেছি, সেখান থেকে আপনি কোনো মতামত নিতে পারে। সেই স্বাধীনতা আপনার আছে।”
তিন ঘণ্টার এই বৈঠকের মধ্যে এক ঘণ্টা আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিন দলের বক্তব্যের পর তিনি সবাইকে একমত হয়ে জুলাই সনদে সই করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “এই একমাত্র সুযোগ। আমাদেরকে এটা গ্রহণ করতেই হবে। এটা থেকে বিচ্যুত হবার উপায় নেই। সমঝোতা বলেন, ঐক্য বলেন, যাই বলেন, যখন নির্বাচনে যাব, একমত হয়ে সবাই যাব। এর মধ্যে কোনো দ্বিমত আর আমরা রাখব না।”
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সামনে রেখে ইউনূস বলেন, “আমার একান্ত আবেদন, যখনই আপনারা এই সনদ করবেন, কোলাকুলি করে, যে হ্যাঁ, ‘আমরা একমত হয়ে গেছি’। তাহলে নির্বাচন ইত্যাদি সব সার্থক হবে।”
সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন একে অপরের ওপর কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয় মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “সংস্কার সংস্কারের মত চলবে, এটা কন্টিনিউয়াস প্রসেস। বিচারেও টাইম লিমিট করা যায় না, তাতে অবিচার হবে। সেটা চলবে, যে সরকারই আসুক।”
তিনি বলেন, “বিচার চলবে, এটা আমাদের কমিটমেন্ট, জাতির কমিটমেন্ট। কিন্তু নির্বাচনকে এটার কন্ডিশনাল করা যাবে না। আর যদি ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে কোনো রকম একটি অনিশ্চিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়, সেটা ফ্যাসিবাদ চেষ্টা করছে। আমরা যদি এমন কোনো কর্মকাণ্ড করি, যে ফ্যাসিবাদী শক্তি সুযোগ পাবে, আসকারা পাবে, সেটা আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য... অনেকে বলছেন, এটা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে। আমি বলছি, এটা রিজিওনাল সিকিউরিটির জন্য থ্রেট হতে পারে। এখানে দুইটা রিজিওনাল শক্তি, একটা গ্লোবাল শক্তি ইনভলভ হয়ে যেতে পারে। আমরা বাংলাদেশকে সেখানে নিতে চাই না। নির্ধারিত টাইম লাইনে নির্বাচন হতেই হবে।”
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) মনির হায়দারের সঞ্চালনায় আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও বক্তব্য দেন। বৈঠক শেষে বেরিয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, “আগামী বুধবার আবার বসব, সেদিন বিস্তারিত আরো কিছু জানতে পারবেন, কী হয়।”
তবে দলগুলো জুলাই সনদ সই করবে কবে, সে বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে নতুন কিছু জানানো হয়নি।